প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২২, ০০:০০
জীবনকে আঁকা খুব সহজ নয়। চাইলেই কেউ অক্ষরে জীবন এঁকে ফেলতে পারে না। জীবনকে অক্ষরে আঁকতে হলে শিল্পিত ও সংবেদী মন চাই, জীবনভেদী অবভাসনের প্রগাঢ় ও প্রাজ্ঞ দৃষ্টি চাই। কথাশিল্পী ইলিয়াস ফারুকী দীর্ঘদিন ধরে অক্ষর সাজিয়ে এঁকে চলেছেন জীবনকে। সেই আঁকায় জীবনবোধ যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি জীবনবেদও পরিলক্ষিত হয়। ‘মেঘলা দিনের সারথি’ তার আরেকটি ছোটগল্পগ্রন্থ যাতে জীবন হয়ে উঠেছে ব্যঞ্জনাময়।
মোট এগারটি গল্পের বৈচিত্রময় সমাহারে গল্পগ্রন্থটি নান্দনিক কথাশিল্পে মোড়ক-মণ্ডিত হয়েছে। তিথি ও আব্দুল খালেকের ফুলশয্যা, ইঁদুর, কী করা হয়, মানুষ, মেঘলা দিনের সারথি, কালো সন্ধ্যা, নক্ষত্রেরা এমনই হয়, কষ্টেরা সোহানার মতো, এ কেমন সময় ছিল, সীমানা যেখানে একাকার, দুহাজার পঁয়তাল্লিশ ইত্যাদি শিরোনামে গল্পগুলো বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে জীবনের ওপর আলোকসম্পাত করেছে। তার গল্প বলার ভঙ্গি নির্মেদ কিন্তু উপমা ও চিত্রকল্পের ব্যবহার তার বক্তব্যের নান্দনিক চাতাল তৈরি করে দিয়েছে। ‘এ কেমন সময় ছিল’ গল্পটি দিয়ে গ্রন্থের সূচনা এবং ‘নক্ষত্রেরা এমনই হয়’ তার শেষ গল্প। গল্পের সূচনায় আমরা চিনকি নামের এক আশ্চর্য নারী চরিত্রকে পাই যে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে অভাবনীয় লড়াই করে চলে। সে শিক্ষিতা নয়, রূপবতী নয় কিন্তু অসাধারণ যৌবনবতী। ব্যাংক কর্মকর্তা নায়ক নিজেই বলেছে নিজেকে ও পাঠককে, এই যৌবন উপেক্ষা করতে পারার মতো বয়স্ক সে নয়। গল্পটি আমাদের মানুষের মৌল চরিত্র ও তার আকর্ষণ সম্পর্কে অবহিত করে। চিনকির একতরফা প্রেমের প্রয়াসে নায়ক সকল কিছু বিবেচনায় যৌক্তিক কারণে তাকে প্রত্যাখ্যান করলেও চিনকি সেই যুবকের মধ্যে যৌবন-পিপাসা জাগিয়ে তুলে বুঝিয়ে দেন, মানুষ মাত্রেই যৌবনবৃত্তির কাছে পরাজিত হয়, পরাজয় বরণ করতে হয়।
নামগল্প ‘মেঘলা দিনের সারথি’ আমাদের শোণিত-প্রবাহে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উত্তাপ ছড়িয়ে দিয়ে যায়। লেখক খুব চমৎকার করে আমাদের সেই দিনগুলোর বীভৎসতার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন। আজকের প্রজন্মের কাছে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে উপস্থাপনের মহান দায় নিয়ে তা ভালোভাবেই সম্পন্ন করেছেন লেখক ইলিয়াস ফারুকী। বাঙালির ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের মতো মহান সময় যেমন আর কখনো আসবে না, তেমনি বাংলা সাহিত্যেও চমৎকার গল্প বলার এমন পটভূমি আর দ্বিতীয়টি নেই। গল্পকার তার কল্পনায় দুহাজার পঁয়তাল্লিশ সালকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তাতে আগামীতে মানব-মানবীর জৈবিক সম্পর্কগুলো যান্ত্রিক অনুভূতির মতোই হয়ে যাবে। আবেগ হয়ে যাবে রিমোট দিয়ে নিয়ন্ত্রণের মতো যান্ত্রিক অনুষঙ্গ। ‘ইঁদুর’ গল্পটি একটি রূপকাশ্রিত উপাদেয় গল্প যাতে মানুষের রূপ নিয়ে অজস্র ইঁদুরকে আমরা ঘুরে বেড়াতে দেখি মনুষ্য সমাজে। ইঁদুর ধরার কলের মতো প্রাজ্ঞতা ধারণ করে সেইসব ছদ্মবেশি মানুষদের সহজেই চিহ্নিত করা যায়। ‘নক্ষত্রেরা এমনই হয়’ গল্পটিতে অতি মেধাবীদের করুণ পরিণতিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সমাজে মেধার চেয়ে অর্থের প্রতি মানুষের লোভ বেশি, টান বেশি। এ কথাই গল্পচ্ছলে লেখক ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে একটা ত্রিভুজ প্রেমের আখ্যানের অবতারণা করেছেন। এ আখ্যানে প্রকৃত প্রেমিক ও মেধাবীর করুণ পরিণতি ঘটেছে যা লেখক খুব সুন্দরভাবে জীবন্ত করে তুলেছেন মর্মস্পর্শী বর্ণনায়। ‘মেঘলা দিনের সারথি’ গল্পগ্রন্থের সবচেয়ে সেরা গল্প ‘মানুষ’। অল্প কথায় তিনি খুব গভীরভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে অধিক চর্চিত সত্যকে তুলে এনেছেন। আগে আমরা সবাই মানুষ, তারপর আমাদের ধর্মীয় বা সম্প্রদায়গত পরিচয়। মাঝির ভূমিকা এ গল্পে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এখানে প্রাজ্ঞ ব্যক্তির প্রতীক। নৌকা এখানে সেই বাহন যা সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে যাত্রীরূপে বহন করে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। মাঝ নদীতে ঝড়ের কবলে পড়া নৌকায় বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ নিজ নিজ ধর্মমতে ইষ্টকে ডাকলেও তারা একে অপরের হাত ধরে নিজেদের বিপদ হতে পরিত্রাণের প্রয়োজনে এক হয়ে যায়। চরম বিপদে তাদের এই সংহতি প্রমাণ করে দেয়, মনুষ্যত্বই আমাদের এক এবং অদ্বিতীয় পরিচয়। জগতে মানুষ হয়ে উঠতে পারাটাই আমাদের সবচেয়ে বড় সাধনা।
রাজীব রায়ের প্রচ্ছদে যাযাবর মিন্টুর পালক প্রকাশনী হতে বের হওয়া গ্রন্থটিতে গল্পের আখ্যানধর্মীতার চেয়ে গল্পের ন্যারেটিভে লেখকের মনোযোগ ছিল অধিক। ফলে এতে সাদামাটা সংলাপের চেয়ে জীবনের দার্শনিক বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে সংগত কারণে। বইটি পাঠকের মনে বিনোদন তৈরির চেয়ে পাঠককে ভাবিয়ে তোলার খোরাক যোগাবে অধিক। চিন্তাশীল প্রজন্ম নির্মাণে এই বই হয়ে উঠুক যোগ্য হাতিয়ার।