শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

এই জনমে

মিজানুর রহমান রানা
এই জনমে

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

চৌদ্দ.

স্বাধীনতার অনেক বছর পেরিয়েছে। মেহের জল্লাদ এখন আর এই নামে পরিচত নয়। সে এখন এমপি মেহের আলী। সংসদ সদস্য হয়েছে, গাড়ি হয়েছে, বাড়ি হয়েছে, হয়েছে শানশওকত।

প্রতিদিন গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা টানিয়ে সংসদ ভবনে যেতে হয় তার। এটা তার কাছে খুব বিরক্ত লাগে। সে তো বাংলাদেশ চায়নি, বাংলার পতাকা চায়নি। সে চেয়েছে অবিচ্ছিন্ন পাকিস্তান। তবুও তার চাওয়া-পাওয়ার বাইরেই সব হয়েছে।

মেহের জল্লাদ ভাবে, ভালোই তো হলো। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা নিষ্ঠুরভাবে খুন করেছি। নারীদের ধর্ষণ করেছি, মানুষের সম্পদ লুট করেছি। তারপর স্বাধীনতার পর মাত্র দুবছর জেল খেটে বের হয়ে গেছি জেলখানা থেকে। সে মনে মনে তাকে ধন্যবাদ জানায়, যে জেনারেল শাসক হয়ে তার মতো অনেক জল্লাদকে মুক্তি দিয়েছে। তারপর তাদেরকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছে। এরপর তারা কেউ কেউ সংসদ সদস্য হয়ে মন্ত্রীও হয়েছে। এখন তাদেরকে রাজাকার বলতে পারে না কেউ। জনগণ তাদেরকে স্যালুট করে। মন্ত্রীর দেখা পাওয়ার জন্যে লাইন ধরে বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

এই তো সেদিন এক সাংবাদিক তাকে রাজাকার বলায় সে উত্তর দিয়েছিলো, ‘এখন আর বাংলাদেশে কোনো রাজাকার নেই। যা ছিলো যুদ্ধের সময়, এখন সবাই দেশের জনগণ। কাউকে রাজাকার বলা যাবে না আর।’

পত্রিকাগুলোতে এসব কথা প্রকাশ হয়েছে। মেহের জল্লাদের দম্ভ আরো বেড়েছে। তারা মন্ত্রী হয়ে এখন বাংলাদেশের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। বাজার অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি সবকিছুই এখন তাদের হাতে। তারা যা চায়, যেমনি চায় তেমনিভাবেই দেশ চলছে। কে তাদের কী বলবে?

জনগণের সম্পদ লুট করে তাদের দলের বিরাট অর্থ-সম্পদ হয়েছে। প্রতিটা জেলা-উপজেলায় তারা সেই সম্পদ দিয়ে ব্যাংক, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল নির্মাণ করে আরও অর্থশালী হচ্ছে। এসব টাকার কিছু অংশ খরচ হচ্ছে বিরোধী দলকে রাজনীতি থেকে ঠেঙ্গানোর কাজে। দেশে জঙ্গি হামলা, বোমা হামলাসহ গুমণ্ডখুন এসব কাজেও আয়ের কিছু অংশ ব্যয় হচ্ছে। এই দেশ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নামণ্ডনিশানা মুছে ফেলার কাজেও টাকা ব্যয় হচ্ছে। অন্য দলের সঙ্গে লেজুড়বৃত্তি করে শক্তি বেড়েছে তাদের। তাই এখন দেশটা মেহের আলী জল্লাদদের। এরা এখন সংখ্যায় অনেক হয়েছে। টাকার গন্ধে, ক্ষমতার স্বার্থে সমর্থক-অনুসারী হাজার হাজার বেড়েছে। তাদের বিরুদ্ধে টু-শব্দটি করারও এখন কেউ নেই। যারা তাদের বিরুদ্ধাচরণ করতো তাদেরকে ক’দিন পূর্বে গ্রেনেড হামলা করে দমন করা হয়েছে। ধীরে ধীরে দেশকে বিরোধীদল শূন্য করার নীল নকশা রয়েছে তাদের। এরপর তারা সংখ্যায় শক্তিতে আরও বড় হবে। মানুষকে ধোঁকা দিয়ে তারা পূর্ণশক্তিতে একাই দেশ শাসন ও শোষণ করবে। সমস্ত পরিকল্পনাই হয়ে গেছে, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

এসব কথা ভেবে ভেবে বাংলার পতাকাবাহী সরকারি গাড়িতে বসে হাসে মেহের। হঠাৎ করেই মনে হলো হেকমতের কথা। মনে মনে বলে, ওহ হেকমত। কোথায় তুমি? স্বাধীনতার আগে আমার সহযোগী ছিলে, স্বাধীনতার পর বেশি আখেরাতের চিন্তায় পেয়েছিলো তোমায়। তাই আমার কাছ থেকে সরে গেলে। এরপর কী হলো? এখন তুমি এলাকার মসজিদের ইমাম। নামাজকর্ম নিয়ে সারাদিন মশগুল থাকো। ক-টা টাকা বেতন পাও? সামান্য টাকা। আর আমি? আমার তো টাকা গোণার হাজার লোক রাখলেও গুণে শেষ করতে পারবে না। আর আমার ক্ষমতাও অসীম। আমার গাড়ি আছে, বাড়ি আছে, তিনটা সুন্দরী স্ত্রী আছে। ছেলেমেয়েরা দেশের বাইরে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করছে। ওরা বলেছে সময় হলে আমাকেও নিয়ে যাবে। বাহ, আমি তো সফল। আর তুমি হেকমত কী পেলে সততা দেখাতে গিয়ে?

গাড়িতে বসে হাসে মেহের জল্লাদ। তার হাসিতে গাড়ি চালক ওসমান মিয়া গাড়ি চালাতে চালাতে গাড়ির আয়নায় জল্লাদের হাসি দেখে। সে মনে মনে ভাবে, আমি জানি তুমি কে? কী তোমার পরিচয়। শুধু পেটের টানে তোমার গাড়ি চালাই। তুমি জেনে রেখো, আল্লাহ কাউকে ছাড় দেন, তবে ছেড়ে দেন না। তোমারও সময় হচ্ছে, একদিন তুমি পড়বে ধরা সময়ের আয়নায়। তখন তোমার মরণ কামড় কেউ ঠেকাতে পারবে না।

জেগে উঠেছে ইরফান। চোখ মেলেই দেখতে পেলো তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে অধরা। ইরফানের চোখ মেলে তাকিয়ে থাকা দেখে তার সমস্ত শরীর স্বর্গীয় শক্তিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। সে উচ্চারণ করলো, ‘ইমতিয়াজ, তুষার, অনন্যা, ইশানবালা, রূপালি তোমরা কোথায়? আমার ইরফান জেগে উঠেছে, সে আবার কথা বলবে। তোমরা আসো, তোমরা আসো।’

সবাই নিকটেই ছিলো, অধরার চিৎকারে ছুটে এসে দেখলো, ইরফান চোখ মেলে চারদিকে তাকাচ্ছে। কেউ কিছু বলার আগেই ইরফান ঠোঁট দুটি ফাঁক করে বললো, ‘যুদ্ধটা এখনও শেষ হয় নাই, এই যুদ্ধ চলবে...।’

কথাটা শেষ করতে পারলো না সে, তারপর আবার ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লো।

হঠাৎ ইরফানের বুকের মধ্যে আছড়ে পড়লো অধরা। তার বুকের নিঃশ্বাস গ্রাস করছে ইরফানকে, তার চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে ইরফানের মুখে। তার উষ্ণ শ্বাস ইরফানের বুকে ঝরণার ফল্গুধারার বান ডাকে। আবারও ইরফান চোখ মেলে অধরার দুটি চোখের তারায় তাকায়। একটা সুন্দর হাসি দিয়ে আবারও চোখ দুটি বুঁজে। এরপর ঘুমের ঘোরেই বলে উঠে, ‘অধরা তুমি এখনও বেঁচে আছো? আমি তোমার জন্যেই বেঁচেছিলাম। তবে আমি জানতাম না, সব বাগানে ফোটে না ফুল। ছিলাম তোমার জন্যে সারাটা জীবন ব্যাকুল...।’ কথাগুলো বলে আবারও গভীর ঘুমে আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে ইরফান।

বাকশক্তিহীনের মতো কথাগুলো শুনছিলো অধরা। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। তবে সে জানে আবারও পূর্ণ শক্তিতে জেগে উঠবে ইরফান, তারপর সে বেরিয়ে পড়বে দেশবিরোধী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করতে। যতদিন বাংলাদেশ থেকে দেশবিরোধীরা নির্মূল না হবে, ইরফানের যুদ্ধ শেষ হবে না...। ইরফানরা ক্লান্ত হয়ে ঘুমায়, কিন্তু মরে না কখনও। এক ইরফান থেকে আরেক ইরফানের জন্ম হবে, এরপর এরাই এই দেশকে চক্রান্তকারীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে নিজেদের রক্ত বিলিয়ে দিবে।

এমন সময় কামরায় চিত্রনায়ক আমির প্রবেশ করলেন। তার সাথে স্ত্রী সুজানাও রয়েছে। আমির কামরায় প্রবেশ করে সবাইকে দেখেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন। সবার সাথে করমর্দন করে অধরাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইরফান কেমন আছেন?’

অধরা কোনো কথা বললো না। ঠিক সে সময়েই অধরার মুঠোফোনে দেশের বাইরে থেকে কল আসলো তিরণার। অধরা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তিরণা বলে উঠলো, ‘হ্যালো আপু, শুনলাম ইরফান ভাইকে নাকি পাওয়া গেছে হাসপাতালে?’

অধরা কোনো কথা বলতে পারছে না। তার হাত থেকে ফোনটি নিয়ে কথা বললো আমির, ‘হ্যাঁ। আজিম বলছি, পাওয়া গেছে ইরফানকে। সে এখন ঘুমাচ্ছে। আর তোমার আপু তাঁকে পেয়ে বোধশক্তিহীন হয়ে পড়েছে। কথা বলতে পারছে না। তুমি ভালো আছো তো?’

--'ওহ আমির ভাইয়া, কেমন আছেন আপনি, সুজানা আপুসহ সবাই ভালো তো?’

তিরণাকে বিস্তারিত জানিয়ে কথা শেষ করে ইমতিয়াজসহ সবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো আমির, ‘কেমন আছো ভাই-বোনরা?’

আমিরের কথা শেষ না হতেই এই সময়ই আবারও চেতনা পেলো ইরফান। তারপর ধীরে ধীরে উঠে বসলো। সবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। তারপর বললো, ‘বাংলাদেশ ভালো না থাকলে আমরা কি ভালো থাকতে পারি?’

ঠিক সেই সময়েই ক’জন সাংবাদিক প্রবেশ করলো। তারা বললো, ‘আমরা কি গ্রেনেড হামলায় আহত মি. ইরফানের সাক্ষাৎকার নিতে পারি?’

ইরফান কিছুই বললো না। এ সময় অধরা বলে উঠলো, ‘আপনারা তাদেরই সাক্ষাৎকার নিন, যারা দুর্নীতির টাকায় আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে, যারা রাজাকার থেকে মন্ত্রী হয়ে দেশে দম্ভ দেখায়, মানুষের হক মেরে খায়। আর মুক্তিযোদ্ধারা ফুটপাতে ঘুমায়। অনাহারে মরে। আপনারা তাদের সাক্ষাৎকার নিবেন, যারা ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ঋণখেলাপি হয়ে জনগণের টাকা মেরে খায়। ফুটপাতে অনাহারে থাকা মানুষটির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কখনও? দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি ধ্বংসের কারণ সম্পর্কে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কখনও, খুনি-লুটেরাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কখনও। যারা মানুষের সম্পদ লুট করে বুক চিতিয়ে সমাজে ঘুরে বেড়ায় তাদের সাক্ষাৎকার নিন। একজন সামান্য মুক্তিযোদ্ধা ইরফানের সাক্ষাৎকার নিয়ে কী লাভ আপনাদের। সে তো বেঁচেও মরে থাকার মতোই। সে আর কী বলবে? তার আর কিছুই বলার নেই। সে একজন যোদ্ধা মানুষ, যখন হুঁশ ফিরবে আবারও তার যুদ্ধক্ষেত্রেই চলে যাবে। যেখানে অনাহারী পেটের ক্ষুধায় যুদ্ধ করছে, যেখানে মা-বোনেরা সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্যে যুদ্ধ করছে, যেখানে স্কুল-কলেজে পড়ুয়া মেয়েরা ছেলে সহকর্মীর টিটকারী, আপত্তিজনক কথা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করছে, যেখানে বাবা তার সন্তানের ভরণ-পোষণ দিতে না পেরে বাস-গাড়ির তলায় আত্মাহুতি দিচ্ছে, সেখানেই আপনারা পাবেন ইরফানকে। এছাড়া তার আর কোনো গন্তব্য আমার জানা নেই।’

কামরায় গভীর নিস্তব্ধতা। কেউ কোনো কথা বলছে না। সবাই ভাবছে, অধরা তার জীবনের সবক’টি না বলা কথা-দুঃখ আজ সময়ের সাথে মস্তিষ্ক থেকে বের করে দিয়েছে। এসব কথার জবাব কি আছে কারো কাছে?

কথাগুলো শুনে ইরফানের দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিলো। অধরা ধীরে ধীরে ইরফানের কাছে গিয়ে দুচোখের অশ্রুবিন্দুগুলো মুছে দিলো। তারপর জড়িয়ে ধরে বললো, ‘যদি আমায় ভালোবাসো।’

অধরার কথায় ইরফান নিজের কণ্ঠস্বর শুনে সব কষ্ট ভুলে সুখের হাসি হাসলো, তারপর ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করলো।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়