প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২২, ০০:০০
চাঁদপুরে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও একটি অপ্রীতিকর ঘটনা
যাতায়াতের সুব্যবস্থার জন্যে বহুকাল থেকে চাঁদপুরের সুনাম ভারতবর্ষে ছড়িয়ে আছে। বিশেষত নৌপথ ও রেল যোগাযোগের জন্যে এ অঞ্চল সুবিদিত। ভারতবর্ষের অনেক বরেণ্যজন যাত্রাপথ হিসেবে চাঁদপুর রূটটি ব্যবহার করতেন। খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৯৩১ সালের ৬ মে শিয়ালদহ থেকে কুমিল্লা যাওয়ার পথে চাঁদপুরে থামেন। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসু, বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী, বিমল প্রতিভা দেবী, কুস্তিগীর গোবর গুহ প্রমুখ। কিন্তু চাঁদপুরে থামার অভিজ্ঞতা তাঁদের সুখকর ছিল না। রাজনৈতিক কারণে অনুশীলন কমিটির ছাত্র সমিতির সদস্যরা চাঁদপুরে তাঁদের ওপর কয়লা গুঁড়ো নিক্ষেপ করেন।
‘পরিচয়’ সাময়িকপত্রে এ ঘটনা সম্পর্কে লেখা হয়েছে : ‘চিটাগং মেলে কুমিল্লার পথে চাঁদপুরে গাড়ি পৌঁছালে সেখানকার অনুশীলন পার্টির ছাত্র সমিতির কিছু সদস্য স্টেশনে গাড়ির কাচ ভেঙে সুভাষ ও শরৎচন্দ্র প্রভৃতির ওপর কয়লার গুঁড়ো ছুঁড়ে শেম শেম ধ্বনি দিয়ে বিক্ষোভ জানায়।’ শরৎচন্দ্রসহ অন্যরা স্বাভাবিকভাবেই এ ঘটনায় মর্মাহত হন। দিলীপকুমার রায়কে চাঁদপুরের ঘটনা সম্পর্কে শরৎচন্দ্র চিঠিতে লিখেছেন : ‘পথে একদল শেম শেম বললে, গাড়ীর জানালার ফাঁক দিয়ে কয়লার গুঁড়ো মাথায় গায়ে ছড়িয়ে দিয়ে প্রীতিজ্ঞাপন করলে, আবার একদল বারো ঘোড়ার গাড়ী চাপিয়ে দেড় মাইল লম্বা শোভাযাত্রা করে জানিয়ে দিলে গুঁড়োটা কিছুই নয়, ও মায়া।’
কুমিল্লায় অনুষ্ঠিতব্য ত্রিপুরা জেলা রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনকে কেন্দ্র করে এ দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সুভাষচন্দ্র বসুর সমর্থন করতেন। তিনি তাঁকে (সুভাষচন্দ্রকে) ত্রিপুরা জেলা রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনের সভাপতি নির্বাচিত করতে চাচ্ছিলেন।
জানা যায়, তৎকালীন যুগান্তর পার্টির ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল ‘বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন’। এ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্ব মানতেন। অন্যদিকে অনুশীলন পার্টির ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল অল বেঙ্গল স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন। তাঁদের প্রধান নেতা ছিলেন যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত। ত্রিপুরা জেলা রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনের সভাপতি নির্বাচন নিয়েই এ অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। যদিও শেষ পর্যন্ত শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় সুভাষ চন্দ্র বসু সভাপতি নির্বাচিত হন। সূত্র : পরিচয় পত্রিকা, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ১৪০৪, পৃষ্ঠা ১৫৩-১৫৪।
চাঁদপুরে কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বরেণ্য কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০)। কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ (১৯২৯)-এর অমর ¯্রষ্টা তিনি। বিভূতিভূষণ তৎকালীন পূর্ববাংলার অনেক শহর ও গ্রাম ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর পদধূলি পড়েছে চাঁদপুরেও। তাঁর ভ্রমণকাহিনী ও দিনলিপির গ্রন্থ সঙ্কলন ‘দিনের পর দিন’। এ গ্রন্থে বিভূতিভূষণ যাত্রাপথে চাঁদপুরে আসার উল্লেখ করেছেন।
১৯৩৭ সাল। বিভূতিভূষণ শিক্ষকতা করতেন। স্কুলের ছুটিতে তিনি চট্টগ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এসময় তিনি চাঁদপুরেও আসেন। তিনি চাঁদপুরে ট্রেনে ভিড় দেখে লিখেছেন, ‘বেজায় ভিড় এমন কিছু নয়- তবে ভিড় দেখলাম স্টীমারে ও চাঁদপুর ট্রেনে বসে, শোওয়া তো দূরের কথা, কাৎ হবার জায়গা নেই। তার উপরে এক এক স্টেশনে গাড়ি দাঁড়ায় আর ছাড়তে চায় না- বিষম বিরক্তির ব্যাপার!’
চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুর হয়ে কলকাতা ফেরার বর্ণনাও তিনি দিয়েছেন। লিখেছেন, ‘লাকসাম জংশন ছাড়িয়ে একটু খানি শুয়েচি- অমনি উঠে দেখি চাঁদপুর ঘাট। স্টীমারে এসে বেশ জায়গা পেলুম। যেমন ঝড় তেমন বৃষ্টি।’ বিভূতিভূষণ দেখেছেন ঝড়বৃষ্টি মাথায় করেও মানুষ নৌকায় খাবার বিক্রি করছে। নদীতে অনেক চর, সেখানে লোকজন বাস করছে।
১৯৪৬ সালে বিভূতিভূষণের দিনলিপি ও ভ্রমণগ্রন্থ ‘উৎকর্ণ’ প্রকাশিত হয়। এখানেও তিনি চাঁদপুর স্টীমারে যাওয়ার কথা লিখেছেন। যদিও তাঁর অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। তিনি ডেকে জায়গা পাননি, বসতে হয়েছিল পানির ট্যাঙ্কে। বিভূতিভূষণ লিখেছেন, ‘চাঁদপুরে স্টীমারে পানীয় জলের ট্যাঙ্কের উপর বসে বেলা একটা পর্য্যন্ত কাটালুম। ডেকে পা রাখবার জায়গা নেই, সর্বত্র লোকে বিছানা পেতে শুয়ে বসে আছে।’
বিভূতিভূষণ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরেছেন। বিশেষত চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী ইত্যাদি। মূলত আসা-যাওয়ার পথ হিসেবে তিনি চাঁদপুরের নৌপথ ব্যবহার করেন। তবে বিভূতিভূষণ নোয়াখালীর ভ্রমণের পর মেঘনা নদীর তীরবর্তী গ্রামে দুদিন থাকার উল্লেখ ও বর্ণনা করেছেন। এ গ্রামটি চাঁদপুরের কোনো গ্রাম হতেও পারে।
তথ্যসূত্র : দিনের পর দিন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মিত্র এন্ড ঘোষ পাবলিশার্স, প্রথম প্রকাশ চৈত্র ১৩৬৭।