মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা : অসীম ব্যথার বাহন
অনলাইন ডেস্ক

মানুষ ও প্রকৃতির পদভারে সমস্ত পৃথিবী কোলাহলময়। এ কোলাহল মানুষের সংসার যাপনে এবং মরণেও। জন্ম-মৃত্যু, প্রেম-প্রীতি, সুখ-দুঃখ, দহন-প্লাবন নিয়মিত চলছে। ভাঙ্গনের জ্বালাও নিরবধি। প্রকাশ্য এ নিয়ম-নিয়তির বাইরেও প্রকৃতি ও মানুষের একটা গোপন পৃথিবী রয়েছে। প্রত্যেক মানুষেরই জীবনে কিছু কথা থাকে যা কোনোদিন বলা হয় না। কিছু কিছু হৃদয়ের দুয়ার যা কোনোদিন খোলা হয় না। তেমনি বধির প্রকৃতিও কী যেনো অহরহ বলতে চায়, কিন্তু বলা হয় না। ব্যথা হয়ে জমাট বেঁধে লুকিয়ে থাকে প্রাণের গহীনে। খণ্ড-বিখণ্ড, ছিন্নভিন্ন স্বপ্ন মানুষ যোজনা দিতে দিতে জীবন কাটিয়ে দেয়। অব্যক্ত ব্যাকুলতা কখনো কখনো ডুকরে ওঠে। কবি সৌম্য সালেক এমনই এক তৃষাতুর কবি। যিনি পলকে পলকে খুঁজে বেড়ান অতৃপ্ত বাসনার সুর। মানুষ ও প্রকৃতির অসীম যন্ত্রণা ও অব্যক্ততা নিবিড় করে হৃদয়ঙ্গম করেছে। তার লেখা, ‘পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা’ এমনই এক ব্যথার সুরের বাহন। কবি পৃথিবী ও সংসারের এ নিয়ম যাপনের বিরুদ্ধ ¯্রােতে ভেসে অনুভব করেছেন পৃথিবীর অপ্রকাশিত সব বেদনার আখ্যান। মানুষ ও প্রকৃতির অব্যক্ত অনুভূতি ধরেছেন শব্দের কাহনে কাহনে। কবি বলতে চান, ‘চলমান প্রত্যক্ষণটুকু এবং জাগতিক ঘটনাপ্রবাহ মানুষের অন্তরীন আলোড়ন সংগ্রহকে সম্পূর্ণ প্রকাশ করে না। এর বাইরেও রয়েছে অনেক অশ্রুপাত, বিভেদের অগণ্য কাহিনি, স্বপ্নের আরও অধিলোক। কবির এমন আকুতির অনুভবে ‘পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা’য় বিধৃত কাব্যলক্ষ্মীর রূপের সুধা আস্বাদন করার চেষ্টা করবো। জীবনের পরিসমাপ্তি জেনেও মানুষ আশায় বসতি গাড়ে সম্মুখে সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন রেখে। এ স্বপ্ন যেনো পরিশ্রান্ত হওয়ার নয়। তবুও সময়, জীবনে ক্লান্তি নিয়ে আসে। সুখের ভাবনার বৈপরীত্যে জীবনের পাশে এসে দাঁড়ায় অপ্রত্যাশিত ঘটনা। এমনই ইঙ্গিত পাই ‘পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা’র প্রথম কবিতায় ‘ওরা দুজন সাগরে সূর্যডুবা দেখতে গিয়েছিল/ভেবেছিল, ফিরে যাবে জীবনের সংরক্ত সজ্জায় সময়ের বরে লীন হবে লুটেপুটে/ সূর্য ডুবে ডুবে, দিনরাত্রির সেই খর-মোহনায়/ ওরা ডুবেছিল----/ সন্ধ্যাতারাদের চোখ ফোটার অবকাশে/ নীল-মত্ত-মজ্জনে’

কবিদের অনুভব অন্যের ব্যগ্রতাকে পরিস্ফুটন করে। ভাষায়, চিন্তায়, চিত্রকল্প, মনন ও আবেগে কবি তার পংক্তিমালার মধ্য দিয়ে আপন হয়ে যায় স্বপ্নের কাছাকাছি বিপন্ন মানুষের। আর খানেক সম্মুখে এগুলেই কবির কাব্য প্রতিভার স্ফূরণ দেখতে পাই। ঝরঝরে শব্দের নিবিড় চিত্রকল্পে মানবের মনের জমানো বৈচিত্র্যময়তাকে গেঁথেছেন সাবলীলতায়। ‘সেই তুমুল অঘ্রানলোক’ কবিতায়¬-

‘সবকিছু উগরে দিয়েছে ওরা

প্রীতি ও বিচ্ছেদ, সুর ও সুরভি, রতি ও রসনা

সবকিছু বেরিয়ে পড়েছে

ঠোঁট বেয়ে বুক ছেয়ে, ক্লেদে-মাংসে

পাঁকে পাঁকে গলগল...’

সহজাত প্রবৃত্তি থেকে মানুষ স্বপ্নকে লালন করে অতিমাত্রায়। তাই অধিলোকে স্বপ্নের অভিমুখিতা অনস্বীকার্য। কিন্তু এক সময় অতিক্রান্ত হয় সবকিছু-

‘অনন্ত আশ্রমে তাদের নিঃশব্দে লীন হতে দেখে শুরু হয় আর্তনাদ, সংক্ষেত, ছোটাছুটি

তারপর মদির দাহনলোকে নেমে আসে দীর্ঘ বৃষ্টিপাত’

মানুষ দুঃখ ভোলাতে চায় তাই নিরবধি সুখীদের সাথে নিজেকে মিশায়

তাতে ঘুছে কি ব্যথা! সম্মুখের নিশ্চিত বিপদকাল ভেবেও সুখের যাপনে বিভোর হয়ে ওঠে। এক সময়ে অবশেষে চেতনা হলে আহত হয় মানব হৃদয়। ব্যথা মুছে যায় না কোনোদিন। ক্ষয়ে যাওয়া জীবনও কিছুতেই লুটাতে চায় না। গভীর আবেশে বিলাতে চায় প্রেম, রতি, বাসনা অথচ চলমান সময় এই বাসনার বুকে ক্ষত এঁটে দেয়। বেলা ফুরিয়ে যায়, নিশি ভোর হয়ে যায়, জীবন ধাবমান মহাকালের পথে এগিয়ে যায়। এই পথিমধ্যও মানুষের আবেগ, উচ্ছ্বাস, পুরাতন অতীতকাল মননে ভাস্বর হয়ে ওঠে।

কবির সৃজন চিত্রকল্প-

‘ভারী অবসন্ন পায়ে, ফের সে নিতে গেলো টলটল অধিরক্তপ্রাণ

কিন্তু কম্পমান হাত খসে বিচূর্ণ হয়েছে সব

মুহূর্তেই লাল-নীল অনুজলকণিকায়

ছেয়ে গেছে চারিপাশ

চেতন হতে না হতেই তার অনুভব হচ্ছিল

মেঝে ছড়ানো সূক্ষ্ম কাচের গায়ে

পুরানো ব্যথাগুলো আবার তার

দেহমনে মারাত্মক আক্রমণ আরম্ভ করেছে’

যাপিত জীবনে বারবার পরিশুদ্ধ হতে চায়। সঙ্গিন ভেবেও হারানো অতীত কাছে নিতে চায়। এটা সহজাত প্রবৃত্তি, কিন্তু যখন মন চেতন হয়ে ওঠে তখন দ্যাখে এসব নিরাশা, ছলনায় ভোলানো। এই মনোবৃত্তি জীবনকে আরো বেশি পোড়াতে থাকে। ধ্বংস করে দেয় চলার অলিগলি। আবার এই মানুষ কি না হতে চায়! অর্থ, বিত্ত-বৈভব, খ্যাতি, যশ-প্রতিপত্তি, আশা থাকে আকাশচুম্বী অথচ মানুষ কিছুতেই সময়কে অতিক্রম করতে পারে না। যাপিত জীবনের প্রামাণ্য কিছু ঘটনা অতীতকালের সাক্ষ্য বহন করে বেড়ায়। এমনই সুরের মূর্ছনা কবির কবিতায় ঝংকৃত হয়েছে।

কবিতাটির ক’লাইন পাঠ করা যাক-

‘লোকটি কবি হতে চেয়েছিল

ঘুরবে সে এপারওপার

তাই সে দুঃখ কড়াবে পণ;

কিন্ত দুঃখ না পেয়ে, কবি না হয়ে

একদিন অকস্মাৎ সে মারা গেল’

ধাবমান পৃথিবীতে সবকিছুর অগোচরে অনেক কষ্ট থাকে, থাকে আবার ব্যক্তিকেন্দ্রিক সুখেদুঃখের যাপন, যা ব্যতিক্রম। ‘পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা’য় এমনই সুরের মায়াজালে বিষয়টি লিপিবদ্ধ হয়েছে।

‘নৈঃশব্দের চেয়ে কিছু বেশি

খসে পড়ে হিম অনুপাতে

ইথারের সুমধুর তানে ছড়ায় মাধরী

ঘাসে ঘাসে, জল ও মাটির কিনারে মনোহর’

কবির কথন অথবা এই সব চিরন্তন সত্য, অনাদি হতে মানুষ জেনে আসছে। দুঃখবোধের অশ্রুঝরা আর আনন্দন যাপনের সমাগম বৈপরীত্যের রথে চলে তবুও কবি নিবিড় আলাপনে নৈর্ব্যক্তিক কর্ষণে অন্যকিছু ভাবেন...

‘এসো উপবনে

বিজন মধুস্বর-পাশে ঘুমায় ফুলেরা

এমন অনাহত নাদে বিরাম ব্যাহত হবে না

সে রব, হলুদ পাতার পাশে মিটমিট মন্দ্র-মোহন বাজে;.

চিরদিন সুধ্বনি কুড়ায় জোনাকি :

নিশিদিন ঘুমচোখে জ্বলে তার সারাদেহ

এ এক প্রাচীন বিহিত!’

কবির এমন আকুতির বিচার বিশ্লেষণে এটা বোধগম্য যে, সমাজের মানুষের অপ্রাসঙ্গিক অথবা অপ্রাসঙ্গিক যাতনা চিরকালীন। এ থেকে মুক্ত হতে চান। অন্তরস্থ ক্ষত বা খরা নিপাতন করার মানসে শব্দঋণের মেলবন্ধনে সেটি শিল্পে রূপান্তরিত করেছে।

‘পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা’য় মানুষের জাগতিক থেকে মহাকালের দ্বৈরথে চলার যে নিয়ম তা মানুষের কাছে নানান বৈপরীত্য বহন করে। কারণ মানুষ ¯্রােতমুখী। কিন্তু সময় ও ¯্রােত মানুষকে পরিবেশের অনুকূলে চলতে দেয় না। পৃথিবী বৈচিত্র্যময়, এখানে এই মানুষের যাপনে বৈচিত্র্যময়তার রূপ পেয়েছে নানান আঙ্গিকে। চরম বাস্তবতা কবির কলমের নিব ছুঁয়েছে যথাযথভাবে...

‘এখন কেউ আছে তমাদি-তোরণ খুঁড়ে

কেউ বায় ক্ষত-অশ্রু-উজান বুকে

নতুনের আবাহনী গায় সুখী

কেউ বা হতেছে নীল, মধুহীন রাত চষে

আবার কেউ কেউ চিত হয়ে থাকে

রতি ও রাতের জখমে খুনে লাল’

পৃথিবীর শুরু থেকে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, সবল-দুর্বল, শক্তি-পরাশক্তি, নতুন-পুরাতন, জয়-পরাজয়, মিলন-বিরহ একটির বিপরীতে অন্যটি ধাবমান। আর এগুলো যখন মানুষের জীবনে আসে তখন কারও কারও অনুভূতিকে নাড়া দেয় এবং যে অনুভূতি শিল্পে রূপান্তরিত হয়ে থাকে। কবির মানসলোকে শৈশবকালের প্রকৃতির বৈচিত্র্য নিবিড় শান্তি আনে। তাই নিবিষ্ট আছে ঘনমেঘ হরিৎ-সকাল, পানাফুল দিঘি, দৌড়-দাপাদাপি-জল মন্থনে হা-ডু-ডু বিকেল, মধুমাস, মেঠো নদী, কাশবন, বাঁকাপথ কবি এসব বুকে ধারণ করে চলমান পরিবর্তিত সময়ের সাথে যোজন-বিয়োজন করার চেষ্টা করেছে এবং শৈশবকালে প্রকৃতি ও দেশপ্রেমের নিরেট উদাহরণ উপস্থাপন করেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আধুনিকতার নামে যে অপকর্ষণ, অমানবিকতা চলছে তা দেখে কবি বিষণ্নবদনে বলেন..., ‘হে অনুমেয় আকাশের আভা, তুমি যা ধরে আছো এতো নীল ছিল না সেখানে, নীল রক্ত এতো বিষাদ ছোঁয়া!’ মানুষ আধুনিকতার চর্চার কথা বললেও নৈতিকতা, মানবিকতা, সভ্যতাকে এড়িয়েই চলছে প্রতিনিয়ত, যেখানে নাই দেশপ্রেম, প্রকৃতি প্রেমের সমোরোহ। ‘ফাঁস’ কবিতায় কবি বলে ‘সবকিছু ফাঁস হয়ে গেছে/জন্মের নগ্নতা ফাঁস’ মূল্যবোধের চর্চার অভাবের কারণ অথবা একে অন্যের প্রতি সম্মানবোধ না থাকায় কেউ কারও গোপন বিষয়ও ফাঁস করে বেড়ায়। সমাজব্যবস্থায় নিয়মনীতি, শাসনকার্য, ন্যায়নীতি, নড়বড়ে হয়ে গেলে যখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়, তখন ফাঁস হয়ে যায় গোপন প্রেমের সন্ধিও। বইয়ের শেষের দিকের একটি কবিতায় একজন ব্যর্থ প্রেমিকের আর্ত চিৎকার ফুটে ওঠেছে, এ প্রেম ছিল প্রকৃতি, মানবপ্রেম অথবা নিজস্ব শিকড়ের প্রতি প্রগাঢ় টান। অনুশোচিত প্রেমিক কেঁদে ওঠে, ‘সেই সিক্ত শ্যামাঙ্গির কথা ভেবে আর কত ব্যথা পাবো/আর কত পোড়াবো হৃদয় স্মরণে-সজ্জায় নিশিদিন/’

অতীতকালের স্মৃতি ভোলা যায় না। জীবনব্যাপী অনেক স্মৃতি সঞ্চিত হয়। মানুষে মানুষে প্রেম, প্রকৃতির প্রতি টান। পরমাত্মার প্রতি টান। কিন্তু জীবন সময়কে অতিক্রম করতে পারে না বলেই মানুষ এ ঘাট থেকে ও ঘাটে জীবন তরী ভিড়ায়। কিন্তু হারানো দিনের স্মৃতি তাকে তাড়া করে। মনের জানালায় উঁকিঝুঁকি দেয়। অবশেষে সেই সব দিন ফেরৎ পেতে ব্যাকুল হয় - ‘পৃথিবীর চক্রপথে যদি কভু দেখা পাই/হৃদয়ের অবিরাম আশ্বাসে সাড়া দেয় এই দেহযান/আজও একা চুপিসারে বসে থাকি নদীতীরে ব্যথাহত বিজন সন্ধ্যায়’। ‘পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা’ ব্যথার সুরের বাহন, ভাষা বিনির্মাণ, শব্দ চয়নে অনন্য। কবি সৌম্য সালেক সাবলীল ভাষা বিনির্মাণের মাধ্যমে মানুষের সূক্ষ্ম বেদনাবোধকে তুলে এনেছেন।

বইটিতে মোট কবিতা আছে ৪৪টি। প্রচ্ছদ এঁকেছেন মোমিন উদ্দীন খালেদ, প্রকাশ করেছেন ফরিদ আহমেদ। বইটির দাম রাখা হয়েছে ১৬০ টাকা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়