প্রকাশ : ২৭ জুন ২০২৪, ০০:০০
বাবা দিবসের উৎপত্তি
-----রহমান মৃধা-----
বাবা দিবসের ধারণাটি প্রথম আমেরিকায় উদ্ভাবিত হয়। সনোরা স্মার্ট ডড নামের একজন নারী এই দিনটি প্রথমবারের মতো ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তার বাবা উইলিয়াম জ্যাকসন স্মার্ট একজন সিভিল ওয়ার ভেটেরান ছিলেন। সনোরার মা মারা যাওয়ার পর তিনি একাই ছয়টি সন্তানকে লালন-পালন করেন। মায়েদের সম্মানে মা দিবস পালনের পর, সনোরা তার বাবাকে এবং অন্যান্য বাবাকে সম্মান জানানোর জন্যে একটি বিশেষ দিনের প্রস্তাব করেন।
১৯১০ সালের ১৯ জুন ওয়াশিংটনের স্পোকানে প্রথম বাবা দিবস পালিত হয়। এরপর ধীরে ধীরে এই দিবসটি জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এই দিনটিকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন।
বাবা দিবসের গুরুত্ব এবং উদযাপন
বাবা দিবস শুধুমাত্র আমাদের বাবাদের জন্যে বিশেষ একটি দিন নয়, বরং এটি আমাদের সমাজের সব পুরুষ অভিভাবক এবং পথপ্রদর্শকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি সুযোগ। এই দিনে আমরা শুধু জীবিত বাবাদেরই নয়, প্রয়াত বাবাদের প্রতিও শ্রদ্ধা জানাই। তাদের স্মৃতিচারণ করে এবং তাদের দেওয়া শিক্ষাকে জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করি।
বিশ্বব্যাপী বাবা দিবস উদযাপন
বাবা দিবস শুধু আমেরিকাতেই নয়, বিশ্বজুড়ে পালিত হয়। বিভিন্ন দেশে এই দিনটি ভিন্ন ভিন্ন দিনে পালিত হয় এবং উদযাপনের ধরণও ভিন্ন। যেমন--
যুক্তরাজ্য ও কানাডা : যুক্তরাষ্ট্রের মতো একই দিনে পালিত হয়।
অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড : সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম রোববার পালিত হয়।
জার্মানি : অংপবহংরড়হ উধু-র দিন (খ্রিস্টের স্বর্গারোহণ) পালন করা হয়, যা প্রায় ৪০ দিন পর আসে।
থাইল্যান্ড : ৫ ডিসেম্বর, রাজা ভূমিবল আদুল্যাদেজের জন্মদিন পালন করা হয়।
সুইডেন : বাবা দিবস পালিত হওয়া শুরু হয় ১৯৩১ সালে। প্রথমে এটি জুন মাসে পালিত হতো, কিন্তু পরে মে মাসের শেষ রোববারে পালিত মা দিবসের কাছাকাছি হওয়ায়, নভেম্বরের দ্বিতীয় রোববারে স্থানান্তরিত করা হয়। বাবা দিবসটি মা দিবসের চেয়ে কিছুটা সহজভাবে পালিত হয়।
একটি হৃদয়স্পর্শী গল্প : বাবার সাথে প্রথম চাকরির দিন
একদিন সকালে আমি আমার প্রথম চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছিলাম। আমি খুবই নার্ভাস ছিলাম এবং আমার মনে আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল। বাবা তা বুঝতে পারলেন এবং আমাকে বললেন, ‘আজকের দিনটা তোর জীবনের একটি নতুন অধ্যায়। সব সময় মনে রাখিস, সৎভাবে পরিশ্রম করবি, কখনো হাল ছাড়বি না। তুই সফল হবি, কারণ তোর মধ্যে সেই সামর্থ্য আছে।’
বাবার কথাগুলো আমাকে সাহস দিল এবং আমি ইন্টারভিউতে ভালো করলাম। আমার চাকরি হলো এবং সেই দিনটি আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। আজ আমি সফলভাবে আমার পেশাগত জীবন পরিচালনা করছি, যার পেছনে বাবার প্রেরণা ও আশীর্বাদ ছিল। বাবার সেই কথাগুলো আমার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে একটি পথপ্রদর্শক হয়ে আছে।
বাবার অনুপ্রেরণায় বিশ্বভ্রমণ
আমার বাবা-মা’র সঙ্গে হজযাত্রার স্মৃতি আগে উল্লেখ করেছি, কিন্তু বাবার সঙ্গে অন্যান্য ভ্রমণও বিশেষ ছিল। বাবার কাজের সুবাদে আমরা বিশ্বের নানা দেশ ঘুরেছি। তিনি সব সময় চাইতেন আমরা নতুন নতুন সংস্কৃতি এবং জীবনধারা সম্পর্কে জানি। সুইডেন থেকে শুরু করে ক্যালিফোর্নিয়া, প্রত্যেকটি ভ্রমণ আমাদের জীবনের মূল্যবান অভিজ্ঞতা ছিল।
বাবার স্নেহময় আচরণ
বাবা সব সময় আমাদের কাছে স্নেহময় এবং বন্ধুর মতো ছিলেন। তাঁর কঠোর শাসনের পেছনে লুকিয়ে ছিল আমাদের প্রতি তাঁর অপরিসীম ভালোবাসা। আমার জীবনের একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই, যেখানে বাবার সেই স্নেহময় দিকটি প্রকাশিত হয়েছিল।
কীভাবে বাবাকে সম্মান ও ভালোবাসা দেখাবো
বাবাকে সম্মান ও ভালোবাসা দেখানো মানে শুধু বিশেষ দিনেই নয়, বরং প্রতিদিনই তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা এবং ভালোবাসা প্রকাশ করা। নিচে কিছু উপায় দেওয়া হলো, যেগুলোর মাধ্যমে আমরা আমাদের বাবাদের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারি :
১. সময় দিন
আপনার বাবার সাথে সময় কাটান। ব্যস্ত জীবনের মাঝে একটু সময় বের করে বাবার সাথে কথা বলুন, তাদের সাথে বসে গল্প করুন, তাদের প্রিয় কাজগুলোতে অংশ নিন। এই সময়টুকু তাদের জীবনে অনেক গুরুত্ব বহন করে।
২. কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। তাদের করা ছোট ছোট কাজগুলোর জন্যে ধন্যবাদ জানান। যেমন, রান্নার পরিষেবা বা কোনো কাজের জন্যে ধন্যবাদ জানাতে পারেন।
৩. স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর
বাবার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখুন। তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যপরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা করুন এবং সময়মতো ওষুধ খাওয়ার জন্যে নজর দিন।
৪. স্মৃতিচারণ
পুরানো স্মৃতিগুলো নিয়ে আলোচনা করুন এবং সেই স্মৃতিগুলোকে নতুন করে জীবিত করুন। একসাথে ফটো অ্যালবাম দেখুন বা পুরানো দিনের গল্প করুন। এটি শুধু বাবাকে আনন্দ দেবে না, বরং সম্পর্কও আরো গভীর করবে।
৫. সাহায্য ও সমর্থন
বাবাকে তাদের কাজকর্মে সাহায্য করুন এবং তাদের যে কোনো সমস্যায় পাশে দাঁড়ান। তারা কোনো কাজে সাহায্য চাইলে উৎসাহিতভাবে সেটি করুন।
৬. উপহার দিন
বাবাকে তাদের প্রিয় কোনো উপহার দিন। এটি ছোট কিছু হতে পারে, যেমন প্রিয় বই, প্রিয় খাবার, অথবা কোনো স্মারক। উপহারের মাধ্যমে আপনি আপনার ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারেন।
৭. শিখুন এবং অনুসরণ করুন
বাবার শিক্ষা ও আদর্শ অনুসরণ করুন। তারা যেসব মূল্যবোধ এবং নীতি আমাদের শেখান, সেগুলো মেনে চলুন এবং তাদের জীবনধারার অনুসরণ করুন।
৮. বিশেষ দিনে বিশেষ আয়োজন
বাবা দিবস বা জন্মদিনে তাদের জন্যে বিশেষ কিছু করুন। যেমন, একটি সারপ্রাইজ পার্টি আয়োজন করতে পারেন, প্রিয় খাবার রান্না করতে পারেন বা একসাথে কোনো সুন্দর স্থানে ভ্রমণ করতে পারেন।
৯. শুনুন
আপনার বাবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। তাদের মতামত, পরামর্শ এবং অনুভূতিগুলো গুরুত্ব সহকারে নিন। এটি তাদের মনে করবে যে, তারা আপনাকে গুরুত্বপূর্ণ এবং আপনার জীবনে তাদের স্থান রয়েছে।
১০. ভালোবাসা প্রকাশ
প্রতিদিন বাবাকে ভালোবাসার কথা বলুন। কথায় এবং কাজে তাদের প্রতি আপনার ভালোবাসা প্রকাশ করুন। একটি সাধারণ ‘তোমাকে ভালোবাসি বাবা’ বলাও অনেক বড় ব্যাপার হতে পারে।
১১. দায়িত্ব ভাগ করে নিন
বাবার দায়িত্বগুলো ভাগ করে নিন। বিশেষত যদি আপনার বাবা বয়স্ক হন বা অসুস্থ হন, তবে তাদের দৈনন্দিন কাজগুলোতে সাহায্য করুন।
১২. শিক্ষা ও পরামর্শ নিন
বাবার কাছ থেকে শিক্ষা ও পরামর্শ নিন। তারা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, সেগুলো থেকে শিখুন এবং তাদের পরামর্শ মেনে চলার চেষ্টা করুন।
১৩. সহনশীলতা
বাবার মতামত এবং সিদ্ধান্তের প্রতি সহনশীল হোন। তারা যে কোনো ব্যাপারে অভিজ্ঞ এবং তাদের মতামতকে সম্মান করা উচিত।
১৪. পরিবারে সম্পর্ক উন্নয়ন
পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে বাবার সম্পর্ক উন্নয়নে সাহায্য করুন। পরিবারে একতা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে বাবার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
১৫. প্রযুক্তিগত সহায়তা
যদি আপনার বাবা প্রযুক্তির সাথে তেমন পরিচিত না হন, তবে তাদের প্রযুক্তিগত সমস্যায় সাহায্য করুন। ফোন, কম্পিউটার বা ইন্টারনেট ব্যবহারে সহায়তা করুন।
সংক্ষিপ্ত প্রতিফলন
আমাদের বাবা আমাদের জীবনের প্রধান রোল মডেল এবং পথপ্রদর্শক। তাদের ভালোবাসা এবং ত্যাগের মূল্যায়ন করতে এবং তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে আমরা সবসময় সচেষ্ট থাকি।
প্রতিটি বাবা দিবসে আমি আমার বাবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। বাবার প্রতিটি শিক্ষার মর্ম আমি বুঝতে পেরেছি এবং তা আমার জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছি। বাবা, আপনি আমার জীবনের প্রকৃত রোল মডেল। আপনার মতো হতে পারাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো সাফল্য হবে। আপনার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।
প্রতিটি সন্তানের কাছেই তার বাবা পৃথিবীর সেরা। বাবার কাছে আমাদের প্রতি যে ভালোবাসা, যত্ন এবং ত্যাগ থাকে তা অনন্য এবং অমূল্য। যখন আমরা বলি 'আমার বাবা বিশ্ব সেরা' তখন এটি অন্যদের বাবার প্রতি কোনো অবমূল্যায়ন নয়। বরং এটি আমাদের প্রতি বাবার ভালোবাসা এবং যত্নের প্রশংসা।
অন্যান্য বাবাদের অনন্যতা এবং শ্রেষ্ঠত্ব
১. অবিরাম সমর্থন : অনেক বাবা আছেন, যারা দিনের পর দিন কঠোর পরিশ্রম করে যান শুধু তাদের সন্তানদের সুখ এবং সাফল্য নিশ্চিত করতে। তাদের অবিরাম সমর্থন এবং উৎসাহ সন্তানদের জীবনের পথে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে।
২. মানসিক শক্তি : কিছু বাবা আছেন, যারা জীবনের নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে ধৈর্য এবং মানসিক শক্তির উদাহরণ স্থাপন করেন। তাদের এই গুণাবলি সন্তানদের জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রেরণা যোগায়।
৩. জ্ঞান ও শিক্ষা : কিছু বাবা আছেন, যারা তাদের সন্তানদের জীবনের প্রতিটি স্তরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেন। তাদের দেওয়া মূল্যবোধ এবং শিক্ষা সন্তানদের সঠিক পথে চলার নির্দেশনা দেয়।
৪. বন্ধুর মতো আচরণ : অনেক বাবা আছেন, যারা তাদের সন্তানদের সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করেন। তারা সন্তানদের জীবনের সব সমস্যায় পাশে দাঁড়িয়ে সমাধানের পথ দেখান এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন।
৫. উদারতা ও উদার মন : কিছু বাবা আছেন, যারা তাদের উদারতা এবং উদার মনের মাধ্যমে সন্তানদের হৃদয়ে জায়গা করে নেন। তাদের উদারতা সন্তানদেরও উদার হতে শেখায়।
৬. নীরব ত্যাগ : কিছু বাবা আছেন, যারা তাদের সন্তানের জন্যে নীরবে ত্যাগ করেন। তারা নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে সন্তানের স্বপ্ন পূরণে সর্বদা প্রস্তুত থাকেন।
সকল বাবার প্রতি শ্রদ্ধা
সব বাবাই তাদের সন্তানদের কাছে বিশেষ এবং সেরা। আমাদের বাবা যেভাবে আমাদের ভালোবাসেন, অন্য বাবাও তেমনভাবেই তাদের সন্তানদের ভালোবাসেন। সবার ভালোবাসার প্রকাশ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু সবার ভালোবাসা সৎ এবং নিঃস্বার্থ।
নিজের বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা
আমরা আমাদের বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ, কারণ তারা আমাদের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান স্থান ধরে রেখেছেন। আমাদের বাবার ত্যাগ, ভালোবাসা, এবং যত্নের জন্যে আমরা কৃতজ্ঞ। আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তারা আমাদের পাশে ছিলেন এবং থাকবেন।
উপসংহার :
প্রতিটি বাবা তার নিজের সন্তানের কাছে পৃথিবীর সেরা। তাদের ভালোবাসা, ত্যাগ এবং সমর্থন আমাদের জীবনের মূল ভিত্তি। আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে, আমাদের বাবার ভালোবাসা অমূল্য এবং অসীম। তাই প্রতিটি দিন আমরা তাদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে পারি।
শুভ বাবা দিবস!
লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।