প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০
(গত সংখ্যার পর)
মারুফ বেশ অবাক হয়। ফুফুর বাড়িতে আগেও গিয়েছিলাম একবার অনেক ছোট থাকতে, তখন তো এই রাস্তাটা ছিলো না যতটুকু মনে পড়ে। ইকবাল বললো, হয়তো তখন ছিলো না। এখন তৈরি হয়েছে।
-হ্যাঁ মাটি ফুঁড়ে বের হয়েছে তো। আমার মনে আছে আরেকটা রাস্তা ছিলো না।
ইকবাল মাথা চুলকাতে থাকে, কিন্তু এখন কোন্ রাস্তায় তোর ফুপুর গ্রামে যাওয়া যায় সেটা বল।
-আমারও তো ঠিক মনে পড়ে না কোনটায় যাবো। রাস্তা ছিলো তখন একটা আর এখন দুইটা। মারুফ অবাক না হয়ে পারে না। এদিকে ঘড়ির কাঁটা দশটা পার করেছে অনেক আগেই। ইকবাল আস্তে আস্তে মারুফের কাছে এসে বলে, এখানে বেশিক্ষণ থাকাও ঠিক না আর হারিকেনের তেলটাও ফুড়িয়ে আসছে। অনেক ভেবে-চিন্তে তারা বামদিকের রাস্তাটায়ই হাঁটা ধরে। ইকবালের হাতে হারিকেন ধরা। মারুফ আগে আগে হাঁটছে।
হাঁটছে তো হাঁটছে তারা। অতঃপর তারা দুজনেই একটা ভিন্ন রকম পথে নিজেদের আবিষ্কার করে। ইকবাল দেখে এই পথের ডানদিকে অনেক পরিষ্কার একটা মাঠ, তারপর যতদূর চোখ যায় সব ধানক্ষেত। আর বাদিকে খোলা এক অংশ জায়গাজুড়ে কিছু সুপারি গাছ আর একটা ভাঙ্গা পালকি পড়ে আছে। একপাশে অনেকগুলো লাল ইট সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ইটের গুঁড়ো মিশে মাটিও অনেক জায়গায় লাল। তাদের ঠিক সামনেই একটা বেশ বড় একটা বকুল গাছ। থোকায় থোকায় অনেকগুলো বকুল ফুল ধরে আছে। মারুফ লক্ষ্য করলো রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টের বাতিটা লাল আলোর। যেমন গুদামঘরের বাল্বগুলা হয়, ঠিক সে রকম। মাটির রাস্তা তারপর সব মিলিয়ে জায়গাটাকে একই সাথে বেশ রহস্যময় মনে হচ্ছে। আর কিছুটা ভৌতিক। অনেকটা ভয়ও লাগছে তাদের। কেমন একটা ঠাণ্ডা ভয় ঝেকে ধরছে তাদের। যদিও দুজনেই গ্রামের পরিবেশে বড় হওয়া ছেলে। রাতবিরাতে এসব পথ তাদের কাছে ব্যাপার না।
পাল্কিটা কিসের হতে পারে? প্রশ্ন করে ইকবাল।
-কী জানি কাদের পাল্কি। হাঁটতে থাকি চল। রাত সাড়ে এগারোটার মতো বাজে।
আকাশের চাঁদটা মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে। কোথাও একটা রাতজাগা পাখি করুণ সুরে ডেকে উঠে। পথ চলতে চলতে সারি সারি দশ বারোটি ঘর চোখে পড়ে তাদের। কিন্তু ঘরগুলোর বেহাল অবস্থা দেখে সেখানে কেউ বসবাস করে বলে তাদের মনে হয় না। ঘরগুলো রাতের অন্ধকার থেকেও অনেক বেশি গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। ইকবাল আর মারুফ পথ চলতে থাকে। চলতে চলতে তাদের দুজনেরই ঝিমুনির মতো হতে থাকে। ঘুমে চোখ যেনো বন্ধ হয়ে যেতে চায়। মারুফ ভাবে, কতক্ষণে যে ফুফুর বাসায় পৌঁছাবো আর একটু আরাম করে ঘুমাতে পারবো। তার উপর সেই অনেকটা সময় ধরে তারা না খেয়ে আছে। আর এতদূর পথ হেঁটে আসার ক্লান্তিতে তাদের দুজনের শরীরই ভেঙ্গে পড়তে চায়।
কখন যে চোখ লেগে আসে বুঝতে পারে না। একটু পর মারুফ চোখ খুলে আবিষ্কার করে তারা সেই বকুল গাছটার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে।
ইকবালও ভীষণ রকম অবাক হয়। এমন হওয়াটা কীভাবে সম্ভব তারও মাথায় আসে না। হঠাৎ কোথা থেকে যেনো একটা মাঝবয়সী ছেড়া ধুতি পরা লোক হরিবোল হরিবোল চিৎকার করতে করতে দৌড়ে এসে পাশের মাঠটায় হারিয়ে।
ইকবাল আর মারুফ দুজনেই জমে যায় ভয়ে। মারুফ আস্তে ইকবালের কানে কানে বলে, দেখলি ব্যাপারটা চোখের সামনে লোকটা উধাও হয়ে গেলো। ইকবালের মুখে কোনো শব্দ নেই। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না মুহূর্তের মধ্যে কোথা থেকে একটা লোক এসে আবার চোখের সামনেই মিলিয়ে গেলো। ওরা আবারও হাঁটা শুরু করে, কিন্তু এবারও ঘুরে ফিরে আগের জায়গাই চলে আসে। ইকবালের মাথা খারাপ হয়ে যায়। এ কেমন কুক্ষণে জায়গা। বার বার একই পথে কেনো ফিরে আসবে তারা। মারুফ শক্ত করে ইকবালের হাতটা ধরে। ইকবাল, আমরা আরেকটা বার চেষ্টা করি এবার আশা করি এই পথে আর ফিরে আসবো না। ইকবাল, আমরা আরেকটা বার চেষ্টা করি এবার আশা করি এই পথে আর ফিরে আসবো না। ইকবাল বলে, চল আবার পিছনে ফিরে যাই। বেলপুকুরের রাস্তা থেকে আবার শুরু করবো। এবার আর বামদিকের পথ ধরবো না।
চল, আবার প্রথম থেকে শুরু করি। বলেই ইকবালের হাত ধরে হাঁটা শুরু করে মারুফ।
বেলপুকুরের রাস্তায় আবার ফিরে আসে তারা আর ফিরে এসেই প্রচণ্ড রকম অবাক হয় এই দেখে যে সেখানে মাত্র একটাই রাস্তা যেটা আগে ছিলো বা দিকে কিন্তু এখন ডানদিকে। আর বামদিকের অংশটাজুড়ে ঘন জঙ্গল। ইকবালের গলা শুকিয়ে আসে। আশ্চর্য, আমরা যখন এখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম তখনও এই অংশটায় জঙ্গল ছিলো না। বরং ডানদিকে একটা পথ ছিলো আর বাঁ দিকের পথটা দিয়েই আমরা শুরু করেছিলাম। ঠিকই তো বলছিস। তখন দুইটা রাস্তা ছিলো এখন একটা। কী হচ্ছে আমাদের সাথে! মারুফ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকে।
ইকবাল বলে, কেউ একজন হয়তো আমাদের পথ ভুল করতে চাইছে। কিন্তু এই কেউ একজনটা কে? শান্ত স্বরে প্রশ্ন করে মারুফ। ভেবে দেখেছিস ইকবাল? ইকবাল আর কথা বলতে পারে না। বড় করে একটা ঢোক গিলে। মারুফের কাছে এসে বলে, শোন মারুফ, কী হচ্ছে তা তুইও বুঝতে পারছিস, আমিও বুঝতে পারছি। কাজেই ভয় পেয়ে দিশেহারা হলে চলবে না। জিনিসটা চায়ই যে আমরা ভয় পেয়ে পথ ভুল করে সারারাত এভাবে দিগি¦দিক হারিয়ে ঘুরি। বা হয়তো মেরেও ফেলতে পারে। চোখ বন্ধ করে মারুফের হাত চেপে ধরে। আল্লাহর নাম নে মারুফ। আল্লাহর নাম নে, আল্লাহই আমাদের উদ্ধার করবেন। তিন কুল পড়ে নিজের ও মারুফের বুকে ফু দেয়।
চল আবার শুরু করি। পকেটের ম্যাচ কাঠিগুলা সাবধানে রাখ। যে কোনো মুহূর্তে লাগতে পারে। হাঁটতে হাঁটতে আবার বকুলতলায় আসে তারা। তাদের থেকে ঠিক কিছু দূরে সেই লাল ইটের জায়গাটা, সেই পাল্কি, ভাঙ্গা মাটির হাড়ি কলসি, ল্যাম্পপোস্টের লাল ভূতুড়ে আলো আর কেমন কলজে নাড়ানো একটা ঠাণ্ডা ভাব। বিশাল বকুল গাছটায় আস্তে আস্তে হাওয়া বইছে। যেনো কোনো অশরীরী সুরের তালে তালে ধীরে ধীরে নাচছে।
মারুফ-ইকবাল দেখলো পাল্কির কাছে একটি মাঝবয়সী মেয়ে বসে আছে। লাল পেড়ে গেরুয়া রংয়ের শাড়ি পরনে। মাথার চুল এলোমেলো। হাঁটুতে মুখ গুঁজে মড়া কান্না কাঁদছে।