বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ০১ মে ২০২৩, ০০:০০

বর্ষবরণ : বাঙালি জাতির মুখচ্ছবি
অনলাইন ডেস্ক

‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ/ তাপসনিঃশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ষবরণের গান। এই গানের শব্দ, সুর, তাল ও লয়ের মধ্যে ধরা আছে নবজীবনের আহ্বান। বৈশাখের তপ্ত বায়ুর ঝাপটায় চিন্তা, মনন ও বিশ্বাসের সব আবর্জনা ও নির্জীবতা বিধৌত হয়ে নবীন জীবন তৃষ্ণা জেগে উঠবে- এই হলো কবির প্রত্যাশা। যা কিছু মিথ্যা ও অকল্যাণকর; শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌন্দর্যের সঙ্গে যার সম্পর্ক শত্রুর এবং সভ্যতার অগ্রগতিতে যা প্রতিবন্ধক তা বিদূরিত হয়ে নবজীবনের মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার আহ্বানও আছে এই গানে। বর্ষবরণ নামক সর্বজনীন উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রতিটি বাঙালি চেতন ও অবচেতনে ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কবির মতো সম্প্রীতি, সমৃদ্ধি ও সৌন্দর্যের প্রত্যাশাকেই যেন মূর্ত করে তুলতে চায়। ফলে আর দশটি উৎসব থেকে বর্ষবরণ মৌলিক অর্থেই স্বতন্ত্র।

কৃষিজীবী বাঙালি-সংস্কৃতির মূলগত আবেদনই হলো অসাম্প্রদায়িকতা ও আত্মীয়তান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। বর্ষবরণের মধ্য দিয়ে প্রতিবছর বৈশাখের প্রথমদিনে সেই অসাম্প্রদায়িকতা ও আত্মীয়তার সুদীর্ঘ সম্পর্কজালকেই যেন নতুন করে বুঝে নেয় এ দেশের সাধারণ মানুষ। বছরব্যাপী বিচিত্র সম্পর্কজালে মালিন্যের যে ছোট-বড় ও স্থূল-সূক্ষ্ম দাগ মনে ও মননে রেখাপাত করে যায়, উৎসবকে কেন্দ্র করে সেই দাগ সযত্নে মুছে দেবার প্রয়াসও চলে গোপনে গোপনে। অসংখ্য দুঃখণ্ডকষ্ট ও ব্যথা-বেদনা আমাদের জীবনের নিত্যসহচর এবং সেহেতু গোপন অশ্রুপাত ও আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এই জীবন তো শুধু মালিন্য আর মনোবেদনার স্তূপ বহন করার জন্যই নয়। তাই বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে আমরা ভুলে যেতে চাই অতীতের যা কিছু যন্ত্রণা, যা কিছু জাড্য। একই গানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন : ‘যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি/অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক/মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’

কৃষিকাজের সুবিধার্থে সম্রাট আকবর বাংলা সন প্রবর্তন করেন। সময়ের বিবর্তনে বাংলা সন শুধু টিকে থাকেনি বরং বিচ্ছিন্ন, বিভক্ত বাঙালি সমাজকে দিয়েছে ভারতীয় চেতনা এবং গৌরববোধের এক বিশেষ শক্তি। এই বাংলা সন প্রথমে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিল। পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিতি পায়। সুতরাং বাংলা বর্ষবরণ যে খুব পুরনো নয়, সনটির উদ্ভব থেকেই তা বোঝা যায়।

এক সময় নববর্ষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান ছিল হালখাতা। এছাড়া এক সময় বৃষ্টি-প্রার্থনাও ছিল বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের বিশেষ অংশ। কেননা কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে বৃষ্টির জলই ছিল চাষাবাদের একমাত্র প্রকৃতিগত সেচব্যবস্থা। গ্রামীণ জীবনে এখনো নববর্ষ উদযাপনের সঙ্গে প্রথাগত বৃষ্টি প্রত্যাশার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি।

পৃথিবীর তাবৎ দেশের নববর্ষের মতো আমাদের জীবনেও নববর্ষ মঙ্গল আর কল্যাণের প্রতীক। ফলে এই দিনে ঘরবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার সঙ্গে সঙ্গে নিত্যব্যবহার্য প্রতিটি জিনিস ধোয়ামোছা করে পরিপাটি করে তোলা হয়। এই দিনে গ্রামের মেয়েরা পরতে চেষ্টা করে নতুন বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শাড়ি আর ছেলেরা পাজামা-পাঞ্জাবি। এদিনে ভালো খাওয়া, ভালো পরা এবং ভালো থাকতে পারাকে ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক বলে বিশ্বাস করা হয়। আর চলে ঘরে ঘরে বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-পরিজনের আদর-আপ্যায়ন। লোকজ পিঠাণ্ডপায়েস ও নানা ধরনের মিষ্টান্ন দিয়ে ধুমধাম করে চলে এই আপ্যায়ন পর্ব। ধর্মণ্ডবর্ণ নির্বিশেষে চলে এই আতিথেয়তা। আর আনন্দিত চিত্তে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় তো আছেই। এসব আয়োজনের মধ্যে ভবিষ্যৎ মঙ্গলাকাঙ্ক্ষার এক গোপন মনোবাঞ্ছা আমাদের মধ্যে সর্বদাই ক্রিয়াশীল থাকে।

বর্ষবরণ উৎসবমুখর হয়ে উঠে বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে। সারা বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে কয়েকটি গ্রামকে কেন্দ্র করে বসে বৈশাখী মেলা। বিশেষ করে গ্রামীণ হাট-বাজারগুলোই এর উপযুক্ত স্থান। হিন্দু-মুসলিমণ্ডবৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই মেলায় অংশগ্রহণ করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ফলে বৈশাখী মেলা শুরু থেকেই সর্বজনীন লোকজ সাংস্কৃতিক উৎসব। এই মেলায় পণ্যদ্রব্যের সবই স্বল্পমূল্যের লোকজ পসারি। যেমন স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাতসামগ্রী এবং হস্তশিল্প ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রীর সমাহারে মেলা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। শিশু-কিশোরদের খেলনা, নারীদের সাজসজ্জার উপকরণ ও লোকজ খাদ্যদ্রব্য যেমন- চিঁড়া, মুড়ি, খই, বাতাসা, গজা ও নানারকম মিষ্টান্ন জাতীয় খাদ্যে মেলা হয়ে উঠে উপভোগ্য। বেলুন, বাঁশি আর বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের আয়োজনে আর এসবের নাদণ্ডনিনাদে চতুর্দিক মুখরিত হয়ে উঠে।

একমাত্র বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করেই আমাদের গ্রাম জীবনে নিঃসঙ্কোচ বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। আমাদের ধর্মীয় উৎসবসহ অন্য অধিকাংশ উৎসবই বিনোদনহীন। সে ক্ষেত্রে বর্ষবরণের মেলা ব্যতিক্রম। এই মেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগমন ঘটে লোকগায়ক ও লোকনর্তকদের। তারা মেলায় যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরাগান, গাজীরগান ইত্যাদি পরিবেশন করেন। এছাড়া বাউল, মারফতি, মুর্শিদি, ভাটিয়ালি ইত্যাদি আঞ্চলিক গান পরিবেশন করে তারা মেলাকে বিনোদনের আনন্দে ভরিয়ে তোলেন। কোনো কোনো মেলায় পরিবেশিত হয় ‘লাইলী-মজনু’, ‘ইউসুফ-জুলেখা’, ‘রাধা-কৃষ্ণ’ ইত্যাদি বিচিত্র আখ্যান। সাম্প্রতিককালে চলচ্চিত্র প্রদর্শন, নাটক, পুতুল নাচ, নাগরদোলা, সার্কাস ইত্যাদির আয়োজনও হয়। ফলে মেলার আকর্ষণ বহুগুণে বেড়ে যায়। গ্রামে শিশু-কশোরদের বিনোদনের জন্য বায়োস্কোপের আয়োজন বহুকালের পুরনো ঐতিহ্য।

এখন বড় বড় শহরে বিশেষ করে ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে ভিন্ন এক রূপমাধুর্য ও সাজসজ্জা নিয়ে বর্ষবরণ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। নগর-সংস্কৃতির আদলে এর জাঁকজমকই আলাদা। গ্রামীণ মেলা ও উৎসবের মতো তা ঢিলেঢালা নয়, অলস ও বিশ্রম্ভ বিচরণ এখানে প্রায় অসম্ভব। এক ধরনের প্রগাঢ় উত্তেজনা এখানকার মেলা ও উৎসবের প্রাণপ্রবাহের মধ্যে বহমান। উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানানোর সেই প্রাত্যুষিক পর্ব থেকে শুরু করে দিবাবসানের প্রান্তিক আয়োজন পর্যন্ত সর্বত্রই থাকে অসংখ্য লোকের সম্মিলনে এক নাগরিক উৎসবমুখরতা। অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের নানারকম অনুষ্ঠান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অনুষ্ঠিত হয় রমনা পার্ক এলাকা থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তৃত এলাকাজুড়ে। এই দিনে ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাকে সজ্জিত হয় নানা বয়সের নারী-পুরুষ। নববর্ষকে স্বাগত জানাতে যুবতীরা পরে লালপেড়ে ও সাদা জমিনে শাড়ি, হাতে পরে নানা রঙের মুঠি মুঠি চুড়ি, খোঁপায় ঝোলায় ফুল, গলায় ফুলের মালা, কপালে পরে বিচিত্র রং ও গড়নের টিপ। গ্রামে এক সময় পায়ে আলতা পরত মেয়েরা। এখনো কেউ কেউ পরে। কিন্তু শহরে তা নেই বললেই চলে। তবে মেহেদি পাতার রঙে হাত রাঙানো হয় গ্রাম-শহর সর্বত্রই।

১৯৬৫ সাল থেকে ছায়ানট রমনা বটমূলে আয়োজন করে আসছে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগমনী গান ‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ’ পরিবেশনের মাধ্যমে সূর্যোদয়ের সময় বর্ষবরণ করে এই প্রতিষ্ঠান। তারপর দিনব্যাপী চলতে থাকে নানা অনুষ্ঠান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট ক্যাম্পাসের বকুলতলায় আয়োজন করে প্রভাতী অনুষ্ঠান এবং ইনস্টিটিউটের শিল্পীদের অক্লান্ত ও আনন্দিত পরিশ্রমে প্রতিবছর আয়োজিত হয় নয়ন-মনোহর বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। সেই শোভাযাত্রার মধ্যে ধরা দেয় বাঙালি জীবনের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কার-সংস্কৃতি। সব শ্রেণির মানুষ এই শোভাযাত্রাকে উপভোগ করে গভীর এক অর্থব্যঞ্জনায়। এছাড়া বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করর্পোরেশন, নজরুল একাডেমি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, নজরুল ইনস্টিটিউটসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তাদের নিজ নিজ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতিগত ঐতিহ্যের বিভিন্ন স্বরূপকে মূর্ত করে তোলে। আর সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত হয় বিচিত্র প্রবন্ধ-নিবন্ধসহ ক্রোড়পত্র। অনিবার্যভাবেই বাঙালি সংস্কৃতিচর্চায়, বাঙালি সংস্কৃতির মহিমা ও মাধুর্য বিকাশে এবং এর অনন্য সৌন্দর্য ঊর্ধ্বে তুলে ধরার ক্ষেত্রে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে এসেছে। এখন বর্ষবরণ অনুষ্ঠান অবিতর্কিত ও অনিবার্য এক জাতীয় উৎসবের নাম।

আমাদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মর্মে নিহিত আছে এক অসাম্প্রদায়িক জীবনতৃষ্ণা। জাতি নয়, ধর্ম নয়, বর্ণ নয়, জাত-পাত নয়- মানুষের একমাত্র পরিচয় সে মানুষ।

আর এই পরিচয়েই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে মিলিত হয় সব ধর্মণ্ডবর্ণ-গোত্রের মানুষ। এখানে কেউ ছোট নয়, কেউ বড় নয়, কেউ গুরুত্বের নয়, কেউ গুরুত্বহীন নয়, এখানে সবাই সমান এবং সবার আনন্দিত উপস্থিতির মধ্যে নববর্ষের উৎসব মহিমান্বিত হয়ে ওঠে। এই জীবন তৃষ্ণা ও জীবন দর্শনই আমাদের জাতিগত ঐতিহ্যের মূলগত ভিত্তি, আমাদের প্রাণপ্রবাহের মূলগত ধারা। যারা এর প্রতিপক্ষ তারা নিঃসঙ্গ ও আগন্তুক। তারা আমাদের কেউ নয়।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক, গবেষক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়