বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের স্মৃতিভাষ্যে বঙ্গবন্ধু
মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা সবচেয়ে উজ্জ্বল ও গৌরবদীপ্ত। তাঁর অপরিসীম সাহস, আপসহীন সংগ্রাম ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাই তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, তিনি বাঙালি জাতির জনক। বঙ্গবন্ধু চেয়েছেন এ দেশ হবে সোনার বাংলা। যেখানে ধর্মণ্ডবর্ণ-ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই সমৃদ্ধি ও শান্তি নিয়ে বাস করবে। বাংলাদেশ হবে বিশ্বের মানুষের জন্যে অনুসরণীয়-অনুকরণীয় রাষ্ট্র। তিনি আমৃত্যু সে লক্ষ্যেই কাজ করে গেছেন। এ দেশ এবং এ দেশের মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল বিরল। কর্মগুণেই তিনি পরিণত হয়েছেন বাঙালির ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশে।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন আপাদমস্তক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সচেতন নেতা। তিনি জানতেন সাংস্কৃতিক জাগরণ ব্যতীত দেশকে শৃঙ্খলমুক্ত করা যাবে না। কারণ নিজস্ব সংস্কৃতিই হচ্ছে বাঙালির শেকড়। বঙ্গবন্ধুর কাছে ছিল সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষের অবাধ যাতায়াত। তিনি তাঁদের শ্রদ্ধা ও স্নেহ করতেন। বিপদে-আপদে পালন করতেন অভিভাবকের ভূমিকা। কেবল বাংলাদেশেই নয়, ভারতের সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষের কাছেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন পরম আপনজন। এ কারণেই আমরা দেখি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বরেণ্য অভিনেতা ছবি বিশ্বাস, অভিনেত্রী হেমা মালিনী, শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, শ্যামল মিত্র, চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় প্রমুখের প্রত্যক্ষ স্মৃতি রয়েছে। এরা প্রত্যেকেই বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আনন্দিত ও আপ্লুত হয়েছেন, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসেছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বরেণ্য শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখেছেন একাধিকবার। পেয়েছেন তাঁর সান্নিধ্য ও আন্তরিক আতিথিয়েতা। স্বভাবতই জাতির পিতার ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হন এ গুণী শিল্পী। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তাঁর স্মৃতি ও মূল্যায়ন :

সেবার দেখা হল শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। তখন উনি বাংলাদেশের হৃদয়ের মণি। দেশ স্বাধীন হয়েছে। বঙ্গভবনে ঢুকতে স্বাগত জানালেন স্বয়ং মুজিবুর রহমান। আমাকে বললেন, জানেন আপনার রেকর্ড ছিল আলমারিভর্তি। শয়তান ইয়াহিয়ার দল সব ভেঙে তছনছ করেছে। আপনার গানের আমি খুব ভক্ত। আমাদের সঙ্গে ছিল আমার গাওয়া দুটি লং প্লেয়িং রেকর্ড। উপহার দিলাম ওঁকে। উপহার পেয়ে কী খুশি হলেন মানুষটা। রেকর্ড দুটো মাথায় ঠেকিয়ে বললেন, আপনার কণ্ঠের গান বয়ে এনেছেন আমাকে উপহার দিতে। এর থেকে বড় আর কী হতে পারে? শুনে আমি সঙ্কুচিত হচ্ছিলাম। আমার স্বামী সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর নিজের হাতে তোলা গুরুদেবের একখানি ছবি। সেই ছবি পেয়েও শেখ সাহেব দারুণ খুশি। একজনকে ডেকে বলে দিলেন, বঙ্গভবনে তাঁর বসার জায়গার সামনের দেওয়ালে সেই ছবিটি টাঙিয়ে দিতে।১

আরেক ভারতীয় শিল্পী- শৈলজারঞ্জন মজুমদারও পেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য। বাংলাদেশ তাঁর জন্মস্থান, এসেছিলেন জন্মভূমির স্পর্শ পেতে। সেসময়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে থেকে যেতে বলেছিলেন। স্মৃতিকথায় শৈলজারঞ্জন মজুমদার লিখেছেন :

মনে পড়ে, তিনি (বঙ্গবন্ধু) বারবারই বলেছিলেন থেকে যেতে। বলেছিলেন, ‘আপনারে আর ছাড়ুমই না।’ উত্তরে বলেছিলাম, আমাদের গ্রামের বাড়িতে উদ্বাস্তু, শহরের বাড়িতে মসজিদ হয়েছে, থাকার জায়গা কোথায়? উত্তরে জোর দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ছাইড়্যা দ্যান। আমি আপনেরে বাড়ি দিমু, গাড়ি দিমু, ডোমিসিল দিমু।’ তিনি বলেছিলেন, আপনার জায়গার অভাব হবে না। সে আমিও আমার অন্তরের অন্তর্স্থলে উপলব্ধি করেছি।২

বঙ্গবন্ধু শিল্পীদের কত আপনজন ছিলেন, তা সংগীতজ্ঞ শৈলজারঞ্জন মজুমদারের স্মৃতিভাষ্য থেকে অনুধাবন করা যায়। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বাংলাদেশে থেকে যাওয়ার জন্যে কেবল অনুরোধই করেননি, তাঁকে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোও প্রদানের কথা বলেছেন। কেবল একজন সংস্কৃতি অন্তপ্রাণ মানুষের পক্ষেই এমনটি করা সম্ভব।

বঙ্গবন্ধু সঙ্গীত ভালোবাসতেন। তাঁর রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গীত ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তাঁর জনসভায় গুণী শিল্পীরা গান গাইতেন। সে গানগুলো ছিলো রাজনীতি ও অধিকার সচেতন। বাউল স¤্রাট শাহ আবদুল করিম বঙ্গবন্ধুর বহু জনসভায় গান গেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে পুরস্কারও দিয়েছেন। শাহ আবদুল করিম স্মৃতিকথায় বলেছেন, তাঁরা মিটিংয়ে আমাকে একটি গান গাওয়ার অনুরোধ করলেন। আমি তখন গান গাইলাম। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটা গান গেয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে দেখিয়ে বলেছিলাম : ‘পূর্ণচন্দ্র উজল ধরা/চৌদিকে নক্ষত্র ঘেরা/জনগণের নয়নতারা/জনাব মুজিবুর রহমান/জাগরে মজুর কৃষাণ/জয় জয় বলো এগিয়ে চলো/হাতে লও সবুজ নিশান/জাগরে মজুর কৃষাণ।’

গান শুনে বঙ্গবন্ধু খুব খুশি হলেন। তিনি আমাকে একশ টাকা পুরস্কার দিলেন। আর বললেন, ‘মুজিব ভাই থাকলে করিম ভাই থাকবে’।৩

কেবল শাহ আবদুল করিম নন, গান শুনে সাইদুর রহমান বয়াতিকেও উপহার দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ১৯৭২ সালে বিডিআর দরবার হলে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সাইদুর রহমান বয়াতি সেদিন বঙ্গবন্ধুকে নিজের লেখা একটি গান শোনান। গানটির দুটি লাইন ছিল :‘বঙ্গবন্ধু মুজিবর বাংলার দুগ্ধের সর/সে বিনে বাঁচে না বাংলার প্রাণ আর।’ জাতির পিতা তাঁর গান শুনে একটি ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন।৪

‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি বঙ্গবন্ধুর খুব প্রিয় গান ছিল। তিনি চাইতেন জনসভা, সাংস্কৃতিক আয়োজনে এ গানটি বেশি বেশি পরিবেশিত হোক। কোনো কোনো অনুষ্ঠানে তিনি নিজেই গানটি পরিবেশনের জন্যে অনুরোধ করতেন। সন্জীদা খাতুনের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৫৫/৫৬ সালে কার্জন হলের একটি অনুষ্ঠানে তাঁকে গান গাওয়ার জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি মঞ্চে ওঠার আগে একজন এসে জানালেন- শেখ মুজিবুর চাইছেন তিনি যেন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গান। সেদিন এ গানটি সম্পূর্ণ গেয়েছিলেন সন্জীদা খাতুন। তাঁর লেখা থেকে আরও জানা যায়, দেশ স্বাধীনের পূর্বে রেসকোর্সের জনসভাগুলোতে বঙ্গবন্ধু জাহিদুর রহিমকে ডাকতেন এবং তাঁকে জনসভায় ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতে অনুরোধ করতেন।৫ ১৯৭২ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে বিমানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন কূটনীতিবিদ শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি। দেশে ফিরতে ফিরতে বঙ্গবন্ধু নিজে গেয়েছিলেন ‘আমার সোনার বাংলা’। মর্মস্পশী সেদিনের স্মৃতি সম্পর্কে মি. ব্যানার্জি লিখেছেন :

ফ্লাইটে নানা কথার মধ্যে হঠাৎ বঙ্গবন্ধু বললেন, ব্যানার্জি তুমি গান গাইতে জানো? অবাক হয়ে বললাম, আমি তো গানের গ-ও জানি না। তিনি বললেন, আরে তাতে কী! তুমি আমার সঙ্গে ধরো। বলেই তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন, আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম। বেশ পেছনে বসা ড. কামাল হোসেনদেরও দাঁড়াতে বললেন এবং তাঁর সঙ্গে গান ধরতে বললেন। তিনি ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ খুব দরদ দিয়ে গাইতে থাকলেন আর তখন তার দুই চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকল। একজন মহান নেতার গভীর দেশপ্রেম ও মাতৃভূমির প্রতি পরম ভালোবাসা আমাকে আবার মুগ্ধ করল।৬

সঙ্গীতশিল্পী আবদুল জব্বার বঙ্গবন্ধুকে বাবা বলে ডাকতেন। এতটাই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তাঁর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুও তাঁকে অসম্ভব স্নেহ করতেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তির পর আবদুল জব্বার তাঁর সান্নিধ্যে আসেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে আদর করে ডাকতেন ‘পাগলা’। তিনি চেয়েছেন ঐতিহাসিক সাতই মার্চ ভাষণের পূর্বে আবদুল জব্বার ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গাইবে। এরপর তিনি ভাষণ দিবেন। সেদিন তা-ই হয়েছিলো। এতটাই গুরুত্ব বঙ্গবন্ধু এই শিল্পীকে দিতেন। জাতির পিতার সঙ্গে সান্নিধ্যের কথা আবদুল জব্বার সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমাকে তিনি ছেলের মতো জানতেন। বাংলাদেশে তাঁর যত ছেলে-মেয়ে আছে, তাদের মধ্যে আমি ছিলাম বাবা বঙ্গবন্ধুর গানের ছেলে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার পিতা-পুত্রের সম্পর্ক ছিল। ‘হাজার বছর পরে এসেছি ফিরে, বাংলার বুকে আজ দাঁড়িয়ে’, ‘সালাম সালাম’- এসব গান তো গেলেই টেবিল বাজিয়ে গাইতাম। তিনি আমাকে প্রায়ই ডেকে নিতেন। যদি মন চাইত দেখব, আমার জন্য দরজা খোলা থাকত, হুড়হুড় করে তাঁর বাসায় ঢুকে যেতাম। গায়ক হিসেবে আমি ধন্য যে তাঁর সঙ্গে ভাত খেয়েছি, তাঁর পায়ের কাছে বসেছি, তাঁর দোয়া পেয়েছি।৭

বঙ্গবন্ধুর সাথে সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষদের যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তার আরেকটি উদাহরণ চলচ্চিত্রে বঙ্গবন্ধুর অভিনয়। জাতির পিতা চাষী নজরুল ইসলামের ‘সংগ্রাম’ চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে অভিনয় করেন। দৃশ্যটি ছিলো সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে স্যালুট দিবে, আর তিনি স্যালুট নেবেন। অভিনেতা খসরুর পীড়াপীড়িতে বঙ্গবন্ধু এ সিনেমায় অভিনয় করতে রাজি হন।৮

বঙ্গবন্ধু সবসময়ই নবীন শিল্পী-সাহিত্যিকদের উৎসাহ দিতেন। গুণী যে কোনো মানুষই ছিলো তাঁর কাছে আদরণীয়। অভিনেত্রী অঞ্জনা তখন শিশুশিল্পী। স্বাধীনতার পর আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জারের বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠান হয়েছিলো। শিশু অঞ্জনা সে অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করেন। তাঁর নৃত্যশৈলীতে মুগ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘প্রাউড অব আওয়ার অঞ্জনা। আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, যাও বাংলাদেশকে নাচে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করবা। অনেক দূর এগিয়ে যাও মা তুমি।’৯ বঙ্গবন্ধুর সেই প্রশংসাবাক্য এখনও অঞ্জনার কানে বাজে।

পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনের যে মানুষরাই আসতেন, তারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতেন। তাঁর সান্নিধ্য পেতে চাইতেন। প্রধানমন্ত্রী হয়েও ব্যস্ততার মধ্যে বঙ্গবন্ধু তাঁদের সময় দিতেন। প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। লুৎফর রহমানের স্মৃতি থেকে জানা যায়,

আমরা সকলে মিলে ছুটলাম তার বাসভবনের দিকে। সেখানে পৌঁছানোর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন আমাদের সামনে এলেন, তখন শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাকে প্রণাম করতে উদ্ধত হলে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বলে উঠলেন, একি করছেন হেমন্ত বাবু। যার গান শোনার জন্য দেশি-বিদেশি মানুষ উন্মুখ, সেই আপনি কিনা আমার মতো সাধারণ মানুষকে প্রণাম করে লজ্জা দিচ্ছেন কেন? হেমন্তবাবু আত্মণ্ডপ্রত্যয়ে উত্তর দিলেন, আমি বাঙালি জাতির জনককে প্রণাম করে ধন্য হলাম।১০

বঙ্গবন্ধু সংস্কৃতিকর্মীদের সুখে-দুঃখে পাশে থাকতেন। প্রাধান্য দিয়ে তাদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন। একটি মানবিক ঘটনার কথা এ অংশে উল্লেখ করতেই হবে। ১৯৭২ সালের ১৩ এপ্রিল মন্ত্রীদের নিয়ে জরুরি মিটিং করছিলেন বঙ্গবন্ধু। ওইসময় তিনি সেখানে অন্য কাউকে প্রবেশ করতে নিষেধ করেন। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই রুমে ডুকলেন সুরকার সমর দাস। তাঁর চেহারা বিষণ্ণ। বঙ্গবন্ধু তাঁকে কাছে ডেকে কী হয়েছে জানতে চাইলেন। জানা গেলো : সমর দাসের ১১ বছরের ছেলে অ্যালবার্ট দাস জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি। তাকে চিকিৎসার জন্যে দ্রুত চট্টগ্রামের খ্রিস্টান মেমোরিয়াল হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে তাকে সড়কপথে অ্যাম্বুল্যান্সে নেয়া সম্ভব নয়। এ জন্য তাকে বিমানে/হেলিকপ্টারে নিতে হবে। সমস্যা হলো চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে হাসপাতালের দূরত্বও প্রায় ৭০ মাইল। ফলে সাধারণ ফ্লাইটে নেয়া সম্ভব নয়। তাই জরুরিভিত্তিতে একটি হেলিকপ্টার প্রয়োজন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছেও তখন ছোট বিমান/হেলিকপ্টার পাওয়া যায়নি। একমাত্র উপায় ছিলো প্রধানমন্ত্রীর জন্য বরাদ্দকৃত হেলিকপ্টারটি ব্যবহার করা। সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ভিগো ওলসেন স্মৃতিকথায় লিখেছেন :

সমরকে দেখে মিটিং থামিয়ে দিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর কাছ থেকে অ্যালবার্টের সব খবর শুনলেন। এরপর তুলে নিলেন টেলিফোনের রিসিভার। বিমানবাহিনী প্রধানকে ফোন করে প্রধানমন্ত্রীর হেলিকপ্টারে করে অ্যালবার্টকে খ্রিস্টান মেমোরিয়াল হাসপাতালে পাঠানোর নির্দেশনা দিলেন। এরপর সমরকে ডেকে বললেন, ‘তোমার ছেলে মানে আমারই ছেলে। ওর জন্য আমার দোয়া রইল।’১১

সেদিন হেলিকপ্টারটি ব্যবহারের কারণেই অ্যালবার্ট দাসের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়েছিলো। প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল অ্যালবার্ট। তার সুস্থ হওয়ার খবর শুনে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘সমর, অ্যালবার্ট সুস্থ হয়েছে, এটা খুশির খবর। বেশি খুশি হয়েছি এ জন্য যে ওকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য হেলিকপ্টার দিতে পেরেছিলাম।’১২

বঙ্গবন্ধু জানতেন, কোনো জাতিকে এগিয়ে নিতে হলে শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চা জরুরি। সংস্কৃতিবান মানুষ জনরুচি গড়তে ভূমিকা রাখে, মানুষকে অধিকার সচেতন করে তোলে। তাই তাঁর কাছে সবসময়ই সংস্কৃতি কর্মকাণ্ডের প্রাধান্য ছিলো। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে সংস্কৃতি অঙ্গনের ব্যক্তিবর্গ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অর্থবহ ভূমিকা রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর উদারমনা দর্শনের কারণে সংস্কৃতি অঙ্গনের নানা প্রতিবন্ধকতা বহুলাংশেই দূর হয়েছিল। সংস্কৃতিপ্রেমী বাঙালির জন্যে বঙ্গবন্ধু তখনও আদর্শ ছিলেন, এখনও আছেন।

তথ্যসূত্র : আনন্দধারা, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, আজকাল পাবলিশার্স, বইমেলা ১৯৯৮।

যাত্রাপথের আনন্দগান, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, আনন্দ পাবলিশার্স, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৫, পৃ. ১৩৩-৩৪।

এ ডকুমেন্টারি ফিল্ম অন বাউল সাধক শাহ আবদুল করিম, নিরঞ্জন দে, সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় : ১৯৯৩; শাহ আবদুল করিম স্মৃতি পরিষদ।

সাইদুর রহমান বয়াতির সাক্ষাৎকার, শেখ মেহেদী হাসান, ১৪ জুন ২০১৯, কালের কণ্ঠ।

বোধিবৃক্ষ, সন্জীদা খাতুন, প্রামাণ্য চলচ্চিত্র, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।

শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জির স্মৃতিচারণ, বঙ্গবন্ধুর জানা-অজানা অধ্যায়, আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট, ১৭ মার্চ ২০২০।

মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের সাক্ষাৎকার, সাক্ষাৎকার গ্রহণে : ওমর শাহেদ। কালের কণ্ঠ, ১৬ জুন, ২০১৭

চাষী নজরুল ইসলামের সাক্ষাৎকার, প্রথম আলো, প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০১৫।

অঞ্জনার সাক্ষাৎকার, বিডিনিউজ২৪, ২৭ জুলাই ২০১৭।

বঙ্গবন্ধুর ছবি তোলা এবং আমি, আলোকচিত্রী লুৎফর রহমান। লুৎফর রহমান বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ক্যামেরাম্যানদের মধ্যে একজন ছিলেন।

সুরকার সমর দাস ও একটি ঘটনা, ভিগো ওলসেন, কালের কণ্ঠ, প্রকাশ ১৩ জানুয়ারি ২০২০।

পূর্বোক্ত।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়