প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অভিযাত্রীদের একজন রবীন্দ্রনাথ। তিনি সশরীরে কোনো অভিযানে অভিযাত্রী হয়েছেন এ কথা বলা যায় না। যদিও পৃথিবীর অনেক দেশ তিনি ঘুরেছেন। ইউরোপ, রাশিয়া, জাপান, চীন--বাদ পড়েনি কিছুই। তবুও তিনি সশরীরে অভিযাত্রী নন। কিন্তু তাঁর অভিযাত্রা চলেছে নিরন্তর। তিনি বাঙালির চিন্তারাজ্যে অবিরল অভিযাত্রী। শিশু হতে শুরু করে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন অন্দর মহলের নারীদের চিন্তারাজ্যে, স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্যের সংসার-রাজ্যে, এমনকি প্রবীণের চিন্তার দেশেও তিনি ছিলেন অন্তহীন এক অভিযাত্রী। রবীন্দ্রনাথের মতো নিরন্তর অভিযাত্রী না হলে এমন দর্শন-সাহিত্য আর মনোরাজ্যের সকল নিগূঢ় কথা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব ছিলো না।
সেই ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথ যখন ব্রজেশ্বরের হাতে পড়ে কড়া শাসনের যাঁতায় পিষ্ট হচ্ছেন তখন থেকেই তাঁর মধ্যে অভিযাত্রার প্রবণতা তৈরি হয়। 'আমার ছেলেবেলা' শীর্ষক আত্মজৈবনিক গ্রন্থে আমরা পরিণত রবীন্দ্রনাথকে শিশু রবীন্দ্রনাথের কর্মগুলো মূল্যায়ন করতে দেখি। তিনি উল্লেখ করেছেন, শৈশবে বেত নিয়ে রেলিংগুলোতে তিনি ছাত্রজ্ঞানে শাসনের খেলা খেলতেন। সেই থেকে শিশুরাজ্যে অভিযাত্রীর পদধ্বনি আমরা তার মাঝে শুনতে পাই। শিশু রাজ্যে অভিযাত্রী রবীন্দ্রনাথ একেবারে আনকোরা নয়, বেশ পাকা। ‘বীর পুরুষ' কবিতায় এক পাকা অভিযাত্রীর দেখা মেলে। শিশু মননে 'বীর' ভাবার স্বপ্নবিলাস দেখা যায়। শিশুরা বিশেষত নিজেকে মা-দিদির মতো ভয়-কাতুরে চরিত্রগুলোর ক্ষেত্রে বীরত্ব প্রদর্শনে পিছিয়ে রাখে না। মনে করো কালনায়, যেন বিদেশ ঘুরে মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে বলে রবীন্দ্রনাথ সেই যে ডুব দিলেন শিশু মনোরাজ্যে, তা থেকে বের হলেন এক সম্পূর্ণ বীরত্বের কাহিনী আবিষ্কার করে। ডাকাত দলের পুরোটাকে তলোয়ারের ঘায়ে কুপোকাৎ করে বিজয়ী বীর হয়ে অভিযাত্রী রবীন্দ্রনাথ বের করে নিয়ে আসেন বীর পুরুষ ‘শিশু'কে।
শিশুর মনোরাজ্যে কেবল জানার আগ্রহ। রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেন--শিশুর মনে জমে আছে বিপুল প্রশ্ন-ভাণ্ডার। তা থেকেই প্রশ্ন ছেঁকে আনেন--‘মা আমি এলুম কোথা থেকে?', উত্তরও তিনি দেন--'ইচ্ছে হয়ে ছিলি আমার মনের মাঝারে।' প্রতিটি শিশুর চিন্তা রাজ্যে সত্যিই বড়ো উদ্ভট আর কাল্পনিক সব কাণ্ড-কীর্তনে ভরা। মনে আছে হাস্যকর কিছু চরিত্র। রবীন্দ্র--আর যা বলে বলুক অন্য লোক। অভিযাত্রায় সেই চরিত্রগুলোই ফুটে উঠে--‘ক্ষান্তবুড়ি দিদি শাশুড়ি পাঁচবোন থাকে বাঙালি নারীর মনোরাজ্যে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে সহজে ভ্রমণ আর কেউ করতে পারেনি। নারীর উক্তিতে তার প্রমাণ মেলে যখন নারী বলে উঠে,
'বুক ফেটে কেন অশ্রু ঝরে তাও কি বুঝিতে পার না?
তর্কেতে বুঝিবে তা কি? এই মুছিলাম আঁখি--এ শুধু চোখের জল, এ নহে ভর্ৎসনা।'
বাঙালি মেয়ের অযুত কষ্টভার সেতো রবীন্দ্রনাথের অভিযাত্রায় আবিষ্কৃত হয়েছে সবচেয়ে বেশি মর্মস্পর্শী হয়ে। রবীন্দ্রনাথই তো সাধারণ মেয়েকে তার লেখায় তুলে এনে বলেছেন--
'নিজের কথা বলি। বয়স আমার অল্প
একজনের মন ছুঁয়েছিল
আমার এই কাঁচা বয়সের মায়া।
তাই জেনে পুলক লাগত আমার দেহে-
ভুলে গিয়েছিলেম অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে
আমার মতো এমন আছে হাজার হাজার
অল্প বয়সের মন্ত্র যাদের যৌবনে।'
বাঙালি সমাজে একে তো মেয়ে কদরহীন, বাবার ঘাড়ে বোঝা। তার ওপর যদি মেয়ে কালো হয় তবে তো কথাই নেই। কালো মেয়ে মানে হলো বাবার মাথায় একহালি হিমালয়ের চাপ। রবীন্দ্রনাথ কালো মেয়ের মনোরাজ্যে ঘুরে তুলে 'কৃষ্ণকলি'কে তুলে এনেছেন আমাদের সামনে। কৃষ্ণকলি হতে দেবযানীর মনোরাজ্যে রবীন্দ্রনাথ ভ্রমণ করে নারীর চির আকাঙ্ক্ষার রূপটি ফুটিয়ে তুলেছেন নান্দনিকভাবে 'বিদায় অভিশাপ'-এ এসে। আমরা নায়িকার মুখে শুনি কঠোর বাক্য, দেবযানী অভিসম্পাতে বলছে--
'ক্ষমা কোথা মনে মোর !
করেছ এ নারীচিত্ত কুলিশ কঠোর
হে ব্রাহ্মণ ।'.......
রবীন্দ্রনাথ নিজে পুরুষ হলেও সাধারণ বাঙালি পুরুষের মনোরাজ্যে তাঁর অভিযাত্রা অব্যাহত রেখেছেন নিরন্তর। 'পুরুষের উক্তি' জুড়ে রবীন্দ্রনাথ জানান দিয়েছেন--
'আঁখি মেলি যারে ভালো লাগে
তাহারেই ভালো বলে জানি।
সব প্রেম প্রেম নয় ছিল না তো সে সংশয়--
যে আমারে কাছে টানে তারে কাছে টানি।'
সাধারণ পুরুষ হতে ভৃত্যের মনোরাজ্যে চষে রবীন্দ্রনাথ বের করে আনেন চিরকালীন দোষীর এক অভিনব খ্যাতি। এ রকম খ্যাতিতে পুরাতন ভৃত্য সদাসর্বদা তুচ্ছিত হয় গৃহকর্ত্রীর কাছে-
'ভূতের মতো চেহারা যেমন নির্বোধ অতি ঘোর-
যা-কিছু হারায় গিন্নি বলেন, কেষ্ট বেটাই চোর।'
শোষণ হলো বাঙালি সমাজের যেন চিরকালীন প্রথা। বারবার এই প্রথায় পড়ে শোষিত পুরুষ কেবল--
'কহিলাম আমি, তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই/চেয়ে দেখো মোর আছে বড়ো জোর মরিবার মতো ঠাঁই।' - এই বলেই ক্ষান্ত হয়। তার কপালে বিহিত কিছু জোটে না।
গভীর মানবিক দর্শন যার করায়ত্ত, যিনি ছেঁকে আনেন মনন রাজ্য হতে সৃষ্টিশীল মণিমুক্তোমালা--তিনি বাংলার বুড়ো ভামদের তার অভিযাত্রার তালিকা হতে বাদ দিবেনই বা কী করে? 'নিষ্কৃতি' কবিতাতে বুড়ো ভাম, বিপত্নীক, মঞ্জুলিকার বাপ আমাদের সমাজের এক সাধারণ চরিত্র। এক পত্নী বিগত হতে না হতেই অন্য পত্নীতে অভিরুচি। এতে আপন মেয়েকে অতি বয়েসী কারো কাছে পাত্রস্থ করতেও তার বাধে না। কেননা, মা-মরা কচি মেয়েটাই যে তার দ্বিতীয় দার গ্রহণে বড়ো বাধা ।
একজন হরিপদ কেরানীর মনে কী কী ভাবনার উদয় হতে পারে কিংবা আকবর বাদশাহর সাথে হরিপদ কেরানী নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারে--এসবই রবীন্দ্রনাথ তার বাঙালি মননের অভিযাত্রায় আবিষ্কার করে চলেন 'বাঁশি' কবিতার মধ্য দিয়ে । বাঙালির চিন্তারাজ্যে কখন প্রেমের অভিষেক, কখন বিরহের সুর সেতো ধরতে পেরেছেন রবীন্দ্রনাথই। তাই কখনো গানে গানে তিনি বলেন,
'আজি সবার রঙে রঙ মিশাতে হবে।'
একজন আধুনিক, উচ্চশিক্ষিত বাঙালির সুরুচির মনোরাজ্যে কী ধরনের ভাঙ্গা-গড়া চলে, কী ধরনের নির্মাণ-ভাঙ্গন হয় সেতো 'শেষের কবিতা'য় অমিতকে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন কবি, নারীরও যে এক মনন সখা চাই--যার কাছে সংসারের আটপৌরে জীবনের বাইরে কেবল মনন ও মনশীলতার বেদনা-ব্যাকুলতা প্রকাশ করা যায়, তা' যেনো লাবণ্য-হৃদয় দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আমাদের পাঠ দিয়ে গেছেন।
রবীন্দ্রনাথ বাঙালি চিন্তা রাজ্যের অধিকর্তা। বাঙালির মনন-মানসে, চিন্তায়-চেতনায় যা খেলে যায় তার সবই লিবিপদ্ধ হয়েছে কবির হাতে। বাঙালির চিন্তারাজ্যে অভিযাত্রী রবীন্দ্রনাথ তাই বাঙালির নিকট আজও সমান প্রিয়। কোনো বৈঠকী আড্ডা কিংবা কোনো শিক্ষার পাঠচক্র--সকল রাজ্যেই রবীন্দ্র-অভিযাত্রা অত্যন্ত শব্দায়মান। বাঙালি আজ তার চেতনায় সংস্কৃতি কিংবা সৌন্দর্যের যে সংজ্ঞা নির্মাণ করে, তাতেও রবীন্দ্রনাথ অভিযাত্রী। রবীন্দ্রনাথ তো অনেক আগেই বলে গিয়েছেন-- 'অধিকার ছেড়ে দিয়ে অধিকার রাখার বিড়ম্বনা আর নেই। বাঙালির মনন রাজ্যে আলস্যের উছলতা দেখে তিনিইতো বলেছেন--'সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধা জননী/রেখেছ বাঙাল করে মানুষ করনি।'
যে মানুষটি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, তার মনের মাঝে রবীন্দ্রনাথ ঘুরে বেড়ান- 'ও আমার দেশের মাটি তোমার' পরে ঠেকাই মাথা' এই দেশাত্মবোধের কালজয়ী চেতনা হয়ে। যে নারী মাতৃত্বের সম্পদে নিরন্তর দুঃখ জয় করে চলার চেষ্টা করেন, তার মনোরাজ্যেও রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন--'মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই/দীন-দুখিনী মা যে আমার/তার যে বেশি সাধ্য নাই'।
আজকের রবীন্দ্রনাথ ছবির রাজ্যেও অভিযাত্রী হয়ে রং আর তুলিকে দিয়ে গেছেন ভাষ্য। কবিতা লেখার ছলে ভুলগুলোকে নান্দনিক শিল্প করে রবীন্দ্রনাথ আজ ক্যানভাসে মূর্ত । শিল্পীর রবীন্দ্রনাথ, শিল্পেরও রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ আপামর বাঙালির চিন্তা মানসের বিনির্মাতা। বাঙালির রুচি ও রীতি তৈরিতে, চিন্তা ও চলমানতার ধারা তৈরিতে রবীন্দ্রনাথ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। রবীন্দ্রনাথের পরিব্রাজক মনের বাঙালির চিন্তারাজ্যে এক অনন্য অভিযাত্রী।