রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

সুবর্ণ-শতক : পাঠ পর্যালোচনা
অনলাইন ডেস্ক

“একটি দেশের জন্মদাতা

বারেবারে খুঁজিবর

দোয়েল জানায় নামটি তাঁরই

জাতির পিতা মুজিবর”

আমরা আমাদের ক্ষুদ্র জীবনের সৌভাগ্যের একটি বছর পার করছি। আমরা বাঙালি জাতির দুইটি মাইলফলকে দাঁড়িয়ে। একটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ, অন্যটি এ জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এই দুই সৌভাগ্যময় প্রাপ্তিকে এক সুতোয় গেঁথেছে সাহিত্য একাডেমি, চাঁদপুর-তার ‘সুবর্ণ-শতক’ গ্রন্থে।

১৯৭১ সালের আগে বাংলার হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এদেশ কখনো পুরোপুরি বাঙালি কর্তৃক শাসিত হয়নি। মাঝেমধ্যে এদেশের কিছু অঞ্চল বাঙালি কর্তৃক শাসিত হলেও বেশিরভাগ সময়েই বহিরাগত শাসক দ্বারাই শাসিত ও শোষিত হয়েছে। বহু নেতা যুগে যুগে এদেশের মানুষকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখালেও বঙ্গবন্ধুই প্রথম ও একমাত্র নেতা যিনি এদেশের সকল মানুষের মাঝে জাতীয়তাবোধের সঞ্চার করতে পেরেছেন। দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি এদেশের জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন। অঞ্জনা খান মজলিশের মতে, ‘তাঁকে দেখলে মনে হয় তাঁর কাছে আশ্রয় পাওয়া যাবে, নির্ভর করা যাবে।’ এই নির্ভরতার কারণেই এদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাঁর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন। তাই বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন।

বঙ্গবন্ধু আজীবন এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্যে রাজনীতি করেছেন। বিশেষ করে কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের জন্যে কল্যাণমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন-যে সমাজে থাকবে না কোনো বৈষম্য-বঞ্চনা। শুধু এদেশের নয়, সমগ্র বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত মানুষকে নিয়েই তিনি ভাবতেন। তাইতো বিশ্বমঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি সদর্পে ঘোষণা করতে পারেন-“বিশ্ব আজ দুইভাগে বিভক্ত-শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে” এই পক্ষপাতের কারণেই তিনি বিশ্বের শোষিত জনগণের অবিসংবাদিত নেতায় রূপান্তরিত হয়েছিলেন, একাত্মা হয়েছিলেন। ডাঃ দীপু মনির ভাষায়-‘মুজিব জনগণের, আর জনগণ মুজিবের।’ এ জনগণ শুধু বাংলাদেশের নয়, সমগ্র বিশ্বের জনগণ। তাইতো বঙ্গবন্ধু এখন ‘বিশ্ববন্ধু’।

এই বিশ্ববন্ধুর জন্মশতবর্ষ এবং এদেশের জন্মের সুবর্ণজয়ন্তী আজ একাত্ম হয়েছে ‘সুবর্ণ-শতক’ বইয়ের মাধ্যমে। এই বইয়ে বঙ্গবন্ধুর ১৯৭০ সালে চাঁদপুরে জনসভার ভাষণসহ ২১টি প্রবন্ধ, ২টি গল্প ও ৮টি কবিতা গ্রন্থিত হয়েছে। প্রবন্ধগুলোর বিষয়ে বহুমাত্রিকতা পাঠককে আলোড়িত করে। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু তিনটি মুক্তির কথা উল্লেখ করেছেন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক। এই তিনটি মুক্তির মাঝেই সোনার বাংলার স্বপ্ন নিহিত। সুবর্ণ-শতক গ্রন্থের প্রবন্ধগুলোকে আমি মোটাদাগে এই তিনভাগেই ভাগ করতে চাই।

রাজনৈতিক : আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বরাবরই অনন্য লেখক। অল্পকথায় তিনি যেভাবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের বর্ণনা দিয়েছেন, তা আমাদের মোহিত করে। ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে অনেকেই অতীতে বলেছেন, লিখেছেন। এই বইয়ে জাতীয় সংসদে ডাঃ দীপু মনির বক্তব্যের যে লিখিত রূপ প্রকাশিত হয়েছে তাতে শব্দের মূর্ছনায় আন্দোলিত হয়েছি। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অমর কাব্য সম্পর্কে লেখকের অসাধারণ মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য-‘ভাষণটি যেনো বিন্দুতে সিন্ধু’। এই চার শব্দের একটি লাইন ৭ মার্চের ভাষণের যথার্থ উপমা।

সেলিনা হোসেন, অঞ্জনা খান মজলিশ, প্রকৌশলী মোঃ দেলোয়ার হোসেন ও অমৃত ফরহাদের প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনা তথা ধর্ম নিরপেক্ষতার দর্শন ফুটে উঠেছে সাবলীল ভাষা ও ভাবনায়। পীযূষ কান্তি বড়ুয়ার বঙ্গবন্ধুর বিদেশি বন্ধুদের নিয়ে তথ্যবহুল প্রবন্ধটি আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। কাজী শাহাদাত, তৃপ্তি সাহা ও অঞ্জনা খান মজলিশের লেখায় এদেশ ও জনগণের জন্যে বঙ্গবন্ধুর মহিমান্বিত ত্যাগের বর্ণনা আবেগময় অভিব্যক্তিতে পাঠক হৃদয়ে নাড়া দেয়। ফারুক সুমনের ‘ভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিবুর রহমান’ তথ্যবহুল সমৃদ্ধ একটি প্রবন্ধ। আর ছাত্রনেতা মুজিবের এবং বঙ্গবন্ধু ও কন্যা শেখ হাসিনার রসায়নের গল্পে উঠে এসেছে যথাক্রমে জাহিদ নয়ন ও মুক্তা পীযূষের প্রবন্ধে।

অর্থনৈতিক : স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন-আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশ। বঙ্গবন্ধু আজীবন গরিব-দুঃখী-মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্যে লড়াই করেছেন। দেশ স্বাধীনের পর তিনি সে লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দেশি-বিদেশি চক্রান্তে ঘাতকের বুলেটের আঘাতে তাঁর মৃত্যুতে সে অগ্রযাত্রা থমকে যায়। পরবর্তী ২১ বছরে সে যাত্রা আর গতি পায়নি, বরং অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে যায় এদেশ। ১৯৯৬-২০০১ বিশেষ করে ২০০৯ থেকে বর্তমান পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে। যে দেশ একসময় আমাদের শোষণের যাতায় পিষ্ট করেছে, সেই পাকিস্তানের চেয়ে বর্তমানের বাংলাদেশ সকল সূচকে এগিয়ে। অসাধারণ লেখনী ও তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বাংলার এই অগ্রযাত্রার কথা তুলে ধরেছেন প্রফেসর অসিত বরণ দাশ। আর এই অগ্রযাত্রা তথা উন্নয়নের অর্থনীতি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ এবং এর সমাধানের ভাবনা প্রকাশিত হয়েছে রুশো মাহমুদের প্রবন্ধে। বঙ্গবন্ধুর কৃষি ভাবনার সাথে বঙ্গবন্ধু কন্যার কৃষি উন্নয়ন তুলে ধরেছেন এইচএম জাকির। এছাড়া হাসান আলীর চিত্তাকর্ষক শিরোনামে ‘স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বার্ধক্য বিষয়ে অর্জন’ প্রবন্ধে বর্তমান সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়ে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উঠে এসেছে।

সাংস্কৃতিক : হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত এদেশের সংস্কৃতি বঙ্গবন্ধু হৃদয়ে ধারণ করতেন। এজন্যই তিনি হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রিস্টান সকলের প্রিয় নেতা হতে পেরেছেন। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে শেখ মুজিব শুধু অধ্যয়নই করতেন না, তাঁদের লেখায় তিনি দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে রতন কুমার মজুমদার ও মোঃ সাইদুজ্জামানের লেখা দুটিতে। মুহাম্মদ ফরিদ হাসানের ‘ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধ’ প্রবন্ধটি তথ্যবহুল সমৃদ্ধ একটি লেখা। বিশেষ করে তাঁর প্রাঞ্জল বর্ণনায় ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধ যেনো পাঠকের সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। আর স্বাধীনতা-উত্তর হাজীগঞ্জের সাহিত্য চর্চার ইতিহাস উঠে এসেছে মাহবুবুল আলম চুননুর ব্যতিক্রমধর্মী লেখায়।

‘সুবর্ণ-শতক’ পূর্ণতা পেয়েছে বরেণ্য লেখকদের গল্প ও কবিতার সংযোজনে। এক্ষেত্রে আমার পাঠকমন রসাস্বদনেই তৃপ্ত থাকতে চায়, পাঠ-পর্যালোচনায় ভারী হতে চায় না।

পরিশেষে বলি, আমরা গর্বিত এই দেশে জন্মে, এই সুবর্ণ সময়ে থাকতে পেরে। আমরা গর্বিত সর্বকালের এক ও অনন্য বাঙালি নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের নানা আয়োজনে থাকতে পেরে, যে নেতার আদর্শ আমাদের চিরপ্রেরণার উৎস। কবি কামাল চৌধুরীর ভাষায়-

“তুমি ছিলে, থাকবে চিরকাল

চিরন্তন শিখায় জ্বলছে আলো

টুঙ্গিপাড়ায় ঘুমাও বাংলাদেশ

সব বাঙালির বুকে আগুন জ্বালো”

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। জয় হোক ‘সূবর্ণ-শতক’-এর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়