প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
নকল কী? কেন আমরা নকল করি? নকল না করলে এর বিপরীত কি অন্য কোনো সমাধান আছে? ইত্যাদি ইত্যাদি। ‘দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন করা’ কথাটি একটি প্রবাদ। কিন্তু সে জ্ঞান হতে পারে ‘কু’ বা ‘সু’ শিক্ষা। ইন্টারনেটের এই যুগে সবকিছুই পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। তাই কোনো কিছু উদ্ভাবন করে তা কপিরাইটের বন্ধনে বেঁধে রাখা কঠিন ব্যাপার। জন্মের শুরুতেই আমরা যা দেখছি বা শুনছি, তা-ই শিখছি বা অনুকরণ করছি। অন্যভাবে বলতে পারি, কপি করছি বা নকল করছি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। তাই বলা যেতে পারে, নকল করা বা কপি করা এটা কোনো নতুন সমস্যা নয়। সমস্যা হলো, নকল যদি নিজের বা সমাজের জন্যে কোনো ভালো ফল ফলাতে না পারে, তাহলে সে নকল অকল্যাণকর। নকল যদি নিম্ন মানসম্পন্ন হয়, তাহলে তার পরিণতি হবে বেকারত্ব আর জীবন হবে অন্ধকার।
জীবনকে বড় করে ভাবতে এবং শিখতে হলে দরকার ভালোভাবে শেখা, আর তার জন্যে দরকার সৃজনশীল উপায়ে নকল করা এবং শেখা। নকল বা কপি করার সঙ্গে শিক্ষার কী সম্পর্ক থাকতে পারে তার ওপর একটু গুরুত্ব দিতে চাই দুটো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে।
জাপানিরা খুব দেশ-বিদেশ ঘোরাঘুরি করে এবং তাদের সঙ্গে সব সময় ক্যামেরা থাকে, তারা যা দেখতে বা জানতে চায়, তার ওপর সব সময় ছবি তোলে। তারা বেশ কপি করতে পারদর্শী তা আমরা জানি। তবে তারা শুধু কপি নয়, সঙ্গে কিছু নতুনত্ব ও সংযোজন আনার চেষ্টাও করে। তাদের এই কপি করার মধ্যে রয়েছে জানার জন্যে শেখা এবং তাদের থেকেই শেখা, যারা জানে। এখন এই জানা অজানার মাঝে আমার জীবনের নকলের বা কপি করার ওপর কিছু অভিজ্ঞতার বর্ণনা করছি।
২০০১-০২ সালে আমাকে জাপানে পাঠানো হয় দুটো কোম্পানি পরিদর্শন করতে। একটা তোশিবা কম্পিউটার কোম্পানি আরেকটি টয়োটা গাড়ি কোম্পানি; যদিও আমি কাজ করি ফার্মাসিউটিক্যালস্ ইন্ডাস্ট্রির ওপর। কেন আমাকে পাঠানো হলো ওই দুটি ভিন্ন ধরনের কোম্পানিতে? কারণ ছিল একটাই, যারা জানে তাদের থেকে শেখা। টয়োটার তৎকালীন এমডির সঙ্গে তাঁর প্রোডাকশন ফ্যাসিলিটি দেখা। কথা হতেই তিনি বলেছিলেন, ‘দয়া করে এখানে থাকুন আর ভালো করে দেখুন, আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসছি।’ তিনি পাঁচ মিনিট পরে ফিরেছিলেন এবং আমাকে সেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে যা আমি দেখেছিলাম, তার ওপর কথা বলেছিলেন দীর্ঘ তিন দিন। তাঁর প্রশ্ন ছিল, কী কী দেখলাম? কী না দেখলাম? যা দেখলাম তা কেন দেখলাম, ইত্যাদি ইত্যাদি। গাড়ির জগতে কম খরচে ভালো কোয়ালিটিসম্পন্ন গাড়ি তৈরি করা আবশ্যক। তাই ‘টয়োটা’ কাইজেন (Kaizen) তত্ত্বের আলোকে পর্যবেক্ষণ করে উৎপাদনের প্রতিটি পদক্ষেপ। কাইজেন হলো নিরন্তর উন্নতি করা, পদ্ধতিগতভাবে দীর্ঘ মেয়াদে কাজের এমন এক ধারা, যার মাধ্যমে কর্মপদ্ধতিতে সামান্য, খুঁটিনাটি পরিবর্তনের মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে দক্ষতা ও মানের উৎকর্ষ সাধন করা যায়। আমাকে পাঠানো হয়েছিল এই কাইজেন তত্ত্ব শিখে নকল বা কপি করে সেটাকে কাজে লাগানোর জন্যে, ওষুধশিল্পে। তোশিবা থেকে শিখেছিলাম, নকল বা কপি করেছিলাম তাদের কার্যকর উপায় এবং সঙ্গে দক্ষ পরিচালনা।
পরবর্তী সময়ে ২০০৩ সালে পাঠানো হলো আমাকে হল্যান্ডে। কারণ ছিল একটাই, নকল বা কপি করা। জানতে গিয়েছিলাম মনুষ্যত্বের সঙ্গে তাদের শিল্প ব্যবস্থাপনার সম্পর্ক। হল্যান্ড একটি মজার দেশ, যাদের নৈতিক মূল্যবোধ পৃথিবীর মধ্যে খুব উন্নতমানের। তাদের শিক্ষার হার শতভাগ। তাদের ভালো-মন্দের বেশির ভাগ দায়িত্ব তারা নিজেরাই বেশির ভাগ সময় নির্ধারণ করে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় তাদের অপরাধ থেকে শুরু করে সব ধরনের খারাপ অভ্যাসের পরিমাণ কম।
যা শিখলাম, একেবারে নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত নিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রম, কোনো ফাঁকিজুকি নেই। কোনো গোপন সূত্র নয়, প্রস্তুতি ও পরিশ্রম এবং যারা শেখে, তাদের কাছ থেকে শেখাই তাদের চাবিকাঠি। আমার শিক্ষা থেকে এটাই একজন পরামর্শক হিসেবে বলতে চাই যে, বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ধরনের আলোচনা হবে, যাতে করে একটি দুর্বল শিক্ষা প্রশাসনও ধীরে ধীরে সুশিক্ষার দিকে অগ্রসর হতে পারে। শিক্ষাঙ্গনে সুইফট ম্যানেজমেন্ট আনতে পারলে বাংলাদেশে সুশিক্ষা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তবে তার জন্যে দরকার সরকারের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও প্রেরণা, তত্ত্বাবধান। তা না হলে চলতে থাকবে যেমনটি চলছে। মাসে মাসে বেতন থেকে শুরু করে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রয়েছে। অথচ তারা জানেন না কী করতে হবে বা কেন করতে হবে? অথবা আমি বলবো, এর কারণ একটাই, তা হলো শিক্ষাপদ্ধতির দুর্বল ব্যবস্থাপনা।
লেখক : রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]