প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
মিশরে রমজানের ঐতিহ্য ফানুস
পৃথিবীর শত আঁধারের মাঝে আলোর সঞ্চারণের প্রতীকী মাধ্যম হলো ফানুস। প্রাচীনকালে সাইরিয়াস নামক নক্ষত্রের উদয় উদ্ যাপনের জন্যে ফারাও-রা (ফেরাউন) যে উৎসব পালন করত, সেই উৎসবে ব্যবহৃত মশাল থেকেই প্রকৃত পক্ষে ফানুসের উদ্ভব হয়। প্রাচীন মিশরীয়রা ফারাও সম্রাটদের জন্মদিন পালন করার সময় রাস্তাগুলোকে আলোকিত করতো ফানুস দিয়ে। তাছাড়াও নেপোলিয়ান মিশর আক্রমণ করার পর তার দখলদারিত্বের প্রতিবাদে পুরো মিশরবাসী আকাশে ফানুস ছেড়ে প্রতিবাদ করেছিলো।
আধুনিক মিশরে রমজানে ফানুস প্রচলন নিয়ে এক্ষণে বিস্তারিত জানাচ্ছি।
মিশরে রমজানের সাজসজ্জার উপকরণ হিসেবে ফানুসের প্রথাগত ব্যবহারের সূচনা ধরা হয় ফাতিমীয় খিলাফতের সময় থেকে। ফাতিমীয় খিলাফত মূলত ছিলো মিশরকেন্দ্রিক। ৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ফাতেমি খলিফা মুইজ ঈল-দ্বীনিল্লাহ আবু তামিম মা'আদণ্ডবিন মানসুর আল-উবাইদি পবিত্র রমজান মাসে তৎকালীন মিশরের রাজধানী ফুসতাত আগমন করেন। তখন তার সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে ফুসতাতকে ফানুস দিয়ে আলোকসজ্জিত করা হয়েছিল। সেই থেকে রমজানে ফানুসের ব্যবহার করে আসছে মিশরীয়রা।
প্রতি বছর আরবী মাস শা'বানের ১৫ তারিখের পর পরই বিশ্বের প্রাচীন কৃষ্টি সভ্যতা সমৃদ্ধ মুসলিম দেশটির রাজধানী ইসলামিক কায়রো সহ সারাদেশের বিভিন্ন দোকানে বাহারী নামের রংবেরং-এর ফানুসের পসরা সাজিয়ে বসে দোকানিরা। রমজানের শুরু হওয়ার ১৫দিন আগে থেকেই রাস্তায় বের হলেই কানে ভেসে আসে দেশটির ঐতিহ্যবাহী রমজানের গান.....ওহাওয়ী -ওয়া- ওহাওয়ী, ইউয়োয়া- উয়াহা....।
এদেশে রমজান মাসে সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত প্রতিটি বাড়ি, রাস্তা ও দোকানে ফানুস জ্বালানো ও আলোকসজ্জা করা রমজানের সংস্কৃতি। দেশটির রাজধানী কায়রো সহ বিভিন্ন শহর ও গ্রামের অলি-গলির দোকানগুলো এখন বাহারি রঙের ফানুসে সয়লাব। রমজান শুরু হওয়ার আগে থেকেই দোকানিরা হরেক রকম ফানুস এনে সাজিয়েছেন দোকান। বিভিন্ন ডিজাইন ও রঙ বেরঙ-এর ফানুসের রয়েছে অদ্ভুত ধরনের যতসব বাহারি নাম। যেমন, আল-খামাসি, আবু শামা, আবু লাদ, আল-দালিয়াইয়া, আল-খুম্মাস, আল-বুর্জ, শামামা ইত্যাদি।
মিশরীয়দের কাছে সব থেকে জনপ্রিয় ফানুসটির নাম খামাসি। লোহা ও তামার কাঠামোতে তৈরি রঙিন কাচ দিয়ে ঝরানো ফানুসটি খুবই শক্ত ও টেকসই। ত্রিশ দশকের দিকে মিশরের সংসদ ভবনে এই ফানুসটি ঝোলানো হয়েছিল বলেই এর এত জনপ্রিয়তা।
ইসলামিক কায়রোর মুইজ-ঈল-স্ট্রিটে গিয়ে দেখা যায় ছোট বড় বিভিন্ন আকার এবং মাপের ফানুসে দোকানগুলো সয়লাব। প্রকারভেদে একেকটি ফানুসের দাম ৪০ গিনি (১০০ টাকা) থেকে ৫ হাজার গিনি (১২ হাজার ৫০০ টাকা)। তবে এর মধ্যে ছোট সাইজের ফানুস বিক্রি হচ্ছে বেশি, যার মূল্য ১০০ থেকে ৩০০ গিনি বা ২৫০টাকা থেকে ৮০০ টাকা। মেট্রোরেল, পাবলিক বাস ও রাস্তায় বসেও ফেরিওয়ালারা চিনের তৈরি ছোট ছোট ফানুস বিক্রি করছে ফেরি করে।
কায়রোর কূটনীতিক পাড়ার নাইন স্ট্রিট, ইসলামিক কায়রোর আল-আজহার, সাঈদা হোসাইন, খান-ঈল খলিলি ও সাঈদা জয়নব এলাকার দোকানিরা জানান, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের রমজানে ফানুসের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। কারণ, গত বছরের তুলনায় এ বছর ফানুসের দাম ৫০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।
তারা বলেন, এ বছর মিশরীয় পাউন্ডের বিপরীতে অপ্রত্যাশিতভাবে ডলারের মূল্য বাড়ার কারণে ফানুসের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। কারণ, ফানুস তৈরির কাঁচামাল আমদানি করতে হয় অন্য দেশ থেকে।
রমজানে ফানুসের অধিক ব্যবহারের জন্যেই তা একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে মিশরে। এ শিল্পের সঙ্গে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িয়ে আছে। প্রতি বছর নতুন নতুন ডিজাইন নিয়ে ফানুস বাজারে আনার চেষ্টা করে ফানুস ব্যবসায়ীরা। মিশর প্রতি বছর স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও মধ্যপ্রাচ্য সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রমজানে ফানুস রপ্তানি করে থাকে। ক্ষুদ্র পুঁজি নিয়ে বেসরকারি খাতে স্থানীয়ভাবে ফানুস তৈরিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে মিশর।