প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
কনকনে শীতেও জাগে ভালবাসার স্পৃহা
সুইডিশ ভাষার একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ‘লুস্ট‘ (ষঁংঃ), যার বাংলা আভিধানিক অর্থ আকাঙ্ক্ষা, কামনা, বাসনা, স্পৃহা বা ইচ্ছা। অনেকভাবে চেষ্টা করেছি সুইডিশদের মতো করে শব্দটির অর্থ খুঁজে পেতে, কিন্তু অনুভূতিটা সুইডিশ ভাষার মতো এখনও পাইনি। তবে বাংলা অনেক শব্দ যা ওপরে বর্ণনা করেছি সেগুলো মিলে সুইডিশ শব্দ লুস্টের অনুভূতিটা বোধগম্য হবার মতো। সুইডিশ জাতি শব্দটি ব্যবহার করে যেমন “লুস্ট আত অ্যালস্কা (ষঁংঃ ধঃঃ ব্ধষংশধ), লুস্ট আত রেছা (ষঁংঃ ধঃঃ ৎবংধ), লুস্ট আত লেভা (ষঁংঃ ধঃঃ ষবাধ)।” বাংলায় মানে দাঁড়াবে “ভালোবাসার ইচ্ছা, ভ্রমণ করার শখ, বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা।” মানব জীবনে ‘লুস্ট’ ছাড়া সব কিছুই মূল্যহীন। কারণ ‘লুস্ট’ না থাকা মানে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা মনের বিরুদ্ধে জোর করে কিছু করা। জোর করে কিছু করার মাঝে মজা আছে কি? নেই। তাই সচরাচর সুইডিশ জাতি ‘লুস্ট’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকে সুন্দর কিছু করতে বা ভাবতে।
> আরেকটি শব্দ ‘লগোম’ (ষধমড়স)-এর সঠিক ১০০% সিনোনিম বা প্রতিশব্দ ব্যবহার পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। লগোমের বাংলা আভিধানিক অর্থ ‘ঠিক’ বলা যেতে পারে। আমরা যেমন বলি, তরকারিতে লবণ ঠিক হয়েছে, মানে কম বা বেশি হয়নি।
‘লগোম’ এবং ‘ঠিক’ শব্দটি সত্যিকার অর্থে একই মনে হয় আমার কাছে। তবুও সুইডিশরা যখন ‘লগোম’ শব্দটি ব্যবহার করে তখন তা পারফেক্টলি ম্যাচ করে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে।
> লুস্ট এবং লগোম দুটি শব্দ যা অন্য দশটা শব্দের মতো নয়। কারণ এ দুটো শব্দে জড়িয়ে রয়েছে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষার ছন্দ এবং গন্ধ, যা সত্যিকার জীবন খুঁজে পেতে সাহায্য করে। যে জীবনে লুস্ট নেই সে জীবনের মূল্য নেই। যে জীবনে ভালোবাসা নেই সে জীবনের মানে নেই।
> ভালোবাসা কী আসলে? ভালোবাসা বেদনা, যাতনা, সাধনা। ভালোবাসা হতে পারে আনমনে, হতে পারে দুটি মনের বাসনা-সাধনা। ভালোবাসা হতে পারে না পাবার বেদনা। ভালোবাসার মধ্যে রয়েছে শুধু ভালোবাসা। তাহলে কেন এসিড মারা হয় কাউকে না পেলে? কেন খুন করা হয় কেউ প্রেমে সাড়া না দিলে? আবার ভালোবাসা কেনই বা ঘৃণায় পরিণত হয়? আসলে ভালোবাসা কী?
> আমি তোমাকে ভালোবাসি। এ সহজ কথাটি আমরা যত সহজে বলতে পারি বা বলতে শিখেছি, বাস্তবে তা প্রমাণ করতে হয়তো সারাজীবন লেগে যেতে পারে তার প্রতিফলন ঘটাতে।
> ভালোবাসা কী?
> কেন আমরা ভালোবাসি?
> কখন ভালোবাসা ঘৃণায় পরিণত হয়?
> স্বার্থ, সম্পর্ক, কারণ বা উদ্দেশ্য ছাড়া আছে কি ভালোবাসা বা ঘৃণা?
> বিনা স্বার্থে ভালোবাসার কথা শুনেছি অনেকবার, কিন্তু এখনও দেখিনি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। আছে নাকি কারো কাছে এমনটি উদাহরণ?
> আমি ভালোবাসার খোঁজে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে, তবুও সেই স্বার্থহীন ভালোবাসা কারে বলে তা জানতে বা দেখতে পারিনি আজও। দুটি প্রাণের সাধনা এবং দুটি মন যখন কাছাকাছি, হৃৎস্পন্দন যখন দ্রুতগতিতে চলতে থাকে ভালোবাসা বা প্রেম এসেছে জীবনে ভাবতে পারি। এমনটি ঘটতে পারে যখন নারীর স্পর্শে নরের সমন্বয় ঘটে।
> দেনা-পাওনা ছাড়া ভালোবাসার স্বীকৃতি আছে কি?
> মা-বাবার ভালোবাসা সন্তানের প্রতি, এটাও কি দেনা-পাওনা? নাকি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা? সন্তানের প্রতি বাবা-মার ভালোবাসা তাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য।
> স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ভালোবাসা বা স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসা এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি সেই ভালোবাসা ঘৃণায় পরিণত হয়, সেটাকে সমাজে বলা হয় অস্বাভাবিক। এই স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিক ঘটনায়ই প্রকৃত পক্ষে ‘জীবন’। আমরা আমাদের ধ্যানে, জ্ঞানে ও কর্মে মানবজীবন পাবার সন্ধানে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের ধ্যানে, জ্ঞানে ও কর্মে দানবেরও প্রভাব পড়ে দৈনন্দিন জীবনে। যার কারণে আমরা মাঝে মধ্যে দানবের মতো আচরণ করে থাকি। মানবের মাঝে দানবের সমন্বয় যখন ঘটে, হোক না সে হাজারও কাছের বা ভালোবাসার মানুষ, তাকে ভুলে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না। এমনটি শুনেছেন নিশ্চিত, যেমন--এত ভালোবাসি তোমাকে, জীবন দিয়ে দিবো। কিন্তু স্বার্থের ব্যাঘাতে দূরে ফেলে চলে গেছে বিপদের মুহূর্তটি আসার সঙ্গে সঙ্গে, এমনটিও দেখেছি। মুখের কথা আর তাকে কাজে পরিণত করা এক নয়।
> ভালোবাসা সত্যিই স্রষ্টার দেওয়া নিয়ামত, যার মধ্যে রয়েছে শুধু ভালোবাসা। সব ভালো কাজের মধ্যেই রয়েছে ভালোবাসা। যে কথা বা কাজে মজা নেই, তাতে ভালোবাসাও নেই। গানে যেমন মজা আছে, দরদ আছে, ভালোবাসা আছে, তাই গানের মানে না বুঝলেও ভালো লাগে।
> কিন্তু চুরি করা, ধর্ষণ করা, দুর্নীতি করা, কাউকে ছোট করে কথা বলা বা অন্যায় করা--এর মধ্যে মজা আছে বলে আমার মনে হয় না বা এগুলো করলে যে ভালোলাগে বা ভালোবাসা জাগে তাও না, তারপরও আমরা এসব কাজ করি। যখন কিছু করলে মনের মধ্যে ভালো না লাগে বা হৃদয়ে ভালোবাসার সৃষ্টি না হয়, তাহলে কেন সে কাজগুলো আমরা করি? হয়তো অনেকে বলবে, পেটের দায়ে বা প্রয়োজনের তাগিদে অন্যায় করি! কিন্তু কিছু কিছু ভালোবাসা রয়েছে যা একান্ত হৃদয়ছোঁয়া এবং ভালোলাগা থেকে সৃষ্টি, তারপরও সে ভালোবাসা অনেক সময় বেদনাদায়কও হয়।
> পাঠক, জীবনে অনেক অপ্রিয় বা প্রিয় ঘটনা যা ঘটে, অনেক কথাই যায় না বলা, যা শুধু হৃদয়ে থেকে যায়। আবার কিছু কথা, কিছু ব্যথা হঠাৎ ফিরে আসে মনের মাঝে। ৪০ বছর একাকী দূরপরবাস জীবন আমাকে অনেক শিক্ষা ও উপদেশ দিয়েছে। তা হলো ফ্রেন্ডলিস্টের সব বন্ধুই আসল বন্ধু না। সব ভালোবাসা ভালোবাসা না। সেখানে কিছু সুবিধাবাদী বন্ধুও থাকে। ইতিহাস থেকে শেখা “মা’র চেয়ে যদি কেউ বেশি ভালোবাসে তখন তাকে বলা হয় ডাইনি”।
> জীবনে চরম আঘাত পাবার আগে নিজেকে সরিয়ে নেয়া শিখতে হবে। বন্ধুর বিপদ দেখলে যখন কেউ দৌড়ে পালায় তাদের খুঁজে খুঁজে আনফ্রেন্ড করা শিখতে হবে। মনে বিশ্বাস রাখতে হবে, রিয়েল ফ্রেন্ড কখনও আনফ্রেন্ড হয় না বা হতে পারে না। আরো শিখেছি ‘বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু’। তাই ভালোবাসার ফ্রেম থেকে কেউ ঝরে যাবে, কেউ নতুন করে আসবে, এটাই জীবন।
> আমি ভালোবাসি আমার সন্তানের মাকে। আমি ভালোবাসি আমার ছেলে-মেয়েকে। আমি ভালোবাসি আমার পরিবারের অনেককে। আমি ভালোবাসি দেশকে এবং দেশের মানুষকে। আমি ভালোবাসি পৃথিবীকে এবং পৃথিবীর মানুষকে, তবে বিভিন্ন ভাবে।
> সুইডিশ জাতি ভালোবাসা শব্দটিও খুব ব্যবহার করে থাকে। ভালোবাসার সুইডিশ প্রতিশব্দ অ্যালস্কা (ব্ধষংশধ)। ইয়গ অ্যালস্কার দেই (ঔধম ব্ধষংশধৎ ফরম)--আমি তোমাকে ভালোবাসি। মজার বিষয় হলো, শুধু বাংলা ভাষাতেই কয়েকভাবে যেমন তোমাকে আমি ভালোবাসি, ভালোবাসি তোমাকে আমি, ভালোবাসি আমি তোমাকে বা আমি তোমাকে ভালোবাসি বলা এবং লেখা যায়, যা অন্য কোনো ভাষায় সম্ভব কিনা জানি না।
> এত সুন্দর একটি শব্দ ভালোবাসা এবং এতভাবে একে বলা যায়, তারপরও আমরা ভালোবাসার সঠিক মূল্যায়ন করতে অনেক সময় ভুলে যাই!
> বহু বছর আগের কথা। একবার একটি সুইডিশ মেয়েকে সামান্য পরিচয়ে বলেছিলাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি। মেয়েটি আমাকে বলেছিল কোথায়, কখন, কীভাবে? আরও বলেছিল, তুমি আমাকে ভালোবাসো অথচ আমি তো তার কিছুই না পারছি দেখতে, না পারছি অনুভব করতে, না পারছি বুঝতে? আমি তো অবাক! বলে কী? পরে বুঝেছিলাম কেন সে অমন করে বলেছিল। ভালোবাসা এককেন্দ্রিক হলে যা হয় আর কি! দুটি মন যখন দুজনার না হয়ে এক হয়ে যায় তখনই ভালোবাসা দেখা, শোনা, চেনা, স্পর্শ, জানা এবং অনুভব করা যায়। ভালোবাসা বেঁচে থাকার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা, যার মধ্যে রয়েছে শুধু ভালোবাসা।
> জীবনে লুস্ট, লগোম এবং অ্যালস্কা না থাকলে জীবনের মূল্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। পৃথিবীতে যারা লগোম, লুস্ট এবং ভালোবাসার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় মগ্ন হয়েছে, তারাই জীবনে বেঁচে থাকার স্বাদ পেয়েছে। ভালোবাসার উপর লেখাটি ফেব্রুয়ারির ভালোবাসা দিবসের সৌজন্যে লিখতে পারতাম, কিন্তু মনে হলো ভালোবাসা তো প্রতিক্ষণ এবং সারাক্ষণের জন্যে।
> কারণ ভালোবাসা এমন একটি সুন্দর স্বর্গীয় জিনিস, যা বছরে একবার নয়, বার বার ফিরে আসা উচিত আমাদের সবার জীবনে। ভালোবাসা ফিরে আসুক গ্রীষ্ম, বর্ষা, হেমন্ত, শীত, বসন্ত, শরত, সময়ে অসময়ে।
> জীবনে বেঁচে থাকার মাঝে প্রতিদিন নিজেকে জানবো আর শিখবো--ভালোবাসা কারে বলে। তবে এটা সত্য যে, ভালোবাসার মধ্যে রয়েছে শুধু ভালোবাসা। কারণ যখন দেখবেন কেউ রয়েছে দূরে আপনাকে ছেড়ে, মনে মনে কল্পনাতে সে আসছে কেন যেন বারে বারে। সে হৃদয়ের মন্দিরে আছে বসে, আপনি মনেপ্রাণে ব্যথিত হবেন। প্রশ্ন করবেন মনে মনে, কেন একা ফেলে চলে গেলে, দুঃখ দিয়ে না ফেরার দেশে? এর নামও কিন্তু ভালোবাসা, কারণ ভালোবাসার মধ্যে রয়েছে শুধু ভালোবাসা।
রহমান মৃধা : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।