প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২২, ০০:০০
অন্ধকার একটি কক্ষের ভেতর দমবন্ধ করে বসে আছে ইকবাল। বাইরে প্রচ- বৃষ্টি হচ্ছে। এমন দিনে ইকবাল ইলিশ-খিচুড়ি খাওয়ার আবদার করে। সোমারও বৃষ্টি পছন্দ। তাই খিচুড়ি রাঁধতে খুব বেশি দেরি হয় না। আজ ক’দিন বৃষ্টির শব্দ বিষের মত লাগছে। ইকবালের শক্তি থাকলে সে এখনি বৃষ্টি থামিয়ে দিত। দুদিন হলো সোমা বাসায় নেই। বাবার বাড়ি গেছে। ইকবালেরও যাওয়ার কথা, কিন্তু মন টানেনি। সোমা অবশ্য হাসিমুখেই গেছে। যাওয়ার আগে বারবার বলেছে, দু-তিনদিন পর ইকবালও যেন চলে আসে।
মাসদুয়েক হয় ইকবাল দুঃসময়ের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। সোমাকে এখনো দুঃসংবাদটি বলা হয়নি। যদিও অফিসের বড়কর্তা ক্ষীণ একটি শিখা জে¦লে রেখেছেন। বস বলেছেন, ‘ইকবাল সাহেব, বুঝেনই তো সবকিছু। করোনাকালে অফিসের অবস্থা খুবই খারাপ। বিনা বেতনে ছুটি কাটান কিছুদিন। কারোনা কমলে আমি ডেকে নেবো।’ ইকবাল ক্ষীণকণ্ঠে বলেছিল, স্যার, জানেনই তো, বিয়ে করেছি একবছর হয়নি। এই চাকুরির উপরই নির্ভর করে আছি। আপনি স্যার প্লিজ দেখবেন...। এসব বলতে বলতে তার গলা ধরে আসে। ইকবাল সেদিন বাসায় এসে বলেছে, করোনার জন্যে অফিস বন্ধ। তবে প্রতি মাসে বেতন ব্যাংকে জমা হবে। শুনে অনেক খুশি হয়েছিল সোমা।
ইকবাল দশ-পনের দিন পর অফিসে খোঁজ নেয়। আশার খবর কেউ দিতে পারে না। কলিগদের দু-একজন কল করে সান্ত¡না দেয়। আরো ৩১ জন ছাঁটাই হয়েছে ইকবালের মতো। তারা কল দিয়ে অফিস ম্যানেজম্যান্টকে গালাগালি করে। বেসরকারি চাকুরি করার যন্ত্রণা এখন হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছে ইকবাল। খুব একটা সঞ্চয় তার নেই। মাস তিনেক চলা যাবে। এরপর? ইকবাল চোখে-মুখে অন্ধকার দেখে।
প্রতিদিনই ডিপ্রেশন বাড়ে। অনেক জায়গাতেই নতুন চাকুরির চেষ্টা করেছে ইকবাল। প্রায় সব জায়গাতেই লোক ছাঁটাই হয়েছে। করোনায় কোথাও কাজ নেই। ইকবাল কী করবে বুঝতে পারে না। গ্রামের বাড়িতে কেবল বাবা-মা। তাদেরকে মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠাতে হয়। সে যে গ্রামে চলে যাবে, তার উপায়ও নেই। সোমা শহুরে মানুষ। বিয়ের সময়ই শ^শুর-শাশুড়ি শর্ত দিয়েছিল, তাদের মেয়েকে গ্রামে রাখা যাবে না। ইকবাল শর্ত মেনেছিল। সোমাকে সে ভালোবাসে। যে কোনো শর্তেই তার আপত্তি ছিল না। কিন্তু এভাবে এই দুঃসময় আসবে কে ভেবেছিল? ভালোই তো বেতন পেত সে। ভালোবাসার সংসারে অভাব-অনটন ছিল না। প্রতিদিনই ইকবাল ভাবে, আজই ঘুম থেকে উঠে শুনবে করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে। এ টিকা দিলে আর কেউ করোনাক্রান্ত হবে না! অফিস-আদালত খোলা। জনজীবন স্বাভাবিক। তখন অফিস তাকে সসম্মানে ডেকে নিবে। অথবা অন্য কোথাও সে চাকুরি দেখে নিতে পারবে। কিন্তু স্বপ্ন বাস্তবের ধারেকাছে থাকে না। প্রতিদিনই করোনায় মৃত্যুর হার বাড়ে।
সোমা বেড়াতে যাওয়ার পর ইকবাল পুরো বাসায় একা। বুয়া আসে না। সোমা রান্না করে ফ্রিজে রেখে গেছে। খাবার নিয়ে অসুবিধা নেই। যদিও খাবার খেতে তার ইচ্ছে হয় না। সারাদিনই সে বাসা অন্ধকার করে রাখে। অনেকসময় চুপচাপ কাঁদে। আবার সোমা কল দিলে হাসিমুখে কথা বলে। যেন তার কেবল আনন্দই আনন্দ। গতকাল ভিডিও কলে সোমা অবশ্য চমকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার চোখ ফুলে আছে যে? ইকবাল বলেছে, সারাদিন ঘুমাই তো, তাই। সোমা বলেছে, সে কালই চলে আসবে। কিন্তু ইকবাল জানে, ও আসতে পারবে না। গণপরিবহন বন্ধ। উত্তরা থেকে ফার্মগেট আসা সহজ কথা নয়।
অন্ধকার কক্ষে বসে ইকবাল কত কী ভাবছে। ব্যাংকের জমানো টাকা পুরালে সে ফ্রিজটা বিক্রি করে দিবে। তাহলে আরো একমাস চলা যাবে। একটু ছোট দেখে নতুন বাসা খুঁজতে হবে। নতুন চাকুরি না পেলে শেষ পর্যন্ত গ্রামেই চলে যেতে হবে। সোমা থাকবে তার বাবার বাসায়। আরো কত কী ভাবে। ইকবাল মনে মনে বলে, আল্লাহ সেদিন যেন আমার জীবনে না আসে। তুমি রহম করো।
বাইরে বৃষ্টি কমে গেছে। ইকবাল মোবাইল দেখলো, রাত ৯টা বাজে। মোবাইল সাইলেন্ট করা ছিল। তাতে ৯ মিসড কল। সব কলই সোমার। ইকবাল বিস্মিত হয়। সোমার কোনো বিপদ হল না তো! এতোবার সে কল করেনি কখনো। ইকবাল দ্রুতই কল ব্যাক করে। সোমা কপট রাগ দেখিয়ে বলে, কোথায় থাকো তুমি? এতবার কল করলাম। দরোজা খোলো। ইকবাল হুড়মুড়িয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। লাইট জ¦ালাতে জ¦ালাতে বলে, কখন এসেছো তুমি? দরোজা নক করো নাই কেন? সোমা মোবাইলের অপরপ্রান্ত থেকে বলে, ‘আগে তো দরোজা খোলো। পা ব্যথা হয়ে গেল।’ ইকবাল দরোজা খুলে অবাক হয়। কেউ নেই। সোমা মুঠোফোনের ভেতর খিলখিল হাসতে থাকে। বলে, ‘কেমন বোকা বানালাম?’ ইকবাল সত্যিই বোকা বনে যায়। সোমা গম্ভীর হয়ে বলে, ‘ইকবাল সাহেব আপনার জন্যে একটা বিশেষ খবর আছে। খুব কঠিন খবর।’ ইকবালের ভেতরটা কেঁপে উঠে। তাহলে কি সোমা জেনে গেছে তার চাকুরি নেই অনেকদিন! সে কি অফিসে কল দিয়েছিল? ইকবাল কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে আদুরে স্বরে বলার চেষ্টা করে, বলো কী খবর? সোমা হাসতে হাসতে বলে, তুমি বাবা হতে যাচ্ছো! ইকবাল প্রথমে কথাটা বুঝেনি। বুঝা মাত্রই সে বিস্মিত হয়। বলে, সত্যি? জবাবে সোমা খিলখিল হাসে। তারপর কত কথা।
তখন রাত বেশি হয়নি। কিন্তু করোনাকাল বলে ঢাকার রাত ১০টাকে ১২টার মতো মনে হয়। ইকবাল বাসা থেকে বের হয়েছে। শ^শুরবাড়ি যাবে। যেভাবেই হোক যেতে হবে। দুঃসময়ে কী বিস্ময়ের খবর সোমা তাকে দিয়েছে। মনের ভেতর কেবল দুশ্চিন্তা উঁকি দেয়, তার তো চাকুরি নেই। সন্তান এলে তাকে ভরণপোষণের ভার কি সে নিতে পারবে? তাহলে কি সোমাকে অ্যাবরশন করাবে? আর সোমাই কি তা মেনে নিবে? অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খায় ইকবালের মনে। চোখ ঝিমঝিম করে। শত দুশ্চিন্তার মধ্যেও পিতৃত্বের আনন্দটুকু সে আড়াল করতে পারে না।
ইকবাল সিএনজি খুঁজছে। ভাগ্য ভালো, সিনেমা হলের সামনেই গাড়ি পাওয়া গেল। ভাড়া বেশি, কিন্তু ইকবাল তোয়াক্কা করে না। সোমাকে সে কিছুই জানায়নি। সময়-অসময়ের অজানা কিছু কথা জমা থাকা ভালো।