বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

বঙ্গবন্ধু-বচন ও প্রবাদ-প্রবচন
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

বঙ্গবন্ধু একজন অসাধারণ সাহিত্যিক। তাঁর পাঠ-বিশ্ব যেমন সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত তেমনি তাঁর লেখার সাহিত্যমূল্যও শিল্পমান উত্তীর্ণ। তিনি একদিকে যেমন দক্ষিণ বঙ্গের আঞ্চলিক টানে কথা বলতেন, তেমনি তাঁর লেখায় প্রমিত ভাষার গাঁথুনিও চমৎকার। তিনি যেমন শ্লেষ ব্যবহারে অভ্যস্ত তেমনি রস-রচনাতেও সিদ্ধহস্ত। তাঁর মুখের ভাষা এবং রচনায় প্রচুর বাগধারা ও প্রবাদ-প্রবচনের ব্যবহার লক্ষণীয়। এর মাধ্যমে তাঁর শিক্ষাগত সামর্থ্য পরিস্ফুটিত হয়। আবার কতিপয় মুজিবীয় বচনও লক্ষণীয় যা অনায়াসে প্রবচনে রূপ পেতে পারতো। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠে এ রকম বেশকিছু মুজিবীয় প্রবচন ও প্রবাদ-প্রবচনের সন্ধান পাওয়া গেছে। নি¤েœ তাদের কয়েকটিকে আলোচনায় আনা হলো।

ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ১. একজন মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী গোটা বিলাত শহর কিনতে পারত।

প্রবাদ-প্রবচনের অর্থ ও ব্যাখ্যা : বাংলা ভূমি সেই আদি কাল থেকেই সম্পদে ধনী ছিলো। চর্যাপদের পদকর্তাদের লেখা থেকেই আমরা জানতে পাই, তখন হরিণের নিজের মাংস যেমন তার প্রাণনাশের কারণ ছিল, তেমনি বাংলার অঢেল সম্পদও এ ভূমিকে লুণ্ঠনের জন্যে দায়ী ছিলো। একে একে বর্গী থেকে শুরু করে পাঠান-মোগলেরা এসে বাংলাকে শোষণ করে গেছে। যখন ইংরেজ আসে এ অঞ্চলে, তখন এক একজন মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ীরই এমন সম্পদ ছিল যা খোদ বিলাত বা লন্ডনে ছিলো না। তখনকার সমৃদ্ধি আমাদের সারাবিশ্বে খ্যাতিমান করে তুলেছিল এবং ইংরেজরা সেই সমৃদ্ধির অধিকাংশই লুট করে বিলাতে নিয়ে যায়। মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ীদের আর্থিক সামর্থ্য তখন প্রবাদের মতো প্রচলিত হয়ে যায় ভারতবর্ষ জুড়ে।

বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাক্যে ব্যবহার : ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যখন বাংলাদেশ দখল করে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায়, তখন বাংলার এত সম্পদ ছিল যে, একজন মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী গোটা বিলাত শহর কিনতে পারত। (১৮ পৃঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান)

প্রাসঙ্গিক কথা : ১৯৪৩ সালে খাজা নাজিমুদ্দীনের প্রধানমন্ত্রীত্বকালে তার ভাই দুর্নীতিগ্রস্ত খাজা শাহাবুদ্দীন ছিলেন শিল্পমন্ত্রী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী। এ সময় তীব্র দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে যায়। ইংরেজরা যুদ্ধের জন্য নৌকা বাজেয়াপ্ত করে এবং সৈন্যদের খাবার রসদ যোগাতে ধান-চালের গুদাম জব্দ করে। ব্যবসায়ীরা দশ টাকা মণ চাল চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি করে এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে। জনগণকে বাঁচাতে শেখ মুজিবের তাগিদে সোহরাওয়ার্দী রাতারাতি সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট গড়ে তোলেন। গ্রামে গ্রামে লঙ্গরখানা খোলেন। দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার থেকে বজরায় করে আটা, গম, চাল সাহায্য আনাতে শুরু করলেন। কিন্তু ইংরেজদের নীতি ছিল, বাংলার মানুষ যদি মরে তো মরুক, যুদ্ধের সাহায্য আগে। যুদ্ধের সরঞ্জাম প্রথম স্থানে রাখতে হবে। আক্ষেপ করে তাই শেখ মুজিব বলেন, যুদ্ধ করে ইংরেজ আর না খেয়ে মরে বাঙালি; যে বাঙালির কোন কিছুরই অভাব ছিল না। এই দুঃখে আক্ষেপ করে শেখ মুজিব মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ীদের এককভাবে আর্থিক সামর্থ্যরে কথা স্মরণ করে বিলাত কিনতে পারার ক্ষমতার সাথে তুলনা করেন।

ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ২. এমন উর্বর জমি দুনিয়ায় খুব অল্প দেশেই আছে।

প্রবাদ-প্রবচনের অর্থ ও ব্যাখ্যা : বাংলাদেশের ভূমি হলো পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বরতম ভূমি। যে কোন বীজ এই মাটিতে পড়লে অনায়াসে তা হতে অঙ্কুরোদ্গম হয়ে চারা গজায়। এই মাটিতে বছরে তিনটি ফসল ফলে অনায়াসে। ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে খুব উর্বর এই মাটি পৃথিবীতে অনন্য ও বিরল। এটি যেমন ধ্রুব সত্যের পরিণতি লাভ করেছে তেমনি প্রবচন হিসেবেও তা গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। কেবল যে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রেই এ ভূমি উর্বর তা কিন্তু নয়, এখানে যে কোন মতবাদের চর্চাও খুব সহজে মানুষের মনের উর্বর জমিতে সফলতা পায়।

বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাক্যে ব্যবহার : সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি খুব কম দেশেই আছে। তবুও এরা গরীব। (পৃঃ ৪৮, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান)

প্রাসঙ্গিক কথা : এত উর্বর ভূমি সত্ত্বেও কেন বাঙালিরা পৃথিবীতে উন্নতি করতে পারেনি, তার কারণ সন্ধান করতে গিয়ে শেখ মুজিব ‘পরশ্রীকাতরতা’কে বাঙালির অন্যতম অন্তরায় বলে উল্লেখ করেন। বাঙালির পরশ্রীকাতরতা এতো বেশি প্রগাঢ় যে, ভাইও ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। আর এ কারণেই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। নিজেকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না ততদিন বাঙালির মুক্তি আসবে না।

ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ৩. তারা ছায়া দেখলেও গুলি করে।

ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচনের অর্থ ও ব্যাখ্যা : মিলিটারির মধ্যে যারা ক্ষিপ্র ও অতি তৎপর, তারা হলো দাঙ্গা দমনকারী। এরা এতই প্রশিক্ষিত যে কারো ছায়া দেখলেও ঠিক ঠিক নিশানা করে তাকে গুলিবিদ্ধ করতে পারে। মহাভারতের অর্জুন যেমন নিচে কুয়োর পানিতে মাছের চোখের ছায়া দেখে ওপরের চানমারী মাছকে বিদ্ধ করতে পেরেছিল, তেমনি এই দাঙ্গা দমনকারী মিলিটারিরাও দাঙ্গাবাজদের ছায়া দেখলেই গুলি ছুড়ে লক্ষ্যভেদ করতে পারে।

বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাক্যে ব্যবহার : তারা ছায়া দেখলেও গুলি করে। উপায় নাই। (পৃঃ ৬৭, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান)

প্রাসঙ্গিক কথা : ১৯৪৬-এর দাঙ্গায় শেখ মুজিব ও সিলেটের মোয়াজ্জেম চৌধুরীর ওপর দায়িত্ব বর্তেছিল পার্ক সার্কাস ও বালিগঞ্জের মাঝখানে বিদ্যমান মুসলমান বস্তিটি পাহারা দেয়ার। তারা বস্তিতে পৌঁছানোর আগেই কারফিউর সময় শুরু হয়ে যায়। মিলিটারির কারফিউ এড়িয়ে তারা অনেক কষ্টে পার্ক সার্কাস ময়দানের পেছনে আসেন। তারপরে পৌঁছান সওগাত প্রেসের মালিক ও পত্রিকার সম্পাদক নাসিরউদ্দীন সাহেবের বাসার কাছাকাছি। সেখান থেকে আর একটা রাস্তা পার হয়ে এক বন্ধুর বাড়িতে ঢুকে কোনমতে প্রাণে বাঁচলেন। কিন্তু কিছুতেই বন্ধুর বাবা-মা তাদের বের হতে দিতে রাজি ছিলেন না। কারণ এই মিলিটারিরা অত্যন্ত প্রশিক্ষিত, যারা ছায়া দেখেই লক্ষ্য ভেদ করতে পারে। তাই বাধ্য হয়েই রাতটা তাঁদের সেই বাড়িতেই কাটাতে হলো। ফলে আর জায়গামতো পৌঁছাতে পারলেন না।

ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ৪. চোরের বাড়িতে দালান হয় না।

প্রবাদ-প্রবচনের অর্থ ও ব্যাখ্যা : চুরি করে অর্জিত অর্থে যে সম্পদ তৈরি হয় তাতে জড়িয়ে থাকে বহু মানুষের চোখের জল আর হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। এই টাকায় যে কিছুই হোক না কেন তাতে অভিশাপের অনল জ্বলতে থাকে। ফলে হাজারো চেষ্টা করলেও চোর তার বাড়ি নির্মাণ করতে পারে না।

বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাক্যে ব্যবহার : চোর রহিম মিয়ার নিজের জীবন নিয়ে আক্ষেপ শুনে শেখ মুজিবুর রহমান নিজে তা লিপিবদ্ধ করেন নিম্নোক্তভাবে :

“আপনাদের বাড়িতে চুরি করে যখন কিছু হল না, তখন ঘোষণা করলাম, লোকে বলে চোরের বাড়িতে দালান হয় না, আমি দালান দিব”। (পৃঃ ১৮১, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান)

প্রাসঙ্গিক কথা : গোপালগঞ্জ থানার ভেন্নাবাড়ি গ্রামের রহিম একজন কুখ্যাত চোর। সে ডাকাতিও করতো। তার মতো সেয়ানা ডাকাত ওই তল্লাটে আর ছিলো না। রহিম মিয়া শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে ঢুকে তাঁর মা-বোনদের সোয়াশ’ ভরি গহনা আর নগদ বেশকিছু টাকা চুরি করেছিলো। তাকে বহুদিন পরে মুজিব কারাগারে দেখতে পান। চোর নিজেই পরিচয় দেয়। এক পর্যায়ে সে তার জীবনের দুঃখের ঘটনা বর্ণনা করে আর শেখ মুজিব নিজে তা লিপিবদ্ধ করেন। এ সময়েই চোর নিজে বলে ওঠে, লোকে বলে চোরের বাড়িতে দালান হয় না, তবু সে নিজেই দালান দিবে।

ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ৫. বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মতো উড়ে বেড়ায়।

প্রবাদ-প্রবচনের অর্থ ও ব্যাখ্যা : মানুষের মন তার আবাসের প্রকৃতির সাথে খাপ খেয়ে চলে। যার বাসভূমি যেমন, তার মনঃভূমিও সে অনুযায়ী গড়ে উঠে। পার্বত্য এলাকার মানুষের মন হয় পাহাড়ি প্রকৃতির মত খোলা। যারা সমুদ্রের কাছে থাকে তারা হয় সমুদ্রের মত উদার। আমরা যারা পলিমাটি এলাকার মানুষ, আমাদের মন হয় কাদামাটির মত কোমল। ঠিক তেমনি যারা ঊষর মরু এলাকার মানুষ, তাদের মন হয় মরুভূমির মতই রুক্ষ আর বাতাসের বেগে উড়ে যাওয়া বালির মতোই শেকড়হীন।

বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাক্যে ব্যবহার : প্রকৃতির সাথে মানুষের মনেরও একটা সম্বন্ধ আছে। বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মত উড়ে বেড়ায়। (পৃঃ ২১৪, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান)

প্রাসঙ্গিক কথা : লাহোরে তাঁর রাজনৈতিক গুরুর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সেই সুবাদে প্রথমবারের মত করাচিও ভ্রমণ করেন। করাচি ছিল তখনকার পাকিস্তানের রাজধানী। কিন্তু চারদিকে ধু ধু বালু দেখে শেখ মুজিবের মন উচাটন হয়ে উঠল। তিনি পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব বাংলার ভূমিরূপের তুলনা করে তার সাথে মনের সম্পর্ক তুলে ধরলেন আপন মনে। মরুভূমির পাষাণ বালুর চেয়ে আমাদের নরম পলিমাটিই উত্তম। বাংলার মানুষের মন ওই রকমই কোমল, ওই রকমই সবুজ। প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যে আমাদের জন্ম, সৌন্দর্যই আমরা ভালোবাসি।

ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ৬. কাঁধে পাড়া দিয়ে ইলেকশন পাস করা।

প্রবাদ-প্রবচনের অর্থ ও ব্যাখ্যা : নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে গেলে কারও না কারও কাঁধে ভর করতে হয়। কোন একটা দলের জনপ্রিয়তাকে ব্যবহায় করেই নির্বাচনে ভোটারদের রায় জয় করে নিতে হয়। এভাবেই নির্বাচনে জয় আসে। নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার এটা একটা জনপ্রিয় কৌশল। পাথরে পা রেখে যেমন কাদা পার হতে হয়, তেমনি কেউ গরীবের কাঁধে পাড়া না দিয়ে ধনী হতে পারে না। নির্বাচনী প্রকৌশলেও তাই।

বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাক্যে ব্যবহার : আওয়ামী লীগের কাঁধে পাড়া দিয়ে ইলেকশন পাস করতে চায়, তারপর তাদের পথ বেছে নেবে। (পৃঃ ২৪৭, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান)

প্রাসঙ্গিক কথা : চুয়ান্ন সালের নির্বাচনে পাস করার জন্যে মুসলিম লীগের সভ্যরা আওয়ামী লীগের সুবিধা পেতে চেয়েছিলো। তাই তারা আওয়ামী লীগের সাথে যুক্তফ্রন্ট করতে চায়। এ কারণেই শেখ মুজিব ক্ষিপ্ত হয়ে মাওলানা ভাসানীকে বলেছিলেন যে, ওরা আওয়ামী লীগের কাঁধে পাড়া দিয়ে ইলেকশন পাস করতে চায়। মাওলানা সাহেব যদি কাউন্সিল সভায় থাকতে না চান, তবে শেখ মুজিব টেলিগ্রাম করে সভা বন্ধ করে দেবেন বলে ভাসানীকে সতর্ক করে দেন।

আমার দেখা নয়াচীন

ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ৭. সুযোগ পেলে চীন দেশে যাওয়া।

প্রবাদ-প্রবচনের অর্থ ও ব্যাখ্যা : প্রাচীনকাল থেকেই চীন জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত। প্রাচীন চৈনিক সভ্যতা জগদ্বিখ্যাত। নবীজি (সাঃ)-এর পবিত্র হাদিসেও আছে জ্ঞানার্জনে সুদূর চীন দেশে যাওয়ার কথা। পিকিং সভ্যতা জগতের সেরা সভ্যতার একটি। তাই একথা আজও বিভিন্ন সময়ে বলা হয়, সুযোগ পেলে চীন দেশে যেন যায়।

বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাক্যে ব্যবহার : জেলে থাকতে ভাবতাম আর মাঝে মাঝে মওলানা ভাসানী সাহেবও বলতেন, ‘যদি সুযোগ পাও একবার চীন দেশে যেও।’ (পৃঃ আমার দেখা নয়াচীন, শেখ মুজিবুর রহমান)

প্রাসঙ্গিক কথা : চিয়াং কাইশেকের নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে চীন নয়া চীন হিসেবে গড়ে ওঠে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির হাতে। অল্পদিনের মধ্যেই তারা খুব দ্রুত অনেক উন্নতি করেছে। চীনের খবর তৎকালীন পাকিস্তানে বেশি আসতে দেয়া হতো না। তবুও যা পাওয়া যেত, তার ভিত্তিতেই শেখ মুজিবের নয়া চীনকে দেখতে খুব মন চাইতো। ভাসানী সাহেবের পরামর্শও নয়া চীনকে দেখার দৃঢ় ইচ্ছে তৈরি করে তরুণ শেখ মুজিবের মনে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে নয়া চীনের বর্ষপূর্তির শান্তি সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ আসে তরুণ শেখ মুজিবের কাছে। আর একারণেই শেখ মুজিবের মনে চীনে যাওয়ার প্রবাদ মনে পড়ে যায়।

ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ৮. জনসমর্থন ছাড়া বিপ্লব হয় না।

ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচনের অর্থ ও ব্যাখ্যা : বিপ্লব সহজ কোন ব্যাপার নয়। একটি আন্দোলন বা আদর্শকে নিয়ে রাষ্ট্র বা সমাজকে পাল্টাতে হলে শুধুমাত্র দলীয় নেতা-কর্মী দিয়ে হয় না, থাকতে হয় রাষ্ট্রের জনগণ বা সমাজের লোকজনের সমর্থন ও অংশগ্রহণ। জনগণের সমর্থন ছাড়া বিপ্লব মুখ থুবড়ে পড়ে, সফল হয় না।

বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাক্যে ব্যবহার : এর কারণ কী? কারণ জনগণের সমর্থন ছাড়া বিপ্লব হয় না। সংগ্রামরত কম্যুনিস্টদের একটা সুবিধা তারা কারেন সম্প্রদায়ের সমর্থন পেয়ে। (পৃঃ ২৪, আমার দেখা নয়া চীন, শেখ মুজিবুর রহমান)

প্রাসঙ্গিক কথা : চীন সফরের সূচনায় তাঁরা রেঙ্গুনে ট্রানজিট পেলেন। অল্প সময়ে বার্মাকে জানার সুযোগ পেয়ে শেখ মুজিব সে দেশের কম্যুনিস্ট ও কারেন সম্প্রদায়ের সরকারের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ বা বিপ্লবের কথা অবহিত হন। তাঁর ভাষ্যে কমিউনিস্টরা কেবলমাত্র কারেন জনগোষ্ঠী ছাড়া বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমর্থন পায়নি দেখে তাদের বিপ্লব সফল হয়নি।

ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ৯. মিয়া বাড়ি খাবার নাই, বাহির বাড়ি বড় কাচারি।

প্রবাদ-প্রবচনের অর্থ ও ব্যাখ্যা : বাড়িতে খাবার নাই কিন্তু বাইরে বেজায় ঠাঁট বজায় আছে। অনাহারে ঘরের লোকদের ত্রাহি অবস্থা অথচ ঠাঁটবাট বজায় রাখে মিয়ার বাড়ির মিয়ারা। এটা এক ধরনের তীব্র শ্লেষ। গরীব মানুষের ফুটানি বেশি হওয়ার মতো।

বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাক্যে ব্যবহার : আমাদের দেশে গ্রামে একটা কথা আছে, ‘মিঞা বাড়ি খাবার নাই, বাহির বাড়ি বড় কাচারি, দশা হয়েছে তাই। (পৃঃ ৪৬, আমার দেখা নয়া চীন, শেখ মুজিবুর রহমান)

প্রাসঙ্গিক কথা : নয়া চীনের শান্তি সম্মেলনে দক্ষিণ আমেরিকার এক দেশের ডোলিগেট শেখ মুজিবকে প্রশ্ন করেন, পাকিস্তান কি একটা আলাদা স্বাধীন দেশ নাকি ইন্ডিয়ার একটা প্রদেশ? এরকম একটা বোকা প্রশ্ন শুনে শেখ মুজিব থ বনে গেলেন। তাঁর মনে হলো, পৃথিবী কিংবা রাজনীতির কোন খবর রাখে না, এই লোক শান্তি সম্মেলনে হয়তো দলে পড়ে এসেছে।

আবার অন্য একজন বিদেশি বন্ধুর শালা এক চিঠি দেখালেন যাতে লেখা ঠিকানা, ‘পাকিস্তান-ইন্ডিয়া।’ এসব দেখে শেখ মুজিব পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতদের খরচের বহর আর প্রচারণার দুর্বলতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের কাজ হলো নিজদেশ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে প্রচারণা চালানো। অথচ পাকিস্তান যে স্বাধীন দেশ, এটাই জানে না অনেকে।

ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন : ১০. তখনতো ইয়া নফ্ছি ইয়া নফ্ছি ডাক ছাড়তে!

প্রবাদ-প্রবচনের অর্থ ও ব্যাখ্যা : ইয়া নফ্ছি ইয়া নফ্ছি মানেই হলো আর্তনাদ করা, হে আল্লাহ্ আমাকে বাঁচান। স্রষ্টার কাছে প্রাণ বাঁচানোর আবেদন করাই এ প্রবাদের মূল কথা। মানুষ যখন চূড়ান্ত বিপদে পতিত হয় তখন স্রষ্টাকে ডাকে। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে তখন আর কোন দিকেই তার খেয়াল থাকে না।

বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাক্যে ব্যবহার : চিয়াং কাইশেকের সময় তো এত নাচ নাই। তখন তো ইয়া নফ্ছি ইয়া নফ্ছি ডাক ছাড়তে। (পৃঃ ৫৭, আমার দেখা নয়া চীন, শেখ মুজিবুর রহমান)

খদ্দের কোথায়? সকলেরই তো ইয়া নফ্ছি ইয়া নফ্ছি। (পৃঃ ৬১, আমার দেখা নয়াচীন, শেখ মুজিবুর রহমান)

প্রাসঙ্গিক কথা : লিবারেশন ডে-এর উৎসবে চীনে সন্ধ্যায় বাজি পোড়ানোর উৎসবে সবাই নাচানাচি-হুড়োহুড়ি করছিলো। প্রায় লাখখানেক লোক বেশকিছু এলাকাজুড়ে গান-বাজনা, ফূর্তি ও হুড়োহুড়ি শুরু করে দিয়েছে। বাজি পোড়ানো দেখে শেখ মুজিবের নতুন কিছু মনে হলো না। তিনি এসব তাঁর গ্রামের এলাকায় দেখেছেন। তাদের নাচন-কুর্দন দেখে শেখ মুজিব মনে মনে বলেছিলেন, চিয়াং কাইশেকের সময় তো এত নাচ নাই। কারণ তখন পেটে খাবার ছিলো না। এখন পেটে খাবার পড়েছে কি না তাই নাচও বের হয়। অথচ আগে কেবল মুখ দিয়ে জান বাঁচানোর আবেদনই বের হতো।

আবার, একষট্টি পৃষ্ঠার বর্ণনায় শেখ মুজিব বলেছেন, তাঁর সাথে প্রফেসর হালিমের দেখা হলো, যিনি বই পড়তে ও সংগ্রহ করতে ভালোবাসতেন। চিয়াং কাইশেকের পতনের পর ধনী মানুষগুলো তাদের জিনিসপত্র সস্তায় বিক্রি করে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পালিয়ে যাচ্ছিলো। এ সময় বইয়ের বড় লাইব্রেরির মালিকও সস্তায় তার সব বই বিক্রি করার ঘোষণা দিলো। কিন্তু খদ্দের পাবে কোথায়? সবারইতো তো ইয়া নফ্ছি ইয়া নফ্ছি। আগে প্রাণে তো বাঁচুক। এই উছিলায় নিজের জীবনের সঞ্চয় দিয়ে তিনি সস্তায় বই কেনা শুরু করলেন বেছে বেছে, যাতে পরবর্তীকালে তিনি নিজেই একটা বড় বইয়ের দোকানের মালিক হতে পারেন।

ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ১১. লাঙল যার জমি তার।

প্রবাদ-প্রবচনের অর্থ ও ব্যাখ্যা : কৃষকের হাতিয়ার হলো লাঙল। লাঙল দিয়ে জমি চাষ করেই তাতে ফসল উৎপাদন করা হয়। কাজেই প্রকৃত অর্থে কৃষকই জমির মালিক। জমির মালিক জমিদার কিংবা সরকার যদি হয় তবে তাতে কৃষক ঠকতে পারে, জমি পতিত হয়ে থাকতে পারে, সময়মত ফসল চাষ না-ও হতে পারে। লাঙল যার জমি তার প্রবাদটি কৃষক ও জমিদারের মধ্যকার চিরকালীন দ্বন্দ্বের সমাধান খোঁজার অনন্য চেষ্টা। এক সময় কৃষক তার শ্রমে-ঘামে ফসল ফলিয়ে তিনভাগ জমির মালিককে দিতে হতো আর একভাগ নিজে নিতে পারতো। এতে কৃষকের সাংবাৎসরিক খাদ্য-চাহিদা মিটত না। এজন্যই যে প্রকৃত কৃষক, জমি তারই হওয়া উচিত, মহাজন বা জমিদারের নয়। এটা অনেকটাই ‘জাল যার জলা তার’ প্রবাদের সমার্থক।

বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাক্যে ব্যবহার : নয়া চীন সরকার কায়েম হওয়ার পরে তারা প্রথম কাজ শুরু করলেন, ‘লাঙল যার জমি তার’ এই প্রথা প্রবর্তনের মাধ্যমে। (পৃ ৮৯, আমার দেখা নয়া চীন, শেখ মুজিবুর রহমান)

প্রাসঙ্গিক কথা : চিয়াং কাইশেককে অপসারণ করে নয়াচীন সরকার গঠিত হওয়া মাত্রই তারা কৃষিতে আমূল বিপ্লব নিয়ে আসে। বড় বড় জমিদারদের জমি বাজেয়াপ্ত করে গরিব জমিহীন কৃষকদের মধ্যে বন্টন করে দিলো। সত্যিকারের কৃষক জমির মালিক হলো। যে সমস্ত অনাবাদী খাস জমি পড়েছিলো, তাও ভাগ করে দিলো কৃষকদের মধ্যে। হাজার হাজার বেকার কৃষক জমি পেলো। কৃষকেরা যখন বুঝলো জমির মালিক তারা, তাদের শ্রমের ফসল আর ফাঁকি দেয়ে জমিদার নিতে পারবে না, তখন তারা পুরো উদ্যমে চাষাবাদ শুরু করলো। এভাবেই 'লাঙল যার জমি তার' প্রথাটি নয়া চীনকে কৃষিতে বিপ্লব এনে দিলো।

ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ১২. প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্য ,সকলেই সকলের জন্য।

প্রবাদ-প্রবচনের ব্যাখ্যা : মানুষ সামাজিক জীব। সে দলে থাকতে পছন্দ করে। একজন আরেকজনের প্রয়োজনে বা বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে, পাশে দাঁড়ায়। এভাবে সামাজিক শক্তির সমবায়ের মাধ্যমে মানুষ জীবনের জয়গান গায়। কেবল নিজেকে নিয়ে আপন স্বার্থ চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকা মানুষের প্রকৃতি নয়। মানুষ সামগ্রিক শুভবোধ ও কল্যাণবোধের মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতায় হাত বাড়িয়ে দেয়। সুখে-দুঃখে একে অপরের পাশে থেকে পৃথিবীতেই রচনা করে তোলে স্বর্গ।

বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাক্যে ব্যবহার : ‘প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্য, সকলেই সকলের জন্য’, এই নীতির খুব প্রচার হয়েছে এবং কাজও সেইভাবে হতেছে। (পৃঃ ৯১, আমার দেখা নয়া চীন, শেখ মুজিবুর রহমান)

প্রাসঙ্গিক কথা : নয়াচীনে কম্যুনিস্ট শাসন কায়েম হওয়ার পর একদিকে যেমন ‘লাঙল যার জমি তার’ এই নীতি প্রবর্তনের মাধ্যমে প্রকৃত কৃষকদের হাতে জমির মালিকানা গেলো, তেমনি কৃষকদের মধ্যে ফসল উৎপাদনের উদ্যম তৈরি হলো। এর ফলে গ্রামে গ্রামে ‘মিউচুয়াল এইড সোসাইটি’ গড়ে তুলে সমবায়ের মাধ্যমে গ্রামের গরিব চাষীরা এক হয়ে তাদের চাষাবাদ শুরু করে। এই সমবায়কে ইংগিত করেই শেখ মুজিব ‘প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্য, সকলেই সকলের জন্য’ নীতির উল্লেখ করেছেন।

ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ১৩. সত্য মিথ্যা খোদা জানেন।

প্রবাদ-প্রবচনের অর্থ ও ব্যাখ্যা : মানুষ কখনোই পরম সত্য বা পরম মিথ্যা নিরূপণ করতে পারে না। মানুষ যা পারে তা হলো আপেক্ষিক সত্য ও আপেক্ষিক মিথ্যা নির্ণয় করা। প্রকৃত সত্য ও প্রকৃত মিথ্যা কেবল স্রষ্টা বা খোদাই জানেন। তিনি অন্তর্যামী। যিনি যাপিত জীবনের কষাঘাতে পড়ে দিশেহারা হন, তিনি খোদার কাছে প্রতিকার চেয়ে বিচার দেয়া ছাড়া আর কীইবা করতে পারেন?

বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাক্যে ব্যবহার : আমি বললাম, তাহলে আমরা যা শুনেছি তা মিথ্যা। পীর সাহেব হেসে বললেন, ‘সত্য মিথ্যা খোদা জানেন।’ (পৃঃ ৬৫, আমার দেখা নয়াচীন, শেখ মুজিবুর রহমান)

প্রাসঙ্গিক কথা : চীনে শান্তি সম্মলনে গিয়ে বঙ্গবন্ধু কেবল খোঁজ নিতে তৎপর ছিলেন, দেশে থাকতে চীন সম্পর্কে যা যা শুনেছেন তা সব সত্য কি না। শুনেছিলেন, চীনে কম্যুনিস্টরা ধর্ম-কর্ম পালনে বাধা দেয়। শান্তি কমিটির ভোজসভায় স্থানীয় জামে মসজিদের ইমামকে কাছে পেয়ে তারা ছেঁকে ধরলেন। জানতে চাইলেন, চীনা কমিউনিস্টরা কোরআন-হাদিস পড়তে দেয় কি না, নামাজ-রোজা করতে দেয় কি না। ইমাম সাহেব আরবী-ফার্সি জানতেন। ইংরেজি-উর্দু জানতেন না। পীর মানকি শরীফ ফারসি জানতেন। দুজনেই ফারসিতে আলাপ করে আসল চিত্র পেলেন। পীর মানকি শরীফ ইমাম সাহেবকে প্রশ্ন করে জানলেন, চীনে মুসলিমদের ধর্ম পালনে কোন বিধি-নিষেধ নেই। তারা ছেলে-মেয়েদের কোরআন-হাদিস পড়াতে পারেন, নামাজ-রোজাতেও কোন বাধা নেই। এ কথা নিজ কানে শুনে শেখ মুজিব বিস্ময়ে পীর মানকি শরীফের কাছে নিজের আবেগ প্রকাশ করে বলেন, দেশে থাকতে যা শুনেছিলেন তা তাহলে মিথ্যে! এর উত্তরে কোন উপযুক্ত জবাব না থাকায় পীর মানকি শরীফ সৃষ্টিকর্তার ওপর তার ভার তুলে দেন।

ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ১৪. ক্ষমাই মহত্ত্বের লক্ষণ।

প্রবাদ-প্রবচনের অর্থ ও ব্যাখ্যা : পৃথিবীতে ক্ষমা করতে পারার চেয়ে বড় গুণ আর নেই। যিনি ক্ষমা করতে পারেন তিনিই মহৎ। চরম শত্রুকেও ক্ষমা করে দিয়ে উদারতা যে দেখাতে পারে সে ব্যক্তি মহত্ত্বম। ক্ষমা তাই একটি স্বর্গীয় গুণ।

বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাক্যে ব্যবহার : তেমনি আবার দেখা দিলো খ্রিস্ট ধর্মের মধ্যে, যেখানে ক্রাইস্ট বলে দিয়েছেন, ‘এক মুখে আঘাত করলে আরেক মুখ এগিয়ে দাও, ক্ষমাই মহত্ত্বের লক্ষণ’। (পৃঃ ১১১, আমার দেখা নয়াচীন, শেখ মুজিবুর রহমান)

প্রাসঙ্গিক কথা : দেশ বিভাগের সময় সিলেট পূর্ববঙ্গে তথা পাকিস্তানে যাবে না ভারতের অংশ হয়ে থাকবে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল। কংগ্রেসী মাওলানা আর পীর সাহেবেরা সিলেটকে ভারতের অংশ করে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী সাহেব ও শেখ মুজিব চেয়েছিলেন সিলেট পাকিস্তানে যোগ দিক। শেখ মুজিবুর রহমান যখন বক্তব্য দিতে দাঁড়ালেন, তখন কংগ্রেসী পীর সাহেবেরা মাইক্রোফোন ব্যবহারকে হারাম বলে ফতোয়া দেন। শেখ মুজিব তাদের দেয়া হারামণ্ডহালালের ফতোয়া মানতেন কম। কারণ তা মানলে পাকিস্তান হতো না। চীন সফরে গিয়ে শেখ মুজিব ধর্মীয় কুসংস্কার বিষয়ে বলতে গিয়ে এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করে বলেন, মুসলিমদের মধ্যে যেমন ধর্মীয় কুসংস্কার আছে, তেমনি কুসংস্কার বেশি ছিল বৌদ্ধদেরও। আর খ্রিস্টানরা দুনিয়ার অনুন্নত দেশগুলোকে শোষণ করার জন্য যুদ্ধ করে। অথচ স্বয়ং ক্রাইস্ট বলে গিয়েছেন, ‘ক্ষমাই মহত্ত্বের লক্ষণ, এক মুখে আঘাত করলে আরেক মুখ এগিয়ে দাও।’ কিন্তু তারা ক্রাইস্টের সে আহ্বান থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে।

ব্যবহৃত প্রবাদ-প্রবচন ১৫. একমুখে আঘাত করলে আরেক মুখ এগিয়ে দাও।

প্রবাদ-প্রবচনের অর্থ ও ব্যাখ্যা : শত্রুকে শত্রুতা দিয়ে জয় করা যায় না। কেউ যদি একগালে মারে তাকেও প্রত্যুত্তরে একগালে মেরে শোধ নেয়ার মধ্যে শত্রুতার উপশম হয় না, বরং এতে আরও শত্রুতা বাড়ে। তাই কেউ একগালে চড় মারলে বরং তাকে প্রত্যাঘাত না করে আরেক গাল পেতে দেয়া উচিত। এতে আঘাতকারীর বোধোদয় হতে পারে। এটি মূলত বাইবেলের কথা।

বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাক্যে ব্যবহার : ক্রাইস্ট বলে দিয়েছেন, ‘এক মুখে আঘাত করলে আরেক মুখ এগিয়ে দাও, ক্ষমাই মহত্ত্বের লক্ষণ’। (পৃঃ ১১১, আমার দেখা নয়া চীন, শেখ মুজিবুর রহমান)

প্রাসঙ্গিক কথা : নয়া চীনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার মূলোৎপাটনের কথা বলতে গিয়ে শেখ মুজিব এক পর্যায়ে চিয়াং কাইশেকের আমলের চীন ও কামাল আতার্তুকের তুরস্কের তুলনার অবতারণা করেন। প্রসঙ্গক্রমে মুসলিমদের মধ্যে কুসংস্কার চর্চার বাড়াবাড়ির কথা বলতে গিয়ে তিনি বৌদ্ধ ও খ্রিস্ট ধর্মের কুসংস্কার চর্চাকেও উল্লেখ করেন। তিনি এই ভেবে মর্মাহত হন যে, আজকের খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসিরা যীশুর ক্ষমার বাণী ভুলে গিয়ে, একগালে আঘাতের বদলে প্রত্যাঘাত নয়, আরেক গাল পেতে দেয়ার আহ্বানকে পাশ কাটিয়ে ক্ষুদ্র ও গরীব দেশগুলোতে যুদ্ধ বাধায় আর শোষণ করে। অথচ খ্রিস্ট ধর্মই হলো মানবপ্রেমের ধর্ম।

মুজিব একজন রাজনীতির কবি। তাঁর ভাষণ যেমন মহাকাব্যিক তেমনি তাঁর লেখাও সত্যিকারের সাহিত্যগুণে সুখপাঠ্য। তাঁর ভাষণ ও তিনটি গ্রন্থ অধ্যয়ন করে আমরা একজন মহান সাহিত্যিকের দেখা পেয়েছি। উপরের আলোচনায় সেই মুজিবকেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যথাযথভাবে। বঙ্গবন্ধু কেবল তাঁর সংগ্রামে নয়, সাহিত্যের মাধ্যমেও অমর হয়ে থাকবেন বাঙালির মননে-মানসে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়