প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন
(সপ্তম খণ্ড)
বলা হয়ে থাকে মানুষ হলো দ্বিজ। অর্থাৎ মাতৃগর্ভ হতে জন্মগ্রহণ করার পরে শিক্ষকের হাতে তার দ্বিতীয় জন্ম ঘটে। তেমনি পড়াশুনার বিভিন্ন স্তর অতিক্রমকালে মানুষের পুনঃ পুনঃ জন্ম হয়। উচ্চ মাধ্যমিক স্তর অতিক্রমের পর টার্শিয়ারি স্তরে শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাকে পরবর্তী কর্মক্ষেত্রের বীজ রোপণ করতে হয়। উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পাস করার পরে পরবর্তী স্তরের শিক্ষায় নির্ধারিত হয় তার ভবিষ্যৎ। তাই বলা যায়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সুযোগ পাওয়ার পর মানুষ যেন পুনর্বার জন্ম লাভ করে। আমাদের সমাজে এর পর থেকেই শিক্ষার্থীর মর্যাদার মাত্রা পরিবর্তিত হয়ে যায়। দুদিন আগেও যাকে কেউ অবহেলা-অবজ্ঞা করতো, দুদিন পরেই তার মর্যাদা পরিবর্তিত হয়ে যায়। একজন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী বা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর যে আলাদা আদর ও কদর সমাজ তৈরি করে তাতে বুঝা যায়, মাতৃগর্ভ ছাড়াও বিদ্যার বিকিকিনিতে মানবশিশু ক্রমাগত তার পরিচয় অর্জন করে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে আসা-যাওয়া শুরু করতে না করতেই চেনাজানা মহলে একটা গুরুত্ব পাওয়া শুরু হলো। পাড়ার বড়োভাই আরিফ ভাই নিজে একজন কবি এবং সংগঠক। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিবিএ এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। একদিন তিনি তার কোনো কাজে আমাকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন। বেশ গর্বের সাথে আমাকে তাঁর ঊর্ধ্বতনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী হওয়ার আগেই অনেকবার তার সামনের পথ দিয়ে আনাগোণা করেছি। মাঝে মাঝে সাদা এপ্রোন পরা বড়ো ভাইবোনদের দেখে হৃদয় যে আন্দোলিত হয়নি তা নয়। মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে ঢুকলেও আগে কখনো এর ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামাইনি। তবে ধীরে ধীরে বিভিন্ন দরকারে-অদরকারে ইতিহাসের কিছুটা জানতে হয়েছিলো।
ষোলোশ ছেষট্টি সালে মোগল নৌবাহিনীর আক্রমণে আন্দরকিল্লা রঙমহল পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত আরাকানরাজের দুর্গটি পুড়ে যায়। আঠারোশ চল্লিশ সালে সেই দুর্গের স্থলে তৈরি হয় একটি ডিসপেন্সারি যা পরবর্তীকালে উনিশশো এক সালে দুশ’ পঞ্চাশ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে রূপ লাভ করে। উনিশশো সাতাশ সালে এখানে স্কুল অব মেডিসিন প্রতিষ্ঠা পায় এবং তাতে চার বছরের এলএমএফ কোর্স শুরু হয়। উনিশশো সাতান্ন সালে এই জেনারেল হাসপাতাল এলাকায় গড়ে উঠে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ। কলেজটির শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী শহিদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত। উনিশশো ঊনসত্তর সালে কলেজটি বর্তমান সাততলা ভবনে স্থানান্তরিত হয়। উনিশশো সাতান্ন সালে প্রথম ব্যাচ শুরু হওয়ার পর উনিশশো বিরানব্বই-তিরানব্বই সেশনে ক্যাম্পাসে পদার্পণ করে পঁয়ত্রিশতম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। আজ মনে হয়, পঁয়ত্রিশতম ব্যাচকে আপনগর্ভে ধারণ করবে বলেই পেছনে পাহাড়ের কোলে হেলান দিয়ে এতোদিন প্রতীক্ষায় ছিলো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ। অপরূপ নিসর্গের মায়ায় পাখা ঝাপটানো কপোতের অবয়বে উড্ডীয়মান ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে কলেজ ও হাসপাতালের ভবনটি। আজ এতে দুহাজার দুশোটি শয্যা। হাসপাতাল ভবনের পেছনে পাহাড়ের কোলে আছে সুপরিসর খেলার মাঠ। সেই মাঠের পাশ দিয়ে একটা পথ ধীরে ধীরে পাহাড়ের উপরের দিকে উঠে বাঁকে মিলিয়ে গেছে। দূর থেকে দেখলেই মনে হয় রোড টু হেভেন। অর্থাৎ স্বর্গের সিঁড়ি যেন। তারই বাম পাশে টিলার ওপর নানাবিধ বৃক্ষের সারি সন্ধ্যার মায়ামাখা আলো-আঁধারিতে পর্তুগীজ দুর্গের মতোই রহস্যময় মনে হয়। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভবনের পূর্ব গেইটের সাথে লাগোয়া ছাত্রী নিবাস, যার নাম কান্তা ছাত্রী নিবাস। বিকেল হলেই এই ছাত্রীনিবাসের গেইট হয়ে যেত ছাত্রদের তীর্থস্থান। যাদের মেয়েবন্ধু ছিলো তারা এসে এই গেটে ধর্ণা দিতো গেটের পাহারায় থাকা দাদুকে নাম আর কক্ষ নম্বর জমা দিয়ে। এই গেইটের অদূরে হাসপাতালের বর্জ্য ফেলা হতো। একটা বড় নালা চলে গিয়েছে পূর্ব-পশ্চিমে। নালা হতে হাইড্রোজেন সালফাইডের গন্ধ আর হাসপাতালের বর্জ্যরে দুর্গন্ধে একটা মিশ্র ওডোর তৈরি হতো। সেই পেট উল্টানো গন্ধকে উপেক্ষা করে কপোত-কপোতীরা বসে যেত ঘন্টার পর ঘন্টা প্রণয়ের স্বরে বাক বাকুম বাক বাকুম করতে করতে। কোনো এক রসিক জন হয়তো প্রথমে এই কিঞ্চিৎ বঙ্কিম নাতিদীর্ঘ সরণিকে নাম দিয়েছিলো লাভ লেইন। সেই থেকে এই নামই হয়ে গেছে কিংবদন্তি। নাথিং ইজ আনফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার। এই প্রবাদপ্রতিম কথাটির সত্যতা মিলে আমাদের কলেজের কান্তা ছাত্রী নিবাস হয়ে হাসপাতাল ভবনের পেছনের বর্জ্যমণ্ডিত রাস্তাটি দেখলেই। যুগলবন্দি কথোপকথনে হাঁটতে হাঁটতে বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি কতবার যে লাভ লেইন পরিক্রমা করতো এক একটা যুগল তা ছিলো হিসেবের বাইরে। জীর্ণ জীবনের পুঁজে যারা খুঁজে পেতো প্রিয়সঙ্গের অনন্ত সুধা আর তার সাথে হাইড্রোজেন সালফাইডের অমৃত নহর, তারা তো প্রণয়যোদ্ধা বটেই। লাভ লেইনের পাশ কাটিয়ে মাঝে মাঝে কমিউনিটি মেডিসিনের স্যারের পড়াতে পড়াতে বল পড়ে যাওয়ার ঘটনা মনে পড়ে যায়। আর তখন কী এক অপার বিস্ময় তৈরি হয় ছিদ্রান্বেষী মনটাতে! বল কি সেসময় খুঁজবো নাকি বুঝবো এটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। রোড টু হেভেন পার হয়ে পাহাড়ি পথ ধরে এগুতে এগুতে আবির্ভূত হয় মেইন হোস্টেল। এটা ছাত্রদের আশ্রয়স্থল। হোস্টেলের সামনেই একটা টংয়ের দোকান যাতে কলা-চানাচুর-মুড়ি-বিস্কুট আর ধূমপায়ীদের অমৃত নিয়ে সেবাদানে সদা তৎপর মনসুর ভাই ও তার অগ্রজ। আমাদের ঠিক আগের ব্যাচের বড় ভাই জাফরুল্লাহ ভাই তাঁর দোকানের মুড়ি-চানাচুর খেয়েই পুরো মেডিকেল লাইফ পার করে এসেছেন। শোনা যায়, তিনি কোনোদিন হোস্টেলের অন্নসেবা গ্রহণ করেননি।
কলেজের চারটে লেকচার গ্যালারিকে চারজন ভাষা শহিদের নামে নামকরণ করা হয়েছিলো। সালাম লেকচার গ্যালারি, বরকত লেকচার গ্যালারি, জব্বার লেকচার গ্যালারি ও বরকত লেকচার গ্যালারি। পাশাপাশি ডেন্টাল ইউনিটের অকাল প্রয়াত ছাত্রী সুতপার নামেও একটি লেকচার গ্যালারির নামকরণ করা হয়। আমাদের কয়েক ব্যাচ জুনিয়র বিডিএসের শিক্ষার্থী সুতপা আমরা ক্যাম্পাসে থাকাকালীন মারা যায়। সেসময় সুতপার নামে মূল ভবন থেকে ডেন্টাল ইউনিট ও লাইব্রেরিতে যাওয়ার রাস্তাটিকে সুতপা সরণি নামে অভিহিত করা হয়েছিলো। আমাদের কলেজের ক্যাম্পাসে বর্তমানে ডাঃ মিলন মুক্ত মঞ্চ স্থাপিত হয়েছে। লাইব্রেরিতে দুহাজার আঠারো সালে বিশ্বের প্রথম বোনস্ লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা বিনা পয়সায় বোনস্ ইস্যু করে অধ্যয়ন করতে পারে। মেডিকেল শিক্ষা নির্ভর বইয়ের পাশাপাশি এখানে নূতন ভবনে সাহিত্য লাইব্রেরিও স্থাপিত হয়েছে, যাতে করে পড়াশুনার একঘেঁয়েমি কাটানো যায়।
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মেডিকেল কলেজের বেশ ক'জন ছাত্র অংশ নেয়। এর মধ্যে দাবাড়ু কাজী সাদিক, শাহ আলম বীর উত্তম উল্লেখযোগ্য। বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলমের নামে আমাদের মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে অডিটোরিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে। ‘শিখতে আসো, সেবার তরে বেরিয়ে যাও’, এই হলো আমাদের মেডিকেল কলেজের মটো। সাদা কোট ছাড়া আমাদের আর কোনো নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম ছিলো না।
বাবা-মায়ের প্রগাঢ় ইচ্ছে ছিলো তাঁদের যে কোনো এক সন্তান মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা করবে। মেজদাকে নিয়ে দেখা সেই স্বপ্ন তাই সঙ্গত কারণেই বাস্তবায়নের ভার পড়লো আমার ওপর। খুব দ্রুত যুক্তি সাজাতে পারা ও যুক্তি খণ্ডাতে পারার পারঙ্গমতা হতে আমার ব্যারিস্টার হওয়ার গোপন ইচ্ছেকে প্যান্ডোরার বাক্সবন্দী করে কাঁধে চড়াতেই হলো প্রাচীন ও বনেদী তিনটে কোটের অন্যতম সাদা কোটকে, যাকে কেউ কেউ এপ্রোন বলে ভুল করে অভিহিত করেন। চট্টগ্রামের স্থানীয় হওয়ার সুবাদে কারণে-অকারণে আমার আসা-যাওয়া ছিল হাসপাতাল ভবনে। রাতের গভীরে মেডিকেল চত্বরে মালপোয়া ধরনের পিঠে ও পিঁয়াজুর বিকিকিনিতে আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, ঘুমঘোরের রাতে কে খায় এইসব ঘুমতাড়ানো খাবার। পরে অবশ্য ছাত্রত্বকালীন গভীর রাতে টেবিল টেনিস খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে গেলে কিংবা ক্যাম্পাসে ব্যান্ড সঙ্গীতের আসরে মগ্ন হতে হতে বহুবার এই গভীর রাতের ঘুমভাঙা আহারে শামিল হয়েছি। আমার জীবনের একটা মজার ঘটনাও এইসব পুয়া-পুরি-পিঁয়াজুর আসরে সূচিত হয়। একবার আমাদের সিনিয়র ও শ্রদ্ধেয় মাহফুজ ভাই (যিনি তখন ছাত্রলীগের ক্যাম্পাস সভাপতি ছিলেন, বর্তমানে সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক), ফরায়েজী বিপ্লব ভাই, বন্ধু ও সতীর্থ আশিক এবং আমি মিলে টেবিল টেনিস খেলে গোল চত্বরের শিকের ওপর বসলাম। উদ্দেশ্য ছিল ক্লান্তি বিতাড়ন ও উদরপূর্তি। মাহফুজ ভাই দোকানের পিচ্চিটাকে ডেকে বললেন, খানপাঁচেক পিঁয়াজু দাও। ডান হাতের পাঞ্জা দেখিয়ে তিনি যে ভঙ্গিতে বললেন তাতে আমার মনে হলো এই পাঞ্জা প্রদর্শনের কোনো বিশেষত্ব আছে। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করে বসলাম, মাহফুজ ভাই, আপনি খানপাঁচেক বললেন কেন? খানছয়েক বা খানদশেক নয় কেন? তিনি জবাবে স্মিত হেসে বললেন, এই এমনিই বললাম। মনে হোলো তাই। কিন্তু তাঁর এই 'খানপাঁচেক' বলাটা আমাকে তাড়িত করে বেড়িয়েছে দীর্ঘ সতের বছর। সেই তাড়না বয়ে বেড়ানো আমি ‘পাঁচ পাঁচালি’ শিরোনামে বিশাল একটা প্রবন্ধ লিখে তবেই সারলাম। তার উপজাত হিসেবে ‘সাত সতেরো’ এবং ‘অপূর্ণ তিন সমগ্র’ শিরোনামে আরো দুটি সংখ্যাতাত্ত্বিক প্রবন্ধ লিখে তাদের মলাটবন্দী করলাম আমার প্রথম প্রবন্ধ সংকলন ‘প্রজ্ঞা-প্রসূন’ গ্রন্থে।
বিরানব্বই সালের শুরুর দিকে হবে হয়তো। তখনও আমাদের এডমিশন টেস্ট হয়নি। এ সময়েই আমার মেজদির প্রসবব্যথা উঠে তীব্র হয়ে যায় হঠাৎ করেই। তখন অটোরিকশা ডেকে তাকে হাসপাতালে দ্রুত নিতে হয়েছিল। আমি লুঙ্গি পরা অবস্থায় পায়ে জুতো না পরেই ড্রাইভারের পাশে উঠে পড়ি। মেডিকেলের লিফটে উঠেই মেজদির প্রসব হয়ে যায়। তখন লিফটে থাকা হবু মহিলা ডাক্তারদের সহায়তায় ঝামেলা ছাড়াই পার পেয়ে যান তিনি ও নবজাতক। বেশ কয়েক মাস পরেই আমাদের ভর্তি পরীক্ষা হয় এবং আমার মনে এই প্রতীতী জাগে যে, আমি এই মেডিকেল কলেজেই পড়ছি।
ঊনিশশো তিরানব্বই সালের বিশে জুলাই আমাদের ব্যাচ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে প্রবেশ করে। তখন কলেজের ছাত্র সংসদ বা চমেকসুতে ছাত্রলীগের দাপট। যদিও সরকারে ছিলো বিএনপি। ক্যাম্পাসে তখন চারটা ছাত্র সংগঠন সক্রিয় ছিলো। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্র শিবির ও ছাত্র ইউনিয়ন। আমাদের অধ্যক্ষ ছিলেন অধ্যাপিকা ডাঃ সৈয়দা নূরজাহান বেগম এবং উপাধ্যক্ষ ছিলেন অধ্যাপক ডাঃ শেখ ম. কামালউদ্দীন আহমেদ। যারা চট্টগ্রামে থাকতেন সে সময়, তারা জানেন, নূরজাহান ম্যাডাম কী রকম এক জাঁদরেল চিকিৎসক। চট্টগ্রামের অধিকাংশ মা-ই তাঁর ভয়ে তটস্থ থাকতেন। তাঁর হাতে অনেকেই কেবল যে ডাক্তার হয়ে বের হয়েছে তা নয়, বরং তাদের অনেকেই তাঁরই হাতে মায়ের পেট থেকেও বের হয়েছে। আমাদের বড় ভাই-বোনদের অনেকেই তাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্র সংগীত শুনতে পেয়ে মুগ্ধ হয়েছেন। গাইনিকোলজির একজন উপমহাদেশখ্যাত দিকপাল ছিলেন আমাদের প্রিন্সিপাল। তাঁকে নিয়ে কিংবদন্তি আছে, ভাইবা বোর্ডে তিনি যাকে বকাঝকা করবেন সে পাস। ছাত্রীদের তিনি খুব সহজে ছাড় দিতেন না। আমাদের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ শেখ ম. কামালউদ্দীন আহমেদ ছিলেন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ।
আমাদের যেদিন অরিয়েন্টেশন, সেদিন গ্যালারিতে এসেছিল ক্যাম্পাসের সবক’টি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। তাদের দেওয়া ফুলের সৌরভে আমরা হয়ে উঠি মাতোয়ারা। একটি ছাত্র সংগঠনের শ্রদ্ধেয় নেতা তার বক্তব্য দেওয়ার সময় আমাদের সতীর্থ ছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বার বার শুধু এক চোখ টিপ মারছেন। এটা ঐ কক্ষে উপস্থিত সবার জন্যেই খুব বিব্রতকর হয়ে পড়লো। মনের মধ্যে একটা মিশ্র অনুভূতি নিয়ে বের হলাম লেকচার গ্যালারি থেকে। এরপরই জানলাম, তার অকুলার মাসল্ ইনভলান্টারি টুইচিং হয়।
প্রথমদিনের অরিয়েন্টেশনের শেষে ‘ফিশিং’ নামে এক ধরনের অভ্যর্থনার মুখোমুখি হলাম। নিজেদের সমর্থক বানানোর জন্যে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন এটা-সেটা খাওয়াতে শুরু করলো। দরকার না থাকলেও ভালো ব্যবহার শুরু করলো। কেউ কেউ কেন্টাকিতে নিয়ে নুডলস্ও খাইয়েছেন। কিন্তু বেশিদিন এই ‘ফিশিং অভ্যর্থনা’ বলবৎ রইল না। ত্রিপল মার্ডার ভ্যাকেশানের অশনি আমাদের এই মধু চন্দ্রিমা যাপনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম প্রথম অনেককেই ‘সিরোসিস’-এর স্থলে কাইরোসিস, ‘স্টমাক’-এর স্থলে স্টমাচ, ‘ব্লাড’-এর স্থলে বিলাড এবং ‘ভ্যাগ পেইন’ এর ক্ষেত্রে ভ্যাগু পেইন জাতীয় পাঠ শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলাম। এমনকি টিউটোরিয়ালে ‘ইউ হ্যাভ টু লার্ন কিছু কিছু বাংলা’ শুনে মনটা মরে গিয়েছিলো। মেডিকেলের মতো টার্শিয়ারি শিক্ষায় এ কোন্ বিদঘুটে অবস্থা। ধীরে ধীরে ফর্মালিনের গন্ধ ও ঝাঁঝে অশ্রুক্ষরণ সে বেদনা উবিয়ে নিয়েছিলো।
মেডিকেল কলেজের জীবন এক স্বর্গপ্রতিম জীবন, স্বর্ণস্মৃতির অধ্যায়। এ জীবনের প্রাপ্তির খেরোখাতা চিরকাল ভরা ছিল অমর্ত্য সুধায়। কাঁধে হোয়াইট কোট আর স্টেথিস্কোপ ঝুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে বুকখানা ফুলে উঠতো নিজের অজান্তে তা টেরই পেতাম না। অডিটোরিয়ামের বাইরে চারপাশে কোটরে কোটরে প্যাঁচা বা পাখির পরিবর্তে যুগলের অভয়ারণ্য আসলে স্বর্গোদ্যানের ছবিকেই মনে করিয়ে দেয়। এখানে অ্যাডাম একা নন, প্রতিজন অ্যাডামই ঈভের সঙ্গ পেয়ে মশকের কামড়কে উপেক্ষা করেন প্রণয়ের পরিতৃপ্ত শক্তিতে। পঁয়ত্রিশতম ব্যাচের সেই জীবন এক জাদুকরি উপাখ্যানের সময়। মর্ত্যের মৃত্তিকায় অমর্ত্যরে এক স্মৃতিনন্দিত নিবাস চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাস। (চলবে)