প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
ব্রাগানসা ও অতৃপ্ত হৃদয়ের অসম্পূর্ণ ভালোবাসার গল্প
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭৪ বছর ৩ মাস। তবে সাধারণভাবে বলতে গেলে আমাদের দেশের মানুষের স্বাস্থ্যকর আয়ু ৬০ থেকে ৬২ বছর। বাকি ১২ থেকে ১৪ বছর মানুষ বাঁচে ডায়াবেটিস, উচ্চ কোলস্টেরল, হাইপারটেশন, ডিমেনশিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক জটিলতা এবং দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে। বলতে গেলে জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ তাদের জীবনের শেষ বছরগুলো পার করে।
আমার বর্তমান বয়স ২৫ বছর, সে হিসেবে জীবনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ এরই মাঝে পার করে দিয়েছি। তবে এ ২৫ বছরে প্রাপ্তির খাতা একেবারে শূন্য। সকল ধরনের আশা এরই মাঝে ছেড়ে দিয়েছি। ভাগ্য সব সময় আমার সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করে।
ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের প্রতি আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল। আজও সে আগ্রহের প্রতি বিন্দুমাত্র ভাটা পড়ে নি। শেক্সপিয়ারকে যারা মনেপ্রাণে ধারণ করেন বা তাঁর লেখা বিভিন্ন সাহিত্যকর্মের সাথে যাদের পরিচয় রয়েছে, তারা নিশ্চয়ই 'দ্য টেম্পেস্ট' নাটকটির সাথে পরিচিত। এ নাটকের একটি মোরাল বা নীতিকথা হচ্ছে:- "জীবন আমাদেরকে ঠিক ততোটুকু দিবে, যতোটুকু আমরা অন্যদেরকে দিবো।”
সত্যিকথা বলতে গেলে, আমি আমার এ জীবনে এখন পর্যন্ত এমন কোনো কিছু পাই নি যেটা মনে রাখার মতো। আমার পুরো জীবনটা ব্যর্থতা আর হতাশার চাদরে মোড়ানো। হয়তো বা আমি কারো প্রতি সেভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে পারি নি , এ কারণে জীবন থেকেও আমি তেমন কিছুই অর্জন করতে পারি নি।
হাজারো হতাশা, বেদনা আর বুকচিরা আর্তনাদের মাঝে ২০২২ সাল আমার জীবনে এসেছিল মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে। বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটুকুও আজ আমার মাঝে আর অবশিষ্ট নেই। নির্ধারিত সময়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে পারি নি, এ নিয়ে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের থেকে মাঝে-মধ্যে কটু কথা শুনতে হয়। ইউনিভার্সিটি থেকেও আমি ছিটকে পড়েছি। ২৫ পেরিয়ে ২৬-এর পথে পা রাখতে চলেছি, কিন্তু এখনও জোটে নি কোনো নারীর কোমল হাতের স্পর্শ। আমি আজও একা, সব কিছু থেকে বলতে গেলে এখন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। চোখের জলও শুকিয়ে গিয়েছে। কাঁদতে চাই কিন্তু আর কাঁদতে পারি না। মনেপ্রাণে শুধু একটা কথা বলি, আমার মতো জীবন যেনও আর কারও না হয়। আমার শরীরে প্রাণ আছে, কিন্তু সে প্রাণের কোনো স্পন্দন নেই। জীবিত থেকেও আমি মৃত।
ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো পেলে সেটাকে আঁকড়ে ধরে হলেও তাঁর জীবনটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। কিংবা একজন মানুষ যার শরীরের প্রয়োজনীয় সকল অঙ্গ কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে, ডাক্তারেরা শেষবারের জন্যে শুধুমাত্র তাঁর নিঃশ্বাসকে ধরে রাখতে লাইফ সাপোর্টের ব্যবস্থা করে। চোখের সামনে সবাই তাঁকে মারা যেতে দেখছে, কিন্তু ওই যে একটা ভরসার জায়গা, যদি কোনোভাবে লাইফ সাপোর্টের বদৌলতে হলেও তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা যায়। একইভাবে মৃত্যুর দুয়ারে পা রাখা এ প্রাণ শেষ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে গিয়েছিল পর্তুগালের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত একটি ছোট শহর ব্রাগানসায়, ভ্যান্টিলেশন বা লাইফ সাপোর্টের মাধ্যমে হলেও যাতে এ প্রাণের স্বাভাবিক স্পন্দন ফিরিয়ে আনা যায় সে আশায়।
সব মিলিয়ে প্রায় ছয় মাস ব্রাগানসায় বসবাসের সুযোগ হয়েছে। ব্রাগানসা থেকে কয়েক দিন আগে স্লোভেনিয়াতে ফিরেও এসেছি। ব্রাগানসা মৃত্যুর দুয়ার থেকে এ প্রাণকে পুরোপুরিভাবে ফিরিয়ে আনতে পারে নি ঠিকই, তবে আমার জীবনে নতুনভাবে যুক্ত করেছে এমন একটি নাম, যে নামটি আমি কোনো দিনও ভুলবো না। বর্তমানে আমার শরীরের প্রত্যেকটি জীবিত কোষে এ নামটি অ্যাডিনোসিন ট্রাইফসফেট (এটিপি) সরবারহ করছে। তাই এখনও পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় নি।
অক্টোবরের মাঝামাঝি কিংবা অক্টোবরের শেষ সপ্তাহের দিকে কোনো এক সময়। পর্তুগিজ ভাষা শেখার জন্যে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট অব ব্রাগানসাতে ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্সে ভর্তি হয়েছি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষদের কাছে বর্তমানে পর্তুগাল খুবই জনপ্রিয় একটি গন্তব্যস্থল। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য দেশের তুলনায় পর্তুগাল অভিবাসীদের বিষয়ে অনেক বেশি নমনীয়। বৈধভাবে পাঁচ বছর বসবাস করার পর পর্তুগালে যে কেউই নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারেন, যেটা ইউরোপের অন্যান্য দেশে এতো সহজে সম্ভব হয় না। সকলে এ সুযোগটিকে কাজে লাগাতে পর্তুগালে পাড়ি জমান, ইউরোপের লাল পাসপোর্ট যেনো সোনার হরিণের চেয়ে অনেক বেশি কিছু।
প্রকৃতিতে শরতের বিদায়ের ঘণ্টা বাজতে চলেছে, শীত তার আগমনকে বুক ফুলিয়ে জানান দিচ্ছে। সূর্য তার তেজ হারিয়েছে অনেকাংশে। দিনের দৈর্ঘও সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। প্রকৃতি থেকে সবুজভাব চলে যাচ্ছে, রাস্তার দু ধারে সদর্পে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো পাতা হারিয়ে মলিন ও নিষ্প্রভ। প্রকৃতির এ রুক্ষতা আমার জীবনের সাথে একাত্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোধূলিলগ্ন থেকে হিমেল হওয়া একটু একটু করে শরীরের প্রত্যেকটি হাড়ে আঘাত আনতে শুরু করে। নাক ও চোখ বেয়ে জল গড়াতে শুরু করে।
ব্রাগানসার শীত মুর্মূষু প্রকৃতিকে কাঁদায়, তাই মাঝে-মধ্যে আকাশ থেকে নেমে আসে বাদলের ধারা। মানুষের জীবন তাতে আরও অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। বৃষ্টি শীতের তীব্রতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। (চলবে)
লেখক : শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।