প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
‘মানুষ বুদ্ধির পরিচয় দেয় জ্ঞানের বিষয়ে, যোগ্যতার পরিচয় দেয় কৃতিত্বে, আপনার পরিচয় দেয় সৃষ্টিতে।’
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও মুজিব শতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ ‘সুবর্ণ-শতক’ গ্রন্থখানি সৃষ্টিতে এর অভ্যন্তরের স্রষ্টারা তাদের আপনার কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন অতি নিপুণতার সাথে। এই বইয়ের বিষয়বস্তু বাংলাদেশের এক মহাব্যাপ্তি সমন্বিত মহাকাব্য স্বাধীনতা সংগ্রামের সুবর্ণজয়ন্তী এবং এ মহাকাব্যের নায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ ধরায় আগমনের শতবর্ষ নিয়ে। বইটি অনেক বার পাঠ করে মন এক মুগ্ধতায় ছেয়ে আছে।
স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধু নামক মহীরূহকে দেখার সৌভাগ্য না হলেও মুক্তিযুদ্ধের অগণিত বই, ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘আমার দেখা নয়া চীন’, ‘কারাবন্দীর রোজনামচা’, ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শতকবিতা’ পড়ে এই মহাসাগরে ডুব দিয়ে জানার চেষ্টা করেছি মাত্র। কিন্ত এই বইয়ের রচয়িতারা স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাদের যে টুকরো টুকরো ভাললাগা ও ঋদ্ধতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তাতে অবগাহন করে নতুন করে বঙ্গবন্ধুকে জানা গেল।
সুবর্ণ-শতকে যারা লিখেছেন তারা প্রত্যেকেই চাঁদপুরের সুধী, প্রাজ্ঞ ও বিজ্ঞজন, মুক্ত উদার মনের সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালনকারী।
বইটির প্রথম লেখাটি পড়ে জানা গেল ১৯৭০-এর ২০ ফেব্রুয়ারি এ মহামানবের চরণযুগলের স্পর্শে চাঁদপুরের মাটি ধন্য হয়েছিল। এর পরের লেখাটি যাঁর সেই আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কলাম, প্রবন্ধ বা লেখা মানেই জ্ঞানের অতলে ডুব দেয়া। তিনি তাঁর ছোট্ট নিবন্ধটিতে দেখালেন গান্ধীর মূল রাজনৈতিক দর্শন অহিংস অসহযোগ আন্দোলন বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনীতিতে সফলতার সঙ্গে পুনরুজ্জীবিত করলেও বঙ্গবন্ধু সুভাষচন্দ্রের ‘অস্ত্র দ্বারা শত্রুপক্ষকে আঘাত করার’ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর অহিংস অসহযোগ আন্দোলন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। তিনি আরও জানালেন গান্ধী ঘাতকের গুলিতে নিহত হয়ে যেমন বেঁচে উঠেছিলেন তেমনি বঙ্গবন্ধুও ঘাতকের গুলিতে শহিদ হয়ে পুনরুজ্জীবিত হয়েছেন তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে দেশে বিদেশে দল মত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের কাছে। গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু দুই মহান নেতার এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন লেখক।
মেঘনাপাড়ের দুহিতা তথা চাঁদপুরবাসীর আশা-ভরসার স্থল শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের লেখা সম্পর্কে উক্তি করা ধৃষ্টতার পর্যায়ে পড়ে। তাঁর জাতির জনককে নিয়ে লেখার নামকরণ ‘ত্রিকালদর্শী মহানায়কের অমর কাব্য’ সার্থক। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে তিনি বলেছেন অমর মহাকাব্য। আর সেই মহাকাব্যের অমর কবি বঙ্গবন্ধু। শেষে তিনি রবীন্দ্রনাথেই ফিরে গিয়ে সকল মিথ্যাচার আর ইতিহাস বিকৃতিকে রুখে দিলেন এই বলে---"তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদ্ঘাটন সূর্যের মতন"।
এর চেয়ে সাহিত্যিক মূল্যায়ন আর কী হতে পারে!
বরেণ্য কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বঙ্গবন্ধুকে আমাদের মনের আঙ্গিনায় দাঁড় করালেন এক অবিনাশী মানুষ রূপে। তিনি দেখালেন মৃত্যু তাঁকে কেড়ে নিলেও এই মহামানবের বিনাশ নাই। বঙ্গবন্ধু আমাদের সামনে অমরত্বের সাধনা। লেখক বাংলার গণমানুষের চেতনায় মুজিবকে প্রোথিত করলেন প্রদীপ্ত আলো করে।
সম্মানিত জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশের ছোট্ট একটুখানি প্রবন্ধ বলব না, মনের আকুতি প্রকাশে এতো প্রাণময় করে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করেছেন যে, পাঠের শেষে এর রেশ দীর্ঘ সময় ধরে শুধু থাকেই না, এক অন্যরকম ভাললাগায় মনে তৃপ্তি আনে। ওনার লেখা পড়ে অনুপ্রাণিত হবে কিশোর-কিশোরী থেকে যুবা বৃদ্ধরাও।
মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী মোঃ দেলোয়ার হোসেনের লেখায় তথ্য যেমনি আছে, তেমনি আছে আঠারো বছরের যুবকের চোখে স্বাধীনতা লাভের উন্মাদনা, আছে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার নেপথ্য আহ্বান। প্রসঙ্গান্তরে ‘আমি বিজয় দেখেছি’ গ্রন্থে এম আর আখতার মুকুলের দেয়া উদ্ধৃতি---"আধ্যাত্মিক জগতের ধর্মকে কখনোই রাষ্ট্রীয় চৌহুদ্দির মধ্যে আটকে রাখা বা ক্ষমতাসীনদের সুবিধার জন্যে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বাঞ্ছনীয় নয়, ইহার ফল শুভ নয়, বাংলাদেশের অভ্যুদয় এর একটি জ্বলন্ত প্রমাণ’। অন্তরের এক অনির্বচনীয় সত্য ধ্বনি হয়েছে এই উদ্ধৃতিতে।
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার স্যারের লেখায় দেখি সাহিত্য ও রাজনীতির এক বিরোধহীন পথ চলা। এখানে জীবনের প্রতি পদে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিকে লালন করা এক ঋদ্ধ বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে পাই।
ডাক্তার হয়েও যিনি সাহিত্যকে মনে প্রাণে ধারণ করেন, উপস্থাপনা আর বক্তব্যকে যিনি শব্দের মালায় গাঁথেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যার কবিতা চাঁদপুরের নতুন কুঁড়িদের মুখে মুখে, তিনি ডাক্তার পীযূষ কান্তি বড়ুয়া। তার লেখার বিষয় ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর বিদেশি বন্ধুরা’। পাঠকের কাছে এটা সত্যিই এক ভিন্নধর্মী উপস্থাপনা। লেখক দেখাতে চেয়েছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিবেদিতপ্রাণ, অকৃত্রিম এই বিদেশী বন্ধুরা ছিলো বলেই আমাদের স্বাধীনতা লাভের পথ কণ্টক বিছানো না হয়ে কিছুটা সহজতর হয়েছে। স্বল্প অবয়বে এমন তথ্য বহুল লেখা পড়ে নিজেও সমৃদ্ধ হয়েছি। এ যেন বিন্দুর মাঝে সিন্ধুর গভীরতা।
তৃপ্তি সাহা, যিনি শুধু নিজেই বইয়ের সাগরে ডুব দেন না, বইয়ের ফেরিওয়ালাও। ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে বই পড়ার স্বপ্ন, উন্মাদনা, আগ্রহ সৃষ্টি করে দেন। কোমলতা আর মায়ায় ভরা লেখনি ওনার। এ বইয়ে ওনার বিষয়টির দুটি লাইন প্রাণে গেঁথে আছে - নেতাজি যেখানে বলেছেন-"আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দিব। সেখানে বঙ্গবন্ধু কিছু চাইলেন না। বরং বললেন, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দিব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এভাবেই তিনি ইতিহাসের পাতায় অনবদ্য একটি নাম হয়ে গেলেন। তৃপ্তি সাহা! বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আপনার এ লেখাটিও অনবদ্য। এছাড়া কাজী শাহাদাত, অধ্যক্ষ অসিত বরণ দাশ স্যার, বাংলার অধ্যাপক মোঃ সাইদুজ্জামান, গবেষক মুহাম্মদ ফরিদ হাসান, মুক্তা পীযূষ দিদিসহ আরো যে সকল গুণীজন লিখেছেন, প্রত্যেকের লেখা মেনে নয়, মনে নিয়েই পড়েছি। কখনো কবিতার ছন্দে হারিয়ে গেলাম টুঙ্গিপাড়ায়, কখনো যুদ্ধের ময়দানে, কখনো মিছিলে মিটিংয়ে শ্লোগানে, লাল সবুজের পতাকায়, কখনো বা ভাটির জলস্রোতে, কখনো মাটির ধূলিকণায়।
তবে পাঠ আলোচনায় প্রত্যেকের লেখায় বিষয় বৈচিত্র্য থাকলেও এক চিন্তায় সকলেই বিনিসুতার মালায় গাঁথা, তা হলো --মাতৃভূমি মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। প্রত্যেকেই স্বদেশের মাটি দিয়ে ললাটে এঁকেছেন রক্ততিলক। মুক্তিযুদ্ধ সকলের কাছে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংকল্প, আর সব মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু মানে মুক্তির বারতা, মানচিত্র, লাল সবুজের পতাকা আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। তাই এই বইয়ের লেখকদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে পাঠক তথা পুরো জাতির প্রতি নিবেদন, আসুন আমরা চর্যাপদের ভুসুক পা থেকে রবীন্দ্র নজরুল জীবনানন্দ সৈয়দ শামসুল হকের মত মনেপ্রাণে বাঙালি হই, যার বীজমন্ত্র সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। আর সংস্কৃতি নামক ধর্মটি হৃদয়ে লালন করি, যেটি সকল বাঙালির কণ্ঠে কণ্ঠহার হয়ে সম্প্রীতির ব্যজনী বুলাবে। জয়তু সুবর্ণ-শতক।
লেখক পরিচিতি : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজ, চাঁদপুর।