প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
একজন অধ্যাপক, একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী
আজ আমি এমন একজন ব্যক্তির অতি সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত লিখতে যাচ্ছি, যিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, গবেষক, বাংলদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের লড়াকু সৈনিক। তিনি ১৯৭১ সালে লন্ডনে থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। যিনি ১৯৬৫ সাল থেকে তথা ছাত্র জীবন থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে গোপনে আন্দোলন করে গেছেন। তিনি হলেন আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. মোঃ গোলাম মাওলা চৌধুরী। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন বর্তমান চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার দুই নম্বর বালিথুবা ইউনিয়নের সরখাল গ্রামে ১৯৪৪ সালের জানুয়ারি মাসে। তাঁর বাবা মরহুম আলহাজ হাফেজ মোঃ আব্দুর রহিম ছিলেন বরিশালের উজিরপুর থানার হস্তিশুন্ড গ্রামের একটি মাদ্রাসার শিক্ষক। তিনি খুবই ধার্মিক, সৎসাহসী ও মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। ১৯৫০ সালে বরিশালে হিন্দু-মুসলিম রায়ট ছড়িয়ে পড়লে তিনি তার মাদ্রাসায় বেশ ক’টি হিন্দু পরিবারকে আশ্রয় দেন এবং চেয়ার নিয়ে দরজায় বসে থাকেন। মুসলিম দাঙ্গাবাজরা ওদের বের করে দিতে তাঁকে অনুরোধ করে। তিনি তাদের বুঝান এই বলে যে, ‘তোমরা ওদের মারবে কেন? ওরা তোমাদের মতো আল্লাহর বান্দা, মানুষ খুন করা মহাপাপ।’ তাঁর কঠোর ভূমিকায় হিন্দুদের কোনো ক্ষতি হয়নি। ১৯৫৯ সালের ১১ এপ্রিল ওই গ্রামেই তিনি ঈদের নামাজের ইমামতি করা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। এলাকাবাসী অত্যন্ত যত্ন ও তাজিমের সাথে তাঁকে দাফন করেন। দাফনের তিনদিন পর খবর শুনে তাঁর বড় ছেলে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যাপক এ. ডব্লিউ. এম. তোয়াহা মিয়া লাশ কবর থেকে তুলে এনে সরখাল গ্রামে পুনরায় বিশাল জানাজা শেষে দাফন করেন। প্রায় সারাদেশে এ খবর ছড়িয়ে পড়ে। তৎকালীন ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় এ খবরটি বড় করে ছাপা হয়।
গোলাম মাওলা চৌধুরীর মা মরহুমা জরিনা বেগম সন্তানদের সুশিক্ষিত করার জন্যে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন এবং কঠোরভাবে শাসন করতেন। ছয় ভাই ও দুবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বড় ভাই অধ্যক্ষ এ. ডব্লিউ. এম. তোয়াহা মিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে হিসাব বিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ হতে অধ্যক্ষ পদে পদোন্নতি পেয়ে চাঁদপুর সরকারি কলেজে ১৯৮০ সালের শেষদিকে যোগদান করেন। ১৯৮৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এ কলেজ হতে অবসরে যান। মেঝো ভাই অধ্যাপক এ.এইচ.এম. লোকমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বিভিন্ন কলেজে চাকুরি শেষে লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ হতে প্রফেসর হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন। তাঁর আরেক ভাই আবু ইউসুফ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পরিসংখ্যানে মাস্টার্স সম্পন্ন করে ‘চওঅঈঞ ইঅঘএখঅউঊঝঐ’ নামক একটি স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯৯ সালে ‘গঅঘ ঙঋ ঞঐঊ ণঊঅজ’ পদকে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হতে ভূষিত হন। ছোট ভাই ড. মোঃ গোলাম মোস্তফা চৌধুরী ইটঊঞ, ঢাকা হতে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত আছেন। আরেক ছোট ভাই মোঃ রেজাউল করিম চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে রসায়ন শাস্ত্রে মাস্টার্স সম্পন্ন করে বর্তমানে কানাডার একটি তেল কোম্পানিতে উচ্চ পদে কর্মরত আছেন।
গোলাম মাওলা চৌধুরী সরখাল প্রাইমারী স্কুল হতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে চান্দ্রা ইমাম আলী হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর বড় ভাইয়ের চাকুরির সুবাদে কুমিল্লা জিলা স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৬০ সালে সে স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৬২ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। ওই বছরই পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে বি.এস.সি. সম্মান ও ১৯৬৬ সালে এম.এস.সি. ডিগ্রি অর্জন করেন। কুমিল্লা জিলা স্কুলে পড়াকালীন তিনি একজন স্কাউট ছিলেন। ১৯৫৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে ১৯৫৯ সালে ৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান দ্বিতীয় ন্যাশনাল জাম্বুরিতে অংশগ্রহণ করেন। তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের সামনে দিয়ে বুক ফুলিয়ে সামরিক কায়দায় সালাম জানিয়ে মার্চপাস্ট করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন টঙঞঈ-তে যোগদান করেন। এতে যোগদান করে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন এবং শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, সততা ইত্যাদি শিখে হয়েছেন ধন্য।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের ৩০১ নম্বর রুমে থাকতেন। ১৯৬৬ সালের জুলাই-আগস্টের দিকে এম.এস.সি. শেষ পর্বের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই বন্ধু বশির তাঁর জন্য ৫০০ টাকা বেতনের একটি চাকুরির সুখবর দেয়। তিনি বিশ্বাস করেননি। কারণ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সিভিল সার্ভেন্টদের প্রারম্ভিক বেতন ছিল ২৫০ টাকা। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সের জন্যে লিখিত পরীক্ষায় ৪র্থ স্থান অর্জন করেন। সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চাকুরিতে যোগ দিলেন না। তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন শহর ঘুরে দেখা আর শিক্ষকতা করা। উচ্চ শিক্ষার জন্যে বিদেশ যাওয়াই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। ১৯৬৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বড় ভাইয়ের পরামর্শে তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু রাঙ্গুনিয়া কলেজের অধ্যক্ষ সন্তোষ ভূষণ দাসের সাথে দেখা করেন। তখন এ কলেজে চাকুরি হয়ে যায়। মাত্র দুমাস চাকুরি করার পর রংপুর কারমাইকেল কলেজে ১৯৬৭ সালের ৪ নভেম্বরে যোগদান করেন। ৮ মাসের মধ্যেই বদলি হয়ে ১৯৬৮ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রাম কলেজে যোগদান করেন। ১৯৬৭ সালের ১১ নভেম্বর বিদেশে উচ্চশিক্ষায় বৃত্তির জন্য ইন্টারভিউ দেন এবং ইংল্যান্ডের ঝড়ঁঃযধসঢ়ঃড়হ (সাউদাম্পটন) বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বরে বিলেত যাবার কথা থাকলেও তৎকালীন সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার সমস্যার কারণে প্রায় বছরখানেক পর ১৯৬৯-এর সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিলেত গমন করেন। সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হন। ৪ বছর কঠোর পরিশ্রমের পর ১৯৭৪ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, তিনি পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার পক্ষে সরাসরি আন্দোলন করতেন বলে পাকিস্তান সরকার তার বৃত্তি বন্ধ করে দেয়। এতে তিনি দমে যান নি। তাঁর সুপারভাইজার তাকে ল্যাব সহযোগীর কাজ দিয়ে আর্থিক সমস্যার কিছুটা সমাধান করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর সকল ছাত্র-ছাত্রীর বৃত্তি বন্ধ হয়ে গেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে ব্রিটিশ সরকার ঝড়পরধষ ঝবপঁৎরঃু-এর আয়তায় তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। পরে বৃটিশ কাউন্সিল থেকে বৃত্তি পেয়ে পড়াশুনা শেষ করেন। ইংল্যান্ড থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও স্বাধীন দেশে এসে ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে চট্টগ্রাম কলেজে যোগদান করেন। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে যোগ দেন। ১৯৭৭ সালে বদলি হয়ে একই পদে যোগদান করেন রাজশাহী কলেজে। ছয় মাস পর ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় এক বছর অধ্যাপনার পরে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৮২ সালে কমনওয়েলথ ফেলোশিপ বৃত্তি নিয়ে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণার জন্যে ইংল্যান্ডের লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে নোবেল বিজয়ী মট ল্যাবে এক বছর গবেষণা করেন। কাজ শেষে লিবিয়ার ব্রাইট স্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে সাড়ে চার বছর থাকার পর দেশে ফিরে ১৯৯০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। অবসর গ্রহণের আগেই বিশেষ কারণে ২০০৫ সাল থেকে বিনা বেতনে ছুটি নিয়ে ঢাকায় দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদে বিভাগীয় প্রধান ও ডীনের দায়িত্ব পালন করেন দু বছর। ২০০৭ সালের জুন মাসে ড্যাফোডিল আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রনিক্স ও টেলিকমিউনিকেশন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। এ বিশ্ববিদ্যালয় হতে ছুটি নিয়ে ২০০৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে কয়েকদিনের মধ্যে অবসর গ্রহণ করেন এবং ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এখানে দায়িত্ব পালন করেন। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জার্নালে ও সম্মেলনে তাঁর প্রায় ৮০টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত ও উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি অনার্স ও মাস্টার্স শ্রেণির জন্যে দুটি টেক্সট বই প্রকাশ করেন।
ড. মোঃ গোলাম মাওলা চৌধুরীকে শুধু একজন অধ্যাপক হিসেবে মূল্যায়ন করলে তাঁর প্রতি চরম অবিচার করা হবে। কারণ ছাত্রজীবন হতে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার সংগ্রামে ১৯৬৫ সাল থেকে নিজেকে সর্বদা নিয়োজিত করেন। তিনি জানতেন যে, পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে বাঙালি মুসলমানদের ভূমিকা ছিল সর্বাধিক। তাদের মূল আশা ছিলো অর্থনৈতিক উন্নতি। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠির শোষণের ফলে বঞ্চিত বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভ দিন দিন বাড়তে থাকে। এতে তার মনে ভীষণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর যশোহরের দাউদ নামক বন্ধুর সাথে রাজনৈতিক বিষয়ে আলাপ আলোচনা চলতে থাকে। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হন। তিনি বুঝেছিলেন, শুধু ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার কারণে টিকে থাকতে পারবে না, এমন কি কনফেডারেশান হিসেবেও টিকবে না। তাই ১৯৬২ সালে ‘পূর্ব বাংলা’কে স্বাধীন করার লক্ষ্যে বন্ধু দাউদসহ ‘পূর্ববাংলা জাতীয় মুক্তি সংস্থা’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং অতি সংগোপনে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যান। রাজনৈতিক মতামত প্রতিষ্ঠাকল্পে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বদরুদ্দিন ওমর ও আর সি মজুমদারের ‘বাংলার ইতিহাস’ পড়ে ফেলেন। ১৯৬৫ সালের আক্টোবরে যশোহর জেলার ঝিকর গাছা থানার ঝাঁপা গ্রামে সংগঠনের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় দাউদকে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির প্রধান কাজ ছিলো পূর্ববাংলা জাতীয় মুক্তি সংস্থার সাংগঠনিক রূপরেখা এবং দেশ স্বাধীনের নীতিমালা তৈরি করা। ঐ বছরের নভেম্বরে পাকিস্তান দেশ রক্ষা আইনে জাতীয় মুক্তি সংস্থার কয়েকজন সক্রিয় কর্মী গ্রেপ্তার হন। এদের সংগে যশোহরের আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আব্দুল জলিলও গ্রেপ্তার হন। তিনি অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে ফজলুল হক হলের ৩০১নং কক্ষে বসে সংগঠনের রূপরেখাটির কয়েকটি কার্বন কপি করেন। একটি কপি তিনি নিজের কাছে রেখে দেন। পরে রূপরেখাটি পূর্ব পাকিস্তান-ভারতীয় বর্ডারের নিকটবর্তী ভারতের একটি শহরে ছাপানো হয়। লোক চক্ষুকে ফাঁকি দেওয়ার জন্যে এটি রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির মতো দেখতে ছিল। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বস্ত সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব ও ছাত্রদের মাঝে তিনি গোপনে স্বাধীনতার সপক্ষে প্রচার চালান। বন্ধুবান্ধবদের অনেকে তাঁকে ভারতীয় দালাল বলে আখ্যায়িত করতো। ১৯৬৯ সালে ইংল্যান্ডে যাবার সময় সংগঠনের রূপরেখার এক কপি সাথে করে নিয়ে যান। দেশ ত্যাগের সময় পুস্তিকাটির উপরে তার মেঝোভাই আরবীতে লেখে দেন পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত, যার অর্থ ছিলো এই যে, ‘যে জাতি তার নিজের ভাগ্য নিজে পরিবর্তন না করে তাহলে তার ভাগ্যের কখনো পরিবর্তন হয় না।’ নিরাপত্তার জন্যেই এমনটি করা হয়। উল্লেখ্য, তিনি ও তার বন্ধু দাউদ ১৯৬৬ সালের এপ্রিল/মে’র দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করেন এবং তাঁদের পরিকল্পনা তাঁকে অবহিত করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁদের সাবধানতার সাথে কাজ করতে বলেন এবং তাঁদের শুভ কামনা করেন। তিনি তাঁর বন্ধুসহ কমিউনিস্ট নেতা জিতেন ঘোষ ও তাঁর ছাত্র অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্তের সহায়তায় আরেক কমিউনিস্ট নেতা পুর্নেন্দু দস্তিদারের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
বিলেত মুক্তচিন্তার দেশ। তাই সে দেশে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করা ও প্রচার করার সুবিধা ছিল অনেক। তিনি ইংল্যান্ডে অবস্থানরত বাঙালিদের মাঝে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার বাস্তবতার কথা প্রচার করেন। তাঁর প্রচারণায় বাঙালিদের মধ্যে প্রবল উৎসাহ দেখা দেয় ও অধিকাংশ লোকই মতৈক্য প্রকাশ করে। বৃটেনের ইসলামিক সোসাইটির ম্যানচেস্টারে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সম্মেলনে সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি যোগদান করেন ও বিভিন্ন প্রতিনিধির সাথে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা করেন। একজন ইংরেজ প্রতিনিধি এ ব্যাপারে ঘোর আপত্তি জানান। তিনি তাঁকে বুঝালেন এই বলে যে, মধ্যপ্রাচ্যে সব রাষ্ট্রের ভাষা ও কৃষ্টি প্রায় এক এবং অবস্থান পাশাপাশি সত্ত্বেও ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত। অথচ পাকিস্তানের দুঅংশের ভাষা ও কৃষ্টি এবং অবস্থানের ব্যবধান বিরাট। তাই পাকিস্তানের পক্ষে একটি দেশ হিসেবে টিকে থাকা অসম্ভব। আর লহোর প্রস্তাবে একাধিক স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বাঙালিদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য হঠাৎ বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে একটি পরিকল্পনায়। বিদেশী সাংবাদিক সাইমন ড্রিং ও তাঁর ফটোগ্রাফার মাইকেল লুরেন্ট অতি সংগোপনে গণহত্যার খবরাখবর সংগ্রহ করেন। গণহত্যার পূর্ণ বিবরণ ৩০ মার্চ ১৯৭১ সালে দৈনিক টেলিগ্রাফের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়। পত্রিকার বিবরণ পড়ে তিনিসহ সকল বাঙালি দুচোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। তিনি বিদেশ থেকে গণহত্যার প্রতিবাদ ও স্বাধীনতার সংগ্রামে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সাউদাম্পটন ইসলামিক সোসাইটির পক্ষ থেকে গণহত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানোর প্রস্তাব করেন। সোসাইটি তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ করে একটি সভা আহ্বান করে। তিনি সভায় তাঁর বক্তব্যে বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া সব ঘটনা তুলে ধরেন। এ সভার পর সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ইউনিয়ন একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। সরকারি বৃত্তি বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় বাঙালি ছাত্রদের কেউ বক্তৃতা দিতে রাজি না হওয়ায় তিনি বক্তব্য দেবেন বলে আয়োজকদের জানিয়ে দেন। এ সভা সম্বন্ধে যে প্রচারপত্র বিলি করা হয় তাতে বক্তা হিসেবে তাঁর নাম ছাপা হয় এবং তিনি সভায় জোরালো কণ্ঠে বক্তব্য পেশ করেন। ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল যুক্তরাজ্যে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাউন্সিল নামে একটি সংগঠন গড়ে উঠে। এ সংগঠন কর্তৃক আয়োজিত বিভিন্ন প্রতিবাদ সভায় সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুধু তিনিই অংশগ্রহণ করতেন। তিনি সাউদাম্পটন শহরের বাঙালিদের কাছ হতে সংগ্রহ করা অর্থ কাউন্সিলের ফান্ডে জমা দিতেন।
সাউদাম্পটন ইসলামিক সোসাইটির মাধ্যমে গৃহীত গণহত্যার নিন্দা প্রস্তাব তিনি পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রের মন্ত্রণালয়ে চিঠি আকারে প্রেরণ করেন এবং তাদের দেশের সরকারকে এ নৃশংসতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে অনুরোধ করেন।
১৯৭১ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তান হাইকমিশন অফিসের এডুকেশনাল অ্যাটাচের কাছ থেকে একমাত্র তিনিই একটি চিঠি পান। নির্দিষ্ট দিনে লন্ডনের হাইকমিশন অফিসে গেলে তাকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন না করে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পরামর্শ দেয়া হয়। কারণ সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু তিনিই সরাসরিভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলতেন ও কাজ করতেন। তিনি আপোষ না করায় পরবর্তী মাস হতে তার বৃত্তি বন্ধ করে দেয়া হয়। বিদেশের মাটিতে থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যাঁরা সক্রিয় ও সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক ড. মোঃ গোলাম মাওলা চৌধুরীর অবদান অবিস্মরণীয়। আমাদের উচিত তাঁকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান প্রদর্শন করা। ২০২৩ সালের ৭ নভেম্বর তিনি ঢাকায় নিজ বাস ভবনে ইন্তেকাল করেন। তাঁর দুই ছেলে কানাডা ও একমাত্র কন্যা অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। তাঁর সহধর্মিণী ঢাকায় থাকেন।