বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

জীবন এক বহতা নদী। সে নদীর স্রোতে সময় কখন কাকে কোথায় গড়িয়ে নেয় সে হিসেব আগাম কেউ করা কঠিন। নদীময় জীবন এবং জীবনময় নদীর দেশ বাংলাদেশ। তেরশত নদীর কিংবদন্তি নিয়ে সমুদ্রবক্ষে যে ভূখণ্ডের জন্ম হয়েছিলো পলল-সমৃদ্ধ বৃহত্তম গাঙ্গেয় বদ্বীপরূপে, তারই এক অংশে লাল-সবুজের রক্তার্জিত পতাকা নিয়ে আপন ঐতিহ্যে গরবিনী বাংলাদেশ। গাঙ্ বা নদী হতে উৎপত্তি বলেই এ ভূখণ্ড গাঙ্গেয় বদ্বীপ নামে পরিচিতি পায়, যাকে ভূগোলবিদেরা ডেল্টা নামেই অভিহিত করেন। এই বদ্বীপের পূর্বাঞ্চলীয় আন্তঃদেশীয় এক নদীর নাম কর্ণফুলি। ভারতের মিজোরাম রাজ্যের শৈতা গ্রামের লুসাই পাহাড় হতে উৎপত্তি এ নদীর। মিজোরামের লোকেদের কাছে এ নদীর নাম কথলাংতুইপুই। আর আমাদের কাছে এ নদী এক উপকথার জন্মকাহিনীর উৎস। আরাকানী রাজকন্যা আর পাহাড়ি রাজকুমারের বিয়োগান্তক প্রেমকাহিনীর জন্মদাত্রী এ নদী। কোনো এক পূর্ণিমা বিগলিত যামিনীতে সাম্পানে আরোহী হয়ে অভিসারে আসা প্রণয়ী যুগলের সলিল সমাধি ঘটে এ নদীতে। পূর্ণিমার স্বচ্ছ রূপোলী আলোয় রাজকন্যা নদীর জলে আপন আননের সৌন্দর্য অবলোকনকালে তার এক কানের দুল বা ফুল খুলে পড়ে যায় নদীতে। সেই বিরহে রাজকন্যা ঝাঁপ দেয় জলে, তার কানের ফুল খুঁজে আনতে। কিন্তু প্রবল পাহাড়ি স্রোতে রাজকন্যা হারিয়ে যায় অথৈ জলে। কান্তা হারানোর বেদনায় কান্ত প্রেমিকও নদীর জলে সলিল সমাধি ঘটায় আত্মাহুতির মাধ্যমে। সেই মর্মন্তুদ কাহিনীকে উপজীব্য করে এ নদীকে সময় নাম দিয়েছে কর্ণফুলি। কবি নজরুলের কবিতায়ও এ নদীর সেই উপকথা বর্ণিত হয়ে উপযুক্ত আবেগে।

পাহাড়ি নদী ছুটতে ছুটতে সাগরকে কাছে পেতে চায়। কিশোরী নদী যখন তরুণী হয়ে উঠলো কাপ্তাইয়ে এসে তাকে বাঁধ দিয়ে বাধা দিলো পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান। জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে ঊনিশশো চৌষট্টি সালে তাকে আটকে দিতে চাইলো কাপ্তাইয়ে। কিন্তু নদীতো বাঁধনহারা। ছুটতে ছুটতে সে পতেঙ্গার দিকে ধাবিত হয়। যাওয়ার পথে ঊনিশশো তিরিশ সালে বৃটিশের মালা তাকে পরে নিতে হয় গলায়। কালুরঘাটের লাল সেতুটি আজও যেন বৃটিশের মালা হয়ে ইতিহাসকে জীবন্ত করে রেখেছে। নদীর এ গতিপথে মাঝখানে তার মায়া পড়ে যায় এক গ্রামের তীরে এসে। এ গ্রামের নাম চরণদ্বীপ। বৌদ্ধ পল্লির মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত আছে এক কিংবদন্তি। বুদ্ধ গৌতম রামুর রাঙকূট হয়ে মিয়ানমার গমনকালে তাঁর চরণ পড়েছিলো এ গাঁয়ে। সেই থেকে নদীর বুকে চরণ-সমান ভূমিতে পা রাখার কারণেই গাঁয়ের নাম হয় চরণদ্বীপ। সুদূর অতীতে এ গ্রামের মানুষের মূল জীবিকা ছিল কাউন চালের ব্যবসা। পূর্বদিকের পাহাড় হতে সাম্পানযোগে কাউনের চাল সংগ্রহ করে গ্রামবাসীরা বিকিকিনি করতো হাটে-বাজারে। কাউনের এই স্বর্ণাভ বর্ণ হতেও হয়তোবা গ্রামের নাম হয়ে থাকতে পারে স্বর্ণদ্বীপ, যা গ্রামীণ মানুষের মুখে মুখে চরণদ্বীপ হয়ে পরিচিতি পায়। গ্রামের নামের উৎস সন্ধানে এসবই অনুমানমাত্র।

চরণদ্বীপের উত্তরে কুলকুল নাদে বহমান কর্ণফুলি। তার বুকে সাম্পানমাঝির জীবনের প্রজ্ঞা বিকীর্ণ হয়ে ওঠে যাত্রী পারাপারে। ঝড়-ঝঞ্ঝা আর ঘূর্ণিবার্তায় মাঝির প্রজ্ঞা গ্রামবাসীকে নিরাপদে পৌঁছে দেয় জীবনের তীরে। দক্ষিণে আছে ফসলের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। আউশ আর ইরির শোভায় মলয়ের প্রণয় হয়ে ওঠে নান্দনিক শিল্পের মূর্ছনা। ধান্য বীরূৎ আর বাতাসের নিবিড় নিবীতে মনে জাগে রোমাঞ্চের মুগ্ধতা। হেমন্তের ফসল কাটা হলে শীতের সব্জি চাষের আগে আগে খেতগুলো ধানকাটা নাড়ায় (পাকা ধান গাছের অবশিষ্ট মুড়া) সেজে ওঠে ম্যানগ্রোভ বনের মতো। গ্রামের দামাল ছেলেরা পরণের লুঙ্গিকে কাছা মেরে তাতে বল নিয়ে বিকেলকে মাতোয়ারা করে তোলে। গ্রামের পশ্চিমে কালুরঘাটের লালসেতু হাতছানি দিয়ে ডাকে জীবনের পারাপারে। পুবদিকে করলডেঙ্গা পাহাড় যেন মেঘের সাথে মিতালি পাতিয়ে তৈরি করে রাখে নীলাভ এক ঐন্দ্রজালিক জগৎ। সেই পাহাড়েরাই জানান দেয়, 'ব্লু আর দ্য হিলস্ দ্যাট আর ফার অ্যাওয়ে।' পুবদিকে লাম্বুর হাট, গ্রামবর্তী ফকির হাট, পশ্চিমে চৌধুরী হাট এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকের মুন্সিরহাটই হলো এ গ্রামের মানুষের চাহিদা মেটানোর বিপণন কেন্দ্র। নদীর বুকে ক্যাঁক্রোত ক্যাঁক্রোত শব্দে পাহাড়ি কলাবোঝাই সাম্পান চলে যায় শহরের গন্তব্যে। মাঝে মাঝে সাম্পানে চড়ে নায়রী আসে বাপের বাড়ি।

এ গ্রামের এক শিক্ষাব্রতী জাঁদরেল মানুষের নাম দিগম্বর বড়ুয়া। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে তিনি মাস্টারদা সূর্যসেনের শিষ্য ছিলেন। এজন্যে তাঁকে স্কুল হতে বহিষ্কৃতও হতে হয়। এন্ট্রান্স পাস করে তিনি পাহাড়তলি স্কুলে হেডমাস্টার পদে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হলেন। তাঁর ঘরণি হয়ে এলেন কর্ণফুলির উত্তর তীরবর্তী নোয়াপাড়া গ্রামের শিক্ষক সিংহনাদ মাস্টারের বড় মেয়ে চপলা সুন্দরী বড়ুয়া। পরে অমৃত ডাক্তারের বোন হিসেবেও তিনি পরিচিতি পান। চপলা সুন্দরীর বাবা সিংহনাদ মাস্টার ছিলেন একজন দূরদর্শী মানুষ। তিনি শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের নিরাপত্তার জন্যে চৌধুরী পাড়ার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী সাহেবের সাথে নিজের মেয়ের পিতা-পুত্রী সম্পর্ক পাতিয়ে দেন। সেই সম্পর্ক দীর্ঘদিন বলবৎ ছিল। দিগম্বর-চপলা দম্পতির ছেলেমেয়েদের কাছে এই চৌধুরী পাড়া ছিল বিকল্প এক মামাবাড়ি। ঊনিশশো তিরিশ সালের বারো সেপ্টেম্বর তাঁদের ঘর আলো করে জন্ম নেয় জ্যেষ্ঠ সন্তান। বাবা-মা নাম রাখেন সুরেশ। ডাক নাম সায়ন। বড় হলে পরে তাঁর লেখ্য নাম হয় সুরেশ চন্দ্র বড়ুয়া। দিগম্বর-চপলার এই জ্যেষ্ঠ শিশুটিই কালক্রমে আমার জনকরূপে আবির্ভূত হন আমাকে ছায়া-মায়া দিয়ে। পরবর্তীকালে দিগম্বর-চপলার ঘরে আরো দুই পুত্র এবং দুই কন্যার জন্ম হয়। ঊনিশশো বিয়াল্লিশ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দুর্দিনপীড়িত সময়ে স্ট্রোকাক্রান্ত হয়ে আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন দিগম্বর বড়ুয়া। সেই থেকে সংসারের সাথে মায়ে-পোয়ে যুঝতে যুঝতে এক সময় বিজয়ী হয়ে ওঠেন। জীবিকার জন্যে সায়ন পাড়ি দেয় রেঙ্গুনে। তখনকার দিনে রেঙ্গুনই ছিলো এ উপমহাদেশের মানুষের উন্নত জীবিকার কেন্দ্র। ঠিক আজ যেমন মধ্যপ্রাচ্য। এ সময়েই সময় নির্মাণ করে সায়নকে আর সায়ন নির্মাণ করে সায়নকে। জীবনসমরে পিতৃহারা দুর্দিনকে পরাস্ত করতে গিয়ে একসময় রেঙ্গুনে বসেই সায়ন শুনতে পায় দেশে তাঁর মাতৃবিয়োগের করুণ সংবাদ।

সময় গড়িয়ে যায়। সায়নের জীবনে শীত পার হয়ে বসন্ত সমাগত হয়। নিজের সংসার তৈরির তাগিদ অনুভব করে সায়ন। এ সময়ে রেঙ্গুনে চট্টগ্রামের আরেকটি বাঙালি বৌদ্ধ পরিবারের দেখা পায় সে। চট্টগ্রামের চাঁন্দগাঁও বাহির সিগন্যাল বড়ুয়াপাড়ার রঘুনন্দনের পরিবার। তাঁর এক কিশোরী মেয়ের নাম পাখি। পাখিও তাঁর বাবা মায়ের বড় সন্তান। এই দুই বেণী দোলানো পুতুল খেলার কিশোরী বালিকাই কালক্রমে আমার গর্ভধারিণী মা-রূপে আবির্ভূতা হন। পাখি রানি বড়ুয়ার মায়ের নাম ছিল সরোজা বালা বড়ুয়া। মেয়ে বিবাহযোগ্যা হলে তাঁর কাছে একে একে পাত্র আসতে থাকে। সায়নের পা ছুঁয়ে প্রণামের শিষ্টাচার সরোজা বালা বড়ুয়ার ভালো লেগে যায়। আর এটাই তৈরি করে দেয় সায়ন ও পাখির ঘরে আমার আগমনের হেতু। অন্য অনেক পাত্রকে নাকচ করে দিয়ে আমার দাদু-দিদিমা আমার বাবা সুরেশ চন্দ্র বড়ুয়া তথা সায়নের হাতেই সম্প্রদান করেন আমার মা শ্রীমতী পাখি রানি বড়ুয়াকে।

তৎকালীন বার্মার নে উইন সরকারের জাতীয়করণ নীতির কারণে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব গ্রহণ না করে আমার বাবা-মা স্বদেশে ফিরে আসার জন্যে মন স্থির করেন। ঊনিশশো চৌষট্টি সালে কোলে আমার মেঝদাকে নিয়ে বিমানে চড়ে আমাদের পরিবার ফিরে আসে বাংলাদেশে। মায়ের মুখে পরে শুনেছি, বার্মা বিমান বন্দরে আসার সময়ে ওজনে সংকুলান না হওয়ায় আমার মায়ের প্রিয় অনেক স্বর্ণগহনা রেখে আসতে হয়। এর মধ্যে মায়ের খুব পছন্দের স্বর্ণের প্রজাপতি হার উল্লেখযোগ্য। যখনই মা স্মৃতি রোমন্থন করতেন, তখনই অনিবার্যরূপে মায়ের এই প্রজাপতি হারের কথা আলোচনায় আসতোই। আরও একটা কথা মা মাঝে মাঝেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন। সেটা হলো বার্মার মাতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা। তিনি যে রাতের বারোটার সময়ও ছেলেমেয়ে নিয়ে নিরুপদ্রবে মার্কেটিং করতেন কিংবা ঘুরতেন সেটা তাঁর গল্পগাছায় ফুটে উঠতো প্রসঙ্গ এলেই।

গ্রামে যখন আমার মায়ের চরণ প্রথম পড়ল, তখন গ্রামবাসী বৌভাত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মাকে বরণ করে নেয়। গ্রামের লোকজ রীতিতে একটা অনুষ্ঠান প্রচলিত আছে। একে বলে সহমেলা। অর্থাৎ যার জন্যে বৌভাত, সেই বৌকে নিয়ে পাড়ার জা-য়েরা বসে একসাথে আহার করা। এর মধ্য দিয়েই নতুন বৌকে পরিচিত করে তোলা হয়।

ঊনিশশো একাত্তরে যখন চারদিকে বেজে উঠল মুক্তিযুদ্ধের দামামা, তখন গ্রামের অনেক পরিবার সীমান্ত পার হয়ে চলে যাচ্ছিল নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। এ সময় বোয়ালখালি থানা আওয়ামী লীগের নেতা আমার বাবার ওপর রাজাকারদের কড়া নজর ছিল। বাবা ছিলেন বোয়ালখালি থানায় মুক্তিযুদ্ধের নেপথ্য সংগঠক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী। তাই বাবা ও আমাদের বাড়ির ওপর খান সেনাদের দোসরদের নজরদারিতে ভয় পেয়ে মা একদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সবাইতো ঐপারে চলে যাচ্ছে। আমরা এখন কী করবো? বাবা মাকে কড়া করে বলেছিলেন, দরকার হলে আমরা রাজাকারের লাগিয়ে দেওয়া আগুনে পুড়ে মরবো, তবু কিছুতেই দেশত্যাগ করবো না। কিছুদিন পরে যুদ্ধের সময়েই আমাদের ঘরে রাজাকার আসলো। রাজাকার কাঞ্চন মিয়ার হাতে অস্ত্র ছিলো। তারা এসে আমার মায়ের কাছ থেকে চাবি নিয়ে আলমারি তন্ন তন্ন করে খুঁজলো কোনো গুরুত্বপূর্ণ দলিল পায় কি না। ভাগ্যিস আগের রাতে আমার মা বুদ্ধি করে সব কাগজ পুড়িয়ে ফেলেছিলন। কিছু না পেয়ে শেষমেষ তারা চলে যায়। মায়ের মুখে শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমার বড়দা-মেঝদাকে নিয়ে আমার বড়মামা-মেঝমামা পাহাড়ে লুকিয়ে থাকতেন দিনের বেলায়। একদিন আমার দিদিমা বারো বছর বয়সী আমার ছোট মামাকে নিয়ে কালুরঘাট ব্রিজ হেঁটে পার হয়ে তার মেয়েকে দেখতে আসছিলেন। পথিমধ্যে তাঁকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে। 'অ্যাই বুড্ডি কাঁহা যাতা হ্যায়?' আমার দিদিমা জবাবে বলেছিলেন, অসুস্থ মেয়েকে দেখতে যাচ্ছেন। দিদিমা ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী নারী। তাঁর এই বুদ্ধি আমার মা-ও পেয়েছিলেন। দিদিমা বুদ্ধি করে তাদের জানিয়ে দিলেন, ‘হাম চায়না বুড্ডিস্ট হ্যায়।’ এই জবাব পেয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁকে ও তাঁর ছোট ছেলেকে ছেড়ে দিলো। পরে যতবারই দিদিমা আমাদের সামনে এই গল্প বলতেন ততবারই আমরা হেসে হেসে বলতাম, ‘অ্যাই বুড্ডি কাঁহা যাতা হ্যায়?’ তিনিও হেসে দিয়ে বলতেন, অ নাতি দিনগুলি অনেক ভয়ঙ্কর ছিলো।

স্বাধীন বাংলাদেশে আমার বাবা-মায়ের ঘরে আমি সপ্তম সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করি। ভাইদের মধ্যে তৃতীয়। আমি যখন আমার মায়ের পেটে এসে আস্তানা গাঁড়ি তখন থেকেই বংশগতির কারণে তাঁর চুলে সাদা কাশের ছোপ লেগে গেছে বলে মনে হয়। তখন অজ্ঞতার কারণে মনে করা হতো, কালো চুলে ঘি লাগলে নাকি চুল সাদা হয়ে যায়। মাঝে মাঝে মাকে সেই লোকবিশ্বাসের কথাও বলতে শুনেছি। কোনো এক সময় নাকি মায়ের চুলে কেউ ঘি লাগিয়ে দিয়েছিলো। আমাকে পেটে নিয়ে মা একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন। তিনি স্বপ্নে দেখেন, তাঁর খুড়ো শ্বশুর অদীন মাস্টার নাকি স্বপ্নে তাঁর শিয়রে এসে বলছে, ‘অ বউ, আমাকে একটা অষুধ দে মা’। অথচ অদীন মাস্টার দীর্ঘদিন রোগে ভুগে মারা গেছেন মাস ছয়েক আগে বা তারও বেশি। এই স্বপ্ন মাকে সারাদিন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। যেদিন আমার জন্ম হলো সেদিন অদীন মাস্টারের বড় ছেলে হিমাংশু কাকা ভিটার লোকদের মাঝে মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন। এসবই মায়ের মুখে শোনা। মাঝে মাঝে আমি ভাবি, জগৎ ভবিষ্যতের কোনো ঘটনার ক্ষেত্র তৈরি করার জন্যে অতীতেই তার প্রেক্ষাপট তৈরি করে। যেমন হিমাংশু কাকা আমার জন্মের খুশিতে মিষ্টি খাইয়েছিলেন পাড়া-পড়শিকে। আর তিনি যখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিসিইউতে পরলোকগমন করেন তখন তাঁর মরদেহ গ্রামে নেওয়ার ভাড়া কী করে জানি আমার মারফতে পরিশোধ করা হয়।

আমার জন্মের পর কিছুকাল মায়ের সঙ্গে থাকলেও ছোটবোনের আসন্ন জন্মের কারণে আমার পরিচর্যার ভার পড়ে মেজদির কাছে। তিনি তখন মনে হয় ক্লাস এইট-নাইনে পড়তেন। যখন আমার বুঝার বয়স হয়, তখন আমাদের গ্রামের বাড়িতে বেড়ার ঘরে তার আর আমার একটা ছবি বাঁধাই করা টানানো দেখতে পাই। ছবিতে তিনি আমাকে দুহাতে ধরে শূন্যে ভাসিয়ে রেখেছেন। তাঁর পরণে ছিল ব্রোকেডের জামা। বটল গ্রিন যাকে বলে। তাঁর কাছে জেনেছি, ছোটবেলায় নাদুস-নুদুস আমি দুইমুখওয়ালা কাচের ফিডার খাওয়া শেষ হলে দুধের বাঁটকে ছুঁড়ে ফেলতাম। এভাবে অনেকগুলো দুধের বাঁট আমি নাকি ভেঙ্গেছি। ছোটবেলায় আমাকে প্রচুর গ্রাইপ ওয়াটার খাওয়ানো হতো। সুঘ্রাণওয়ালা গ্রাইপওয়াটার খেতে খুব ভালো ছিল। পরে বড় হয়ে জেনেছি, বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানোর জন্যেই মূলত গ্রাইপ ওয়াটার খাওয়ানো হতো। এতে কিছুটা আফিম মেশানো থাকতো নাকি। বাঁট খাওয়া শেষ হলে তবুও টানতে থাকতাম। দুই দিকেই নিপল থাকার কারণে আমার পেট হাওয়ায় বোঝাই হয়ে ফুলে ঢোল হয়ে যেত। এই সমস্যা হতে উত্তরণে বড় মামা আমার জন্যে বড়শিতে মাছ ধরা শুরু করলেন, যাতে মাছভাতে আমার প্রতিষ্ঠা হয়। তখনকার দিনে প্রতিদিন যেমন হাট বসতো না, তেমনি ফ্রিজ না থাকায় মাছও সংরক্ষণ করা সম্ভব হতো না।

মেজদির কোল আমার ঠিকানা হলেও তিনি ছিলেন কিশোরী বালিকা। ফলে বান্ধবীদের সাথে খেলার সময় তিনি আমাকে ঘরের দাওয়ায় বসিয়ে রেখে খেলায় অংশ নিতেন। এরকম একদিন খেলার সময় কেউ খেয়াল করেনি, আমার সামনে কাপড় কাচা সাবানের কেইস রাখা ছিল। তাতে বাংলা ঊনিশশো সাঁইত্রিশ সাবানের গোল্লা ছিল। হয়তোবা আমার মা পুকুরে কাপড় কেচে সাবানটা তুলে রাখতে ভুলে গেছেন। ব্যস্! এই সাবান খেয়ে নাকি আমার যা তা অবস্থা। মেজদি এবং মায়ের অভিমত, এই বাংলা সাবান খেয়েই নাকি আমার ঠোঁট কালো হয়ে গেছে। আসলেও তাই। সিগারেট পান না করেও আমার ঠোঁট ধূমপায়ীদের মতো কালো। কোনো একদিন আমাকে কোলে নিয়ে খেলছিল আমার ইমিডিয়েট বড় বোন, যে আমার চেয়ে সাড়ে তিন বছরের বড়। কেউ একজন দুষ্টুমি করে একটা বাচ্চা কচ্ছপ আমার পায়ে লেলিয়ে দেয়। এতে কচ্ছপের কামড়ে আমার বাম পায়ের পাতার পিঠে দাগ হয়ে যায়। সেই দাগ বড় হতে হতে কাতল মাছের চোখের আকার নিয়েছে এখন। শৈশবে চোখে অসুখ হওয়ার কারণে মেজদির কোলে চড়ে শহরে আসি বাবাসহ ডাক্তার দেখানোর জন্যে। সাম্পানে চড়ে নদীপথে নৌযাত্রাকালে গ্রামে একটা রীতি প্রচলিত ছিল। সাম্পানে উঠে যিনি মাথির দিকে থাকতেন তিনি নদী হতে হাতের কোষে করে পানি নিয়ে যাত্রীদের মাথার ওপর ছিটাতেন। এটাকে স্থানীয় ভাষায় বলে নদী মাতানো।

ছোটবেলায় মায়ের কাছে আমার হাতেখড়ি হলেও আমাকে এবং আমার সন্নিহিত বড় বোনকে পাঠ গ্রহণের জন্যে পাঠানো হলো এক গ্রামতুতো বোনের কাছে। তিনি ছিলেন বয়স হলেও অনূঢ়া। তাঁর কাছে লেখা শিখতে গেলে মাঝে মাঝে শীতকালে খেজুরের রসের পায়েস খেতে দিতেন। এই দিদি পরে হঠাৎ করে রোগে ভুগে মারা যান। মায়ের কাছে আমার তিনবার রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষা সমাপ্ত হয়। আমার কাছে যতবারই বাল্যশিক্ষার শেষপৃষ্ঠার আগের পৃষ্ঠায় যেতাম ততবারই রোমাঞ্চ লাগতো। কারণ ঐ পৃষ্ঠাতে আমার বাবার নাম ছিল। 'সুরেশ তুমি জান না, ঐ বাড়িটি জগদীশ বাবুর।' এটুকু পড়লেই আমার অন্য রকম লাগতো। বাল্যশিক্ষায় মায়ের কাছে সবগুলো ডালের নাম মুখস্থ করার সুফল আমি পরবর্তীকালে পেয়েছিলাম। গ্রামের যে বোর্ড স্কুল, ঐ স্কুলের ভবন নির্মাণের জন্যে আমার বাবা ভূমি দান করেন। আবার বাবা চৌধুরী পাড়া বালিকা বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদেরও সভাপতি ছিলেন। আমার মেজদি যখন ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পায় তখন বাবা সেই বৃত্তির টাকা আরেকজন দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীকে দান করে দেন। গ্রামের বোর্ড স্কুলে আমি বড় বোনের সাথে যাতায়াত করতে থাকি। আমাদেরকে বাড়িতে আমার বড় ভাইবোনদের পড়ানোর জন্যে শফি মাস্টার নামে একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আসতেন। তাঁর শারীরিক কাঠামোর জন্যে তাঁকে সবাই পোয়া ( বালক) মাস্টার নামে অভিহিত করে। তাঁরই জোরাজুরিতে বোর্ড স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আমাকে খালি গলায় একটা গান গাইতে বলা হলো। আমি তখনকার বাংলা সিনেমার একটা জনপ্রিয় গান গেয়েছিলাম, ‘মাগো মা, ওগো মা, আমারে বানাইলি তুই দিওয়ানা’। কোনো বাদ্যযন্ত্র ছিলো না বলে মুখেই মিউজিক দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। এতে সবাই খুব মজা অনুভব করেছিল।

আমাদের বাড়িতে একসময় একজন হিন্দু দারোগা এসেছিলেন। তিনি আমাদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। তাকে দিয়ে আমাকে ভয় লাগিয়ে বাবা আমার একটা বদভ্যাস দূর করেছিলেন। আমার অভ্যাস ছিল দুই হাতে আট-দশটা বেলা বিস্কুট বা রোজ বিস্কুট নিয়ে আমি ঘরের চৌকাঠে বসে থাকতাম। খেতাম না অতো কিন্তু শেষে বিস্কুটগুলো নষ্ট হয়ে যেতো। ঐ দারোগা তার পিস্তল দেখিয়ে আমাকে ভয় লাগিয়ে শেষমেষ এই অভ্যেস বন্ধ করায়। গ্রামে থাকতে একবার সন্ধ্যা সবেমাত্র পার হওয়া রাতে ঘরের দাওয়া হতে পা পিছলে নিচে পড়ে যাই। বাবা এসময় আমাকে ধুলো হতে উঠিয়ে পরিচর্যা না করে হাত তুলে চড়ের ভয় দেখান। ভয়ে তখন আমার মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়, ' বাবা আমি আর পড়ে যাবো না।' আসলে বাবার সাথে আমরা ভাইবোনরা অতবেশি ফ্রি ছিলাম না। বাবাও একটা কড়া ব্যক্তিত্ব বজায় রাখতেন। তিনি বাসায় বা ঘরে ঢুকার আগে অনেক দূর হতেই গলা খাঁকারি দিয়ে আসতেন, যাতে আমরা ভাইবোনরা সতর্ক হয়ে যাই। কখনো তাঁর সামনে ছোটবেলায় টিভি দেখতে বসিনি। আমার ইমিডিয়েট ছোটবোন রূপা ছিলো দুষ্টের শিরোমণি। এজন্যে আমার মাইঝ্যা ভাই (গ্রামীণ সম্বোধনে আমার বাবার চাচী সম্পর্কে আমাদের ঠাকুরমা) তাকে নাম দিয়েছিল দূর্যোধন। তো এই ছোটবোন লেখার খাতার কাগজকে লম্বা করে পাকিয়ে ছোট ভাই পুষ্পকে নাকি চেরাগের আলো থেকে বিড়ি ধরিয়ে দেয়। পুষ্প ছোট বিধায় কিছু বুঝে উঠার আগেই তার ঠোঁটে আগুন ধরে পুড়ে যায়। ভাগ্যিস অল্পতেই রক্ষা। নয়ত সেদিন অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটতো। বাবার কোপানল হতে রক্ষা পেতে রূপা সেদিন লুকিয়েছিল বেশ কিছুক্ষণ।

আমার সন্নিহিত বড় বোন কয়েকটা মুরগী পালন করতো। একদিন একটা খারাংয়ে (বেত বা বাঁশের ফালি দিয়ে তৈরি খাঁচা যার ভেতরে কী আছে তা দৃশ্যমান থাকে) কয়েকটা মুরগীর ছানাকে আধার দিয়ে আমাকে বলেছিল কুকুর পাহারা দিতে। হাতে একটা পুলিশের কালো লাঠিও দিয়েছিল যাতে কুকুরকে ভয় দেখিয়ে ভাগাই। যে কুকুরটা মুরগীর ছানাকে বিরক্ত করতে এসেছিল তার নাম ছিলো বাঘা। তার ঘাড়ে আমি কয়েক ঘা বসাতেই কুকুরটি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমার ঘাড়ে-গর্দানে কামড়িয়ে রক্তাক্ত করে দিলো। এ সময় আমার মা ছিলো পুকুরঘাটে স্নানে। তিনি খবর পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে আসলেন। তাঁকে একেকজন একেক কথা বলতে লাগলো। কেউ বললো ক্ষতস্থানের রক্ত মেখে আমাকে পান খাইয়ে দিতে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় মা তাই-ই করলেন। এরপর পাশের গ্রাম হাজারীর চরে কোন্ এক আত্মীয়া নাকি স্বপ্নে কুকুরে কামড়ানোর ঔষধ পেয়েছেন। অতএব মা আমাকে সেই গ্রামে নিয়ে গেলেন। তার নাম ছিলো তরুবালা। তার স্বপ্নে পাওয়া ঔষধ পুড়িয়া করে আমাকে খেতে দিলেন এবং ঔষধ গরম বলে আঠারো মাস মাছ-মাংস-দুধ-ডিম খেতে না করে দিলেন। সেই যে আমার মাংস খাওয়া বন্ধ হলো আর এর প্রতি ইচ্ছে জাগেনি কখনো। পরে অন্য কারও পরামর্শে আমার মা রুনু মহাজনের স্বপ্নে পাওয়া কুকুরে কামড়ানোর ঔষধের জন্যে গেলেন। তাদের ঠিকানা ছিলো চট্টগ্রাম শহরের সদরঘাটে পোস্ট অফিস গলিতে। গলিতে ঢুকতেই একটা সাইনবোর্ড। তাতে গ্রামোফোনের ছবিসহ হিজ মাস্টার্স ভয়েসের কুকুরের ছবি আঁকা। আমাদের সাথে হিমাংশু কাকা ছিলেন। তখন ছিলো পবিত্র রমজান মাস। ফিরবার পথে বেবিট্যাক্সিতে কালুরঘাট মোহরায় আসলে ইফতারের আজান হয়। হিমাংশু কাকা ট্যাক্সি থেকে নেমে আমাদের জন্যে বুট-মুড়ি-পেঁয়াজু নিয়ে আসলেন। কিন্তু রুনু মহাজনের ঔষধেও আমার মায়ের আস্থা তৈরি হলো না। তিনি শুধু গল্প করতেন তাঁর বাবার বাড়ির এক কাকার। মায়ের ঐ কাকাকে নাকি কুকুরে কামড়েছিল। পরে তাকে কোমর অব্দি পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হয়েছিল। তিনি পানি খেতে চাইতেন কিন্তু পানি দেখলেই ভয় করতেন। মায়ের এই গল্পের কারণে বাবা বাধ্য হয়ে জেলা পরিষদে লিখিত আবেদন করে কুকুরে কামড়ের ভ্যাক্সিন বের করে আনেন। চৌদ্দটা ইঞ্জেকশন নাভির চারপাশে মারতে হবে। দিনে একটা করে। কুকুরে কামড়ের প্রতিষেধক ইঞ্জেকশন মারার জন্যে আমাকে দিদিমার কাছে চান্দগাঁও মামাবাড়িতে রাখা হলো। ইঞ্জেকশন মারতেন ডাঃ শায়েস্তা খান। ইতিমধ্যে আমার গ্রামের বাড়িতে সবাই মিলে পাগলা কুকুরটিকে মেরে ফেললো। শুনেছিলাম, আমাকে কামড়ানোর ওর ঐ পাগলা কুকুর একজন নারী ভিখারি এবং একজন সাম্পানের মাঝিকেও কামড়েছিলো।

গ্রামে থাকতেই একবার পুকুরে স্নানের সময় ডুবে যাওয়ার উপক্রম ছিলো। আমাকে পানিতে নামিয়ে হিমাংশু কাকার বড় ছেলে শিবুদা সাঁতার শেখানোর চেষ্টা করছিলো। কিন্তু তার পায়ে একটা বড় চিংড়ি ঘাঁই মারার কারণে তিনি আমাকে ছেড়ে চিংড়ি ধরতে ডুব দেন। ফলে আমিও ডুবে ডুবে পুকুরের পানি খেতে শুরু করলাম। ভাগ্যিস্ পরক্ষণেই শিবুদা আমাকে ধরে ফেলেছিলো। এই শিবুদার সাথেই আমার আরেকটা মজার ঘটনা আছে। শিবুদা একদিন আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে আমার দশ পয়সা নিয়ে নেয়। আমি তখন এর বিচার দিয়েছিলাম তার বাবার কাছে । তারা আট আনা, আধুলি ইত্যাদি দিয়ে আমাকে সান্ত¡না দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু আমি গোঁ ধরে রইলাম আমার পানপাতা আঁকা দশ পয়সার জন্যে।

ঊনিশশো সাতাত্তর সালে ভারতের গৌহাটি থেকে আমার মেঝ কাকা সপরিবারে বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন। তাদের আসাকে কেন্দ্র করে আমরা সবাই শহরে চলে এলাম। শহরে আলকরণেই আমাদের প্রথম বাসা নেয়া হলো। বাসার মালিক হলেন ইসহাক সাহেব। তিনি সৌদি আরবে প্রবাসী ছিলেন। ইসহাক সাহেবের বাসায় দেয়াল দিয়ে ঘেরা কম্পাউন্ড ছিলো। তাতে তিন পরিবার বসবাসের বাড়ি ছিলো। আমরা ছিলাম মাঝখানের বাসায়। উত্তর দিকের বাসায় থাকতো ইকবালেরা এবং দক্ষিণদিকের বাসায় থাকতো সমীরেরা। আমাদের বাসার কম্পাউন্ডে ছোট একটা উঠোন ছিলো। তাতে আমরা পেরেক উঠানো লাটিম ঘষে ক্রিকেট খেলতাম। দেওয়ালে ইটের খোয়া দিয়ে আঁকতাম স্ট্যাম্প। ঐ বাসার কম্পাউন্ডে নারিকেল গাছ বেয়ে শামুক উঠতো। শহরের বাসায় এসেই প্রথম দিন আমার লাগোয়া বড় বোন রুমা স্নানের জন্যে কাপড়-চোপড় নিয়ে বের হয়। এসময় অঞ্জন কাকা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি রে কই যাস্? স্নান করতে পুকুরে যাই। এখানে পুকুর কই? অঞ্জন কাকার এ কথায় আমরা সবাই হেসে দেই। শুরু হলো শহুরে জীবনের নির্মমতা। ঘরে বাঁধা জীবন। গ্রামের মতো পাড়া বেড়ানোর সুযোগ নেই, নদী কিংবা পুকুরে স্নানের সুযোগ নেই। সম্ভবত আমরা আগস্ট কি সেপ্টেম্বরে শহরে এসেছিলাম। মাঝামাঝি হলেও আলকরণের দেওয়ান সুলতান আহমদ পৌর বালিকা বিদ্যালয়ে আমার ইমিডিয়েট বড়-ছোট দুই বোনকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো। সুদত্ত বাবু ছিলেন এই স্কুলের মাস্টার। তিনি বাবার বন্ধু ছিলেন। দল বেঁধে তিনিই নিয়ে গেলেন। আমাকেও সাথে নিয়ে গেলেন। আমি ভর্তি হওয়ার কথা ছিলো ছেলেদের স্কুলে। কিন্তু আমার মুখে পাঠ্যবইয়ের কবিতা শুনে তারা ভর্তি করিয়ে নিলেন। ঐ স্কুলে আমি ছাড়া আর একজন মাত্র ছেলে ছিলো। তার নাম স্বপন। স্বপন পরে তার বাবার সাথে ভারতে পাড়ি জমায়। কিন্তু আমার বাবার স্বপ্ন ছিলো বড়। তিনি পরের বছর আমাকে পাথরঘাটার গীর্জা সংলগ্ন সেন্ট প্ল্যাসিডস্ স্কুলে ভর্তি করানোর জন্যে ফর্ম ওঠান এবং মেজদিকে দিয়ে তালিম দেওয়াতে থাকেন। ভর্তি পরীক্ষায় আমার রোল ছিলো নাইন। পরীক্ষার দিন তিন তলায় উঠতে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে আমার এডমিট কার্ডের ছবি পড়ে যায়। আমি দূর হতে বাবাকে ইশারায় তা দেখাতে সমর্থ হই। পরে বাবা আরেকটা ছবির ব্যবস্থা করেন। ভর্তি পরীক্ষায় একজন টিচার এসে বললেন ওয়ান টু টুয়েন্টি বানান করে লিখতে। ওটা শেষ হতে না হতেই আরেকজন বললেন ওয়ার্ড বিল্ডিং করতে। এভাবে করতে করতে একঘন্টার পরীক্ষা শেষ হয়। পরীক্ষা শেষে বাবা আমাকে একজন ফাদারের কাছে নিয়ে যান। তিনি আমাকে দুহাত ভরে চকলেট দেন। চকলেট নিয়ে বাসায় আসার পর সবাই আমাকে জেঁকে ধরলো। আমি শুধু বলেছিলাম, আমাকে বিল্ডিং আঁকতে বলেছে। আসলে যে ওয়ার্ড বিল্ডিং করতে বলেছে তা ভুলে গিয়েছিলাম। পরেরদিন ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দেয় এবং আমি ভর্তি হওয়ার জন্যে উত্তীর্ণ হই। শুরু হলো আমার শিক্ষার নাগরিক অধ্যায়ের। স্কুলে সিমেন্টের বাঁধাই করা বাস্কেটবল গ্রাউন্ড দেখে আমার খুব পছন্দ হয়েছিলো। প্রথম প্রথম বাস্কেটবল দেখে ভেবেছিলাম এটা আবার কয় নম্বর ফুটবল। পরে জানা হয়ে যায়, বাস্কেটবল নামে একটা আলাদা ক্রীড়া আছে। স্কুলে প্রিপারেটরি ক্লাসে ভর্তি হয়ে ‘রিলিভ আস’ নামে একটা খেলা শিখি। খেলাটা দৌড়াদৌড়ির খেলা। কিন্তু বলার সময় কেউ রিলিভ আস বলতো না। সবাই বলতো ‘লিলি বস’। স্কুল থেকে দুই দুইবার আমাকে ডাবল প্রমোশনের সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু আমার সরল-সিধা মা ছেলের শিক্ষার গোড়া শক্ত করতে গিয়ে সেই সুযোগ নেননি। একবার ক্লাস ওয়ানে এবং আরেকবার ক্লাস টুতে আমাকে ডাবল প্রমোশনের জন্যে বলা হয়েছিলো।

ক্লাস থ্রি ছিলো আমার জন্যে অত্যন্ত ঘটনাবহুল সময়। এ সময় ক্লাসে একদিন ছোট হুজুর ধর্মক্লাসে আমাদের কথা বন্ধ করাতে না পেরে হাতে কাঠের স্কেল দিয়ে বাড়ি দেন। হুজুরের হাতে স্কেলের বাড়ি খেয়ে আমি একটা ছড়া লিখি প্রতিবাদ করে। পরে যখন ক্লাস টিচারের ক্লাস শুরু হয় তখন সবাই এ ঘটনা টিচারকে জানায়। টিচার আমার ছড়াটা দেখেন এবং তিনি সেটা বড় হুজুর এবং প্রিন্সিপ্যালকেও দেখান। বড় হুজুর ছোট হুজুরকে ডেকে ভর্ৎসনা করেন এবং প্রিন্সিপ্যাল ব্রাদার মার্সেল নির্দেশ দেন যাতে ধর্ম ক্লাসের সময় আমাদের আর ইসলামিয়াত ক্লাসে না বসতে হয়। তাঁর নির্দেশে আমরা ঐ সময়টা স্কুলের হলরুমে কাটাতাম। এরপর থেকে আমার ছড়া লেখার খাতা দেখার জন্যে আর ডি ক্রুজ টিচার সেটি নিয়ে যান।

এ সময়ে চট্টগ্রাম দাবা সমিতির আয়োজনে আলেখিন মেমোরিয়াল চেজ টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। আমি সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে অংশগ্রহণ করি এবং ফিনল্যান্ডের গ্র্যান্ড মাস্টার ক্যারি ববিলানকে হারিয়ে দেই। আমার ঘোড়ার চাল দেখে দাবা সমিতির সম্পাদক সৈয়দ জাহেদ মনসুর আংকেল খুব খুশি হয়েছিলেন। আমার এই অর্জন পরেরদিন দৈনিক আজাদীর খেলাধুলার পাতায় প্রকাশিত হয়। স্কুলের দাবা প্রতিযোগিতায় আমাদের স্পোর্টস টিচার লেজলি স্যার অ্যাসেম্বলিতে আমার হাত উঠিয়ে কী কী জানি বললেন। পরে আমার ক্লাস টিচার জানালেন, আমি নাকি স্কুলের বড়দের সাথে দাবা প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবো।

ডিসেম্বর মাসে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে শিশু কিশোর আনন্দ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এতে খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরীর পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথের 'রাজা ও রাজদ্রোহী' নাটক পরিবেশিত হয়। নাট্য নির্দেশক অধ্যাপক সঞ্জীব বড়ুয়ার নির্দেশনায় আমরা নাটক মঞ্চস্থ করি এবং আমি তৃতীয় শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার অর্জন করি। পঞ্চম শ্রেণিতে উঠার পর প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার কোচিং চলাকালে টেবিল টেনিস খেলার আকর্ষণে আগে আগে স্কুলে চলে যেতাম। কোচিং ক্লাসে আমাদের পড়াতেন মিসেস এমবি রয়, মিসেস এন পাড়ে, মাইকেল গঞ্জালভেস, আলবার্ট বাড়ৈ প্রমুখ শিক্ষকেরা। প্রাইমারিতে আমাদের স্কুল থেকে কেবলমাত্র আমি একাই বৃত্তি পাই।

ক্লাস সিক্সে উঠার পরে টের পাই কোন কোন শিক্ষক প্রাইভেট পড়ার জন্যে আকারে-ইঙ্গিতে চাপ দেন। কিন্তু ক্লাস এইটে উঠার আগে আমার কোনো গৃহশিক্ষক ছিল না। সিক্সের পরীক্ষায় আমি যে নম্বর পাই তা ছিলো সারা স্কুলে সর্বোচ্চ। ক্লাস সেভেনে বি আর দাশ স্যারের ক্লাসে উঠে প্রথম প্রথম বীজ গণিতের জন্যে অধীর বিশ্বাস স্যারের কথা বুঝতে অসুবিধা হতো। পরে অবশ্য তা ঠিক হয়ে যায়। আমি পর পর তিনবার ক্লাস ফাইভ, সিক্স ও সেভেনে বেস্ট বয় হওয়ার গৌরব অর্জন করি। ফার্স্ট হওয়ার পাশাপাশি বেস্ট বয় হওয়াটা ছিল অনন্য গৌরবের। ছোটবেলায় আমি ও আমার ছোট ভাইকে রেজাল্ট দেওয়ার দিন বাবা রিকশা করে স্কুলে নিতেন। তখন রিকশা ভাড়া ছিল আলকরণ থেকে পাথরঘাটা গীর্জা স্কুল পর্যন্ত তিন টাকা। বাবা কেন রেজাল্ট নিয়ে আসার সময় আমাদের হাঁটিয়ে আনতেন তা বুঝতে অনেক সময় লেগেছিল। বাবাকে এলাকায় সবাই চিনতো। হাতে রিপোর্ট কার্ড এবং ফার্স্ট বয়, বেস্ট বয়ের পুরস্কার, অ্যানুয়াল প্রতিযোগিতার পুরস্কার হাতে বাবাকে যখন লোকেরা রাস্তায় জিজ্ঞেস করতো, তখন তিনি মুখে উজ্জ্বল হাসি ধরে রেখে বলতেন, ছেলেরা ফার্স্ট হয়েছে এবং বেস্ট বয়ও হয়েছে। বাবা এই খুশিটা উদযাপনের জন্যেই আমাদের হাঁটিয়ে আনতেন।

মনে পড়ে, প্লে ক্লাসে আমাকে ইংরেজি উচ্চারণ শেখানোর জন্যে বাবা এক প্রৌঢ় ভদ্রলোককে বাসায় আসতে বলতেন। তিনি তাঁকে আংকেল ডাকতেন। তাঁর নাম ছিল শরদিন্দু দস্তিদার। বাবা তাঁকে আংকেল বলেই ডাকতেন। পরে অবশ্য তিনি আমাদের পরিবারে সকলের আংকেল সম্বোধনের ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তাঁর গোঁফ ছিল সাদা ও এমএজি ওসমানীর মতো। শুনেছিলাম, তিনি গোঁফে তা দেওয়ার ভাতা পেতেন। তিনি কখনো না বললেও জানা গিয়েছিল, বাংলাদেশের বরেণ্য কবি ত্রিদিব দস্তিদার তাঁর পুত্র ছিলেন।

মাঝে মাঝে স্কুলে গেলেই শুনতাম কালকে হরতাল। তখন ছিল স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের মৌসুম। বন্ধু পৃথ্বীজিৎ আমি এবং সৌরিনের হরতাল সংক্রান্ত আলোচনা শুনে ভয় পেয়ে যেত। সে আমাদের আলোচনাগুলো রুবি টিচারকে জানিয়ে দিতো। টিচার আমি এবং সৌরিনকে ডেকে বকা লাগাতেন।

ক্লাস এইটে উঠার পর আমার বড় মামার তাগিদে আমাকে কলেজিয়েট স্কুলে নিয়ে যাওয়া হলো। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পাওয়ার কারণে সরাসরি ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই আমাকে ভর্তি করিয়ে নেয়া হলো। যখন আমার টিসি আনা হয় সেন্ট প্ল্যাসিডস্ স্কুল থেকে, তখন স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল ব্রাদার মার্সেল স্কুলের বাস্কেটবল টিম নিয়ে রাজশাহী গিয়েছিলেন। ফলে সহজেই টিসি পেয়ে যাই। তিনি আসার পর জানতে পেরে খুব রাগ হয়েছিলেন যিনি টিসি দিয়েছিলেন তার ওপর। পরে আমার ছোট ভাই পুষ্পের কাছে বলেছিলেন, তিনি নাকি আমাকে দাবায় উচ্চতর পড়াশুনার জন্যে কানাডা পাঠানোর ব্যবস্থা করছিলেন।

একদিন ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় আমাদের স্কুল বিনা নোটিসে সকাল এগারোটায় ছুটি হয়ে যায়। তখন আমি ও আমার ছোটভাই বনফুলদের হার্মোনিয়াম তৈরির কারখানায় খেলতে যাই। খেলতে খেলতে কখন দুটো বেজে গেছে আমরা টের পাইনি মোটেই। অথচ দুপুর একটায় ক্লাস টু-তে পড়ুয়া ছোটবোন সুমনার স্কুল ছুটি হয়ে গেছে তখন। সবাই চলে গেছে, কিন্তু আমরা তাকে আনতে না যাওয়ায় সে আমাদের গৃহশিক্ষক সমরেশ স্যারের সাথে বাসায় এসে পড়ে। আমরা দুই ভাই তাকে না পেয়ে চিন্তিত মনে বাসায় চলে আসি। এসে দেখি সুমনা বাসায়। তারপর আমরা যে বকাবকি শুনলাম তা অশেষ।

মাঝে মাঝে বাবা আমাকে ঘুম হতে জাগিয়ে রাতে আমার স্কুলের খাতা দেখতেন। তিনি আমার হাতের লেখাকে রাবীন্দ্রিক টাইপের করে গড়ে তুলতে বলেন। একটু বাঁকা বাঁকা তির্যক করে লেখা। হাতের লেখাকে রাবীন্দ্রিক টাইপে গড়ে তুলতে গিয়ে মেজদির নোট কপি করে দেওয়ার ঘটনা আমাকে সাহায্য করেছিলো। তিনি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিক্যাল সায়েন্সে অনার্সে পড়তেন। একগাদা নোট এনে তিনি আমাকে কপি করে দিতে বললেন। এই নোটগুলো কপি করতে গিয়ে আমার হাতের লেখা হয়ে গেল বলিষ্ঠ। পরে এই হাতের লেখার জন্যেই ক্লাস থ্রিতে টিচার আমাকে দিয়ে তাঁর টিউশনির বাসায় একটা চিঠি লেখান বকেয়া বেতন আদায়ের জন্যে। এমনিতেই জয়নিং টাইপের ইংরেজি হাতের লেখার কারণে আমাকে প্রতি ক্লাসে শিক্ষার্থীর নামের তালিকা ও রিপোর্ট কার্ডের নামণ্ডরোল নম্বর লিখে দিতে হতো। এভাবে সবার পরিচর্যায় আমার বাংলা-ইংরেজি হাতের লেখা সকলের পছন্দনীয় হয়ে উঠলো। (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়