প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন
(পঞ্চম খণ্ড)
মানুষের জীবন খুবই পলকা, খুবই টলকা। জীবনের দীপ কার কখন নিভে যায় তা বলা যায় না। বন্ধু মিজান খুবই সম্ভাবনাময় এক তরুণ ছিলো। তার ভাল নাম ছিলো সালাউদ্দীন। সুদর্শন। চঞ্চল ছিলো বটে, মুখে হাসি থাকতো সর্বদা। সে তুখোড় ক্রিকেটার ছিলো। উইকেট কিপার ছিলো। ভালো ব্যাটিংও করতো। তার বড়োবোন ছিলেন ডাঃ নাজমুন নাহার ম্যাডাম। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে লেকচারার ছিলেন। মিজান আমাদের কলেজিয়েট স্কুল হতেই সহপাঠী ছিলো। তাকে আমি ক্লাস এইট থেকেই পাই বন্ধু হিসেবে। কলেজে ওঠার পর সুদর্শন মিজানের পরিচয় ছিলো সবার কাছে ইলিয়াস কাঞ্চন। তখন বেদের মেয়ে জোসনার খুব দাপট ছিলো। হলের পর হল দখল করে টানা কয়েক সপ্তাহ চলেছিলো ছবিটা। কোনো কোনো হলে বেদের মেয়ে জোসনা তিপ্পান্ন সপ্তাহ টানা চলেছিলো। ঊনিশশো ঊননব্বই সালের জুনে মুক্তি পাওয়া ছবিটার জের ঊনিশশো নব্বই-একানব্বই সালেও টাটকা ছিলো। এই ছবিটার এগারটা গানের সবক’টাই হিট হয়ে যায়। ছবিটা বাংলাদেশের সর্বকালের ব্যবসা-সফল ছবি ছিলো। তৎকালীন কুড়ি লাখ টাকা লগ্নি করে প্রায় কুড়ি কোটি টাকা ব্যবসা করেছিলো। লোককাহিনীকেন্দ্রিক ছবিটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের দর্শকদের কাছে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। সেই ছবির নায়ক ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন। মিজানকে তার সাথেই তুলনা করা হতো মুখশ্রীর মিলের কারণে। কিন্তু বন্ধু মিজানের হয়তো বা খুবই তাড়া ছিলো বিদায় নেবার!
আমি যখন চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষার্থীরূপে প্রবেশ করি তখন তাতে দাপট ছিলো বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের। তারা তাদের দলভুক্ত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাছ থেকে মাসিক একটা চাঁদা বা অনুদান নিতেন, যাকে ‘বায়তুল মাল’ নামক তহবিলে জমা করা হতো। তারা দেয়ালিকা নামে কিছু একটা বানিয়ে তাতে একতরফাভাবে স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তিকে গালমন্দ করতো। এসব কারণে তাদের শক্তিশালী সাংগঠনিক স্তরবিন্যাস থাকলেও সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী মহলে তাদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়নি। এমনকি যারা ছাত্রাবস্থায় ঠেকায় বা চাপে পড়ে ছাত্রশিবিরের কর্মী হতো, তাদের অনেকেই ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে মুক্তি পেয়ে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে নিতো।
কলেজে পড়াকালীন আমাদের কাহিল করে ফেলতো ব্যাচে ব্যাচে কলেজ ছুটির পর প্রাইভেট পড়া। চাপ ছিলো বেশি। যারা বুদ্ধিমান ছিলো তারা অবশ্য সিলেবাসকে প্রশ্নের আদলে ছোট করে ফেলেছিলো। এরপর সাজেশনের মাধ্যমে তাকে আরো হাতের মুঠোয় নিয়ে এলো। দেখা গেলো, পদার্থবিদ্যায় মাত্র ছয়টা অধ্যায় বেছে বেছে পড়লে হয়ে যায়। কিন্তু আমার পক্ষে তা করা সম্ভব ছিলো না। আমাকে যে কোনো প্রশ্নের উত্তর স্যারেরা হুটহাট জিজ্ঞেস করতেন বলেই সব অধ্যায় পড়ে যেতে হতো। ফলে আমার সিলেবাস বরং বইয়ের চেয়েও বেড়ে যেতো। এতে কখনো কখনো মনে হয়েছে বইগুলো বোধ হয় কেবল আমার জন্যেই এতো বড় বালামে রচিত হয়েছে।
বোকামি করেছিলাম আমরা কয়েকজন বন্ধু। একই সাথে গণিত, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নবিদ্যার প্রাইভেট ব্যাচে ঢুকে গিয়ে। ফলে প্রতিদিন প্রায় ষাট-সত্তরটা গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে হতো। কখনো কখনো তারও বেশি। ফলে কোনো কোনো সময় বিরক্তি লাগতো, কোনো কোনো সময় ফাঁকিও দিতে হতো। যদি গণিত আর পদার্থবিদ্যার প্রাইভেটে একসাথে ভর্তি না হতাম তাহলে চাপ কম পড়তো। প্রতিদিন পড়া শেষ করে টেম্পু চড়ে বাড়ি ফেরার পথে আমি আর বন্ধু সৌরিন আন্দরকিল্লা-মোমিন রোডের সংযোগস্থলে এসে দস্তগীর হোটেলে পরোটা খেতাম খাসির ফুসফুসের বটি দিয়ে।
একবার আমাদের গণিতের প্রাইভেট ব্যাচের স্যার তাহের স্যারের বাসায় আমি আর ইব্রাহিম বসতে গিয়ে টি-টেবিল ভেঙে ফেলেছিলাম। তাহের স্যারের বাসায় একটা কল্লা ছিলা মল্লা কুড়া ছিলো। আমরা স্যারকে কতোবার ভয় দেখিয়েছি, মল্লা কুড়াটা রেঁধে খেয়ে ফেলবো বলে। তাহের স্যার ছিলেন দুজন এবং দুজনেই গণিতের। বিভ্রান্তি ও বিড়ম্বনা এড়ানোর জন্যে অপেক্ষাকৃত তরুণ জনকে তিলা তাহের নামে ডাকা হতো। কারণ ঐ স্যারের মুখে বেশ তিল ছিলো।
চট্টগ্রাম কলেজে আমার আগের ব্যাচে আমার এলাকার বড় ভাই রাসেল ভাই পড়তেন। তিনি আর্টসের ছাত্র ছিলেন। আর্টসের মনোবিজ্ঞান ক্লাসের প্র্যাকটিক্যালে বুদ্ধ্যংক বা আই কিউ নির্ণয়ের জন্যে তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে সাবজেক্ট বানিয়েছিলেন। খুবই মজা পেতাম তার প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের প্রশ্ন করার ধরণে।
আমাদের ফাইনাল পরীক্ষায় বায়োলজি দ্বিতীয়পত্রে ব্যাঙ কাটতে গিয়ে একটু কষ্ট হয়েছিলো। ক্লোরোফর্ম দিয়ে ব্যাঙটাকে অজ্ঞান করে দিয়েছিলো প্র্যাকটিক্যালের দাদু। পদার্থবিদ্যার প্র্যাকটিক্যালে আমাকে প্রায় পৌনে একঘন্টা আটকে রেখেছিলেন এক্সটার্নাল। প্রায় পঁয়তাল্লিশটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তবেই মুক্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু দিনশেষে পঁচিশের মধ্যে চব্বিশ জুটলেও আমার পরে যারা ছিলো তারা সবাই একটা-দুইটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমার সমানই নম্বর পেয়েছিলো। আমাদের যিনি অভ্যন্তরীণ পরীক্ষক ছিলেন, তিনি এক্সটার্নালের কাছে আমার ব্যাপারে সুনাম করার কারণেই আমাকে মূলত পঁয়তাল্লিশটা প্রশ্ন মোকাবেলা করতে হয়েছিলো। তাপ প্রয়োগে মানুষ আয়তনে বাড়ে। প্রমাণ দাও। এটাই ছিলো আমার প্রথম প্রশ্ন। ভাগ্য ভালো, উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগাতে পেরেছিলাম! নয়তো খবর খারাপ হয়ে যেতো। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার আগে অনুশীলনের জন্যে চন্দনপুরাস্থ দিগদর্শনে গেলাম। দিগদর্শনের পরিচালক শফিক ভাই ছিলেন আমাদের বোটানির হামিদ স্যারের বন্ধু। তিনশ টাকা করে ভর্তি ফি দিয়ে দিগদর্শনে মোটামুটি ভালোই প্র্যাকটিক্যাল চর্চা হয়েছিলো।
বাংলা পরীক্ষার আগের দিন দুপুরে বন্ধু সুমিত বাসায় হাজির। কী সমস্যা? সুমিত পড়তো মহসিন কলেজে। মহসিন কলেজে আমাদের আরও অনেক বন্ধু-বান্ধবী পড়তো। তাদের কয়েকজনের আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম একদিন ঝর্ণা ম্যাডামের বোটানি ক্লাস করতে। একদিন ক্লাস করেই বুঝলাম তিনি ভালো পড়ান। মহসিন কলেজে ওঠার ঢালু রাস্তাটি আমাদের কাছে কাজ সহজ করার হেলানো তলের একটা ভালো উদাহরণ ছিলো। সুমিত বাংলা পরীক্ষার আগের দিন দুপুরে এসে আমার কাছে হৈমন্তী ও বিলাসীর নোট চেয়ে বসলো। সহাস্য বদনে আমি আমার বন্ধুকে নোট দুটো দিয়ে নিজের জন্যে নতুন করে আরেকটা নোট বানিয়ে নিলাম। ফলে আমার নোটটা আগেরটার চেয়ে আরেকটু পরিপক্ক হয়ে উঠলো, যেহেতু বেশ কয়েকবার ইতোমধ্যেই ‘বিলাসী’ ও ‘হৈমন্তী’ আমার পড়া হয়ে গেছে। বাংলা পরীক্ষার আগে আগে ঠিক করে নিয়েছিলাম, রবীন্দ্র টাইপের হেলানো ও টানা লেখার পরিবর্তে চন্দ্রাবতী টাইপের সোজা সোজা ফন্টে লিখবো। যেই ভাবা সেই কাজ।
এসএসসি পরীক্ষার সময় স্ট্যাডার্ড কালির দোয়াত আর হিরো কলম নিয়ে গেলেও এইচএসসিতে ইকোনো বলপেনই ছিলো আমাদের হাতিয়ার। ছয়টা ইকোনো বলপেন তিনটাকা করে প্রতিটির দাম, পরীক্ষার তিন-চারদিন আগে থেকে কিনে কাগজে ঘষে ঘষে চালু করে নিতাম। তারপর পরীক্ষার খাতায় লিখতে গেলে মনে হতো, সত্যি সত্যি এক কলমে মাইল পার। পরীক্ষা শেষে বুড়ো আঙুলের আর তর্জনীর মাথা ব্যথা হয়ে যেতো। মূল পরীক্ষার শেষের দিকে এবং প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার সময় মেডিক্যাল, বুয়েট ও ভার্সিটি কোচিংয়ের প্রতিষ্ঠানগুলো কলেজে এসে তাদের প্রসপেক্টাস বিতরণ করে যেতো। এরই মধ্যে বাসায় একটা চিঠিও এসেছে আমার নামে একটা কোচিং সেন্টার থেকে, কোনো একটা চায়নিজ হোটেলে তারা মতবিনিময় সভা ডেকেছে। ঊনিশশো নব্বইয়ের শেষ দিকে অর্থাৎ নভেম্বরের একুশ তারিখে স্বৈরাচার এরশাদকে হটিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্যে তিন জোটের রূপরেখা চূড়ান্ত হয়। সেই মোতাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে তিন মাসের জন্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলো। তৎকালীন মাননীয় প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে জাতির আশার প্রতীকে পরিণত হলেন। সেই প্রথম আমার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার হিসেবে ভোট দেওয়া।
সাতাশ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে আলকরণ নূর আহম্মদ বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে ছিল আমার ভোট কেন্দ্র। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের ভোট দিয়েছিলাম। প্রথম ভোট। আমার প্রথম ভোট পেয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তাঁর বিপরীতে ছিলেন লাঙ্গলে আরিফ মঈনুদ্দিন এবং ধানের শীষে আব্দুল্লাহ আল নোমান। আমাদের এলাকায় নোমান সাহেব এসে হ্যান্ড মাইক নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন। মহিউদ্দীন চৌধুরী প্রতিটা অলিতে-গলিতে গণসংযোগের চেষ্টা করেছেন। এলাকায় তাকে সঙ্গ দিয়েছিলেন ঐ এলাকার কমিশনার এম এ রশীদ। আমার প্রথম ভোট ঐ কেন্দ্রে বিজয়ী হলেও ঐ আসনে হেরে যায়। একই ব্যক্তি অবশ্য পরে হারিকেন মার্কায় মেয়র পদে দাঁড়ালে বিজয়ী হন। এবার আমার ভোটও বিজয়ী হয়।
প্রথম ভোট দেওয়ার অনুভূতি অন্যরকম। নিজেকে নাগরিক নাগরিক মনে হচ্ছিলো। ভোটের কালো অমোচনীয় কালি বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে লাগিয়ে ভোট দিয়ে বাইরে বের হয়েই দেখি, গলিতে প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণার কেন্দ্রে ভোট দেওয়া লোকগুলো বুড়ো আঙুলে লেবু ঘষছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম তারা জাল ভোট দেওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে। যারা বৈধ ভোটার কিন্তু দেশে নেই, তাদের ভোট অন্য কেউ দেওয়ার জন্যেই এই পদ্ধতি। প্রথমবার ভোট দিয়ে এবং ভোট কেন্দ্র ঘুরে বুঝেছিলাম, আমাদের অধিকাংশ ভোটার আসলে ব্যক্তিকে নয়, মার্কাকেই ভোট দেন। ফলে যোগ্য ব্যক্তির চেয়ে দলীয় মার্কার জনপ্রিয়তা বেশি। যতই আমরা বলি না কেন ‘আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো’, দিনশেষে ভোট পেয়ে যায় মার্কা, সে যতই অযোগ্য হোক। পাশাপাশি সবার ভোটের মান সমান ধরাটাও প্রার্থীদের জন্যে অসমীচীন। কেননা, অনেকেই উন্নয়ন বলতে মনে করে নিজের ছেলে বা মেয়ে বা স্বামী বা বউ চাকরি পাওয়া বা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়াকেই।
এলাকায় স্কুল-কলেজ করে দেওয়া কিংবা রাস্তা-ঘাট করে দেওয়াকে অধিকাংশ মানুষই ধর্তব্যের মধ্যে আনেন না। অর্থাৎ ভোটারদের বুঝ-জ্ঞান যাচাই না করতে পারলে অশিক্ষিতের ভোট বেশি পেয়ে কেউ নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ রয়ে গেছে। তখন আমাদের বাসায় যে গৃহকর্মী ছিলো, তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, ভোট কাকে দিবেন। তিনি বলেছিলেন, অমুকে দেখতে সুন্দর। আমি তাকেই ভোট দিবো। ঠিক এ কারণেই হুট করে ভোটে দাঁড়িয়ে সিনেমার নায়ক কিংবা মাঠের খেলোয়াড়েরা নির্বাচিত হয়ে যান, ত্যাগী রাজনীতিবিদেরা সুযোগ পান না। ফলে হুজুগে নির্বাচিতদের জনগণের প্রতি কোন অঙ্গীকার না থাকায় গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করে না। চট্টলবীর মহিউদ্দীন চৌধুরী যেবার প্রথম মেয়র পদে দাঁড়ালেন, সেবার আমাদের এলাকায় কমিশনার পদে নির্বাচন করার জন্যে তারেক সোলায়মান সেলিম ভাই দাঁড়ালেন। তিনি ছিলেন সিটি কলেজের সাবেক বাকশালপন্থী বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা, যিনি পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দেন। তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধুর সাথে রাজনীতি করেছেন। পঁচাত্তরের পরে রাজ্জাক ভাইয়ের নেতৃত্বে তিনি বাকশালের আদর্শ ধরে রাখেন। সেলিম ভাই জুঁই খেলাঘরের পাশাপাশি খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরীর কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর মতো যোগ্য মানুষকে কমিশনার পদে প্রার্থীরূপে পেয়ে এলাকাবাসীর আর নির্বাচিত করতে কষ্ট হলো না। তিনি টানা কয়েকবার ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচিত হন। পরে তিনি দুরারোগ্য কর্কটব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি আমাদের গলিতে এলে তাঁকে আমিই পরিচয় করিয়ে ভোট চেয়েছিলাম। আমাকে স্নেহ করতেন খুব।
বিরানব্বই সালের অক্টোবরের কুড়ি তারিখ আমাদের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল দেয়। তখন আমি ঢাকায় মা-ভাইয়ের সাথে বেড়াচ্ছি। ফলাফল তাৎক্ষণিক জানতে পারিনি। পরে জেনেছি। আমার মতো না হলেও একেবারে খারাপও হয়নি। আসলে গণিত আর জীববিদ্যার কম্বিনেশন গণিত-পরিসংখ্যানের কম্বিনেশনের চেয়ে কঠিন, বিশেষত নম্বর আদায়ে। ফলে পরিসংখ্যান দুই পেপারে যেখানে একশ আটানব্বই তোলা সহজ সেখানে জীববিজ্ঞান দুই পত্রে একশ ষাট তুলতে ঘাম ছুটে যায়। যাই হোক, বাবা নারাজ হলেন না খুব একটা। প্রাপ্ত নম্বর আটশো আশি হতে পারতো সহজেই। কিন্তু কেন জানি আটশ ঊনষাটে এসে আটকে গেলো। বাংলা দুইপত্রে এমন নম্বর পেলাম যা বোর্ড সেরা। তবে যারা সিলেক্টেড পড়েছে তারা তুলনামূলক আগের দিকে ছিলো। এ ফলাফলে বুঝা গেলো, আমাদের পাবলিক পরীক্ষাগুলো নম্বর দিয়ে মেধা যাচাইয়ের জন্যে উপযুক্ত ছিলো, অর্জিত শিক্ষার মূল্যায়নে যথার্থ ছিল না। কেননা সাজেশন নির্ভরতা ও প্রশ্ন প্রণয়নে বন্টনধর্মিতার কারণে অর্ধেক বই পড়ে এইএসসিতে প্রথমণ্ডদ্বিতীয় হওয়ার সুযোগ ছিল। অথচ পুরো বইয়ের জ্ঞান তাদের অর্জন করার প্রয়োজন পড়তো না। এতে বইয়ের গন্ধমাদন পর্বততুল্য আকৃতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়।
ঊনিশশো ঊননব্বইয়ের এগার ডিসেম্বরে সারাদেশের মধ্যে চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো আউটার স্টেডিয়ামে বিজয় মেলার সূচনা হয়। ঊনিশশো একাত্তর সালের ষোলই ডিসেম্বর যাদের জন্ম হয়েছিলো, এরকম তরুণেরাই এই মেলার উদ্বোধন করেন। শহিদ জননী জাহানারা ইমামকে এই মেলায় চৌদ্দ ডিসেম্বরে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বিরানব্বইয়ের ডিসেম্বরে মাসব্যাপী এই মেলা চলতে থাকে। সার্কিট হাউজের সামনে এখন যেখানে শিশু পার্ক সেখানেই বিজয় মেলার আলোচনা সভা চলতো। প্রায় সন্ধ্যাতেই বিজয় মেলায় গিয়ে আলোচনা শুনতাম এবং বন্ধুরা মিলে হৈ চৈ-য়ে মেতে উঠতাম। মেলার চেয়ে আড্ডাবাজিই ছিলো আমাদের আনন্দের উৎস। (চলবে)