প্রকাশ : ০২ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
মার্সিডিজ গাড়িটি জাতীয় সড়ক পেরিয়ে স্থানীয় বাজারের পশ্চিম দিকের রাস্তা ধরে গ্রাম্য রাস্তার দিকে প্রবেশ করে। আগের চেয়ে গ্রামগুলোর অনেক উন্নতি চোখে পড়ে। রাস্তার পাশ দিয়ে ইলেক্ট্রিসিটির খামগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে। দেশের অবকাঠামোগত উন্নতির ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে শহর থেকে গ্রামে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তর। সব ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। গ্রামের রাস্তা আগে কাঁচা ছিলো। ধান ক্ষেতের আইলের মতো কোনো রকম পায়ে হাঁটার রাস্তা ছিলো। কোনো গাড়ি-ঘোড়া (যানবাহন) ছিলো না বললেই চলে। স্থানীয় বাজারে যেতে হতো পায়ে হেঁটে। কিন্তু গ্রামের চেহারা আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছে। গ্রামে এখন আধা পাকা আর দু-একতলার কিছু বিল্ডিংও দেখা যায়। গ্রামের মানুষও সরকারের ‘গ্রাম হবে শহর’ এ স্লোগানের সুফল পেতে শুরু করেছে। আগের কাঁচা পায়ে হাঁটা রাস্তায় ইটের খোয়া বিছানো। কাজ শুরু হয়েছে কিছু দিন আগে। মাসখানেকের মধ্যে হয়তো পিচ ঢেলে কার্পেটিংয়ের কাজ শেষ হয়ে যাবে। এতে গ্রামের মানুষ শহরের মতো যোগাযোগের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা পাবে।
মার্জিডিজ গাড়ি এগিয়ে চলছে। রাস্তায় মাঝে মধ্যে দু-একটা রিকশা আর ভ্যান চোখে পড়ছে। সাথে চোখে পড়ছে দু-একজন মুরুব্বি-শ্রেণির পরিচিত মানুষ। আর কিলো সাতেক এগিয়ে গেলেই দেখা হবে স্যারের সাথে।
দুই.
খুব উৎকণ্ঠা নিয়ে এগিয়ে যাছে মারুফ। কতদিন পর দেখা হবে তার শ্রদ্ধার প্রিয় মানুষটির সাথে। ফোনে ক’বার ভিডিওকলে কথা হয়েছে মানুষটির সাথে। এ...ই যা। প্রায় বছর ১২ পর দেখা।
আজ দেখা হবে সেই অকৃত্রিম বন্ধুবৎসল, ¯েœহের কাণ্ডারি মানুষটির সাথে। অবশ্য স্যার জানেন না এই কাহিনি। মারুফ স্যারকে না জানিয়েই স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছে এখানে। ঢাকা বিমানবন্দরে বিমান থেকে নেমে রাতে একটা আবাসিক হোটেলে উঠে মারুফ। সকাল বেলায়ই স্যারের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে সে। ঢাকা থেকে এই গ্রামের দূরত্ব গুগল ম্যাপে ৩৭৬ কিলোমিটার দেখায়। অবশ্য আগে এই দূরত্ব আরো অনেক বেশি ছিলো। সরাসরি ঢাকার সাথে যোগাযোগের জাতীয় সড়ক মাত্র বছর দশেক আগে চালু হয়েছে।
মারুফ স্যারকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে। স্যার হয়তো মারুফকে দেখে অনেক খুশি হবে এই ভেবে। গাড়ি এগিয়ে চলছে স্যারের গ্রামের দিকে।
তিন.
গাড়িটি গ্রামে প্রায় পৌঁছে গেছে। আর দু-তিন মিনিট লাগবে হয়তো। রাস্তায়ই দেখা হয়ে যায় স্যারের সাথে। প্রায় ১২ বছর পর দেখা মফিজ স্যারের সাথে। গণিতের হিসেবে একযুগ। একযুগে কত কিছুই পরিবর্তন হয়ে যায়। পরিবর্তন হয় মানুষ, পরিবর্তন হয় শহর-নগর, সভ্যতা আর পৃথিবী।
স্যারের চোখে মোটা ফ্রেমের ভারী কাঁচের চশমা। হাতে লাঠি। পরনে একটা ম্লান পাঞ্জাবি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন বৃদ্ধ মানুষটি। হাতে একটি নীল রঙের ঠোঙ্গা। অনুমান করা যায় হয়তো সামনের ফুটপাত থেকে কোনো তরি-তরকারি কিনেছেন কিছু। ঠোঙ্গায় সেই তরিতরকারি।
স্যারকে পেছন থেকে দেখেই চিনে ফেলে মারুফ। এ মানুষটির সাথে যে মারুফের আত্নার সম্পর্ক। ঠিক যেনো রক্তের সম্পর্কের মতো। বরং বলা চলে রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বেশি কিছু...।
মারুফ ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে। গাড়ি থামায় ড্রাইভার। গাড়ি থেকে নেমে আসে মারুফ। স্যারকে দেখে দ্রুত গিয়ে পা ধরে সালাম করে মারুফ। স্যার হাত দিয়ে ধরে বুকে টেনে নেয় মারুফকে। মারুফের চোখে অশ্রু। স্যার অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে মারুফের দিকে। সেই ছোট বালকটিকে দেখে তিনি অবাক। হঠাৎ কোথায় থেকে মারুফ এখানে! মফিজ স্যার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যেনো। কোনো কিছু না জানিয়েই চলে এসেছে মারুফ। স্যার ভাবছে অনেক দুষ্টু হয়ে গেছে মারুফ। আমাকে না জানিয়েই চলে আসলো ছেলেটা। বাসায় তো এখন মেহমানদারি করা মতো কিছু নেই। কি বিপদেই না পরবেন তিনি! অবশ্য মারুফ এখন সরকারের বড় আমলা হলেও তার মধ্যে অন্য অনেকের মতো কোনো অহংকারবোধ নেই। সেই ছোট বেলার মতো ন¤্র, ভদ্র, যাকে বলা যায় নিরেট জেন্টালম্যান। ইউরোপের মহাদেশের সুইজারল্যান্ডের মতো উন্নত, আধুনিক একটি দেশের রাষ্ট্রদূত সে। যে ওই দেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে সে। স্যার মারুফের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখতে কি হয়েছে স্যারের সেই ছোট্ট ছেলেটি! দেখতে যেনো রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দার সুদর্শন নায়ক। মাশাল্লাহ দেখতে শুনতে এখনো ইয়াং, স্মার্ট, এনার্জিটিক। স্যার মারুফের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসেন। গত ১২ বছর আগের চেয়েও যেনো অনেক বেশি ইয়াং আর স্মার্ট লাগছে স্যারের সেই ছোট্ট ছেলে মারুফকে।
চার.
ইতিমধ্যে গ্রামে প্রবেশ করছে মার্সিডিজ গাড়ি। গাড়ি দেখে বাচ্চারা ছুটে এসেছে, কে আসছে গাড়িতে করে দেখার জন্যে। গ্রামে এমন গাড়ি আগে কখনো দেখেনি এরা। গ্রামের রাস্তায় রিকশার পাশাপাশি মাঝে মধ্যে সবুজ রঙের সিএনজি অটোরিকশার দেখা মেলে। এই যা! স্যার আর মারুফকে ঘিরে জটলা বেঁধে গেছে। গুরু-শিষ্যের কাহিনি দেখছে সবাই। মুরুব্বিদের মধ্যে কেউ কেউ মারুফকে দেখে চিনে ফেলে। ছোট যারা আছে তারা শুধু নাম শুনেছে মারুফ সাহেবের। ফেসবুকের কল্যাণে যারা ফেসবুকের সাথে যুক্ত তারাও কিছুটা চিনে মারুফকে। মারুফ মাঝে মধ্যে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং, সভা, সেমিনার কিংবা সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণের কিছু ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে সেই সুবাদে চিনে এ যুবক শ্রেণির ছেলেরা।
স্যার : বলো বাবা কেমন আছো?
মারুফ : স্যার ভালো আছি। আর এখন আপনার সাথে দেখা হয়ে আরো ভালো লাগছে। বলে বুঝাতে পারবো না আমার ভেতর কি হচ্ছে। কত দিন পর আপনার সাথে দেখা। সেই যে কবে আপনার পা ছুঁয়ে সালাম করেছি। আজ আবার করতে পেরে আমার সত্যি অসম্ভব ভালো লাগছে স্যার।
স্যার : আচ্ছা চলো এখন, বাসায় যাবো।
মারুফ : স্যার গাড়িতে উঠেন।
স্যার : না বাবা আমি হেঁটেই যেতে পারবো। পারলে তুমি আমার সাথে চলো। কাছেই তো বাসা। আর মিনিট দুয়েকের মতো লাগবে বাসায় পৌঁছতে।
মারুফ : আচ্ছা স্যার। ড্রাইভার সাহেব আপনি গাড়িটাকে নিয়ে ওই স্কুলের মাঠে পার্কিং করে আমাদের সাথে আসেন। আমি স্যারের সাথে যাচ্ছি। এ বলে স্যারের সাথে হাঁটতে শুরু করে মারুফ। পিছু পিছু কিছু মানুষের একটি দলও তাদের অনুসরণ করে।
এদের সবার পেছনে আছে গাড়ির ড্রাইভার। মাথায় একটি মাঝারি সাইজের কার্টুন। হাতে একটি শপিং ব্যাগ। বোধহয় ফল-ফলাদি আর জামা-কাপড় হতে পারে কার্টুনে আর শপিং ব্যাগে।
হাঁটতে হাঁটতে স্যারের বাসায় পৌঁছে যায় দুজন। স্যারের সেগুনকাঠের বানানো খাটে গিয়ে বসে মারুফ। খাটটি মারুফের চেনা। গতবার যখন দেখা হয়েছিলো স্যারের সাথে তখনও স্যারের এই খাটটি ছিলো। তখন অবশ্য স্যারের সাথে উনার স্ত্রী ছিলেন। কিন্তু এখন শুধু স্যার একাই থাকেন। স্যার পেনশানে যাওয়ার আগের বছর স্যার তাঁর সহধর্মিণীকে হারান। মারুফ মোবাইল মারপত এই খবর জেনে দুঃখ পায়। আফসোস করে সে। এতোদিন দুজন ছিল। দুজনের দেখা-শোনা দুজনই অন্তত করতে পারতো। এখন স্যার পুরো একা। দাম্পত্যজীবনে স্যারের সন্তান নেই। অনেকে স্যারকে আরেকটি বিয়ে করার পরামর্শ দিলেও স্যার নতুন করে কোনো বিয়ে করেননি। বরং স্যারের মনে হতো এটা এক অমানবিক কাজ। অবশ্য এ নিয়ে স্যারের মনে কোনো আফসোস কিংবা হতাশাবোধ ছিলো না কখনো। কারণ প্রাইমারি স্কুলের হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে পড়িয়েছেন তিনি। এরা সবাই তার সন্তানের মতো। মারুফের মতো অনেক সন্তান আছে তার। তাছাড়া তিনি তার স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসতেন। এ ভালোবাসা ছিলো এ যান্ত্রিক পৃথিবীর শর্তহীন আর অপার্থিব ভালোবাসা।
পাঁচ.
মিনিট বিশেক আগে স্যার জোহরের নামাজ পাশের মসজিদে পড়ে নিয়েছেন। এ সময়টাতে তিনি দুপুরের খাবার খান। দুপুরের লাঞ্চ আওয়ারও চলছে এখন।
স্যার : মারুফ তুমি হাত-পা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো বাবা। ঘরের ওই পাশে চাপকল আছে। খেতে হবে। খাবারের সময় হয়ে গেছে।
মারুফ : জ্বি স্যার। যাচ্ছি।
হাত-পা ধুয়ে আসে মারুফ। অবশ্য গাড়ির ড্রাইভার সাহায্য করেছে তাকে। কারণ কতদিন এই চাপকল দেখে না সে। সুইজারল্যান্ডের মতো দেশে চাপকল নেই। অত্যাধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা যে দেশে। সেখানে আমাদের দেশের মতো চাপকলের ব্যবহার নেই। সেখানে কৃষকদেরও এ চাপকল ব্যবহার করতে হয় না। তাছাড়া তিনি যে লেবেলের মানুষ বা দায়িত্ব পালন করছেন সেই লেবেল এ এসে একজন সরকারি কর্মকর্তা সর্বোচ্চ প্রটোকল, বাড়ি-গাড়ি, নিরাপত্তারক্ষী, কর্মচারীসহ নানা সুবিধা পেয়ে থাকেন! যা রাষ্ট্র তার প্রজাতন্ত্রের দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের প্রদান করে থাকে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে গুরু-শিষ্য দুজন। অবশ্য এর সাথে গাড়ির ড্রাইভারও খেয়ে নেয়।
ছয়.
বিকেলে স্যারসহ বের হয় মারুফ। স্যার মারুফকে তার হাতেগড়া এতিমখানায় নিয়ে যায়। এই এতিমখানা স্যারের কাছে এক স্বর্গীয় স্থান। এ যেনো জান্নাতের এক টুকরো বাগান। এখানে তিনি তার অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন। স্যার তার প্রাপ্ত পেনশানের সব টাকা দিয়ে গড়ে তুলেছেন এই এতিমখানা। এই এতিমখানায় আছে ৮৩ জন ছেলে-মেয়ে। যাদের কারো বাবা নেই, কারো নেই মা। কারো বা দুজনের একজনও নেই। এরা অসহায়। অসহায় বললে ভুল হবে। কারণ এই দুনিয়ায় এক আল্লাহ আর এই মফিজ স্যার ছাড়া আপজন বলতে এদের কেউ নেই। মফিজ স্যারই এদের মা-বাবা। ক্ষেত্রবিশেষে উভয় বলা চলে। ছেলে-মেয়েগুলো এখানে পড়াশোনা করে। এখানে পড়ার জন্যে কোনো টাকাণ্ডপয়সা দিতে হয় না কাউকে। বরং এতিমখানা থেকে তারা তিনবেলা খাবার পায় এরা। বছরে দুই ঈদে সবাই জামা-কাপড়-জুতোসহ সব কিছু পায়। কেউ অসুস্থ হলে মফিজ স্যার সাধ্যমতো চেষ্টা করেন সেবা, চিকিৎসা দিয়ে তাদের সারিয়ে তুলতে। এরাই যেনো স্যারের আপন সন্তান। তবে কতোদিন এভাবে চালিয়ে যেতে পারবেন তা নিয়ে তিনি শঙ্কায় আছেন। আনমনে ভাবেন কীভাবে সামনে টেনে নিবেন এ বাচ্চাগুলোকে। বয়সও হয়েছে অনেক। তার উপর পেনশান থেকে প্রাপ্ত টাকার অধিকাংশ টাকাই ইতিমধ্যে খরচ করে ফেলেছেন এই কাজে। আবার ভাবেন খোদার এতো বড় দুনিয়ায় কেউ না কেউ এই বাচ্চাদের দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসবে। হাল ধরবে এ এতিমখানার। মারুফ স্যারের সাথে ঘুরে ঘুরে দেখে আর স্যারের সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে। চোখ বেয়ে যেনো অশ্রু নামে মারুফের। মনে পড়ে যায় তার ছোটবেলার কথা। অতীত স্মৃতিতে ফিরে যায় সে। সেও ছোটবেলায় এই এতিম ছেলেদের মতো ছিলো। বাবাকে জন্মের বছর হারায় সে। এর বছরপাঁচেক পর হারায় মাকে। একবারে এতিম হয়ে পড়ে মারুফ। পাশের বাসার রমিজা খালা না থাকলে হয়তো তখনই মরতে হতো না খেয়ে, অনাদর আর অবহেলায়। হয়তো কবরে গজাতো চকচকে দুর্বাঘাস। আর শীতের কুয়াশা সেই দুর্বাঘাসে শিশিরকণা পড়ে এক দুঃখের আবহ তৈরি হতো হয়তো। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর রমিজা খালা মারুফকে কোলে তুলে নেয়। রমিজা খালা ছিলো তার মায়ের বান্ধবী। মায়ের অভাব কিছুটা পূরণ হয় তার। অভাবের সংসারে খালা নিজে চলতেই কষ্ট হয়। স্বামী একা রিকশা চালিয়ে যা পান তার অর্ধেক চলে যায় গ্যারেজের মালিকের রিকশার দৈনিক ভাড়া শোধ করতে গিয়ে। বাকি যা থাকে তা দিয়ে কোনো রকম কষ্ট করে চলতে পারেন। নিজের চার সন্তান, মারুফসহ সবাই বেড়ে উঠছে একসাথে। বড় ছেলে আর মেয়েকে পাশের স্কুলে ভর্তি করিয়েছে রমিজা খালা। মারুফকেও ভর্তি করিয়ে দেয় তাদের সাথে। কিন্তু অভাব তাদের ছাড়ে না। কীভাবে নিজের ৪ ছেলে-মেয়ের পাশাপাশি মারুফকেও চালাবেন, রমিজা খালা চিন্তা করতে থাকেন আকাশের দিকে তাকিয়ে।
সাত.
কোনো উপায়ন্তর পায় না রমিজা খালা। মারুফকেও চলে যেতে হয় এ রকম এতিমখানার মতো একটি প্রতিষ্ঠানে। রমিজা খালাকে হারিয়ে বিমর্ষ হয়ে পড়ে মারুফ। পরে এক সময় দেখা হয় স্যারের সাথে। বুকে টেনে নেয় মারুফকে। মারুফের সব দায়িত্ব নেয় স্যার। প্রতিমাসে বেতন পেয়ে টাকা পাঠাতেন মারুফের জন্যে। চলতে থাকে মারুফের পড়াশোনা। ওই এতিমখানায় থেকেই এসএসসি, এইচএসসি শেষ করে ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে অনার্স, মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করে সে। পরে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পরীক্ষা বিসিএসে অংশগ্রহণ করে পররাষ্ট্র ক্যাডারে ১ম হয় মারুফ। চাকুরিতে জয়েন করে সে। শুরুতে পোস্টিং হয় দেশে। কয়েক বছর দেশে চাকুরি করে বিদেশে পাড়ি জমায়। ইতিমধ্যে আমেরিকা, ইউরোপের অনেকগুলো দেশের অ্যাম্বাসিতে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছে সে। বছর দুয়েক আগে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পায় মারুফ।
মারুফ স্যারের হাত হাত রাখে। স্যার!
মারুফ : স্যার আমি একটু সুযোগ চাই আপনার কাছে।
স্যার : বলো বাবা। কি সুযোগ চাই তোমার? আর এই বুড়ো মানুষের কিবা করার সাধ্য আছে তোমার মতো এতো বড় মানুষের জন্যে কিছু করার? বলো।
মারুফ : না স্যার, আগে বলেন আমি যা চাইবো আপনার কাছে তা দিবেন? বলেন প্লিজ।
স্যার : আচ্ছা বলে দেখো না, পারি কি না।
মারুফ : স্যার আপনার এই এতিমখানার পুরো খরচের দায়িত্ব আমি নিতে চাই। আপনি থাকবেন এই এতিমখানার উপদেষ্টা হিসেবে। আপনি যেভাবে চাইবেন সেভাবে চলবে এটি। আপনার পরামর্শ এবং উপদেশের মাধ্যমে পরিচালিত হবে এটি। আমি চাই এই এতিমখানা আপনার স্ত্রী জয়নববানু আন্টির নামে হবে। আর এখানের এতিম ছেলে-মেয়েরা সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা যাতে পায় মূলধারার মানুষের মতো আমি তা চাই। এখন থেক প্রতি মাসে আমার বেতনের অর্ধেক এদের জন্যে দিয়ে দিবো। বাকি যা থাকবে তা দিয়ে আমি, আমার স্ত্রী আর ছেলে আদিল আহনাফের সুন্দর মতো দিন চলে যাবে। আর আমিও আমার পেনশনের অর্ধেক টাকা এ এতিম শিশুদের জন্যে দিয়ে দিতে চাই। আপনি রাজি তো স্যার?
স্যার বলেন প্লিজ। স্যার...
মারুফের কথা শুনে স্যার কি বলবে বুঝতে পারেন না। স্যারের বিশ্বাস হয় না মারুফের কথা। কি বলে এই ছেলে।
স্যার ভাবছে হয়তো স্যারকে খুশি করার জন্যে হয়তো এমন করে বলছে মারুফ। স্যারের সাথে অনেক কথা হয় তার। কথাবার্তা শেষে মারুফ বিদায় নিয়ে বিকেলেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। আগামী চারদিন ঢাকায় বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হবে তাকে।
আট.
পরের মাসের ১১ তারিখ স্যারের ঠিকানায় মারুফের কথা মতো মানি অর্ডারের টাকা পৌঁছে যায়। স্যার নিজেকে বিশ্বাস করতে পারে না। চিমটি কাটে নিজের হাতে নিজে। দুই মাস পর আবার এতিমখানায় আসে মারুফ। এতিমখানার জন্যে জমি কিনে। নতুন বিল্ডিং করার জন্য স্যারের হাতে টাকার চেক তুলে দেয়। শুরু হয় নতুন করে ছয় তলার দুটি ভবনের কাজ। কাজ এগোতে থাকে। মারুফ নিজে যতোটুকু পারে নিজে টাকা দেয়। আবার ফিরে যায় নিজের কর্মক্ষেত্রে। পাশাপাশি মারুফ ইউরোপের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান থেকে এতিমখানার জন্যে বড় অঙ্কের অনুদানের ব্যবস্থা করে। যারা প্রতি মাসে এই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাসহ যাবতীয় খরচের সিংহভাগ বহন করবে।
বিদেশে ফিরে যাওয়ার আগে স্যারের নামে স্থানীয় ব্যাংকের শাখায় একটি সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলে দেয় মারুফ। প্রতি মাসে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের অনুদানের টাকা আসে স্যারের এই অ্যাকাউন্টে। ভবন দুটির নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলে। কাজ প্রায় শেষের পথে। স্যার মারুফকে দেশে আসার জন্যে ফোন করে। আগামী বড় উৎসবের সময় দেশে আসবে মারুফ।
নয়.
আজ আবার প্রায় ৫ মাস পর স্যারের সাথে মারুফের দেখা। বড় বড় দুটি ভবন ঊর্ধ্বমুখী হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হরেক রকম বেলুনে সাজানো হয়েছে এতিমখানা প্রাঙ্গণ। বাচ্চারা পরেছে নতুন জামা-কাপড়। চারদিকে যেনো সাজসাজ রব। রান্নার সুবাসিত ঘ্রাণ ভেসে আসছে। ১২৬৩ জন এতিম আর দুঃস্থ ছেলে-মেয়ে আছে জয়নববানুর নামে করা এতিমখানায়। আজ এই নামে উন্মোচন হবে এতিমখানার নাম। ফুলের ডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মফিজ স্যারসহ ছেলে-মেয়েরা। মারুফের সাথে আজ আছে নতুন দুজন অতিথি। একজন মারুফের স্ত্রী তাহসীন ফারজানা। সাথে তাদের সন্তান আদিল আহনাফ। এতিমখানার উদ্বোধন হচ্ছে ফিতা কেটে। আর এই কাজ স্যার চেয়েছিলেন মারুফের হাত দিয়ে করবে। কিন্তু মারুফ চায় এ ভালো কাজের কিছুটা স্মৃতি আদিল আহনাফের মনেও গেঁথে থাকুক।
ফিতা কাটছে আদিল আহনাফ। আজ স্যারের চোখে অশ্রু। এই অশ্রু আনন্দের। এই অশ্রু স্যার থেকে সংক্রামক ব্যাধির মতো সবার চোখে ছড়িয়ে পড়েছে। মারুফের চোখেও অশ্রু। এ অশ্রু কথা দিয়ে কথা রাখতে পারার অশ্রু। স্যারের স্বপ্নপূরণ করতে পারার অশ্রু। তার ছোটবেলার মতো অনিশ্চিত জীবনের মুখোমুখি হওয়া হাজার ছেলে-মেয়ের দায়িত্ব নিতে পারার অশ্রু।
পরের দিন সকাল ১০টা ৪৩ মিনিটে মারুফ তার স্যার এবং এতিমখানার ছেলে-মেয়েদের থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকায় ফিরছে। গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে...
হাউমাউ করে কাঁদছে স্যারসহ এতিমখানার বাচ্চারা। যতো দূর চোখ যায় সবাই তাকিয়ে থাকে গাড়ির দিকে। গাড়ি চলছে তো চলছে। মারুফের স্ত্রী দেখতে পায় মারুফের চোখের মণিকোঠায় যেনো পানি ছলছল করছে। তার স্ত্রীরও চোখ ভিজে আসে অশ্রুতে। কিন্তু কেউ কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না।