প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
নদীবর্তী রেলস্টেশনের সাথে সুদীর্ঘ সখ্যের সূত্রে মাঝে মাঝে নিরেট আড্ডায় মূর্ত হয় ইতিহাস। আমি শ্রোতা সে কালের কথক। পেটে জমে থাকা কালের সাক্ষ্য উদ্গীরণে সে হয়ে ওঠে প্রগলভ। নিজের ভাষ্যে আসাম বেঙ্গলের হাতে তার জন্ম। তার জন্মদিনে মেঘনার ইলিশেরা মেতে উঠেছিল জলজ্যোৎস্নার উৎসবে। তিননদীর কলতানে বেজে উঠেছিল সম্প্রীতির সঙ্গীত। দুজনের আড্ডায় মাঝে মাঝে চায়ে নিজেকে চাঙ্গা করে তুলি। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বিজ্ঞ প্রবীণের ঢঙে বলে যায় ঊনিশশো একুশের বিশে মে’র কথা। ‘গাছ হিলেগা রুপিয়া মিলেগা’র স্বপ্নভাঙা ত্রিশ হাজার চাণ্ডবাগান শ্রমিক এখানেই গড়ে তোলে ‘মুল্লুকে চলো’ নামের স্বপ্নবৃক্ষ। গোরাদাস গুর্খাদের করাতে সে বৃক্ষ চিরে কে সি দে নির্মাণ করে ইতিহাসের আসবাব। ডাকাতিয়াণ্ডমেঘনার জল জানে সে রক্ত স্রোতের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব। এই স্টেশনেই দেবেন ঠাকুরের ছোট ছেলেটা এসে কালীমোহনকে বড় করে দিয়ে গেছে বাঙালির কাছে। নার্গিসের হাত থেকে ট্রেনে চড়ে পালিয়ে চুরুলিয়ার লাল মাটির হাবিলদার ভাড়ার অভাবে এর কাছেই কাটিয়ে গেছে রাত। 'জয় বাংলা'র তর্জনী এসে আপন জ্যোতিতে তাড়িয়েছিল সকল আঁধার। তাঁর পদরেণুতে তীর্থ দর্শনের পিপাসা মেটে কথকের।
একটানা রোজনামচার কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে ওঠে বন্ধু আমার! তারপর দম নিয়ে আবার শুরু করে বয়ান। ক্ষোভ আর শোকের দীর্ঘশ্বাসে অসহিষ্ণু কণ্ঠে সে হয়ে ওঠে 'ক্ষুধিত পাষাণ'। মুক্তিযুদ্ধ তার কণ্ঠে জীবন্ত হয়। বধ্যভূমির আর্তনাদ আর কর্তিত স্তনের পিলে চমকানো গোঙানিতে সে উন্মাদ হয়ে ওঠে। রোজনামচার গল্প আর এগোয় না। অসমাপ্ত রোজনামচার পুরোটা শোনার জন্যে বার বার তার দ্বারস্থ হই। আমার শ্রবণসক্ষমতা বাড়লেও সে হয়ে ওঠে বাকপ্রতিবন্ধী।
বাকপ্রতিবন্ধী ইতিহাস আজও গুমরে মরে মনের বধ্যভূমিতে।
.
মারিমুক্তির ভিষক
ল্যাজারাসের মতো মারিমৃত পৃথিবীর পুনরুজ্জীবন কামনায় যে সভ্যতা বিশ্বাসণ্ডদর্শনণ্ডবিজ্ঞানে প্রত্যাখ্যাত, কবিতার কাছে আজ তার মুক্তির মার্গ খুঁজে ফেরে।
ভক্তির কাছে নিজেকে সমর্পণ কিংবা যুক্তির কাছে বলণ্ডভিক্ষার সময় ক্ষেপণ করে জ্ঞান যখন আশার আলো দেখিয়েও মাঝপথে খেই হারায়, তখন কবি হয়ে ওঠে ত্রাতা।
কীটদগ্ধ সময়কে পুনর্নির্মাণ করার সাফল্যের ইতিহাস আছে কেবল কবিতার। শোকগ্রস্ত বিপ্রের বিপর্যস্ত মনকে যে ফিরিয়ে দিয়েছিলো অন্তঃপুরের নিরেট ভেদনযোগ্য প্রজ্ঞা, অনন্ত সে সুধার শাশ্বত স্রোতের নাম কাব্য এবং কাব্য।
খণ্ডপ্রস্থকে ইন্দ্রপ্রস্থ করে তোলা কিংবা জানকীকে অনন্ত বস্ত্রাবৃত করে তুলেছিল কবিতার প্রাচীন বংশীবাদক। মারিদগ্ধ সময়ের দুর্বৃত্তায়নকে বোতলবন্দি করে মুক্তপৃথিবীর জলপাই শাখায় সবুজের ঝিলিক আনার দায়িত্ব দেয়া হোক কবিকে।
কবিই সর্বকালের সেরা ভিষক, কবিতাই দুরারোগ্যের আবহমান আরোগ্য নিকেতন।
মারিমুক্তির অনাবিষ্কৃত ভ্যাক্সিনের নাম কবিতা।
.
মা
রক্ত শুষে জন্ম হয় রক্তের
যেমনটা পাথর কুচি পাতা ফুঁড়ে জন্ম হয় নতুন চারার
গ্রহ ভেঙে তৈরি হয় গ্রহাণু
যেমনটা সূর্য ক্ষয়ে তৈরি হয় নতুন নক্ষত্র
আমিও জরায়ুতে নির্মিত হই তিলে তিলে মাতৃহনন করে।
আমাকে ধারণ করে স্বপ্ন দেখে মা
শিয়রে প্রয়াত খুড়ো এসে রোগের বড়ি খোঁজে
সেই থেকে ঘুমে নয়, নিত্য গৃহকর্মে
সাদা এপ্রোন পরে হেঁটে যায় স্বপ্নরা।
যে গাঁয়ের মাটিতে জেগে আছে শৈশব
তার দেহে লেগে আছে মায়ের ঘ্রাণ
পাহারা দেয় অহর্নিশ ঘুমেণ্ডজাগরণে
যে নদীর বুকে জমা আছে বালকবেলার তাবৎ গল্প
তার বুকে খুঁজে পাই মায়ের সুধার স্রোতে
যে স্কুল শিখিয়েছে বর্ণমালার আঁক তার টুলণ্ডটেবিলে
মাখা আছে মায়ের মমতা আর শাসনের উষ্ণ পরশ।
যে দেশ সযত্নে বুকে রাখে আমার পদচ্ছাপ
তার বাতাস হয়ে ওঠে মায়ের শীতল আঁচল
ধরিত্রীর যে আকাশ চোখে হারায় প্রতিদিন
তার বুকে খুঁজে ফিরি মায়ের দু'চোখের তারা
যেখানে সাঁতার কাটি অবিরাম স্মৃতির সরোবরে।
বাংলাভাষার প্রতিটি বর্ণ আমার মায়ের মুখ
যখনই কথা বলি, আদর নিয়ে বসে থাকে মা প্রতিটি হৃদস্পন্দনে।
.
বর্ষার নন্দনতত্ত্ব
একমাথা মেঘে যে ছিল বসে ধূসর আঁধার নিয়ে
মেঘে নয় বর্ষা তার চোখেই পেয়েছিল বর্ষণের বর
ফাগুনণ্ডদিনে বিরহের বর্ষা যাকে ভেজাতো লোনাজলে
আষাঢ়ণ্ডশ্রাবণ আজ তার কাছে চির অজানা অচিন।
অথচ কদমেই ছিল কোন এক প্রগলভ দুপুরের হাসি
চৈত্রের খরতাপে চৌচির হওয়া মৃত্তিকার বুকে
সেদিন যারা এঁকেছিল জীবনের কাক্সিক্ষত ফল্গুধারা
আজ তারা মেঘহীন মরুময় আকাশের পরিযায়ী প্রাণ।
বর্ষার বেগবতী নদী যে নারী দু'পায়ে তৈরি করে ঘূর্ণি
আজ তার হাসিতে ফোটে না পদ্ম, চন্দ্রাহারী অমাবস্যা অন্ধকারে উল্লসিত হয়ে ওঠে গুহার প্রথম প্রদোষে
বর্ষণপীড়িত মন বৃষ্টির সেতারে খোঁজে না নন্দনতত্ত্ব।
.
ঠিকানা বদল
ঠিকানা বদল হওয়া মানেই অনিশ্চয়তার নতুন সরোবর
ঠিকানা বদল হওয়া মানেই স্বস্তি ভেঙে অস্বস্তি হওয়া
অস্বস্তির যাতনাগুলো অধিকতর অস্বস্তিকর হয়ে ওঠা
আত্মোন্নতির জন্যে ঠিকানা বদল হয়ে ওঠে এক সময় বিড়ম্বনাণ্ডবৃক্ষ।
যে শিশু সদ্যোজাত, সবেমাত্র মায়ের গর্ভ হতে ঠিকানা বদলে
ভূমিষ্ঠ হয়েছে ধরণীর ধূলিতলে, তার বিড়ম্বনা যেন মহাভারত
তারও আগে পরমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যে ভ্রূণ ঠিকানা বদলেছিল
মায়ের নিরাপদ গর্ভে নয়মাসব্যাপী তারও সয়ে যেতে হয় অনিশ্চয়তা
ঠিকানা বদল মানেই জীবনের ভাঙাগড়া, অপ্রাপ্তির আঁধারও।
যে কিশোরি বাবার কাছে ছিলো দুধেভাতে, ছিলো ভাইয়ের খুনসুঁটিতে
বিয়ের বলিকাঠে তার হঠাৎ ঠিকানা বদলে গেলে বদলে যায় সব
তার স্বস্তিগুলো বুদ্বুদ হয়ে উড়ে যায়, অস্বস্তির গোলা ভরে ওঠে
প্রাপ্তির যে কল্পনা তার মনলোকে ডানা মেলে উড়ছিলো এতকাল
হঠাৎ করেই একদিন ভুল ঠিকানার দ্বারে তার উপনীত হয় বিড়ম্বনা
বন্ধু বা প্রেমিকের বেশে, সুহৃদ বা প্রেমিকার অবয়বে যারা আসে
তাদের অনেকেই অনেকের ভুল ঠিকানা, অনেকেই অনেকের বিড়ম্বনাণ্ডবৃক্ষ
মদনণ্ডমোহনে যে ঘোর তৈরি করে সময়, সময়ই সে ঘোরে ঢেলে দেয় আলো
ঘোরের চোখে তখন বাস্তবের গরল এসে জোয়ার তোলে অশ্রুর লোনাজলে।
ঠিকানা বদলানো মানেই নিশ্চয়তা নয়, ঠিকানা নতুন হওয়া মানেই প্রাপ্তি নয়
ঠিকানা বদল হওয়া মানে নতুন বিড়ম্বনা যেমনটা মর্ত্যরে মানুষের অমর্ত্যে যাত্রা
শাস্তি না পুরস্কার এই অনিশ্চয়তায় যে মানুষ মাটির শয্যায় ঠিকানা বদলায়
কেউ কোনদিন জানেনি, জানবেও না এই ঠিকানা বদলে আদৌ সে কী পায়!