মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৪ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন
অনলাইন ডেস্ক

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন কেবল একটি নাম নয়, কর্মগুণে তিনি হয়ে উঠেছেন একটি প্রতিষ্ঠান এবং বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও সাংবাদিকতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর মতো শতবর্ষী কর্মময় মানুষ আমরা খুব একটা পাইনি। যতদিন বেঁচেছিলেন দু হাত ভরে নিরলস কাজ করে গেছেন। ১৮৮৮ সালো ৩ নভেম্বর তাঁর জন্ম, বর্তমান চাঁদপুর জেলার পাইকারদি গ্রামে। স্বাভাবিকভাবেই তখনকার সময়টা অগ্রসর নয়, বরং ভীষণ রকমের পশ্চাৎপদ। ওই সময়ে সংস্কৃতির চর্চা ছিল ধর্মান্ধতার শেকলে মারাত্মকভাবে বন্দী। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন এমন অনগ্রসর সমাজে কেবল জন্মই নেননি, এর মধ্য দিয়ে তিনি বেড়েও উঠেছেন। কিন্তু অন্য তরুণ-যুবকদের চেয়ে তিনি ছিলেন আলাদা। তাঁর স্বাতন্ত্র্য ছিল বিদ্রোহী ও ভাবুক সত্তায়।

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন একটি পত্রিকা প্রকাশ করার কথা ভাবতেন। তিনি মনে করতেন, শক্তিশালী একটি পত্রিকার মাধ্যমেই সমাজের কুসংস্কার, অজ্ঞতা, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করা যাবে। পাশাপাশি সংস্কৃতির উন্নয়ন সাধনও সম্ভব হবে। তাঁর এমন চিন্তা থেকে ১৯১৮ সালে প্রকাশিত হলো সওগাত। এর প্রথম সংখ্যার প্রথম লেখাটি ছিল বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের। লিখেছেন মানকুমারী বসু, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, শাহাদাত হোসেন, জলধর সেন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, ভূজঙ্গধর রায় চৌধুরী ও আলী প্রমুখ। সওগাত প্রথম সংখ্যাটি ছিল ঐতিহাসিক ও মাইলফলকে পরিপূর্ণ। সওগাতই ছিল প্রথম চিত্রবহুল মুসলমানদের পত্রিকা। কেবল তা-ই নয়, আধুনিককালে শিল্পের মান বিবেচনায় এটি বাংলার মুসলমানদের করা প্রথম সাহিত্য পত্রিকাও।

সওগাত প্রথম সংখ্যা নিয়ে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। কবি পত্রিকাটি পেয়ে খুশি হয়েছিলেন। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন স্মৃতিকথায় লিখেছেন :

আমি প্রথম সংখ্যা ‘সওগাত’ তাঁর হাতে দিলাম। কিছু না বলে তিনি পত্রিকাটি আগাগোড়া কয়েকবার পাতা উল্টিয়ে দেখলেন এবং কবি সত্যেন্দ্রনাথ সত্তের ‘সৌন্দর্য্য সূর্যের প্রতি’ ও কুমুদরঞ্জন মল্লিকের ‘হাফেজ’ এই দুটি কবিতা পড়েই ফেললেন। মনে হলো লেখা দুটি পড়ে তিনি খুশি হয়েছেন। আমাকে বললেন, পত্রিকাটির এতো সুন্দর নাম রেখেছে কে?

আমি বললাম : বহু চিন্তা করে সবার গ্রহণযোগ্য হবে বলে এই নামটি আমিই নির্বাচন করেছি।

কবি বললেন, তোমার রুচিবোধ প্রশংসার যোগ্য। এরপর পুনরায় বললেন, মুসলমান সমাজের বর্তমান অবস্থায় তাদের মধ্য থেকে যে এরূপ সুন্দর একখানা মাসিক পত্রিকা বের হতে পারে আমার ধারণা ছিলো না। আজ পর্যন্ত তোমাদের এ ধরনের কোনো মাসিক পত্রিকা আমার হাতে আসেনি। আশা করি, তোমার প্রচেষ্টা সার্থক হবে।

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সেই সাক্ষাতে কবির কাছে একটি লেখা চেয়েছিলেন। ততদিনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখার স্বত্ব বিশ্বভারতীকে দিয়ে দেন। লেখক সম্মানী দিয়ে বিশ্বভারতী থেকে লেখা সংগ্রহ করতে হত। কিন্তু নাসিরউদ্দীনের তখন সম্মানী দেয়ার অবস্থা ছিল না। তিনি রবীন্দ্রনাথকে সে-কথা জানিয়েছিলেন। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ সওগাতের জন্যে পথের সাথী নামে একটি কবিতা চিঠিসহ পাঠান। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘বিশ্বভারতীকে টাকা দিয়ে আমার লেখা নেয়া তোমার পক্ষে সম্ভব হবে না বলে সেদিন জানিয়েছিলে। আমি লক্ষ্য করেছি তুমি খুব নিরাশ হয়ে চলে গেলে। একটা কবিতা পাঠালাম। আশা করি, তোমার ভালো লাগবে। এর জন্যে টাকা দিতে হবে না।’ কবিতাটি সওগাত-এর দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। সওগাতের অগ্রহায়ণ, ১৩২৬ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ নিজ থেকেই ‘সওগাত’ শিরোনামে কবিতা পাঠিয়েছিলেন। নাসিরউদ্দীন লিখেছেন, ‘এরপরেও মাঝে মাঝে তাঁর রচনা সওগাতে ছাপা হয়।’

রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ ও কবিতা পাওয়া নাসিরউদ্দীনের জন্যে উৎসাহের ও সম্মানজনক ছিল। তিনি শেষ বয়সেও পথের সাথী কবিতাটি মুখস্থ বলতে পারতেন।

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের স্মৃতিকথায় রবীন্দ্রনাথ

প্রথম সংখ্যা ‘সওগাত’ বের হবার কয়েক দিন পর সংখ্যাটি সঙ্গে নিয়ে আমি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সাক্ষাৎ করতে তাঁর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে যাই। ঠাকুর বাড়ির গেটের মধ্যে প্রবেশ করে এক মালিকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, কবি বাড়িতেই আছেন। বলা বাহুল্য, এর আগে কবিকে দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আমি সিঁড়ি দিয়ে কিছু উঠেই আমার মনে একটা দ্বিধার সঞ্চার হলো। ভাবলাম, আমি কবি নই, অপরিচিত একটি যুবক মাত্র। কী সাহসে এতো বড় কবিস¤্রাটের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি সামান্য একটা পত্রিকা হাতে করে। নিরুৎসাহ এসে পড়লো এবং সিঁড়ি দিয়ে নিচের দিকে নামতে লাগলাম। পেছন থেকে মালি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো : দেখা করলেন না? উপরে চলে যান, বাবু বৈঠকখানায়ই আছেন।

ধীর পায়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠে গেলাম। কবিকে সালাম করলাম। শান্ত-স্নিদ্ধ দৃষ্টিতে তিনি সালাম গ্রহণ করলেন এবং আমাকে বসতে বললেন। আমি কোনো কথা বলবার আগেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার হাতে ওখানা কী? আমি প্রথম সংখ্যা ‘সওগাত’ তাঁর হাতে দিলাম। কিছু না বলে তিনি পত্রিকাটি আগাগোড়া কয়েকবার পাতা উল্টিয়ে দেখলেন এবং কবি সত্যেন্দ্রনাথ সত্তের ‘সৌন্দর্য্য সূর্যের প্রতি’ ও কুমুদরঞ্জন মল্লিকের ‘হাফেজ’ এই দুটি কবিতা পড়েই ফেললেন। মনে হলো লেখা দুটি পড়ে তিনি খুশি হয়েছেন। আমাকে বললেন, পত্রিকাটির এতো সুন্দর নাম রেখেছে কে?

আমি বললাম : বহু চিন্তা করে সবার গ্রহণযোগ্য হবে বলে এই নামটি আমিই নির্বাচন করেছি। কবি বললেন, তোমার রুচিবোধ প্রশংসার যোগ্য। এরপর পুনরায় বললেন, মুসলমান সমাজের বর্তমান অবস্থায় তাদের মধ্য থেকে যে এরূপ সুন্দর একখানা মাসিক পত্রিকা বের হতে পারে আমার ধারণা ছিলো না। আজ পর্যন্ত তোমাদের এ ধরনের কোনো মাসিক পত্রিকা আমার হাতে আসেনি। আশা করি, তোমার প্রচেষ্টা সার্থক হবে।

আমি বিনম্রকণ্ঠে বললাম, আমার পত্রিকায় ছাপানোর জন্যে যদি একখানি লেখা দিতেন। কবি বললেন, আমার সমস্ত লেখার স্বত্ব বিশ্বভারতীকে দান করেছি শান্তিনিকেতনের জন্যে। আমার লেখা পেতে হলে বিশ্বভারতীর কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। আমার লেখার পারিশ্রমিকও তাঁরাই গ্রহণ করে থাকেন।

আমি বললাম : আমার টাকা পয়সা বিশেষ নেই। কেবলমাত্র মনের বল ও উৎসাহ নিয়েই সওগাতের কাজে হাত দিয়েছি। বিশ্বভারতীকে টাকা দিয়ে লেখা নেয়া কাগজের এই প্রাথমিক অবস্থায় হয়তো সম্ভব হবে না।

কবির উৎসাহসূচক বাণী ও স্নেহাশিষ নিয়ে সেদিন ফিরে এলাম। চার পাঁচ দিন পর পুরু কাগজে বিশ্বভারতীর মনোগ্রাম আঁকা একখানা লেফাফা ডাকে পেলাম। ভেতর বিশ্বকবির একখানা চিঠি এবং ‘পথের সাথী’ নামে একটি কবিতা। চিঠিতে তিনি লিখলেন- বিশ্বভারতীকে টাকা দিয়ে আমার লেখা নেয়া তোমার পক্ষে সম্ভব হবে না বলে সেদিন জানিয়েছিলে। আমি লক্ষ্য করেছি তুমি খুব নিরাশ হয়ে চলে গেলে। একটা কবিতা পাঠালাম। আশা করি, তোমার ভালো লাগবে। এর জন্যে টাকা দিতে হবে না।

“ঘরের লোকে কেঁদে কইলো মোরে,

আঁধারে পথ চিনবে কেমন করে

আমি কইনু, চলবো আমি নিজের আলো ধরে

হাতে আমার এই তো আছে বাতি।”

কবিতাটি সওগাতের পরবর্তী সংখ্যার (১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা-পৌষ, ১৩২৫) প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়। কবি একটা মহান উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বভারতীকে তাঁর সমস্ত লেখার স্বত্ব দান করেছেন জেনে সওগাতে লেখা দেবার জন্যে আর তাঁকে বিরক্ত করিনি। কিন্তু কবি ইচ্ছা করেই দ্বিতীয় বর্ষেও প্রথম সংখ্যা (অগ্রহায়ণ, ১৩২৬) সওগাতের জন্যে ‘সওগাত’ শীর্ষক আরো একটি সুন্দর কবিতা ডাকযোগে পাঠিয়ে দেন। এরপরেও মাঝে মাঝে তাঁর রচনা সওগাতে ছাপা হয়। ‘সওগাত’ নামটি রবীন্দ্রনাথের খুব পছন্দ হয়েছিলো। তাই তিনি দ্বিতীয় বর্ষেও প্রথম সংখ্যা সওগাতের জন্যে লিখে পাঠালেন ‘সওগাত’ নামে একটি কথিকা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়