প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
পৃথিবী চলে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূত্র মেনে। যারাই পৃথিবীর চলন ও ঘূর্ণন নিয়ে গবেষণা করেছেন তারাই এ কথা বিশ্বাস করেন। মহাকাশের জ্যোতির্মণ্ডল ছেড়ে কখনো কখনো কিছু কিছু অপ্রতিম জ্যোতির্ময় নক্ষত্র মায়ের গর্ভে অধিষ্ঠান করে এবং ভূমিষ্ঠ হয়ে মানুষের রূপেই বিরাজিত হয়ে আপন প্রভায় জগত আলোকিত করে তোলে। বাঙালির গর্বের এ রকম এক জ্যোতির্ময় নক্ষত্র কবি কাজী নজরুল ইসলাম। জ্যোতির্বিজ্ঞান যারা চর্চা করেন তারা বিশ্বাস করেন জাতকের জন্মকালের জ্যোতিষ্কসমূহের পরিবেশ এবং পারস্পরিক আকর্ষণ-বিকর্ষণের ভৌত ও মহাজাগতিক বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট জাতকের জীবনের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। ঠিক এ কথাই আমরা শতভাগ ফলতে দেখি বাংলার বুলবুল কবি কাজী নজরুলের জীবন আলেখ্যজুড়ে। পর পর বেশ কয়েকটা সন্তানের অকাল মৃত্যুতে মা জাহেদা খাতুনের পীর-ফকির আর সাধু ও সন্তের কাছে মানতের ফলে জন্ম হয় কাজী নজরুলের। জন্মকালে উত্তর-পশ্চিমাকাশে যে কালবোশেখীর ঘনঘটা ছিল, বাতাসের মদমত্ত হাতির যে দাপট ছিল তা দেখে জ্যোতির্বিজ্ঞানে আস্থাশীল ব্যক্তি মাত্রেই বুঝতে বাকি থাকে না, সদ্যোজাত খোকাটি একা আসেনি, এসেছে তুফান মাথায় করে। অর্থাৎ বৈরি প্রকৃতির দাপট মাথায় করে জন্ম নেয়া শিশুটি একদিকে যেমন নিজেই বিরূপতার শিকার হবে জীবনভর, তেমনি সে আনবে ঝড় জীবনের পৃথিবীজুড়ে। অর্থাৎ জাতক সর্বদা অস্থিরতার মধ্য দিয়েই জীবনাতিবাহিত করতে থাকবে। বাস্তবে তার জন্মকালের বৈরি প্রকৃতিই যেন জীবনব্যাপী বহমান থাকে।
নজরুলের স্বভাবই হলো অস্থিরতা। তাকে যে কেউ প্রথম দেখাতে মনে করতে পারে নজরুল মানেই ঝড় কিংবা ঝঞ্ঝা। সুফীবাদের উদারতা আর প্রগাঢ়তা নিয়ে হাজী পাহলোয়ানের মাজারের পবিত্র পরিবেশে যে ছেলেটি শৈশব কাটিয়ে কৈশোরে উত্তীর্ণ হয়, পিতার অকাল মৃত্যুতে তাঁর জীবনে নেমে আসে ঝড়। কিন্তু এ ঝড় তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে এলাকা ছেড়ে যেতে, কেননা মা জাহেদা খাতুনকে জীবনের খাতিরে মেনে নিতে হলো দেবরের সংসারে ঘরণী হওয়ার অপ্রীতিকর পরিস্থিতি। যে অভিমান মায়ের ওপরে দুখুর জন্মে গেছে সে অভিমানই তাকে প্রতিনিয়ত অস্থির করে তুলেছে। ফলে বার বার জীবিকা পরিবর্তন এবং ঠিকানা পরিবর্তন করেও দুখু মিয়া তাঁর জীবনের দুঃখকে পরিবর্তন করতে পারেনি। আর এই অস্থিরতাই ভর করেছে তাঁর বিভিন্ন রচনায়। কৈশোরের রচনায় শিয়ারসোল রাজ স্কুলে শ্রেণিকক্ষের চালের ফাঁকে আটকে থাকা পাখি শাবকের বেদনায় আহত হয়ে তিনি যে কবিতা লিখেছিলেন তাতে তার মনের অস্থিরতা ফুটে উঠেছে হৃদয়স্পর্শী হয়ে। অস্থির মন হাবিলদার হয়ে ছুটে যায় ঊনপঞ্চাশ নম্বর বাঙালি পল্টনে। সেখানেও ‘ব্যথার দান’ হয়ে অক্ষরে ফুটে ওঠে অস্থিরতা। ‘কবির মুক্তি’ কিংবা ‘কবিতা সমাধি’তে কবি কেমন যেন অদৃশ্য কারো বিরুদ্ধে সমরে উপনীত হন। ‘বিদ্রোহী’ যে কবিতার রূপ পেলো তাতে তৎকালীন অস্থিরতা একদিকে যেমন বেজে উঠেছে তেমনি কবির মনের অস্থিরতাও কবিতার পরতে পরতে নাদিত হয়েছে। কবি যে ঝড়ের আবহাওয়ায় পৃথিবীতে এসেছেন ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যে, যেন সেই ঝড় চিত্রিত হয়েছে রুদ্র ভৈরব নৃত্যে। এ কী রাজশক্তির বিরোধিতা না কি ললাটশক্তির বিরোধিতা তা নিয়ে চিন্তার অবকাশ আছে। নজরুল তাঁর সূচনা কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণায় বারোটি কবিতার মধ্যে পাঁচটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে এবং সাতটি স্বরবৃত্ত ছন্দে কবিতা রচনা করেন। তিনি বাংলা কবিতার মেরুদণ্ড নামে খ্যাত অক্ষরবৃত্ত ছন্দে কোন কবিতা লিখেননি। অর্থাৎ নজরুলের কবিতায় স্নিগ্ধ নদীর শান্তধারা ছিল না, ছিল উন্মাতাল নদীর নৃত্যপাগল ছন্দ। ঠিক যেমন তাঁর গানে তিনি বলেছেন, ‘ওগো নদী আপন বেগে পাগলপারা / আমি স্তব্ধ চাঁপার ফুল / গন্ধভরা তন্দ্রাহারা...’। অক্ষরবৃত্ত কবিতাছন্দে রচিত তাঁর কবিতা সংখ্যা নগণ্য। তিনি সর্বদা তাঁর মনে বহন করে চলেছেন দ্রুত লয় ও দুর্বার গতি। তাঁর অনুপ্রাসের প্রবণতা এবং কুশলতা তাঁর কবিতায় এনেছে সর্বদাই এই কুচকাওয়াজের তাল যা ঝন্ ঝন্ নিনাদে বেজে ওঠে, হাজার চাইলেও তাতে গাম্ভীর্যের অটল পর্বত-মনোবৃত্তি তৈরি অসম্ভব। তিনি বিশ্বজগৎ দেখার যে সঙ্কল্প করেছেন কবিতায় কোন এক কিশোরের মন নিয়ে, সেই সঙ্কল্পে জানার আগ্রহ থাকলেও অন্যকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলার প্রবণতা ফুটে ওঠে। সেই একই কথা তরুণের অভিযান কিংবা ‘খেয়াপারের তরণী’ কবিতায়ও প্রযোজ্য। অর্থাৎ নজরুলের কবিতা স্বভাবে চঞ্চলা, প্রকৃতিতে দ্রোহপ্রবণ এবং অধীর আবেগপ্লাবী। সেই আবেগের তোড়ে তিনি হয়ে ওঠেন শ্রাবণ-প্লাবনবন্যা। যে ‘বিদ্রোহী’ তাঁকে খ্যাতিমান করেছে সে ‘বিদ্রোহী’ যেন এক আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ সমৃদ্ধ নব্বই মিনিটের ফুটবল খেলা। খেলার মাঠে তা মাতিয়ে তোলে সকল দর্শককে, শেষ হলে কিন্তু তার রেশ ভাবিয়ে তোলে না অবসরে কিংবা উদাস দুপুরে। তা না হওয়ার কারণও আছে বৈকি। জীবনানন্দ যে ছন্দবিদ্যুতে যুগের যন্ত্রণা ধরার কথা বলেছেন, তা এই 'বিদ্রোহ' কবিতাতেই সম্পূর্ণ প্রকাশিত। কাজেই যুগের যন্ত্রণা যুগান্তরের জীবনধারায় আসার কথা নয়।
নজরুলের কবিতায় ব্যক্তিপ্রশস্তির সমাহারও নেহায়েৎ কম নয়। দেশবন্ধু, কামাল পাশা, জগলুল, মিসেস এম রহমান ইত্যাদি ব্যক্তিবৃন্দের প্রশস্তি রচনা করে লেখা কবিতাগুলোতেও নজরুলের তাৎক্ষণিক আবেগের উচ্ছ্বাস প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ নজরুলের রচনায় অধীরতাই মূল উপজীব্য। গভীরতার চেয়ে চঞ্চলতাই তাঁর কবিতার সৌন্দর্য ও শক্তিমানতা। ছান্দসিক মান্নান সৈয়দের ভাষ্যমতে নজরুলের কবিতা অলঙ্কার প্রধান। সালঙ্কারা কবিতা শাশ্বতীয়ানার চেয়ে চমক জাগানিয়া সংবেদের পক্ষপাতী। তাই তাঁর কবিতা জাগরমুখ্য কবিতা। তাঁর কবিতা ভাবমুখ্য কবিতা নয়। তাঁর কবিতায় দর্শন প্রদর্শন করে না, তা কেবল বাস্তবায়নের ফলিত দিকটাকেই চিহ্নিত করে। অথচ বাকরহিত হওয়ার আগে আগে নজরুল আধ্যাত্মিকতার গভীর সরোবরে অবগাহনে লিপ্ত ছিলেন গুরু বরদাচরণ মজুমদারের কল্যাণে। নজরুল যখনই ভাবে গভীরতা পেলেন, দর্শনের সন্দর্শন হলো, তখন নজরুল বাকের চপলতা হারিয়ে নির্বাকের গাম্ভীর্যে অপলক হয়ে গেলেন। অথচ সওগাত মজলিশে গিয়ে কবির পান-গান আর জবানের চপলতায় তাঁর খেতাব জুটেছিল হৈ হৈ নজরুল নামে।
কবিতায় ভাবের আমদানির চেয়ে বেদনার আমদানি নজরুলের অধিক। কেননা তাঁর জীবনটাই বেদনাময়। এটাই তিনি বলেছেন তাঁর বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরীর কাছে। দুঃখ আমার বাদল রাতের মিতা' বলে নজরুল তাঁর জন্মক্ষণের সঙ্গে জীবনযুদ্ধের পাওয়া-না পাওয়ার যে গ্রন্থি রচনা করেছেন তা তাঁকে আজীবন বাদল রাতের অভিযাত্রিক হিসেবেই চিহ্নিত করেছে। তাঁর রিক্তের বেদনে ব্যক্তি জীবনের যে অবয়ব চিত্রিত হয়েছে তাতে অস্থির দুখু মিয়াকেই খুঁজে পাওয়া যায়, যার স্থিরতা না নূরু হিসেবে এসেছে না হাবিলদাররূপে এসেছে।
অনেকের কাছে অস্থিরতা আর অধীরতার জন্যেই নজরুল হয়ে উঠেছেন ধূমকেতু। কবিগুরু নজরুলের ধূমকেতুকে তাই স্থির হতে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু / আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু...’। কিন্তু নজরুল তারপরও স্থিরতায় আসতে পারেননি। বরং অভিমানভরে বলে গেছেন, ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব তবু আমারে দেব না ভুলিতে...।’
‘বিদ্রোহী’ বা ‘ভাঙার গান’-এর কথা শুনলেই অনেকে ভাবতে পারেন, নজরুল কেবল নিয়ম বা শেকল ভেঙে অস্থির মতির পরিচয় দিয়েছেন। বস্তুত তাই নয়। সৃষ্টির প্রয়োজনেও নজরুল অস্থিরতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে...’-এর প্রলয়োল্লাস কিংবা 'পুবের হাওয়া'র উতল ডাকেও অস্থিরতাই উপজীব্য। স্বরবৃত্তের দুলকি চালের চটুলতাই তাঁর এই অস্থিরতাকে ধারণ করেছে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে। ‘নাচে ঐ কালবোশেখী কাটাবি কাল বসে কি...’ বলে যে অস্থির সময়ে আরো অস্থিরতার আহ্বান যে কবি জানান তাঁর কবিতার প্রাণভোমরায় গভীরতার চেয়ে সমকালের চটুলতাই অধিক বাক্সময় হয়ে ওঠে। অনুপ্রাসপ্রধান কবি তাঁর রচনায় ঝড়ের শব্দে সংগীতের মূর্ছনা আনেন, যা প্রাণের স্থৈর্যে আনয়ন করে চঞ্চলতার অভিপ্রায়। সংরাগপ্রবণ কবি তাঁর কাব্যছন্দে বেগবান হতে আহ্বান জানান, ধ্যানী-মৌনী হওয়ার নিবেদন নয়।
পুত্র নজরুল যেমন অস্থির ছিলেন, মায়ের দ্বিতীয় বিবাহ মেনে নিতে না পেরে অভিমানী হয়ে ওঠেন, তেমনি পিতা নজরুলও পুত্রহারা হয়ে দুর্বহ শোকে চঞ্চল হয়ে ওঠেন। আপন মৃত পুত্রকে দেখার জন্যে আধ্যাত্মিকতার আশ্রয় নিয়ে নিজের মনোতৃষ্ণা প্রশমিত করেন। সেই অস্থিরতা নিয়েই তো কবি লিখেছেন, ‘আমার গানের বুলবুলি আজ ঘুমিয়ে গেছে শান্ত হয়ে...’।
নজরুলের জন্ম অজয় নদের নিকটে হলেও নদী হতে তাঁর জন্মভিটার দূরত্ব কুড়ি কিলোমিটার। তাঁর জন্মগ্রামের মাটি কেবল ঊষর আর কঠিন। এতে লাল মাটির প্রকাশ যেমন বেশি তেমনি মাটির তলে ফসলের বদলে কয়লা জমিয়ে রাখার ক্ষমতা বেশি। কয়লা খনির এলাকায় জন্ম নিয়েও নজরুল তাঁর লেখায় বা রচনায় শক্ত শিলার মতো কোন কথা তৈরি করেননি। তাঁর রচনায় ফুটেছে মনের অস্থিরতার ফুল। চুরুলিয়ার কবি ত্রিশালে গিয়ে বাঁশি বাজায় আর গোমতীর তীরে এসে বাসরবিহীন বিয়ে পালায়। শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পেয়েও নজরুল যে অস্থিরতা মনে লালন করেন, তারই বদৌলতে তিনি সংবেদনশীল মানুষের মনে অনুভূতির রাজা হয়ে ওঠেন। নজরুলের সৃজনশীলতা উৎপীড়কের দ্রুত শাস্তি চাইলেও নির্যাতিতের উত্তরণ তাতে দ্রুত ঘটে না। তিনি অধীরতায় বলেছেন বটে, ‘দেখিনু সেদিন রেলে / কুলি বলে এক বাবুসাব তারে দিল ঠেলে নিচে ফেলে’... কিন্তু এটাও মাথায় থাকা দরকার যে বাবুশ্রেণি উধাও হয়ে গেলে কুলিশ্রেণিরও অস্তিত্ব বিলীন হতে বাধ্য। অর্থাৎ ভাবের অধীরতায় বোধের গভীরতা হারিয়ে গেলে কবিতার বাস্তবতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়।
বন্ধু মোজাফফর আহমদের সঙ্গে সন্দ্বীপ ভ্রমণকালে সাগরকে কাছে পেয়ে কবি আলাপ-আলোচনায় অধীর হয়ে ওঠেন। সাগরবক্ষে নৌযানে বসে সিন্ধু হয়ে ওঠে তাঁর কাছে বিরহীর প্রতীক। অর্থাৎ কবি তাঁর নিজের বিরহ তথা মনের অস্থিরতাকে সমুদ্রের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাকেও অস্থির প্রমাণ করেছেন। আবার কারাগারে আটক থেকে নজরুল মাকে দেখা না দিয়ে বিরজা সুন্দরীর হাতে ফলের রস খেয়ে অনশন ভাঙেন কিন্তু পরবর্তীতে তিনিই রচনা করেন ‘অবেলার ডাক’-এর মতো বিলাপের কবিতা। এ তো কবিতা নয় যেন কনফেশন। অধীর অস্থির কবি ধীরতা চেয়ে, স্থিরতা চেয়ে ‘অবেলার ডাক’ কবিতায় নিজের ভুল স্বীকার করেন। কিন্তু কবি যতই অস্থিরতা হতে স্থিরতায় যাত্রা করেন, ততই ধীরে ধীরে তিনি সবাক হতে বাকহীনতায় ধাবিত হন। বড়’র পিরিতি বালির বাঁধ বলে একসময় যে কবি তরোয়াল দিয়ে দাড়ি চাঁচতে চেয়েছিলেন, সে কবি হঠাৎই পরমের সান্নিধ্য পেতে পরমের ইশারায় উদগ্রীব থাকেন। নজরুল তাঁর শেষ দিকের অভিভাষণে পার্থিব সওগাতে পরমের ধ্যান হতে হুট করে নিচে নেমে না আসতে পারার যে অনুভূতি ব্যক্ত করেন তা তাঁর তারুণ্যের তূর্য বাদকের ভূমিকার বিপরীতে দাঁড়িয়ে যায়। তার মানে নজরুল তাঁর কাব্যিক যাত্রাপথে বার বার নিজেকে বদলানোর প্রয়াস নিয়েছিলেন। তিনি চট্টগ্রামে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনে এসে মুসলিম রেনেসাঁকে জাগিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি কাব্যে আমপারার অনুবাদে নিজের আধ্যাত্মিক চেতনাকে সঞ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন। তিনিই আবার শ্যামা মায়ের প্রশস্তিতে সুরের সরোবরে ডুবে ছিলেন। তাঁর শেষ যাত্রায় তিনি মসজিদের পাশে সমাহিত হতে চেয়ে তাঁকে নিয়ে চলমান বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছেন। তাঁর কাব্যজীবন, ব্যক্তিজীবন, রাজনৈতিক জীবন কিংবা আধ্যাত্মিক জীবনের সর্বত্রই অস্থিরতা বিরাজমান। এমনকি সৈনিক জীবনেও তিনি অস্থির ছিলেন বিধায় যুদ্ধ করতে গিয়ে ফার্সি শিক্ষায় মনোনিবেশ করে আবারো সাধারণ জীবনে ফেরৎ এসেছেন। অর্থাৎ অস্থিরতা তাঁর পেশাগত জীবনেও ভর করেছিল। ফলে তাঁর রচনাতেও এই অস্থিরতার শিলালিপি খোদিত হয়েছে সময়ে-অসময়ে।
‘বিদ্রোহী’র ‘ভীম ভাসমান মাইন’রূপী কবি হায়দরী হাঁক হেঁকে সর্বদা চলতে গিয়ে, মহারণের মহা সেনানী হতে গিয়ে নিজেই নিজের সাম্পান ভাঙা বলে গান গেয়ে ওঠেন। কবি বুঝে উঠতে পারেননি অস্থির সময়কে মোকাবেলার সঠিক উপায় ও উপযোগ। কবির এই অস্থিরতার চলচ্চিত্র যেন অনূদিত হয়েছে তাঁর কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে। হৈ হৈ নজরুলের পানের রস হতে জন্ম হওয়া ‘মৃত্যুক্ষুধা’তে কবি এক অস্থির সময়কে ধরে রেখেছেন তাঁর শব্দচাতুর্যে। কিন্তু সেই সৃজনশস্যেও নজরুল অধীর ছিলেন তাঁর মনের অন্তরঙ্গন থেকে। ফলে ঔপন্যাসিক হিসেবে নজরুলের জন্ম হলেও জন্মতিথির সেই কালবোশেখীর ঝঞ্ঝা কাটেনি। অস্থির নজরুলের অস্থিরতা তাঁর প্রেমে ও বিবাহে যেমন জীবনকে তোলপাড় করে দিয়েছে তেমনি ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ দিয়েও নজরুল অস্থির করে তুলেছেন রাজপথকে। কেবল সাহিত্যের জন্যে অস্থির নজরুলই কারাগারে স্থির হয়েছিলপন কিছুূদিন। কিন্তু তা আর হলো কই! ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ দিয়ে কবি আবার অস্থির করে তুললেন বাংলার আকাশ-বাতাস। সেই অস্থিরতায় কেঁপেছে যেমন বৃটিশরাজ তেমনি কেঁপে উঠেছেন স্বয়ং কবিগুরু। ‘গিভ আপ ইয়োর হাঙ্গার স্ট্রাইক’ বলে কবিগুরু যে অস্থিরতা উপশমের আহ্বান জানিয়েছেন, সে অস্থিরতা কাঁধে নিয়েই নজরুল শেষমেষ মহা পরমের মহা প্রাঙ্গণে বাকহীনতার অস্থিরতা নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন চৌত্রিশটা বছর।
গ্রামোফোন কোম্পানীর সঙ্গীত পরিচালক গাড়ি হাঁকিয়ে চলার পরও অস্থিরতার জন্যেই কবি নজরুলকে শেষমেষ আবারও সেই দারিদ্র্যকে সহ্য করতে হয়। আর দারিদ্র্যই তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিল, ‘হে দারিদ্র্য তুমি যে মহান...।’ ওয়াহিদ বক্সের রুটির দোকানে কাজ করা ছেলেটি যখন দিনের বেলা রুটি বানিয়ে গভীর রাতে পড়াশুনা করতো তখন মনে হচ্ছিলো অস্থিরতার বুঝি হলো অবসান। কিন্তু দরিরামপুর হতে বহুঘাটের পানি খেয়ে দুখু মিয়া হয়ে ওঠে কবি কাজী নজরুল। তবু তাঁর কাব্যের অস্থিরতা কাটেনি। কাটেনি বলেই কবিকে বলতে শুনি, ‘জীবনে দীপ যদি জ্বালাতে নাহি পারো সমাধি পরে মোর জ্বেলে দিও।’
নজরুলের রচনা একদিকে যেমন সমকালকে ধারণ করে তেমনি অন্যদিকে হয়ে ওঠে স্বদেশ ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক। তুরস্কের কামাল পাশার সেক্যুলারিজম যেমন তাঁকে আপ্লুত করে তেমনি কবি জন কীটস্-এর সৌন্দর্যবোধ তাঁকে বিনির্মাণ করে। নজরুল তাই একাধারে বিউটিফুল ও ডিউটিফুলের কবি। কিন্তু তবু তাঁর মনে অপ্রাপ্তির দুঃখ। সারাজীবন যে রিক্তের বেদন তিনি বয়ে বেড়িয়েছেন, শেষমেষ তারই যাতনায় তিনি একথা বলে চির বিদায় নিয়েছেন,... ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব তবু আমারে দেব না ভুলিতে।’ নজরুল তাঁর কথা রেখেছেন। কেউ ভোলেনি তাঁকে। তিনি তাঁর রচনার স্বরূপে ধারণ করে আছেন মুগ্ধ চৈতন্যের চাতকতুল্য পাঠককূলকে।