প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০২২, ০০:০০
যুগের সুর যখন দ্রোহের চেতনায় বেজে ওঠে নিঃসঙ্কোচে, তখন তা হয়ে ওঠে কালের অগ্নিবীণা। সে বীণার সুরে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে অত্যাচারী শোষকের দল, সময়ের গর্ভ চিরে শোষিতের মুক্তিবাণী অবমুক্ত হয় বিজয় বারতা নিয়ে। বৃটিশ রাজশক্তির মনে ভয়ের কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে ‘অগ্নিবীণা’ একদিকে যেমন রাজনৈতিক ‘বিজয় মঞ্চ’ তৈরি করে দিয়েছে, তেমনি অন্যদিকে শোষিতের শোণিতপ্রবাহে প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। বাঙালির মনের বীণায় যে সুর আজ থেকে শতবর্ষ আগে অগ্নিবীণা জাগিয়ে তুলেছিলো, আজ তা-ই আমাদের চেতনার বাতিঘর হয়ে পথ দেখিয়ে চলেছে। পড়ে পড়ে মার খাওয়া বাঙালিকে অগ্নিবীণাই প্রতিবাদী হয়ে দাঁড়াতে শিখিয়েছে।
ঊনপঞ্চাশ নম্বর বাঙালি পল্টন হতে যুদ্ধফেরত হাবিলদার নজর-উল্ ইসলাম ঊনিশশো সতের সালের এপ্রিলে কোলকাতা এসে সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করে হয়ে ওঠেন কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯২২ অক্টোবর, ১৩২৯ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে প্রকাশিত হয় তাঁর যুগান্তকারী কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’। এই কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে লেখা আছে, ‘বাঙলার অগ্নিযুগের আদি পুরোহিত সাগ্নিক বীর শ্রীবারীন্দ্রকুমার ঘোষ শ্রীশ্রীচরণারবিন্দেষু’। নজরুল নিজে বিশ্বাস করতেন, বিপ্লব ছাড়া বাংলার স্বাধীনতা আসবে না। তাই তিনি তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থটি বিপ্লবী পুরুষ শ্রী বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে উৎসর্গ করেন। এতে বারটি কবিতা সংকলিত হয়েছে। কবিতাগুলো যথাক্রমে প্রলয়োল্লাস, বিদ্রোহী, রক্তাম্বরধারিণী মা, আগমনী, ধূমকেতু, কামাল পাশা, শাৎ-ইল্-আরব, খেয়া-পারের তরণী, কোরবাণী ও মোহররম। এই গ্রন্থের উৎসর্গ গানটি ‘অগ্নি-ঋষি’ শিরোনামে ১৩২৮ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ সংখ্যার ‘উপাসনা’য় প্রকাশিত হয়। ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতাটি ১৩২৯ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যার ‘প্রবাসী’তে, ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ১৩২৮ বঙ্গাব্দের কার্তিক ২য় বর্ষ ৩য় সংখ্যার মোসলেম ভারতে (মতান্তরে ১৩২৮ বঙ্গাব্দে পৌষ সাপ্তাহিক বিজলীতে), ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ কবিতা ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ৫ ভাদ্র ১ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যার ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায়, ‘আগমনী’ কবিতা ১৩২৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যার ‘উপাসনা’য়, ‘ধূমকেতু’ কবিতাটি ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৬ শ্রাবণ ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা অর্ধ-সাপ্তাহিক ধূমকেতুতে, ‘কামাল পাশা’ কবিতাটি ১৩২৮ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসের মোসলেম ভারতে, ‘শাৎ-ইল্-আরব’ ১৩২৭ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যার মোসলেম ভারতে, ‘খেয়া-পারের তরণী’ কবিতা ১৩২৭ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ সংখ্যার মোসলেম ভারতে, ‘কোরবাণী’ কবিতা ১৩২৭ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসের মোসলেম ভারতে এবং সর্বশেষ ‘মোহররম’ কবিতাটি ১৩২৭ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যার মোসলেম ভারতে প্রথম প্রকাশিত হয়।
নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’র বারটি কবিতা যেনো প্রত্যেকটিই আগুনের গোলা। দেশপ্রেমের শুদ্ধ আগুনকে নিশ্চেতন জনতার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে তিনি জাগরণ এনেছেন ভেতো বাঙালির শোণিত-প্রবাহে। তাই সঙ্গত কারণেই আজও কবিতাগুলো অগ্নিবীণার মতো বেজে চলেছে পাঠকের চেতনার জলসায়। ‘অগ্নিবীণা’র শতবর্ষ এমন এক সময়ে উদ্যাপিত হচ্ছে, যখন বাংলাদেশ পার করেছে সুবর্ণজয়ন্তী আর তার সাথে পূর্ণ হয়েছে ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যের মূল সুরকে যিনি তাঁর কণ্ঠের বজ্রে ধারণ করেছেন, বাঙালি জাতির মহান জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিক। এ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো বৃটিশ শাসনামলের রক্তচক্ষুকে তর্জনী উঁচিয়ে লেখা হলেও আজও তাদের প্রাসঙ্গিকতা জ্বলজ্বলে হয়ে আছে। আজও সমাজে শোষিতের পূর্ণাঙ্গ মুক্তি হয়নি, আজও সাম্প্রদায়িকতার বিষদাঁত মাঝে মাঝে ছোবল দেয়। বাঙালির চেতনাকে সমুন্নত ও সম্প্রীতির পথে রাখতে ‘অগ্নিবীণা’র শতবর্ষ আমাদের জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়েই আবির্ভূত হয়েছে।