প্রকাশ : ২০ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন বাঙালি লেখক, ঔপন্যাসিক ও গল্পকার। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার এবং বাংলা ভাষার অন্যতম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। তিনি ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পশ্চিম বাংলার হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী। পাঁচ ভাই, বোনের মধ্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন দ্বিতীয়। শরৎচন্দ্রের ডাক নাম ছিল ন্যাঁড়া।
পাঁচ বছর বয়সে শরৎচন্দ্রের বাবা তাকে পাঠশালায় ভর্তি করে দেন। এরপর ভাগলপুর শহরে থাকাকালীন সময়ে তাঁর মামা তাকে স্থানীয় দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। ১৮৮৭ সালে তিনি ভাগলপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু ১৮৮৯ সালে তাঁর বাবার চাকুরি চলে গেলে তারা দেবানন্দপুর ফিরে আসেন। ফলে জিলা স্কুলে তাঁর আর পড়াশোনা করা হয় নি। পরে হুগলির একটি স্কুলে ভর্তি হলেও স্কুলের ফি দিতে না পারার কারণে এই স্কুলেও তিনি আর পড়ার সুযোগ পান নি। এক সময় কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক শরৎচন্দ্রের পড়াশোনার আগ্রহ দেখে তাঁর বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ দেন। সেখান থেকেই ১৮৯৪ সালে দ্বিতীয় বিভাগে এনট্রান্স পরীক্ষা পাস করে জুবলি কলেজে ভর্তি হন।
এরপর শরৎচন্দ্র ভাগলপুর শহরের আদমপুর ক্লাবের সদস্যদের সাথে খেলাধুলা ও অভিনয় করে সময় কাটাতে শুরু করেন। এক সময় তিনি বনেলী রাজ এস্টেটে কয়েকদিন চাকরি করেন। কিন্তু পিতার উপর কোনো কারণে অভিমান করে তিনি সন্ন্যাসী সেজে ঘর থেকে চলে যান। তবে তাঁর পিতার মৃত্যুর সংবাদ যখন তিনি শোনেন তখন ভাগলপুরে আসেন এবং পিতার শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি কলকাতায় চলে যান।
এই সময় ‘যমুনা’ পত্রিকার সম্পাদক শরৎচন্দ্রকে তাঁর পত্রিকার জন্য লেখা পাঠাতে অনুরোধ করেন। ‘রামের সুমতি’ গল্পটি শরৎচন্দ্র তাঁর পত্রিকার জন্যে পাঠিয়ে দেন। যা ‘যমুনা’ পত্রিকাতে ১৯১৪ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার জন্যে লেখা পাঠাতে শুরু করেন। ফণীন্দ্রনাথ পাল তাঁর উপন্যাস ‘বড় দিদি’ পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন।
শরৎচন্দ্রের প্রথম মুদ্রিত রচনা ‘মন্দির’ নামের গল্পটি কুন্তলীন পুরস্কারপ্রাপ্ত হয়। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৬ সালে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করা হয়।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রকাশিত কিছু বইয়ের তালিকা দেওয়া হলো-
উপন্যাস : বড়দিদি (১৯১৩), বিরাজবৌ (১৯১৪), পরিণীতা (১৯১৪), মেজদিদি (১৯১৬), পল্লী সমাজ (১৯১৬), বৈকুণ্ঠের উইল (১৯১৬), শ্রীকান্ত ১ম পর্ব (১৯১৭), দেবদাস (১৯১৭), চরিত্রহীন (১৯১৭), দত্তা (১৯১৮), শ্রীকান্ত ২য় পর্ব (১৯১৮), গৃহদাহ (১৯২০), দেনা পাওনা (১৯২৩), পথের দাবী (১৯২৬), শ্রীকান্ত ৩য় পর্ব (১৯২৭ ), শেষ প্রশ্ন (১৯৩১), শ্রীকান্ত ৪র্থ পর্ব (১৯৩৩), শেষের পরিচয় (১৯৩৯)। নাটক : ষোড়শী (১৯২৮), রমা ( ১৯২৮), বিজয়া (১৯৩৫)। গল্প : রামের সুমতি (১৯১৪), বিন্দুর ছেলে (১৯১৪), দর্পচূর্ণ (১৯১৫), স্বামী (১৯১৭), বিলাসী (১৯২০), মহেশ (১৯২৬) ও অনুরাধা (১৯৩৪) ও প্রবন্ধ : নারীর মূল্য, স্বদেশ ও সাহিত্য, শিক্ষার বিরোধ ও স্মৃতিকথা।
শরৎচন্দ্রের সাহিত্য নিয়ে একাধিক চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়েছে। তার মধ্যে শুধু ‘দেবদাস’ উপন্যাস নিয়েই বাংলা, হিন্দি ও তেলেগু ভাষায় আটবার চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। অন্যান্য উপন্যাস নিয়েও বিভিন্ন চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়েছে। এই অপরাজেয় কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।
শরৎচন্দ্রের সৃষ্ট প্রতিটি গল্প, উপন্যাস পাঠক হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করে। প্রতিটি উপন্যাস এক একটি অনবদ্য সৃষ্টি। তেমনি একটি উপন্যাস ‘দত্তা’। যা রচিত হয় ১৯১৮ সালে। লেখক যে কত দরদ দিয়ে দত্তা উপন্যাসের কাহিনী বর্ণনা করেছেন, তা-ই এখন আমরা জানবো।
‘প্রেম চোখ দিয়ে দেখা যায় না হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়।’ ‘দত্তা’ উপন্যাসটি পড়ে আমার ঠিক এই কথাটিই মনে হয়েছে। তাই শুরুটা করলাম এই বাক্যটি দিয়ে।
কাহিনী বর্ণনা : জগদীশ বাবু, বনমালী বাবু আর রাসবিহারী বাল্যকালের বন্ধু। জগদীশের ছেলে নরেন, বনমালীর মেয়ে বিজয়া, আর রাসবিহারীর ছেলে বিলাস। জগদীশ এবং রাসবিহারী দুই জনেরই ইচ্ছে বিজয়াকে পুত্রবধূ করার। ঋণের দায়ে জগদীশ বাবুর সব সম্পত্তি চলে যায়। বাড়িটা বিজয়ার বাবার কাছে বন্ধক রাখে। তিন বন্ধুর মধ্যে জগদীশ বাবু সবার আগে মারা যায়। বিজয়ার বাবা বনমালী বাবু প্রায় অসুস্থ থাকে। তাদের গ্রামে যে জমিদারি আছে তা দেখাশোনা করে রাসবিহারী বাবু এবং তার ছেলে বিলাস।
বনমালী বাবু নরেনকে দেশের বাহিরে পাঠান ডাক্তারী পড়ার জন্য। একথা শুধু বনমালী বাবু আর নরেন জানে। বনমালী বাবু চায় বিজয়ার সাথে নরেনের বিয়ে হোক। কিন্তু মৃত্যুর আগে এ কথা কখনোই মেয়েকে স্পষ্টভাবে বলে যেতে পারেনি। বাবার মৃত্যুর পর বিজয়া গ্রামে আসে জমিদারি দেখাশোনার জন্য। রাসবিহারী বাবু খুবই চতুর লোক। যেভাবেই হোক তিনি বিলাসের সাথে বিজয়াকে বিয়ে দিতে চান। রাসবিহারী এবং বিলাস মনে করে বিজয়ার সকল সম্পত্তি তাদের এবং বিজয়ার উপর তাদের অধিকার সবচেয়ে বেশি।
লেখক এখানে বিজয়ার চরিত্রটি চিত্রিত করেছেন অসম্ভব মায়া দিয়ে। বিজয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে যতটা দৃঢ় আবার কারো দুঃখে তার হৃদয় ঠিক ততটাই কোমল। বিজয়ার মনটা শিশুর মতো। অভিমান, রাগ, ভালোবাসা, দুঃখ, কষ্টে ভরপুর।
নরেন অসম্ভব বিনয়ী, ভদ্র, মার্জিত, শিক্ষিত একজন যুবক। নরেন যথেষ্ট মেধাবী এবং যোগ্যতাসম্পন্ন। কেউ আঘাত করলেও প্রতিবাদ করেনি। নরেন বিশ্বাস করে কেউ রাগান্বিত হয়ে তার সাথে খারাপ আচরণ করলেই যে তাকেও তা করতে হবে বিষয়টি এমন নয়। বরং রাগ শেষ হলে ওই মানুষটি নিজের ভুল বুঝতে পারবে।
বিলাস রাগী, লোভী, বদমেজাজি একটি চরিত্র। রাসবিহারী বাবুর মতে, সবচেয়ে পরিশ্রমী, দক্ষ এবং জ্ঞানী মানুষ বিলাস। তবে এ কথা সত্য, বিলাস পরিশ্রমী। হিসেবের ক্ষেত্রে খুবই কঠোর।
বিজয়া এক দিন তাদের পুরানো চাকরকে সাথে নিয়ে নদীর ধারে হাঁটতে যায়। সেখানে এক অপরিচিত যুবকের সাথে দেখা হয়। কথা বলার পর বিজয়ার মনে হয় যুবকটি শিক্ষিত, ভদ্র এবং বিনয়ী। এরপর কয়েকদিন দেখা হয় সেই যুবকের সাথে বিজয়ার। অসম্ভব ভালো লাগে তাকে। কিন্তু যুবকের পরিচয় বিজয়া জানে না। এই যুবকই নরেন। যেদিন নরেন তার বাড়ি বিজয়াকে দিয়ে চলে যায়, সেদিন বিজয়া তার পরিচয় জানতে পারে। বিজয়ার একটু অভিমান হয়। কেন নরেন তার পরিচয় বিজয়াকে দিলো না। এরপরও নরেনের সাথে বিজয়ার অনেকবার সাক্ষাৎ হয়। বিজয়া তার বিভিন্ন আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ করে সে নরেনকে পছন্দ করে। নরেন যখন বিজয়ার সাথে দেখা করার জন্যে তাদের বাড়িতে আসে, বিজয়া তখন নরেনকে না খেয়ে কখনোই যেতে দেয় না। নরেনও বিজয়াকে অসম্ভব পছন্দ করে।
বিজয়ার বাবা যে নরেনের সাথে তার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তা নরেন জানে। কিন্তু বিজয়া জানে না। বিজয়া জানে বিলাসের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। কিন্তু কখন কাকে ভালো লাগে তা কেউ বলতে পারে না। মনের ওপর মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। মন কোনো শাসন, বারণ শোনে না। তাই তো এত নিয়মের মধ্যেও বিজয়ার মন বারবার কেঁদেছে নরেনের জন্য। সমাজ, শাসন, লোকচক্ষু সব উপেক্ষা করে বিজয়া যায় নরেনের কাছে মনের অব্যক্ত কথা বলতে। কিন্তু কিছুই বলতে পারে না, ব্যথিত হৃদয় নিয়ে চলে আসে।
নরেন সবই বুঝতে পারত। বিজয়ার হৃদয় নরেনকে পেতে চায়। নরেনও বিজয়াকে আপন করে পেতে চায়। কিন্তু নরেন আর বিজয়ার মধ্যে ছিল ব্যাপক পার্থক্য। তাই তো নরেন কখনোই তার মনের কথা বিজয়াকে বলতে পারেনি।
এদিকে যেভাবেই হোক বিলাসের সাথে যেন বিজয়ার বিয়ে হয় সেই প্রচেষ্টায় রয়েছে রাসবিহারী বাবু। বিজয়ার যে সম্পত্তি তারা এত দিন দেখাশোনা করেছে, তা কোনোমতেই হাতছাড়া করতে চায় না। তাই তো রাসবিহারী বাবু বিজয়ার মতামত না নিয়ে কৌশলে বিজয়ার সাথে বিলাসের বিয়ে ঠিক করে। বিজয়া এই বিয়েতে খুশি না। তার হৃদয় কেঁদে চলেছে। নরেনের প্রতি তার খুব অভিমান। নরেন দুঃখী মানুষ। তাই দুঃখ সঙ্গী করে এদেশ ছেড়ে একেবারে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এদিকে রাসবিহারী বাবু বিলাস আর বিজয়ার বিয়ের আয়োজন করতে মহা ব্যস্ত। কী হয় বিজয়ার? এক বুক কষ্ট নিয়ে বধূ সেজে বিলাসের ঘরে যায়, নাকি তার প্রেম পূর্ণতা পায়। জানতে হলে পড়তে হবে উপন্যাসটি।
হয়তো পাঠকরা মনে মনে আমার ওপর রাগ করবেন। বলবেন, কেন আমি শেষটা অসম্পূর্ণ রাখলাম। আমার উত্তর, একটি ভালো উপন্যাস সকলেরই পড়া উচিত। তবে পাঠককে আমি এই নিশ্চয়তা দিতে পারি, উপন্যাসটি পড়ে তৃপ্ত হবেন। আপনার সময় বৃথা যাবে না। বইটি হাতে নিয়ে যখন বসবেন, শেষ না করে উঠতে পারবেন না।
একজন লেখক তখনই সার্থক, যখন সেই লেখকের বই পড়ে পাঠক সন্তুষ্ট হয়। শরৎচন্দ্রের প্রতিটি লেখা পাঠক হৃদয়কে ছুঁয়েছে। একজন পাঠক হিসেবে আমি যখন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বই পড়ি, তখন কখনো আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়, আবার কখনো মন আনন্দিত হয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যেোয়র প্রতিটি লেখা পেয়েছে পাঠকপ্রিয়তা।
সেতারা কবির সেতু : প্রভাষক।