সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০২২, ০০:০০

ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
অনলাইন ডেস্ক

এক সময় এই বাংলায় মাটি নির্মিত দুই মুখ বিশিষ্ট চুল্লির প্রচলন ছিল। এগুলো সাধারণত বাহিরে মুক্ত স্থানে থাকতো। এখানে শুকনো নাড়া দিয়ে ধান সিদ্ধ করে পরে রৌদ্রে শুকানো হতো। শুকনো ধান ঢেঁকিতে চুরে চাল বের করা হতো। বলা বাহুল্য, সে যুগে ধান মাড়াই মেশিন আবিষ্কার হয় নি। আমার বিদ্যারম্ভ মমতাময়ী ‘মা’ এবং স্নেহহ বৎসল বাবার কাছে।

তখন দুই-একদিন পরপরই বড় বড় কড়াইয়ে করে ধান সিদ্ধ করা হতো এবং রৌদ্রে শুকায়ে ঢেঁকিতে চুরানোর উপযোগী হলে ঢেঁকি ছাঁটা চাল বের করে রান্নার উপযোগী করা হতো। তখন এই বাংলায় অধিকাংশই বড় বড় যৌথ পরিবার ছিল। যৌথ পরিবারের সদস্যদের ওপরে অর্পিত দায়িত্বকে সকলেরই অবশ্য করণীয় হিসেবে চলমান থাকতো।

আমার মমতাময়ী জননী যখন ধান-সিদ্ধ বসাতেন, তখন তাঁর ডান পাশে ছিল জ্বালানি হিসেবে নাড়ার স্তূপ আর বামপাশে বসা থাকতাম আমি। আমার সম্মুখে থাকতো কদলীপত্র, বাঁশের কঞ্চির কলম এবং দোয়াত ভর্তি কালি। এই কালি ছিল ধান সিদ্ধ করার কড়াইয়ের তলা থেকে ঝিনুক দিয়ে সংগৃহীত। এই মহান মাতৃপীঠ থেকেই শিক্ষাগুলো ছিল আদি মৌলিক।

এখানে শিখেছি স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, শতকিয়া, কড়াকিয়া এবং ইংরেজি দিন-মাস ইত্যাদি গণনার প্রক্রিয়া। আরো শিখেছি চৌষট্টি পয়সা তথা ষোল আনায় এক টাকার হিসেব এবং শুভঙ্করের আর্যা ইত্যাদি। আমার মাতৃদেবী বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তৎকালীন মাইনর তথা ষষ্ঠ শ্রেণী পাস করা। সে সময় নাকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ছিলেন মাইনর পাস।

আমার বাবা ছিলেন সত্যিকারের শিক্ষানুরাগী। বাবা হঠাৎ একদিন সকালে মাকে বললেন, আমাকে যেন ভাল জামা পেন্ট পরায়ে রাখেন। সে দিনই আমাকে বাকিলা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাবেন। দিন-ক্ষণ, সন আর তারিখ আজ আমার স্মরণাতীত। যথাসময়ে বাবা এসে আমাকে ডান হাতে হাত ধরে নিয়ে চললেন স্কুল পানে। বাম হাতে আমার বগলদাবা করা আছে চিনামাটির তৈরি একখানা শ্লেট আর সীতানাথ বসাক রচিত আদর্শ লিপি। পকেটে ছিল এক টুকরা পেনসিল। যাবার আগে ‘মা’ বলে দিয়েছেন যে, শিক্ষকরা সকলেই পরম গুরু। এসব গুরুর অবাধ্য হওয়া অনুচিত। শিক্ষা গুরুর সদিচ্ছা জীবনের পাথেয়।

যাক্ আমরা যথা সময়ে স্কুলে পৌঁছেই শিক্ষকদের কক্ষে চলে গেলাম। কক্ষে উপস্থিত ৫ (পাঁচ) জন শিক্ষকই আমার বাবাকে সানন্দে অভ্যর্থনা জানালেন এবং পরস্পর কুশল বিনিময় করেন। বাবা যথারীতি আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর প্রধান শিক্ষক মরহুম উমেদ আলী মিয়া মহোদয় আমাকে ওনার কাছে যাওয়ার জন্য ডাকলেন। আমি সশঙ্কচিত্তে তাঁর টেবিলের সামনে যাওয়ার পর তিনি নিজেই আমাকে কাছে টেনে নিলেন। প্রধান শিক্ষকের প্রশ্ন ছিলো, স্কুলে কেন এসেছ? উত্তরে আমি বলেছি, আস্তে আস্তে ভালভাবে বেড়ে উঠার পেছনে স্কুল শিক্ষাই নাকি অপরিহার্য (মা শিখিয়াছেন)। অংক শিক্ষক মরহুম ফাজিলউদ্দিন পণ্ডিত মহোদয়ের জিজ্ঞাসা ছিল আটাশের পরে কত? আমি বলেছি ঊনত্রিশ। বাংলা শিক্ষক মরহুম মোঃ কমর উদ্দিন মিয়া (মিঞা মাস্টার নামে সমধিক পরিচিত) মহোদয়ের নির্দেশে আমি ‘পাখী সব করে রব রাতি পোহাইলো’ কবিতাটি মুখস্থ বলে ফেলি। তারপর পরম শ্রদ্ধেয় স্যারদের নির্দেশে আমি শ্রেণী কক্ষে যাই এবং অন্য ছাত্র বন্ধুদের সাথে বসে পড়ি। বাবার সাথে পরে সম্মানিত শিক্ষকগণের কী আলাপ হয়েছে তা আমার জানা নেই। আমার বাবা আয়ুর্বেদ শাস্ত্রীয় খ্যাতনামা চিকিৎসক ছিলেন বলেই সমাজে যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। আমি পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত যে সমস্ত শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছি তাঁরা সার্টিফিকেটধারী বিখ্যাত শিক্ষাবিদ না হলেও অনেক উন্নত মানের বিশিষ্ট শিক্ষক ছিলেন। যাঁদের থেকে বিচ্ছুরিত জ্ঞানের আলো শিক্ষাকে আলোকিত করে।

কালান্তরে Minor ঐক্যে Class Six উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের সাথে সংযুক্তি ঘটে। আমি Class Six থেকে Matriculation পর্যন্ত যেসব গুণী বিজ্ঞ শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছি তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাজেন্দ্র নাথ রায় চৌধুরী এবং আহম্মেদ উল্লাহ বি.এস.সি.। এঁদের পাণ্ডিত্যের বহর এবং অতি আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি, হতোদ্যমকেও একনিষ্ঠ মনোযোগী করে দিতো এবং জ্ঞানান্বেষীকে অধিকতর কৌতূহলী করে দিতো।

বর্তমানে কী হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে? শিক্ষক থেকে এমন কি আয়া নিয়োগে পর্যন্ত যে নগ্ন আমলাতান্ত্রিক আবেশ চলছে তাতে বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাক্রম যৎ পোরনাস্তি উপেক্ষিত হবে এবং হচ্ছে।

যে জাতি যত বেশি নৈষ্ঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবে সে জাতি তত দৃঢ় এবং ঋজু হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার নৈষ্ঠিকতা নিদারুণ ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। এ অচল অবস্থার সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য সমাধান কেবল এবং কেবল মাত্রই এই সরকারই দিতে সক্ষম। এর ব্যত্যয় নিশ্চয়ই প্রাগৈতিহাসিক যুগের অমেরুদণ্ডী জাতির প্রতীক হবে। নেলসন মেন্ডেলার সেই বিখ্যাত উক্তি দিয়ে আজকের প্রসঙ্গের সমাপ্তি টানছি যে, দেশ পরিচালনায় প্রয়োজনীয় উপকরণের মধ্যে দুটি অপরিহার্য হলো দক্ষ শিক্ষক এবং উন্নত সংস্কৃতিমনা লোক।

বিমল কান্তি দাশ : কবি ও লেখক; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়