মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০

সোনার তরী কাব্যের দর্শন
অনলাইন ডেস্ক

রবীন্দ্রবাণী অতি সরল তবু অতল গভীর। রবীন্দ্রনাথ সহজ তবু অগম্য-নিবিড়। রবীন্দ্রনাথ 'শেষের কবিতা'য় শেষে এসে বলেছেন,

'তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান

গ্রহণ করেছো যতো ঋণী ততো করেছো আমায়'

বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রভাষ্যে সরল এ বাণী সে তার জীবনের বিনয়-সমুদ্রের দু'একটি তরঙ্গ মাত্র। রবীন্দ্র-বিনয়ে বিনোদিত বাঙালি রবীন্দ্র-সরোবরের অতল গহনের গভীরতা মাপতে পারেনি কখনো। তাই রবীন্দ্র-রাজ্য এখনও বাঙালির মানস-কুসুমের অপরিহার্য মালঞ্চ। রবীন্দ্রনাথ যতটা না কবি তার চেয়ে অনেক বড় এবং অনেক গভীরতর উপলব্ধির দার্শনিক। রবীন্দ্র-ছন্দের সরল চরণে দর্শনের মঞ্জির-ধ্বনি পরাণ-পরমে এনেছে মরমিয়া বাণী। তাই রবীন্দ্রকাব্যের নির্যাস মন্থনে জীবনের অদৃষ্ট-দর্শনের অমৃত-নহর বয়ে যায় সমুদ্রের লহরের মতো। রবীন্দ্র কাব্যের আপাত সাংসারিক রূপের মধ্যে যে আধ্যাত্ম্য জলছবি ফুটে উঠে তাতে রবীন্দ্রনাথ যে তার নাথের মিলনে আকুল তা প্রতিভাত হয়। এই রবীন্দ্র 'নাথ' সংসার ধূলিজালে ধূসর-মলিন হয়েও পরমের প্রকাশ ঘটায় চিনত্দনের অলৌকিক সূত্রে। রবীন্দ্র-মননের গভীরতা কেউ যে সঠিক নাগাল পাবে এ বিষয়ে কবি নিজেই সংশয়ে ছিলেন। তাই কবিগুরু নিজেই 'মানসী' কাব্যগ্রন্থে 'আমার সুখ' কবিতায় বলেছেন,

'তুমি কি করেছ মনে দেখেছ পেয়েছ তুমি

সীমারেখা মম

ফেলিয়া দিয়াছ মোরে আদি অন্ত শেষ করে

পড়া-পুঁথি সম?'

সত্যিকার অর্থে রবীন্দ্র-রহস্য এখনও কোন অভিযাত্রিকের কাছে সম্পূর্ণ আবিষ্কৃত হয়নি। রবীন্দ্র-সরোবরে পিপাসু কেবল পান করে যায়, পায় না অলৌকিক অতল সন্ধান।

রবীন্দ্র-কাব্য সম্ভারের যে কবিতা নিয়ে এই প্রবন্ধের শিরোনাম, কবি তা রচনা করেন এ দেশে, পদ্মা নদীর উপর 'পদ্মা' বোটের বুকে, কবিতাখানিতে বাংলার রূপ-রতন-তনু ফুটে উঠেছে প্রতিটি চরণে। বর্ষার বাঙালি রূপ এর চেয়ে ভালো নিক্কণ তোলেনি কোনো কাব্যে। চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখিত পত্রে কবি 'সোনার তরী' কাব্যের জন্ম স্মৃতি জানাতে গিয়ে লেখেন, 'ছিলাম তখন পদ্মার বোটে। জলভারনত কালো মেঘ আকাশে, ওপারে ছায়াঘন তরুশ্রেণীর মধ্যে গ্রামগুলি, বর্ষার পরিপূর্ণ পদ্মা খরবেগে বয়ে চলেছে, মাঝে মাঝে পাক খেয়ে ছুটেছে ফেনা। নদী অকালে কূল ছাপিয়ে চরের ধান দিনে দিনে ডুবিয়ে দিচ্ছে। কাঁচা-ধানে-বোঝাই চাষীদের ডিঙি নৌকা হু হু করে ¯্রােতের উপর দিয়ে ভেসে চলেছে। ঐ অঞ্চলে এই চরের ধানকে বলে জলি ধান। .............ভরা পদ্মার উপরকার ঐ বাদল-দিনের ছবি 'সোনার তরী' কবিতার অনত্দরে প্রচ্ছন্ন এবং তার ছন্দে প্রকাশিত।'

কিন্তু রচনার এক যুগ (অন্যূন) পরে এই কবিতার রূঢ় সমালোচনা সাময়িক সাহিত্যে উত্তাল হয়ে উঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সাধনায় প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য পত্রে (শ্রাবণ, ১৩০০, পৃঃ ৩৪০)-এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়। বলা হয় এবারকার সাধনার মহামূল্য অলঙ্কার 'সোনার তরী'। আমরা বহুদিন এমন সর্বাঙ্গ সুন্দর প্রকৃত কবিত্বময় কবিতা পড়ি নাই।......... ইহার কবিত্ব ও সৌন্দর্য বর্ণনাতীত, তাহা কেবল হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়। এতকিছুর পরও কালে এই 'সোনার তরী' কবিতাটির তাৎপর্য নিয়ে বহু বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এই বিতর্কের অবসানে কবি 'শান্তি নিকেতন' গ্রন্থে 'সোনার তরী' কবিতার তাৎপর্য ব্যাখ্যায় 'তরী বোঝাই' প্রবন্ধে মুখ খোলেন। কবি এ প্রবন্ধে লেখেন 'সোনার তরী' বলে একটা কবিতা লিখেছিলুম, এই উপলক্ষে তার একটা মানে বলা যেতে পারে। মানুষ সমস্ত জীবন ধরে ফসল চাষ করছে। তার জীবনের ক্ষেতটুকু দ্বীপের মতো। চারিদিকেই অব্যক্তের দ্বারা সে পরিবেষ্টিত। ঐ একটুখানিই তার কাছে ব্যক্ত হয়ে আছে।............. এভাবে কবি তার 'সোনার তরী'র তাৎপর্য তুলে ধরেন। আর তাতেই রবীন্দ্র রহস্যের অবগুণ্ঠন সরিয়ে কয়েকটি অনিন্দ্য আলোক-কিরণ ঠিকরে পড়ে বাংলা সাহিত্যে।

'সোনার তরী' কবিতার সূচনাতেই আমরা পাই

'গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা।

কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা।'

কবি তার সূচনার চরণযুগলে প্রকাশ করেন একাকীত্বের বেদনা। কবির জীবনের দ্বীপখানি আজ সমাপ্তির আঁধারে আক্রান্ত। জীবনের নদীকূলে কবি নিঃসঙ্গ বসে আছেন অন্তিম পারাপারে। কিন্তু জীবনের তরণী তার জন্যে থামবে কিনা তার ভরসা তাকে কেউ দেয় না। কবি তাই পরবর্তী পংক্তিতে বলেন-

'রাশি রাশি ভারা ভারা ধান-কাটা হল সারা,

ভরা নদী ক্ষুরধারা খরপরশা,

কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।'

নিঃসঙ্গ কবি জীবনের নদীকূলে ভরসা বিহীন একাকী বসে ভাবেন ফেলে আসা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তিনি ফলিয়েছেন কর্মের ফসল। রাশি রাশি কর্মের ভারা ভারা ফসল কবির জীবনে আনলো সফলতা। কিন্তু কর্মে কর্মে কখন যে সময়ের নদীতে ক্ষুরধারা ¯্রােত বিগত হলো তা টের পাননি। জীবনের কর্মের সোনালী ফসল ভোগ করার দিনে এসে এক সময় জীবনের ব্যাপ্তি হলো শেষ। জীবনের জমিতে কর্মের চাষ করে ফসল তুলতে গিয়ে কবি দেখেন অন্তিম বরষার কাল জলধারা এসে তার জীবনের জমিন-দ্বীপখানি ডুবিয়ে দিয়ে অব্যক্ত'র মাঝে বিলীন করে দিতে সমাগত। কবি জীবনের জমিন-দ্বীপের অনন্তবেদনায় স্মৃতির চাকায় ঘুরে ঘুরে দেখেন কত ছোট এই ব্যক্ত জীবন আর তার সময়ের দ্বীপ। চারিদিকে অব্যক্ত মহাশূন্যতা আর তারই মাঝে ছোট জীবন-দ্বীপে একাকী চাষী কবি। জীবনের প্রভাত বেলায় অনন্ত পরপারের ছবি কবি ঝাপসা অবলোকন করেন।

'গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে।

দেখে যেন মনে হয়, চিনি উহারে, এই যুগল চরণে কবি একাকী জীবন নদী-পাড়ে সংসার-তরণীর মাঝিকে দেখতে পান অকস্মাৎ। দূর থেকে দেখে কবির মনে হয় তাকে তিনি অনেক দিন ধরে চিনেন। বাস্তবিক এ মাঝি যে তার সংসার-তরণীর নাইয়া তা নিকটে তরণী ভিড়ালে স্পষ্ট হয়। অর্থাৎ পরপারের ডাক যখন স্পষ্টতর হয়, জীবনের ব্যক্ত জমিনের ব্যাপ্তি যখন চারিদিকের অব্যক্ত শূন্যতায় মিলিয়ে যায় তখন কবির মনে হয় সংসারের তরণী বুঝি হিসাব-কিতাবের দফতর মিলাতে বসেছে। কবি তারে ডাকেন গলা হেঁকে 'ওগো তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে? বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে। কিন্তু সেই খেয়া মাঝি নেয়না কবিকে। কারণ কবিতে তরণীর কোন কাজ নেই, তরণীর কাজ কবির জীবন-জমিনের ফসলে তথা কর্মে। কবি তবু মিনতি করেন তরণীর মাঝি তথা সংসার নিয়তিকে,

এতকাল নদীকূলে যাহা লয়ে ছিনু ভুলে

সকলই দিলাম তুলে থরে বিথরে

এখন আমারে লহ করুণা করে।

তবুও সংসার তরণীর মাঝির হয় না মায়া। করুণা তার কাছে মেলেনা এক বিন্দু। সংসার তরণীর কাছে নামরূপ কবির কোনো দাম নেই। দাম আছে কবির প্রাণবায়ুর, দাম আছে কবির সুকর্মের ফসলের, দাম আছে কবির সৃষ্টির। সংসারের জমিনে কবির কবিতারা পায় দীর্ঘ জীবন, কবির ছন্দণ্ডগীতি পায় অমরত্ব। কিন্তু প্রাণহারা নিস্তব্ধ কবির দেহে সংসারের কোনো কাজ নাই। তাই সংসার তরণী জীবনের নদীতে কেবল কবির জীবনের ফসল নিয়ে কর্মকে অবহেলা করে চলে। শুধু দূর হতে কবিকে জানিয়ে দেয়

ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী

আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।

এভাবেই এই ধরণীর ধূলিতলে মানুষের জীবন-জমিনের ফসলকে যুগ যুগ ধরে সংসার লালন করে এসেছে, কিন্তু দীপ-নির্বাসিত জীবনের কোনো দাম সংসার কখনও দেখায়নি, দেয়ওনি।

রবীন্দ্রভাষ্যে সোনার তরীর যে তাৎপর্য তাতে এ কথাই কবি বলেছেন 'যখন কাল ঘনিয়ে আসছে যখন চারিদিকের জল বেড়ে উঠছে, যখন আবার ঐ অব্যক্তের মাঝে তার এ চরটুকু তলিয়ে যাবার সময় হলো, তখন তার সমস্ত জীবনের কর্মের যা কিছু নিত্য ফল তা সে ঐ সংসারের তরণীতে বোঝাই করে দিতে পারে। সংসার সমস্তই নিবে, একটি কণাও তার ফেলে দেবে না। কিন্তু যখন মানুষ বলে, ঐ সঙ্গে আমাকেও নাও, আমাকেও রাখো তখন সংসার বলে তোমার জন্যে জায়গা কোথায়? তোমাকে নিয়ে আমার হবে কী? তোমার জীবনের ফসল যা কিছু রাখার তা সমস্তই রাখবো, কিন্তু তুমিতো রাখবার যোগ্য নও। অর্থাৎ, মানুষ যখন তার অহংটাকে চিরন্তন করে রাখতে চায় তখন সংসার তা প্রত্যাখ্যান করে। যে জীবনটি মানুষ ভোগ করে তার খাজনা স্বরূপ অহংটাকেই মৃত্যুর কাছে দিয়ে হিসেব চুকিয়ে যেতে হয়। তাই সংসার আসলে এক সোনার তরী, যাতে কেবল কর্মণ্ডফসলের স্থান আছে কিন্তু কর্মবীরের দেহের কোন স্থান নেই। আর তাই কবি 'সোনার তরী'র তরী বোঝাই দর্শনে ভারানত হয়ে বলেন,

'অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে

সে পায় তোমার হাতে

শান্তির অক্ষয় অধিকার।'

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়