বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২৯ মে ২০২৩, ০০:০০

অগস্ত্য যাত্রায় এক পরিতৃপ্ত কবি
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

‘সুন্দরী ড্যাফোডিল, আমরা কেঁদে হই সারা

তোমায় খুব দ্রুতই চলে যেতে দেখে

অথচ ভোরের অরুণ তখনও দেখায়নি তাড়া

দুপুরের তপন হয়ে বসেনি জেঁকে।’

ইংরেজ কবি রবার্ট হেরিকের ‘ড্যাফোডিলের প্রতি’ কবিতায় মানবজীবনের মৃত্যু-দর্শন নিয়ে যে গভীর বেদনার ধ্বনি প্রাণে স্পন্দিত হয়, তাকে দ্বিগুণ করে দিয়েই অগ্রজ স্বজন ও সাহিত্যিক তছলিম হোসেন হাওলাদার প্রয়াত হয়েছেন অনন্তকালের যাত্রায়।

নিরীহ সাদামাটা মানুষ বলতে যা বুঝায় হাইমচরের অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম নেওয়া আগাগোড়া নিরহংকারী ব্যক্তিত্ব তছলিম হোসেন হাওলাদার ঠিক সেরকমই একজন ছিলেন। নদী সিকস্তি মানুষ মেঘনার বৈরিতায় স্বস্তির খোঁজে সাহিত্যে নির্মাণ করে নিয়েছেন আপন ভুবন। তাঁর এ সাহিত্যযাত্রা শুরু হয় মূলত চারটা স্বরচিত কবিতাকে বাঁধাই করে রাখার মাধ্যমে। যে অজপাড়া গাঁয়ে হারিকেনের আলোয় আঁধারকে যুঝতে হতো, সে অজপাড়াগাঁয়েই তছলিম হোসেন হাওলাদার নিজেকে লক্ষ্যে অটুট রেখে হয়ে উঠলেন কবি, হয়ে উঠলেন সাহিত্যিক। তবে এ কথা বলতেই হয়, কবি তছলিম হোসেন হাওলাদারের উন্মেষ ঘটে একজন ডায়াস্পোরা সাহিত্যিক হিসেবে, যিনি নিজ জন্মজনপদ ছেড়ে সুদূর চায়ের দেশ মৌলভীবাজারে গিয়ে কর্মজীবী হয়ে উঠেন। তাকে নিয়ে মৌলভীবাজারের সাপ্তাহিক মনুবার্তায় লেখা আকলু মিয়া চৌধুরীর একটা প্রাণবন্ত ও নির্মোহ আলোচনাই বলে দেয় তছলিম হোসেন হাওলাদারের কবি হয়ে ওঠার গল্প। একজন নিপাট সংসারী মানুষ হয়েও তছলিম হোসেন হাওলাদার সাহিত্যের সেবায় যে মগ্নতা দেখিয়েছেন তা সাহিত্যের প্রতি প্রগাঢ় প্রেম না থাকলে অসম্ভব।

তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কখনো শাশ্বত’ যা পাঠককে জানান দেয়, ঊনিশশো সাতাশি সালেই হাইমচরের তছলিম হোসেন হাওলাদার একজন আধুনিক কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। তিনি একজন আপাদমস্তক সাহিত্যিক ছিলেন বলেই কড়া গদ্য হতে কোমল কবিতা সবকিছুতেই ছিলো তার বিচরণসক্ষমতা।

তার ‘স্মৃতির অন্তরালে’ গ্রন্থটি আত্মজৈবনিক প্রকৃতির হলেও তাতে তার ছোটভাইয়ের বিষয়ই ছিলো মূল উপজীব্য। ‘সম্পর্ক’ নামের পুস্তিকাটি মূলত তার জীবনকাহিনী যদিও এতে তার বৈবাহিক সম্পর্কই প্রাধান্য পেয়েছে তিক্ত জীবনের অভিজ্ঞানে। পাঠকের মাঝখানে লাভ হলো এই, তার বিয়ের উপাখ্যানে তৈরি হয়ে গেল এক রম্য রচনা। তার এই রচনায় ফুটে উঠেছে দুটি ঐতিহাসিক সামাজিক বাস্তবতা। প্রথমত একটা বিশেষ সময়ে আমাদের সমাজে সরকারি চাকরিজীবীর বেশ কদর ছিলো। বিয়ের বাজারে তারাই ছিল উৎকৃষ্ট পাত্র। উপরি কত পায় তা-ই যেন ছিল গর্বের বিষয়। দ্বিতীয় বিষয় হলো বিবাহে যৌতুক। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে পাত্রের ভাইবোন-চাচা-মামারা এমন চাপ দিতেন, তাতেই দেখা যেত অনেক বিয়ে চূড়ান্ত কথা হওয়ার পরও ভেঙে গেছে। ‘সম্পর্ক’ পুস্তিকায় বর হিসেবে তছলিম হোসেন হাওলাদারকে যৌতুকের বিরোধিতা করতে দেখা গেলেও রুখে দাঁড়ানোর ব্যাপারে বিদ্রোহ করতে দেখিনি।

‘মাঠের যোদ্ধা চাই’ সত্যিকার অর্থেই একটি ভালো প্রবন্ধ সংকলন, যাতে তার মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা জোরালোভাবে প্রকাশ পেয়েছে। শাহবাগের আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তছলিম হোসেন হাওলাদার যে দ্রোহ মনে ধারণ করতেন, তাকেই মলাটবদ্ধ করেছেন তিনি 'মাঠের যোদ্ধা চাই' গ্রন্থে। তিনি মাঠের যোদ্ধা বলতে আদতে তরুণ সাহসী সমাজকে বুঝিয়েছেন যারা প্রগতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে নিজেদের মধ্যে।

গল্পগ্রন্থ ‘কহর দরিয়ার পানি’ তার অতি কাঙ্ক্ষিত একটি গ্রন্থ। এতে তার সৃজনশীলতা তুলনামূলক অধিক পরিপক্কতা পেয়েছে। তবে গল্পগ্রন্থের দু-একটি গল্পে তার ব্যক্তিজীবনের অজানা কোন অধ্যায়কে পরিস্ফুটিত করে তোলা হয়েছে বলে মনে হতে পারে। কয়েকজন সাহিত্যিক মিলে যৌথ গল্প রচনাতেও তিনি জড়িয়ে আছেন, যাতে আলেয়ার বিয়েতে চার যুবকের মধ্যে তিনি একজন।

পালক, সম্প্রীতি নামক ছোটকাগজ সম্পাদনা করলেও তার সম্পাদকীয় দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া যায় ‘অনপেক্ষ’-তে। তিনি নিজে যেমন সেখানে সাহসী লেখা লেখেন তেমনি অন্যের সাহসী লেখারও তিনি পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। ‘অনপেক্ষ’র ব্যাখ্যায় তিনি কোনো দিকে না হেলে ন্যায় ও সত্যকে ধারণ করার বিষয়ে মত প্রকাশ করেন। ‘মুক্তির মিছিলে আমিও ছিলাম’ এটি তার সর্বশেষ প্রবন্ধ সংকলন হলেও এটিই মূলত তার যৌবনের চিন্তার ধারক। অর্থাৎ তিনি যখন কৈশোরোত্তীর্ণ তখন বাংলাদেশ নামক একটি জাতিরাষ্ট্র জন্মণ্ডক্রন্দনে মাতিয়ে চলেছিল বিশ্ব। এ সময়ে তিনি সত্তরের নির্বাচন ও বঙ্গবন্ধুর জনসভা দুটোই সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ করতে না পারলেও মুক্তির মিছিলে তিনি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে না যেতে পারার অক্ষমতা তাকে কাঁদায়। সেই কান্না তিনি ‘মুক্তির মিছিলে আমিও ছিলাম’ গ্রন্থের মাধ্যমে দূর করার চেষ্টা করেন।

তার গদ্যভাষা নির্মেদ ও ঝরঝরে। তবে গদ্যে অধিক খুঁটিনাটি বলার প্রবণতা ছিল। তার গল্পে বাস্তবতা মুখ্য, আখ্যানের চেয়ে তিনি জীবনের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ‘কহর দরিয়ার পানি’ গল্পগ্রন্থে কিছুটা রগড় থাকলেও তার গদ্য ও কবিতা আজকের যুগের তথাকথিত স্মার্ট যৌনতা হতে মুক্ত ছিল। তছলিম হোসেন হাওলাদারের কবিতায় দেশপ্রেম এবং নর-নারীর প্রেম প্রাধান্য পেলেও কালের ক্ষোভই তার মূল স্বর। অসঙ্গতি ও অবক্ষয় তাকে প্রতিনিয়ত প্রতিবাদী করে তুলেছে।

তার কবিতাকে ব্যবচ্ছেদের তলায় রাখলে বলতে হয়, এক্ষেত্রে তিনি নিজের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। মান অনুয়ায়ী তার কাব্যগ্রন্থ নেই। ‘জলের কলতান’ নামে চাঁদপুরের দশ কবির একশটা কবিতার সংকলনে তার দশটা কবিতা সংকলিত হয়। তিনি এ সংকলনের একজন সহ-সমন্বয়কও বটে। এই দশটা কবিতার একনিষ্ঠ পাঠে তার কবিতার শক্তিমত্তা উপলব্ধি করা যায়। তাকে সংযোগ প্রজন্মের কবি বলা যায় না, যদিও তার কবিজন্ম আশির দশকে। কেননা তিনি কবিতায় প্রচলিত ছন্দের ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত ছিলেন না। আধুনিক গদ্যছন্দ এবং উত্তরাধুনিক পরাবাস্তববাদ তার কবিতাকে আঙ্গিক দান করেছে। তবে তার কাব্যভাষা একান্তই তার নিজস্ব। তিনি যখন কলম ধরে লেখেন, ‘পোকারা কিছুটা বোকাও বটে’, তখন তারা আর পোকা থাকে না, হয়ে যায় মিথ, যেন জীবনানন্দের প্যাঁচার মতো। তার কবিতা 'প্রিয় অপ্রিয় ' ধরিত্রীর কষ্টকে উপশমের কবিতা। তিনি পাখির আকাশে উড্ডয়ন কিংবা বৃক্ষের বৃদ্ধি দেখে শঙ্কা বোধ করেন। তাইতো অবলীলায় বলতে পারেন, ‘শিকারি আর কাঠুরের প্রতি আমার বড় বেশি ঘৃণা’। তার ‘নদী’ কবিতাটি একটি চিত্রকল্পময় কবিতা হলেও এর মধ্যে এক মহাকালিক দর্শন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ‘পাড় ভাঙছে। নদী পাড়ের মাটি ঝরে পড়ছে /আমি এখনও এই পাড়ে আছি /একদিন চলে যাব ওই পাড়ে’। কবিতা যখন এরকমভাবে মনে করিয়ে দ্যায় জীবন-বৈতরণীর কথা তখন তা আর কবিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে হয়ে যায় জীবনবেদ। তার আরেকটি অন্যতম শিল্পিত প্রতিবাদের কবিতা ‘এখন নিজেকে’। তিনি বলেছেন এ কবিতায়, ‘একদা নিজেকে মনে হতো কৃষ্ণের মতো /কে বাজাইয়া যাওরে বাঁশি রাজ-পন্থ দিয়া’/ এরকম বিরহ বিধুর সুর শুনতে পেতাম ভেতরে /ভেতরে অভাগী রাধিকার /এখন রুয়ান্ডার জাতিদ্বন্দ্ব আমাকে স্তব্ধমূক করে দেয় /আমার মন পড়ে থাকে ক্ষুধাক্লিষ্ট মানুষের দেশ সোমালিয়ায়।’

সাংগঠনিক দক্ষতাতেও তার সাফল্যের প্রমাণ রয়েছে বিস্তর। নতুনবাজার শাখা উদীচীর সভাপতির দায়িত্ব পালন, চাঁদপুর সাহিত্য পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন ছাড়াও তিনি আরও অনেক সাংগঠনিক পদে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার নেতৃত্ব সাহিত্যের বিকাশে ফলপ্রসূ ছিল সর্বদা। চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমীতে পঁচাত্তরটা সাহিত্য আড্ডার প্রায় সবকটাতেই তিনি থাকতেন সক্রিয় ভূমিকায়। কখনো নিজের লেখা পাঠ, কখনো অন্যের লেখার ওপর আলোচনায় তিনি নিজের গঠনমূলক মতামত দিতে কুণ্ঠিত হতেন না। বন্ধু বৎসল ও সামাজিক মানুষ তছলিম হোসেন হাওলাদার সাহিত্যের মাধ্যমে নিজের মনের কথা ব্যক্ত করতে পেরেই সন্তুষ্ট।

তছলিম হোসেন হাওলাদারের পাঠবিশ্ব ছোট ছিল না মোটেই। সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য তার খুব একটা পড়া না থাকলেও বিশ্বসাহিত্যের ক্ল্যাসিকগুলোর সাথে তার পরিচয় ছিল, পড়াশুনা ছিল। তিনি আহমদ ছফার গদ্যের যেমন ভক্ত ছিলেন তেমনি 'যে জলে আগুন জ্বলে'র কবি হেলাল হাফিজকেও ভালোভাবে ধারণ করতেন। চোখের সমস্যার কারণে শেষদিকে অনেকদিন পড়তে না পারার কারণে তার আফসোসের অন্ত ছিল না। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের চেয়ে তাকে টেনেছে বেশি জীবনানন্দ। হয়তো সে কারণেই তার কবিতায় পঞ্চপা-বোত্তর কাব্যভাষার প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। মিথ এবং পুরাণের ব্যবহারেও তছলিম হোসেন হাওলাদার সচেতন ও আগ্রহী ছিলেন। তার লেখার চেয়েও ভাবনারা ছিল অধিক শাণিত। কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে মহামানব বলতে যাদের আপত্তি, তিনি তাদের মুক্তচিন্তার ফলায় ঘায়েল করে নিজের প্রজ্ঞাকে ব্যক্ত করেছেন।

সাহিত্যিকরা জগতের আগাম খবর সম্পর্কে জ্ঞাত হন বলে অনুমিত। নিজের মৃত্যুর খবর তছলিম হোসেন হাওলাদারের মনে কি আগেই স্পন্দিত হয়েছিল? হয়তো বা তাই। এ কারণেই মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তার কবিতায় জন্ম নিয়েছিল মৃত্যু-চিন্তা। তিনি লিখেছেন কবিতায়,

‘যদি আজই আমার মৃত্যু হয় এবং মৃত্যুর পূর্বে পূর্ণ জ্ঞান থাকে

তবে সবাইকে বলে যাব

পরিতৃপ্ত মন নিয়েই আমি যাচ্ছি

আমার জন্য কেউ কেঁদো না, ফেলো না একফোঁটা চোখের জল।

বেদনা আছে বৈকি সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছি বলে

পৃথিবীর ঘাস গাছ তরুলতা ফল ফুল পশুপাখি পাহাড় নদী সব কিছুই মুগ্ধ করে রেখেছিল আমাকে

তাদের বিচ্ছেদে মনের গহীনে কষ্ট হচ্ছে বলতেই হয়।’

(মৃত্যু ভাবনার কবিতা)

কবি তছলিম হোসেন হাওলাদার অগস্ত্য যাত্রায় এক অগ্রগামী মানুষ হলেও কবিদের ইতিহাসে তিনি তার নাম লিখিয়ে যেতে পেরেছেন অক্ষয় করে। তার লোকোত্তর জীবনে শান্তির নিরন্তরতা বজায় থাকুক। তিনি বেঁচে থাকুন তার কর্মে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়