রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

নিভৃত কুহকের টান
অনলাইন ডেস্ক

নিস্তব্ধ রাত। চারদিকে পাতিলের কালির মতো ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোথাও কেউ নেই। কলা পাতার ফরফর শব্দে পরিবেশটা ভয়াল মনে হয়। অদূরে কুকুরের ভয়ার্ত আর্তনাদ। ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়ানো পিচঢালা রাস্তা। এ সময় রাস্তায় কাউকে আশা করা বাতুলতা। হঠাৎ অতি দূরে অন্ধবাঁকে আলোর ঝলকানি। সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে যাই। টর্চের আলোতে লোকটাকে আমার চিনতে তেমন কষ্ট হয় না। আলো আঁধারের ঘূর্ণিতে যাদের জীবন পাক খায়, তাদের জীবনে বিস্ময়ের বালাই নাই।

জগদীশ কাকার বয়সটা বেশ বেড়েছে। প্রস্তরযুগের বরফ খ-ের মতন। আমাকে দেখে একটুও কৌতূহল দেখালেন না। অন্ধকার গায়ে মেখে কাকার পাশে পাশে সামনে পা বাড়িয়ে দেই। আমার পরিবারের কথা, আত্মীয়-স্বজনের কথা, পাড়া প্রতিবেশীর কথা সবিস্তারে জেনে নেই। ভাঙ্গা রাস্তায় কাকার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটা আমার অনভ্যস্ত পায়ের জন্য অস্বস্তিকর। তবুও তাল মেলানোর আপ্রাণ চেষ্টা। অধিকাংশ মানুষের জীবন অপরের সাথে তাল মিলানোতে ব্যতিব্যস্ত। অবশ্য সেটা স্বার্থের কারণে। এটাকে জান্তব জীবন বলাই সমীচীন। আমি এ ঘেরাটোপ থেকে বাইরে থাকার চেষ্টা করলেও আপাতত তাল মিলিয়ে হাঁটছি। আমাদের প্রতিবেশী নিবারণ মহাজনের খবর জানার চেষ্টা করি। নিবারণের নাম বলার সাথে সাথেই কাকা মুখ থেকে এক দলা থুথু মাটিতে নিক্ষেপ করেন। বললেন,‘ ঐ সুদখোর হারামির বাচ্চাটার কথা আমাকে বলিস্ না, ওর কপালে আমি মুতি।’

কাকার শীতল মুখ রাগে অগ্নিশর্মা। তারপর একে একে কাকা তার অসহায়ত্বের ভাঁজ খুলতে থাকে। শতকরা দশ টাকা সুদে টাকা ধার নিয়ে আজ তার জীবনে ত্রিশঙ্কু দশা। সুদের টাকা ফুলে ফেঁপে বেড়ে কাকাকে সর্বস্বান্ত করে। পথে বসায়। ভিটে মাটি হারায়। কথায় কথায় জানতে পারি, নিবারণ এখন একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। জনপ্রতিনিধি হওয়ারও নাকি খায়েস হয়েছে। সত্যিই সেলুকাস! ভাত ছিটালে যেমন কাকের অভাব হয় না; তেমনি ভোটের চব্বিশ ঘন্টা আগে টাকা ছিটালেও নাকি ভোটের অভাব হয় না। কাকা আরও বলেন, ‘এখন না কি সিস্টেম কইরাও জিতন যায়।’ কাকার কথার তাৎপর্য আমি কিছুটা বুঝি বাকিটা না বুঝার ভান করি। আর মনে মনে বলি, যা কিছু হয় ভালোর জন্যই হয়। যে অঞ্চলের জনগণ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠেনি, সে অঞ্চলে অবশ্য ভোটের অধিকারের চেয়ে ভাতের অধিকার অগ্রগণ্য। কথায় কথা বাড়ে।

আমার বাল্যবন্ধু সুনীলের কথা জানার চেষ্টা করি। কাকা বললেন, সুনীল একটি সরকারি অফিসে কেরানীর চাকরি করে। প্রচুর অর্থের মালিক। ঘুসখোর। মাঝে মাঝে মন্দিরে অনেক টাকা দান করে। বিশ লক্ষ টাকা খরচ করে মন্দির বানিয়ে দিয়েছে। সেই টাকার কারণে এখন মন্দির কমিটির সভাপতি হওয়ার ধান্ধায় আছে।’ গরীব মানুষের পকেট কাটা ঘুসের টাকায় আর যাই হোক পুণ্যের কাজ করলেও সিদ্ধিলাভ হয় না। তিনি প্রবাদ-প্রতিম একটি বাক্য বললেন- ‘ঘুস খাওয়া গু খাওয়ার সমান’।

কথার সুতায় টান পড়ে। কথা কেটে যেতে চায়। কাকাকে বিদায় দিতে হয়। কাকার চলে যাওয়ার শব্দে আমার ভেতরে নিঃসঙ্গতা বাড়ে। চারদিকে সুনসান নিরবতা। ভূতুড়ে পরিবেশ। রাত কয়টা বুঝার জো নাই। হাতঘড়ি নাই। মনে হয় সময় থমকে আছে। ক্লান্ত হই। আলসেমিকে প্রশ্রয় দেই। অন্ধকারের সারি বেয়ে গুটিয়ে পা চালাই। রাজ্যের একাকিত্ব পায়ে এসে ভর করে। পেঁচার ডাক বুকে এসে ঘাঁই মারে। দূর গাঁয়ের কোনো এক মসজিদের আজানের সুর ভেসে আসে। একটু পরেই পাখির কাকলিতে মুখরিত হবে প্রকৃতি। মোরগের ডাক শুনতে পাই। ভোরের আলোতে আমি আমার বাড়ির সন্ধান পেয়ে যাই।

আমাকে দেখে বাড়ির লোকজন সহজে চিনতে পারে না। আমার বাবা-মা বৃদ্ধ। তিন ভাইয়েরা বউ-বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত। ছোটভাই বাবা-মায়ের দেখভাল করে। বাবা-মা বার্ধক্যজনিত কারণে আমাকে ঠিক ঠাওরে ওঠতে পারেন না। আমার উপস্থিতি ভাইদের পুলকিত না করে বিষণ্ন করে। সম্পত্তির ভাগে হয়তো কম পড়বে। বিষয়-সম্পত্তির মোহ মানুষের মৌলিক দুর্বলতা। বিশ্রাম করি। ক্লান্তি আর নির্ঘুমের কল্যাণে দুচোখে নেমে আসে রাজ্যের তন্দ্রা। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হই। যেন শেষ ঘুম। আমার ঘুম ভাঙ্গানোর কারো তাড়া নেই।

সোনাঝরা মিঠে রোদে একসময় চোখের ঘুম আলগা হয়। পাতাঝরা উদাস বিকেল। গোসল করি। পেটের মধ্যে ক্ষুধা মোচড় দিয়ে ওঠে। খাবার খাই। ভাইদের সাথে গল্প জমানোর বৃথা চেষ্টা করি। তাদেরকে জগদীশ কাকার কথা বলি। গতরাতের কথা বলি। এবার তারা নড়েচড়ে বসে। হতভম্ব হয়। তারা সমস্বরে বলে, ‘জগদীশ কাকা ঋণের ফাঁদে পড়ে পরিবারসমেত বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে অনেক বছর আগে। আমি একটুও বিচলিত হই না। জগদীশ কাকাকে আমার খুব স্বাভাবিকই মনে হয়েছিল। আমার সাথে ওনার দীর্ঘদিন দেখা হয়নি। যে কোনো মৃত্যু মানেই দৈহিক ক্রিয়ার সমাপ্তি। স্বাভাবিক মৃত্যু কিংবা অপমৃত্যু যাই বলি না কেন উত্তরকালে কেবল মৃত্যু হিসেবেই পরিগণিত হয়। তারা জগদীশ কাকার সাথে আমার কী আলাপ হলো তা জানার ইচ্ছা পোষণ করে। আমি তাদের নিরাশ করে বাজারে ঘুরতে যাই।

বিক্ষিপ্ত মন। এলামেলো চিন্তা খেলে যায়। মাছের বাজারের আঁশটে গন্ধ বেওয়ারিশ হাওয়ায় ঘুরে বেড়ায়। আমি বন্ধু রফিকের খুঁজে বের হই। গলির মোড়ে ওর দোকানের সন্ধান পাই। বিশাল কাপড়ের দোকান। কোটি টাকার ব্যবসা। আমাকে এতদিন পর দেখেও ও একটুও অবাক হয় না। তেমন একটা খাতির যতœও করে না। ও জানতে চায়, আমি কোথায় উঠেছি। আমি বললাম, ‘আমাদের বাড়িতেই উঠেছি’। রফিক অবাক হলো। সে বলল, ‘তোদের বাড়িতো অনেক আগেই দখল হয়ে গেছে, নিবারণ মহাজন তোদের বাড়ি-ঘর প্রতারণা করে লিখে নিয়েছে। সেই শোকে তোর বাপ মরল, তোর বাপের শোকে তোর মাও মরল। তোর ভাইয়েরা কে কোথায় তার কোনো খবর নেই।’ আমার মুখ পাংশু হয়ে যায়। ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করি। গতরাতের কথা, আজকের কথা বলার আগ্রহ হারাই। তবুও শেয়ার না করে পারি না। তারপর তাকে আমার পাওনা দুই লক্ষ টাকার কথা বলি। সে কপট হাসে। বলে, ‘বন্ধু, তোর মাথা দেখি একদম গ্যাছে, কী আবোল-তাবোল শুরু করলি। আমারে তুই টাকা দিলি কবে? তুই ডাক্তার দ্যাখা; তোর মাথায় গ-গোল দেখা দিছে। গতকাল রাত থেকেই তোর মাথা খারাপ হইছে।’

অসহায় লাগে। নিজেকে হাসির পাত্র মনে হয়। চোখের সামনে সারি সারি মুখ। ব্যস্ত। আমাকে দেখার কারও কোন ফুরসত নেই। সবাই ছুটছে নিজ নিজ কক্ষপথে। তারপর মেঘনা নদীর কাছে ছুটে যাই; নিভৃত কুহকের টানে। নদী মায়ের মত। পবিত্র। আপন। নদীর কাছে গেলে মন শান্ত হয়। আনমনে বসে থাকি পাড়ে। নদীতে গাঁয়ের মেয়েরা-বউরা গোসল করে। জেলেরা মাছ ধরে। বড় বড় লঞ্চ-স্টিমার গন্তব্যে যায়। উপভোগ করি নিভৃতে। হঠাৎ মেঘনার জলে কালো টিপ পরা একটা মুখ দোল খায়। ঢেউয়ের বেগে মুখটা অস্থিরতায় কাঁপে। মুখটা মনে আটকানোর চেষ্টা করি। আরে এতো আলো! আমার আলো! কল্পনার মেঠোপথ ধরে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। মনে পড়ে, কোজাগরি জ্যোৎস্না আলোয় হারিয়ে গিয়েছিলাম দু’জন। বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড়ের সুতানলি সাপের ভয়কে জয় করে প্রায়ই দেখা করতাম নিঃশব্দে। একদিন সব বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত এগারোটায় বাঙালিদের দমন করার জন্য ৩ ব্যাটেলিয়ান পাকিস্তানি সৈন্য ‘অপারেশন সার্চলাইটে’ অংশ নেয়। ঢাকা শহর তছনছ করে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার চুকনগরে একদিনে দশ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। লাশের ওপর লাশ বয়ে যায় নদীতে। পানিতে রক্তের বহর দেখে একদিন শপথ নেই, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিব। পাকহানাদারদের এ অপকর্মের মূল্য দিতে হবে। অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা। অনেক রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা। বিড়বিড় করে আনমনে স্বাধীনতা নিয়ে আরও কত কী যেন বলতেছিলাম।

হঠাৎ নারী কণ্ঠের আওয়াজে ভাবনার তাল কেটে যায়। পিছন ফিরে দেখি আমার আলো। সেই আলো। রক্তিম গোধূলির আলোয় তার খলখল হাসি আমাকে মোহগ্রস্ত করে। কামুক ও। আমি লোকলজ্জার ভয় না করে তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরি। শীতের শেষে ঝরা পাতার মতো আমরা দুজন কোথায় যেন হারিয়ে যাই মুহূর্তেই। তারপর আমি তাকে অভিমানের স্বরে জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি আত্মহত্যা করলে কেনো?’ আলো প্রসন্ন চিত্তে জবাব দেয়-‘পাক-হানাদারদের পাশবিক অত্যাচারে আমি গলায় শাড়ির ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করি।’ আমি বললাম, ‘তুমি একবারও আমার কথা ভাবলে না?’ আলো বলল, ‘যখন আমি খবর পেলাম যুদ্ধে তুমি শহীদ হয়েছো, তখন থেকেই আমি জীবন্মৃত। তাছাড়া সমাজও আমাকে গ্রহণ করত না।’ আমি বললাম, ‘তুমি রাষ্ট্রের বীরাঙ্গনা, তোমার সম্মান অনেক উপরে, তাছাড়া তুমি আমার প্রাণাধিক প্রিয়তমা। আলো, আমার আলো।’ আলোর পেলব ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি খেলা করে। আর কীই বা চাই জীবনে-মরণে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়