সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২২, ০০:০০

ধারাবাহিক উপন্যাস ॥ তৃতীয় কিস্তি

রোদে পোড়া পালিশ

কাদের পলাশ

রোদে পোড়া পালিশ
অনলাইন ডেস্ক

তিন.

একটি মৃত্যু এতোগুলো পরিবারে শান্তির প্রদীপ নিভিয়ে দিতে পারে তা কখনো ভাবেনি শান্তিপুরের মানুষ। এ গ্রামের মানুষ খুবই শান্তিপ্রিয়। কেউ কারো সাথে খুব বেশি বাগবিতণ্ডায় জড়ায় না। এ গ্রামে দু-চারজন প্রভাবশালী মানুষ আছে। তাদের সবাই মান্য করে। বড়দের নম্রতা ছোটের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে। এ গ্রামে হিন্দু পরিবারই বেশি, মাত্র তিনটি হচ্ছে মুসলিম বাড়ি। তা-ও স্বাধীনতার পরপর এখান থেকে চারটি হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যায়। ভারতে তাদের চলে যাওয়ার কারণ আজও স্পষ্ট নয়। তবে ভারত হিন্দু-অধ্যুষিত বলে সেখানেই থাকতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। অবশ্য এদের মনে দেশপ্রেম নেই বলেই হয়তো স্বদেশ ত্যাগ করেছে। বাংলাদেশে এখনো অনেক হিন্দু পরিবার আছে যারা এখানে বাঁচতে চায়। মরতে চায়। ওই চার পরিবার ভারত যাওয়া সময় বাড়ির গাছগাছালিসহ সব বিক্রি করে যায় নাজিমউদ্দীন বেপারীর কাছে। তিনি বাড়িগুলো কিনেছিলেন ছেলেদের জন্যে। পরে চার ছেলেকে চারটি বাড়ি ভাগ করে দেন।

নাজিমউদ্দীন গ্রামের পূর্ব পাশের বাড়িটিতে থাকতেন। তিনি প্রায় দুই যুগ আগে মারা গেছেন। তিনি শিক্ষিক না হলেও আচার-আচরণে এখনকার নামমাত্র ভদ্রসমাজের চেয়ে ঢের ভালো ছিলেন। পুঁথিগত বিদ্যাধারীদের চেয়ে তার আত্মসম্মানবোধ ছিলো প্রবল। তাই হিন্দুরা নাজিমউদ্দীনকে খুব সম্মান করতো। তিনি যখন হিন্দু বাড়িগুলো কেনেন তখন অনেকের মনে সংকীর্ণতা কাজ করতো। সে সময় এ গ্রামের হিন্দুরা মুসলিমদের শেখ বলে ডাকতো। হিন্দু বাড়িতে মুসলমান কেউ ঢুকলে মুখে কিছু না বললেও মনে মনে তা মেনে নিতে পারতো না। পথ দিয়ে কোনো মুসলিম গেলে কোনো কোনো হিন্দু পরিবার সে পথে গোবরের পানি ছিটিয়ে দিতো। বিষয়টি দেখে মুসলিমরাও মনে মনে লজ্জাবোধ করতো। তাই খুব বেশি ঠেকায় না পড়লে হিন্দু বাড়ির রাস্তা ব্যবহার করতো না। অবশ্য সেদিক থেকে এখন চিন্তা-ভাবনার অনেক প্রসার ঘটেছে। মূলত আরো দু যুগ আগেই আদি যুগের চিন্তা-চেতনার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। অবশ্য কেউ কেউ বলে নাজিমউদ্দীনের আচার-ব্যবহারের সৌজন্যেই গ্রামের সবার মাঝে এমন পরিবর্তন এসেছে।

নাজিমউদ্দীন যে হিন্দু পরিবারগুলো থেকে বাড়িগুলো কিনে ছিলেন তাদের একেকজনের নামে একেকটা আমগাছের নাম রাখেন। যে কারণে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাকে সম্মানের চোখে দেখতো। নাজিমউদ্দীন যে বাড়িতে থাকেন সে বাড়ির প্রতিটি বড় বড় মোটা মোটা আমগাছের আলাদা আলাদা নাম রাখেন। যেমন বাড়ির উত্তর পাশের আম গাছটির নাম হিরোর গাছ। অর্থাৎ হিরো নামের একজন লোক ছিলো এ বাড়িতে। তারই নাকি গাছ ছিলো এটি। দক্ষিণ পাশের বড় গাছ হচ্ছে বল্লবের গাছ। বাড়ির ঠিক মাঝখানের আমগাছটার নাম রতনের গাছ। এভাবে একটু বয়োবৃদ্ধ আম গাছগুলোর আলাদা আলাদা নাম ছিলো। যদিও অন্য কোনো গাছের এভাবে নাম রাখা হয়নি। এ নিয়ে হিন্দু বাড়ির মানুষেরা একটু ভিন্ন চোখে দেখতে শুরু করে নাজিমউদ্দীনকে। কারণ এ বাড়ি যারা বিক্রি করে দিয়েছে তাদের নাম না নিলেই বা কী? অবশ্য নাজিমউদ্দীন মনে করেন বাড়ি তারা বিক্রি করেছে তাতে কী? তাদের নাম একটা মাধ্যমে স্মরণ করা যায়। গাছের নাম হিন্দু নামে হবে এ নিয়ে কখনো মনে সংকীর্ণতা কাজ করেনি। বরং গ্রামে অসাম্প্রদায়িক যে চেতনার বীজ বপন করে গেছেন সে ঐতিহ্য আজও বিরাজমান। আম গাছগুলো অবশ্য এখন আর নেই। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক মনোভাব আজও এ গ্রামে সবার মাঝে বিরাজ করছে। তাইতো নিখিলের মেয়ের বিয়েতে মুসলিম সব পরিবারে নিমন্ত্রণ দেয়া হয়। বিয়েতে উপহার নিয়ে সবাই উপস্থিত হয়। আবার নাজিমউদ্দীনের মেয়ের বিয়েতে গ্রামের হিন্দু পরিবারগুলোকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিলো সবাই গায়ে হলুদেতো অংশ নিয়েছিলোই বিয়ের আয়োজনেও উন্মাদনা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলো। তবে ঈদুল আজহায় পশু কোরবানিকে হিন্দুরা মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু কখনো প্রতিবাদও করেনি। অবশ্য এ হীনমন্যতাও এখন কেটে গেছে। বরং এখন কারা কতো বড় ও সুন্দর গরু কিনেছে সে খবর রাখে। দেখতে যায়। হিন্দুদের সবকিছু মুসলিমরা মেনে নিতো, তাণ্ডও কিন্তু নয়। সাতদিন ব্যাপী দুর্গাপূজায় ঢাক-ঢোলের বাদ্যে অনেকেই বিরক্ত হতো। অবশ্য একসময় সবকিছু মানিয়ে যায়। একটা সময় হিন্দুদের সর্ববৃহৎ উৎসবে মুসলিমরাও অংশ নেয়া শুরু করলো। ‘আপন-দুলাল’ যাত্রা দেখার জন্যে পাশের গ্রাম থেকেও মানুষ ছুটে আসতো। যেদিন মঞ্চনাটক হতো সেদিন মন্দির বাড়িতে মানুষ ধরতো না। নাটক শেষ হতে হতে প্রায় সকাল হয়ে যেতো। আপন দুলাল শেষ হলে মানুষ চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি যেতো। সারারাত নির্ঘুম ছিলো সে ছাপ আর চোখে মুখে ফুটে উঠতো না। নাজিমউদ্দীনের নাতি শুভ। তারা অবশ্য শান্তিপুর গ্রাম থেকে পাশেই সোনাইপুর গ্রামে নতুন বাড়ি করে চলে গেছে।

শান্তিপুর গ্রাম এখন আতঙ্কের জনপদ। কখন কাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় সে ভয়ে সাধারণ মানুষও থাকে তটস্থ। এ আতঙ্ক কবে কাটবে মানুষ বুঝতে পারে না। অবশ্য কোনো কারণ ছাড়া নিশ্চয়ই পুলিশ কাউকে আটক করে না। এটা শুধুমাত্র মানুষের মনের ভয়। অথচ একসময় এখানে কোনো গ্রাম ছিলো না। ছিলো নদী। একসময় চর জাগে। তারপর একটা বাড়ি। এভাবে একটা একটা বাড়ি হতে হতে গড়ে উঠে শান্তিপুর গ্রাম। শান্ত নদীর মতো বয়ে চলা শান্ত আর নিরিবিলি ছিলো এ গ্রাম। অবশ্য শান্ত নদীর উপর চর জাগতে জাগতে নদী পালিয়ে গেছে অনেক পশ্চিমে। নদীর নাম মেঘনা। শান্তিপুর গ্রাম থেকে এ নদী এখন প্রায় ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থান নিয়েছে। অবশ্য এর মাঝে তৈরি হয়েছে অনেক গ্রাম। বসতি করেছে হাজারো মানুষ। দিনদিন মানুষ বাড়ছে। বসতি বাড়ছে। ঘর-বাড়ি। যদিও এখনো অনেক বড় বড় বিল রয়েছে। ওই বিলগুলোতে চার মৌসুমে ফসল হয়। সব ঠিকঠাক মতোই চলছিলো। শুধু একটা খুনের পর তৈরি হলো নানা জটিলতা। শান্তিপুর গ্রামের মানুষগুলো নিম্নবিত্তের হলেও চিত্তের দিক থেকে অনেক উঁচু। অথচ একটা ঘটনায় মানুষ এখন মাথা নিচু করে হাঁটে। মানুষ্য মনে ভয় আর আতঙ্কের যেন মহাসমাবেশ। (চলবে)

[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]

* পাঠক ফোরাম বিভাগে লেখা পাঠানোর ই-মেইল : [email protected]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়