প্রকাশ : ২৯ মে ২০২৩, ০০:০০
তছলিম হোসেন হাওলাদার- আমাদের কাছে তিনি তছলিম ভাই। বয়সে আমাদের কারো কারো তিনগুণ বড় ছিলেন, আচরণে-বন্ধুত্বে বয়সের ছাপ কখনও পড়েনি। তিনি ছিলেন আমাদের সহযোদ্ধা, বন্ধু, একই সাথে বড় ভাই। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো প্রায় ১৩ বছর আগে। প্রথমে তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচয়, পরে সামনাসামনি।
২০১০ সাল থেকে আমি প্রায় সব স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকা পড়তাম। একদিন চাঁদপুর কণ্ঠে পড়লাম তছলিম ভাইয়ের লেখা। আরেকদিন আরো একটা লেখা পড়ে খুব ভালো লাগলো। আমার লেখাও তখন প্রকাশিত হচ্ছে। একদিন প্রেসক্লাবের নিচে বসে চাঁদপুর কণ্ঠে তছলিম ভাইয়ের লেখা পড়ছি। কাছেই আমার বয়সী একটা ছেলে বসে ছিল। সে বললো, আপনি যার লেখা পড়ছেন তাঁকে চেনেন? বললাম, লেখা চিনি, প্রত্যক্ষ পরিচয় নেই। ছেলেটি জানালো, ওর নাম টিটু। তছলিম ভাইয়ের ছেলে সে। বললো, একদিন সে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবে।
অবশ্য কয়েকদিন পরেই সামনাসামনি দেখা হয়েছিল আমাদের। সূত্রধর রফিকুজ্জামান রণি। স্থান কালীবাড়ি প্ল্যাটফরম। অনেক আড্ডা হলো সেদিন। প্রথম দিনেই তাঁকে মনে হলো অমায়িক, সাধারণ, নির্লোভ। লেখার পরিচয় দেখার পরিচয়ে বদল হলো। কয়েকদিন আড্ডা হতেই বন্ধুত্ব গাঢ় হলো। তখন থেকে আমাদের প্রতিদিনই দেখা হতো। কি শুক্রবার, বা শনি বা সোম...আমাদের সাহিত্য বিষয়ক আড্ডা ফুরাতো না। পান্থ ফরিদ ভাই, আশিক বিন রহিম, সঞ্জয় দেওয়ান, সাদী শাশ্বত, সাইফুল ইসলাম নাবিদসহ আরও অনেকে থাকতো আড্ডায়। পরে যোগ হয়েছে সৌম্য সালেক। তারও অনেক পরে ইকবাল পারভেজ ও মাইনুল ইসলাম মানিক। অযাচক আশ্রমের সামনে তখন ছোট একটি গাছ ছিলো। তার নিচে আমরা বসতাম। আলোচনার বিষয় থাকতো চাঁদপুরের সাহিত্য, বইপাঠ, নিজের লেখা পাঠ- এসব কিছুর আলোচনা, সমালোচনা এবং আমরা প্রচুর হাঁটতাম। কি সব জীবন ছিলো আমাদের। কবির জীবন, ভাবুকের জীবন। রেললাইন ধরে প্রায়ই হাঁটতাম। বেশিরভাগ যেতাম বড়স্টেশন। আবার প্রায়ই শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তাম। কখনও ডাকাতিয়া পার হয়ে জুটমিলের কাছে, কখনও দোকানঘর। এমনও হয়েছে হেঁটে হেঁটে আমরা হরিণা যাওয়ার চেষ্টা করেছি। হাঁটা ও কথা ফুরাতো না আমাদের। একদিন তো কালীবাড়ি মোড়ে, ... হোটেলের সামনে গল্প করতে বসেছি আমরা। রোজার সময়। কথা বলতে বলতে ফজরের আজানই দিয়ে দিলো! তবু কথা ফুরালো না! তখন আমাদের বয়স ১৮/১৯, আর তার ৫২-৫৩!
আমার সকল লেখা তছলিম ভাই পড়তেন। কড়া সমালোচক ছিলেন তিনি। যা মনে হতো স্পষ্ট বলতেন। ভালো লাগলেও সরাসরি বলতেন, না লাগলেও। তবে লিখতে প্রচুর উৎসাহিত করতেন। বলতেন, লেখার শক্তি আছে। পরিচর্যা দরকার। লিখতে লিখতেই একদিন ঠিক হয়ে যাবে। আমরা ঢাকা বইমেলায় দল বেঁধে যেতাম। তছলিম ভাইও যেতেন। বয়সের ভার শেষ দিকে তাঁকে কাবু করেছিলো। বইমেলায় গেলে তিনি কিছুক্ষণ হাঁটতেন। পরে মেলার এককোণে বসে থাকতেন। বলতেন, তোমরা ঘুরে আসো, আড্ডা দাও। এই যে তাঁর শারীরিক কষ্ট হতো, কিন্তু বইমেলায় যেতে আপত্তি করতেন না।
তছলিম ভাই মৌলভীবাজারে ছিলেন একসময়। আকমল হোসেন নিপুসহ অনেকের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। আধুনিক সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর জানাশোনা ছিলো ব্যাপক। চাঁদপুরে এসে তরুণদের মানসম্মত বই ও পত্রিকা পড়তে উৎসাহিত করতেন। বিশেষ করে ‘উত্তরাধিকার’ এবং ‘কালি ও কলম’ পড়তে বলতেন। আবুল হাসানের কথা প্রায়ই বলতেন। কোনো লেখা যদি তাঁর ভালো লাগতো, সেটি নিয়ে আসতেন আড্ডায়। পড়ে শোনাতেন আমাদের।
ছোটকাগজ ‘মৃত্তিকা’ প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত থাকা তছলিম ভাইয়ের একটি বড় কাজ বলে মনে করি। ছোটকাগজ প্রকাশের বিষয়ে তিনি খুব উৎসাহী ছিলেন। তিনি, রণি ও আমি মিলে ২০১৩ সালে প্রকাশ করি ছোটকাগজ ‘মৃত্তিকা’। তখন এ কাগজটির মাধ্যমে জাতীয় ও স্থানীয় সাহিত্যের মধ্যে একটি মেলবন্ধন তৈরি করতে চেয়েছি আমরা। জাতীয় পর্যায়ের অনেকের লেখা এনেছিলাম আমরা। এ কাজটির জন্যে সীমাহীন পরিশ্রম করতে হয়েছে আমাদের। ‘মৃত্তিকা’র পর চাঁদপুরে লিটলম্যাগ প্রকাশের ধুম পড়ে বলা যায়। গত দশবছরে বিভিন্ন লিটলম্যাগের অন্তত ৫০টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। আবার পরবর্তীকালে বই প্রকাশের ধুমও পড়েছে। সবমিলিয়ে গত ১০ বছরে চাঁদপুর থেকে শতাধিক প্রকাশনা হয়েছে।
তছলিম ভাই ও আমি হাইমচরের একই গ্রামের মানুষ। তাঁর ভাতিজারা আমার স্কুলবন্ধু। গ্রামের পরিচয় অবশ্য দূরের। লেখকবন্ধুর পরিচয়টি ছিল খুব কাছের, নিবিড়। আমাদের সম্পর্ক ছিল পারিবারিক। তছলিম ভাইয়ের স্ত্রী-কন্যা-পুত্ররা আমাকে জানতেন। কতবার তছলিম ভাইয়ের জাফরাবাদের বাড়িতে গিয়েছি, তার হিসেব নেই। তছলিম ভাই ভাবীর কথা প্রায়ই বলতেন। তিনি স্ত্রীকে খুব পছন্দ করতেন, সংসারের দায়িত্ব তার হাতে দিয়ে নির্ভার থাকতেন। আমরা এ নিয়ে কম খুনসুটি করতাম না। তিনি বলতেন, হাছিনার মতো বউ পেয়েছি বলেই জীবনটা এমনভাবে কাটাতে পেরেছি। সত্যিই ভাবী অসাধারণ মানুষ। তাঁর স্নেহ থেকেও আমরা বঞ্চিত হইনি।
তছলিম ভাই রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন। মনে-প্রাণে বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতেন। আওয়ামী লীগ সমর্থন করতেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের শ্রমিক লীগের একটি পদে দায়িত্ব পালনও করেছেন। তাঁর লেখায়, কথাবার্তায় সেই রাজনীতি-সচেতনতার রূপটি ধরা পড়তো সবসময়।
শৈশব থেকে দুঃখণ্ডকষ্টে বড় হন তছলিম ভাই। পরিবারের হাল ধরেন। খুব হিসেব করে চলতে হতো তাঁকে। আমাদের সঙ্গে যখন তাঁর পরিচয়, আমরা কিপটা স্বভাবের জন্যে তাঁকে খুব খেপাতাম। তিনি খেপতেন না। মাঝে মাঝে বলতেন, ছোটবেলা থেকেই হিসেব করে চলতে হতো। এখনও টাকার অসুবিধা নেই। কিন্তু আমার স্বভাবটি যায়নি।
৯ মে ২০২৩ মঙ্গলবার দিনটিতে প্রচণ্ড গরম ছিল। আমি আর মাইনুল ইসলাম মানিক বড়স্টেশন গিয়েছি। উদ্দেশ্য খানিকটা বাতাস পাওয়া। সেখান থেকেই কল দিয়েছি তছলিম ভাইকে। কয়েকদিন ধরে তার খোঁজখবর পাচ্ছিলাম না। কল ধরলেন। বললেন, কালকে শহরে আসবেন। একটি সুখবর আছে। সুখবর শোনার জন্যে তর সইছিল না। নদী পার হয়ে একটি রিক্সা নিয়ে জাফরাবাদ চললাম আমরা। বাসায় যে যাবো তছলিম ভাইকে জানাইনি। সারপ্রাইজ দিবো। বাড়ির সামনে গিয়ে কল দিলাম। ধরলেন ভাবী। বললেন, মোবাইল বাসায় রেখে তিনি বাইরে গেছেন। তিনি আমাকে সুখবরটিও বলে দিলেন। আছর নামাজের সময় ছিলো। আমি ভাবলাম, মসজিদে মনে হয় গেছেন। বাড়ির কাছেই একটি মসজিদে উঁকি দিয়ে দেখি তিনি নামাজ পড়ছেন। নামাজ শেষে তিনি আমাদের দেখে উজ্জ্বল হাসি হাসলেন। বললেন, এসে গেছো! বাসায় গিয়ে বসলাম আমরা। তাঁর বড় ছেলে টিপু ইতালির ভিসা পেয়েছে। খুব খুশি ছিলেন তিনি। টাকাণ্ডপয়সা ম্যানেজ করতে পেরেছেন। ভেবেছেন কাল শহরে গিয়ে আমাদের ভালোমন্দ খাওয়াবেন এবং সুখবরটি দিবেন। সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত আড্ডা দিলাম আমরা। চোখের চিকিৎসা, সন্তানদের কথা, সাহিত্যাঙ্গনের কথা, কবিতার পা-ুলিপি গোছানোর কথা--কত কথা বললেন তিনি। কথার ফাঁকে ভাবী পাকা আম ও নুডুলস দিয়ে গেছেন। সন্ধ্যার সময় তিনি আমাদের এগিয়ে দিয়ে গেলেন অনেক দূর পর্যন্ত।
তাঁর সঙ্গে এ-ই আমাদের শেষ দেখা।
১৫ মে সন্ধ্যায় তিনি প্রয়াত হন।
সন্ধ্যায় মোবাইল বেজেই চলছে। রণি কল দিয়ে জানাচ্ছে খবরটা।
আমি আর ইকবাল পারভেজ রিক্সায় ছুটছি জাফরাবাদের দিকে। চোখের সামনে ঝাপসা সবকিছু। শহর জুড়ে কী অন্ধকার।
তছলিম ভাইকে রেখে এলাম ১৬ মে, বুধবার তাঁর গ্রামের বাড়িতে। চিরনিদ্রায় শায়িত তিনি।
তছলিম হোসেন হাওলাদার আমার নিত্য যাপনের অংশ ছিলেন। সকল পরিকল্পনা, আনন্দের কথা, বেদনার কথা তাঁর কাছে নিশ্চিন্তে বলতে পারতাম। আমার প্রতি তাঁর স্নেহ ছিলো সীমাহীন। গত তিন-চার বছর ধরে শহরে তাঁর আসা-যাওয়া ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তবু সপ্তাহে এক দুদিন জাফরাবাদ থেকে শহরের আসতেনই। উদ্দেশ্য সাহিত্য আড্ডা। তিনি অনেকদিন না আসলে আমরা যেতাম তাঁর বাড়িতে। গল্প করতাম। কথা বলতাম। গত ১৩ বছরেও আমাদের গল্প শেষ হয়নি, কথা ফুরোয়নি।
গত ১৫ মে’র পর আমাদের আর কথা হয় না। আর কখনও হবে না।