সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ২৩ মে ২০২২, ০০:০০

নজরুল ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা : মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের ভূমিকা
অনলাইন ডেস্ক

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পটভূমিতে ১৯৭২ সালে নজরুলকে কলকাতা থেকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বাংলাদেশে আনয়ন এবং ১৯৭৬ সালে এ-দেশের মাটিতে নজরুলের অন্তিম শয্যাগ্রহণের পর কবির স্মৃতি চিরঞ্জীব করে রাখার জন্যে যেমন নজরুলের মাজারে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধ হয়, তেমনি নজরুলের জীবন, সাহিত্য-সঙ্গীত ও তাঁর সামগ্রিক অবদান সম্পর্কে গবেষণা-পরিচালনা এবং নজরুল-রচনাবলি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রকাশ ও প্রচারের উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ সরকারি উদ্যোগে নজরুলের নামাঙ্কিত একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের আবশ্যকতাও গভীরভাবে অনুভূত হয়। এই প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধি এবং অনুভূতি থেকে ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন, কবি আবদুল কাদির, বেগম সুফিয়া কামাল, খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীন, সুফী জুলফিকার হায়দার প্রমুখ তৎকালীন পত্র-পত্রিকায় প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন, ‘নজরুলের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের মতো একটি দায়িত্বপূর্ণ কাজ হলো- জাতীয় সরকার কর্তৃক জাতীয় কবির নামাঙ্কিত ‘নজরুল ভবন’-এর প্রতিষ্ঠা।...একমাত্র সরকারের উদ্যোগে, সরকারি অর্থে এবং সরকারি ব্যবস্থাপনায় ও নিয়ন্ত্রণেই ‘নজরুল ভবন’-এর মতো একটি প্রতিষ্ঠান সম্ভব। এ-সবের অভাবেই কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংস্থা বা নজরুল-চর্চা কেন্দ্রের পক্ষে এ রূপ উদ্যোগ নেয়া সম্ভব নয়।’

উল্লেখ্য, নজরুলের স্মৃতি সঞ্জীবিত রাখা এবং নজরুল-চর্চা ও গবেষণার উদ্দেশ্যে ধানমণ্ডির কবিভবনকে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার দাবি নজরুলের জীবদ্দশায় উত্থাপিত হয়। ১৯৭৬ সালের মে মাসে বাংলা একাডেমি আয়োজিত, কবির জন্মবার্ষিকী সভায় সভাপতির ভাষণে ‘সওগাত’ সম্পাদক ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও ঘনিষ্ঠ নজরুল-বান্ধব মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন বলেন, ‘আমরা দেখতে চাই, কবির নামে একটি ‘কবিভবন’- যাতে থাকবে কবির বাসকক্ষ ও তাঁর ব্যবহার্য জিনিসপত্র। এই ভবনেই থাকবে কবির সম্পূর্ণ রচনাবলি, অসংখ্য গানের রেকর্ড, তাঁর সম্পর্কে লিখিত দেশ-বিদেশের গবেষণামূলক পুস্তক ও প্রবন্ধাদি এবং আর যা যা সংগ্রহ করা সম্ভব তাণ্ডও এই কবি-ভবনে থাকবে। আমি মনে করি সরকার ও উৎসাহী জনগণের পক্ষে ইহা অসম্ভব কাজ নয়। পুনরায় অনুরোধ করিবো, ‘নজরুল-ভবনে’র উদ্বোধনকল্পে সরকার যেনো অবিলম্বে উদ্যোগ গ্রহণ করেন।’ [‘সওগাত-যুগে নজরুল ইসলাম’, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, পৃঃ ৩২৪, নজরুল ইনস্টিটিউট]। বস্তুত ‘নজরুল ভবন’ প্রতিষ্ঠার দাবি ও আন্দোলন কবির জীবদ্দশায়ই শুরু হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট কবির মৃত্যুর পর ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে এক সর্বদলীয় শোক-সভায় সভাপতির ভাষণে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন বলেন, ‘আমাদের জীবনে, আমাদের সাহিত্যে সংস্কৃতিতে নজরুলের দানের কথা স্মরণ করে আমরা বিস্মিত হই কিন্তু তাঁর স্মৃতিরক্ষার ব্যাপারে আমরা উদাসীন।...সেদিনের প্রস্তাবের পুনরুক্তি করে আবার নিবেদন করি, ‘কবিভবন’ প্রতিষ্ঠার কাজে সরকার যেনো অনতিবিলম্বে উদ্যোগ গ্রহণ করেন।’ বস্তুত দেশের অগণিত নজরুলানুরাগী বুদ্ধিজীবী এবং জনগণের দাবির প্রেক্ষিতেই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সরকার ১৯৭৯-৮০ সালের দিকেই নজরুলের স্মৃতিরক্ষা, কবির জীবন, সাহিত্য-সঙ্গীত ও সামগ্রিক অবদান সম্পর্কে গবেষণা পরিচালনা, নজরুলের রচনাবলি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, সম্পাদনা ও প্রকাশনা এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কবির ভাবমূর্তি তুলে ধরার লক্ষ্যে ‘নজরুল ভবন’ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একটি প্রকল্প গ্রহণ ও অনুমোদন করেন। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট জিয়ার বিশেষ উদ্যোগেই এ প্রকল্প গৃহীত হয়। তৎকালীন সংস্কৃতি ও ক্রীড়ামন্ত্রী শামসুল হুদা চৌধুরীর প্রচেষ্টাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ক্রীড়া ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘নজরুল ভবন’ প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে ১৬.৬.৮০ তারিখে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির যে বৈঠক হয় তাতে গৃহীত সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে- ১. প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা হবে ‘নজরুল ভবন’ এবং উহা একটা অটোনমাস বডি হিসাবে কাজ চালাবে। ২. ‘কবিভবন’টি যতোদিন পর্যন্ত ব্যবহারের জন্যে না পাওয়া যাবে ততোদিন পর্যন্ত একটি ভাড়া করা বাড়িতে নজরুল ভবনের কাজ চলবে। উল্লেখ্য, বর্তমান লেখককে ‘নজরুল ভবন’ প্রকল্পের নির্বাহী পলিচালক নিয়োগের সিদ্ধান্তও গৃহীত হয় [দ্রঃ ক্রীড়া ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পত্র নং ৪ এ/ক-১/৭৯ (অংশ)/২১, তাং ৪.৫.৮০ইং]।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, নজরুল একাডেমী ও স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোনো কোনো মহলের বিরোধিতার কারণে ‘নজরুল ভবন’ প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে পারেনি, যদিও এ প্রকল্প অবিলম্বে বাস্তবায়নের জন্যে বুদ্ধিজীবী সমাজ ও জনগণের তরফ থেকে পত্র-পত্রিকায় দাবি উত্থাপিত হয়। ১৯৮১ সালের ২৯ আগস্ট বাংলা একাডেমী আয়োজিত ‘নজরুল মৃত্যুবার্ষিকী’ অনুষ্ঠানের সভাপতিরূপে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন এ বিষয়ে আলোকপাত করে বলেন, ‘নজরুলের জীবিতকালেই আমি ‘নজরুল ভবন’ স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। অবশেষে সরকার ‘নজরুল ভবন’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং একটি কমিটিও নিয়োগ করেন। ...সরকারের বহুবিধ পরিকল্পনায় ন্যায় এটাও কোথায় ধামাচাপা হয়ে রয়েছে কে জানে? আমরা কমিটির সদস্যরাও এ সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানি না।...নজরুলকে নিয়ে সরকারি-বেসরকারি লীলা-খেলার অবসান ঘটিয়ে অবিলম্বে ‘নজরুল ভবন’ প্রতিষ্ঠা করে নজরুল-চর্চার যথাযথ সুযোগ করে দেয়ার জন্যে আমরা পুনরায় সরকারের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি।’ [দ্রষ্টব্য ঐ]। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ‘নজরুল ভবন’ প্রতিষ্ঠার পক্ষে অনেক লেখালেখি সত্ত্বেও, স্বার্থান্বেষী মহলের তৎপরতায় সে-সময়ে ‘নজরুল ভবন’ প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে পারেনি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আকস্মিকভাবে নিহত হওয়ার পর ‘নজরুল ভবন’ প্রকল্প চাপা পড়ে যায়। তবে, নজরুলানুরাগী দেশবাসী- বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী সমাজের দাবির প্রেক্ষিতে, এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘নজরুল ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি স্থাপিত হয় ঢাকার কবির অমর স্মৃতিবাহী ‘কবি ভবনে’- ধানমণ্ডির ২৮নং রোডে ৩৩০/বি নম্বর বাড়িতে। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সরকারের বিশেষ উদ্যোগে নজরুলকে কলকাতা থেকে ঢাকার আনার পর তিনি রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে দীর্ঘদিন এ বাড়িতেই সপরিবারে অবস্থান করেন। ফলে ধানমণ্ডির ‘কবিভবন’ পরিণত হয় এক তীর্থ-কেন্দ্রে। বস্তুত ‘নজরুল ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অনুমোদিত ‘নজরুল ভবন’ প্রকল্পেরই বাস্তবায়ন। প্রাতিষ্ঠানিক নজরুল চর্চার ইতিহাসে ‘নজরুল ভবন’ থেকে ‘নজরুল ইনস্টিটিউট’-এর উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত সবিস্তারে উল্লেখ করা হলো এর কারণে যে, গত অর্ধ-শতাব্দীর অধিকালব্যাপি নানা পর্যায়ের এবং বিভিন্ন মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নজরুল-চর্চা হলেও, এই-ই প্রথম সম্পূর্ণ সরকারি উদ্যোগে এবং সরকারি অর্থে নজরুলের নামাঙ্কিত একটি প্রতিষ্ঠান জন্ম লাভ করলো। তাই, নজরুল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটিকে সবাই বিশেষভাবে অভিনন্দিত করে। নজরুল ইনস্টিটিউট অধ্যাদেশ ১৯৮৪তে এই প্রতিষ্ঠানের যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তা সংক্ষেপে নিম্নরূপ :

(১)। কবির রচনাবলি নিয়ে গবেষণা পরিচালনা ও অধ্যায়ন। (২) দেশ-বিদেশ থেকে কবির সঙ্গীত ও অন্যান্য রচনাবলি সংগ্রহ, সম্পাদনা, সংরক্ষণ ও প্রকাশনা। (৩) কবির সাহিত্যকর্ম ও সঙ্গীত সম্পর্কে গবেষণা পরিচালনা, প্রকাশনা ও প্রচারে ব্যবস্থা করা। (৪) কবির সাহিত্য ও সঙ্গীত এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের অবদান সম্পর্কে আলোচনা-সভা, সম্মেলন, বিতর্কিকা, সেমিনার, বক্তৃতামালা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা। (৫) নজরুল-সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়-সম্পর্কিত বই-পত্র এবং গানের রেকর্ড, টেপ ইত্যাদি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা। (৬) যথার্থরূপে নজরুল-সঙ্গীতের পরিবেশনা ও প্রচারের উদ্দেশ্যে গানের স্বরলিপি প্রণয়ন, গ্রামোফোন রেকর্ড, বাণিজ্যিক টেপ, ছায়াছবি, স্বরলিপির বইয়ে যাতে গ্রহণযোগ্য মান রক্ষিত হয় তা তদারক করা। (৭) নজরুল-সঙ্গীত ও নজরুলের কবিতা আবৃত্তি বিষয়ে যথার্থ প্রশিক্ষণ দেয়া। (৮) ইনস্টিটিউটের অভিমত অনুযায়ী যাঁরা নজরুল-বিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান অবদান রেখেছেন তাঁদের পুরস্কারদানের ব্যবস্থা করা। নজরুল ইনস্টিটিউটের সুষ্ঠু পরিচালনা এবং উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও কার্যক্রমের বাস্তবায়নের জন্যে সরকার ১৯৮৫ সালে এ নজরুল ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেন তাতে নজরুলের অগ্রজপ্রতিম বন্ধু ও ঘনিষ্ঠ সুহৃদ, নজরুল-প্রতিভা ও সাহিত্যের অকৃত্রিম অনুরাগী প্রবীণ সাংবাদিক ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনকে চেয়ারম্যান এবং ডক্টর মুস্তফা নূরউল ইসলাম, ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, শাহাবুদ্দীন আহমদ, কণ্ঠশিল্পী সোহরাব হোসেন, মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্ (নির্বাহী পরিচালক) প্রমুখকে সদস্য করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এবং গত প্রায় এক যুগে নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের অদল-বদল ঘটলেও জনাব মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন আমৃত্যু ছিলেন বোর্ডের চেয়ারম্যান। এটা নিঃসন্দেহে নজরুল-প্রতিভার বিকাশ, লালন ও পরিচর্যা এবং নজরুল-গবেষণা ও নজরুল-চর্চা ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে তাঁর ঐতিহাসিক অবদানেরই স্বীকৃতি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়