সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০

শঙ্খ ঘোষ : স্বতন্ত্র দ্যুতির কবি
ফারুক সুমন

কবি শঙ্খ ঘোষ। কবিতায় তাঁর স্বতন্ত্র দ্যুতি স্বীকৃত সত্য। কিন্তু কবিতা রচনা ছাড়াও এই বিষয়ে রয়েছে তাঁর সুললিত গদ্য। সেসব লেখায় সচকিত হয়েছে শব্দ ও নিঃশব্দের রূপসৌন্দর্য্য। বিশেষ করে কবিতায় শব্দের দুর্ভেদ্য দেয়াল নির্মাণের বিপরীতে তিনি কান পেতে শুনতে চেয়েছেন শব্দের নিহিত সত্যরূপ। শব্দের ভেতরে লুকিয়ে থাকা নিঃশব্দের অসীম সম্ভাবনার ইঙ্গিত তাঁর গদ্যপদ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। এ-কারণে কবিতাশিল্পের বিষয় ও প্রকরণ নিয়ে তিনি লিখেছেন অভিনিবেশ নির্ভর ব্যক্তিগত গদ্য। ‘এ আমির আবরণ’, ‘নির্মাণ আর সৃষ্টি’, ‘কবির অভিপ্রায়’, ‘ছন্দোময় জীবন’, ‘কল্পনার হিস্টিরিয়া’, ‘নিঃশব্দের তর্জনী’, ‘শব্দের পবিত্র শিখা’ ‘শব্দ আর সত্য’, ‘ছন্দের বারান্দা’ এবং জার্নালের মতো গদ্য রচনায় তুলে ধরেছেন কবি ও কবিতার হার্দিক ভাবনা। যদিও নিজের গদ্য নিয়ে ‘কবিতার মুহূর্ত’ গ্রন্থের ‘পা তোলা পা ফেলা’ শীর্ষক গদ্যে রয়েছে তাঁর বিনীত উচ্চারণ-‘গদ্যে নিজের বিষয়ে লিখতে ভয় হয়, গদ্য এত সরাসরি কথা বলে, এত জানিয়ে দেয়। কেবলই মনে হয় প্রকাশ্য করে এসব বলবার সময় নয় এখন। হাত থেকে কেবলই খসে যায় কলম, যে-কথাটুকু বলবার ছিল সেটুকুও ধরতে পারি না ঠিকমতো।’ তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, কবিতার সমঝদার তো বটে, কবিতা পাঠ করেন এমন যে কেউ শঙ্খ ঘোষের এসব গদ্য পাঠে আন্দোলিত হবেন।

শব্দই কবিতা। শব্দকে কবিতার কেন্দ্রে রেখে আধুনিক কাব্যালোচনায় কবিতার শক্তি নিরূপণের প্রয়াস লক্ষণীয়। শঙ্খ ঘোষ সশব্দের সমান্তরলে বারবার বলতে চেয়েছেন নিঃশব্দের অসীম সম্ভাবনার কথা। দেখাতে চেয়েছেন শব্দের বহুমাত্রিক অর্থব্যঞ্জনা। নিঃশব্দের তর্জনীর শক্তিও যে কবিতার জন্যে জরুরি। ফলে প্রগলভতার বদলে নীরবতার আধারে তিনি অন্বেষণ করতে চেয়েছেন কবিতার অধরামাধুরী। তাঁর ভাষায় :

‘তাই মনে হয় লিখতে হবে নিঃশব্দে কবিতা, এবং নিঃশব্দ কবিতা। শব্দই জানে কেমন করে সে নিঃশব্দ পায়, ঐশ সূত্র না ছিঁড়েও। তার জন্য বিষম ঝাপ দেবার দরকার আছে দুঃসহ আড়ালে থেকে। দুঃসহ, কেননা অন্তরাল সহ্য করাই মানুষের পক্ষে সবার চেয়ে কঠিন। কবিকে তো আজ সবটাই খেয়ে ফেলছে মানুষ, তাই মানুষের এই শেষ দায়টা মেনে নিয়েও ঘুরছে সে, অন্তরাল ভেঙে দিয়ে এক শরীর দাঁড়াতে চাইছে অন্য শরীরের সামীপ্যে। তা যদি না হয় তাহলেই সহ্য যায় পেরিয়ে,Ñকিন্তু তবু সেই দুঃসহ আড়ালে বসে সে তৈরি রাখবে একটা দৈনন্দিনের মুখোশ; তাকে কেউ চিনবে না, আঙুল তুলে বলবে না ‘এ লোকটা কবি’, আর তার ভিতর থেকে গোপনে জন্ম নেবে নিঃশব্দ কবিতা।’ [নিঃশব্দের তর্জনী]

শিল্পচর্চায় যে শিল্পমগ্নতা ও আড়াল প্রয়োজন। যন্ত্রনির্ভর এই সময়ে একজন কবি চাইলেই সেই আড়ালে অভ্যস্ত হতে পারেন না। সমাজের নানা প্রতিকূলতা তাকে ঘিরে ফেলে। বৈষয়িক মানুষ ক্রমশ শিল্পীমানুষকে পরাজিত করে। একারণে শঙ্খ ঘোষ একজন কবির অন্তরালের জন্যে ‘একটা দৈনন্দিনের মুখোশ’-এর প্রয়োজন অনুভব করেছেন। যেখানে থেকে কবি উঁচিয়ে ধরবেন ‘নিঃশব্দের তর্জনী’।

শঙ্খ ঘোষ কবিতায় পরিশীলিত শব্দ নির্বাচনের পক্ষপাতি। ‘শব্দের পবিত্র শিখা’ শীর্ষক গদ্যে কীটস-এর প্রসঙ্গ হাজির করে দেখাতে চেয়েছেন। কীটস কবিতার ভাবপ্রকাশে চেয়েছেন ‘উজ্জ্বলের চেয়ে উজ্জ্বলতর এক শব্দ, সুন্দরের চেয়ে সুন্দরতর এক শব্দ। শুদ্ধ আবেগ সত্য আবেগকে প্রকাশ করবার মতো শুদ্ধ সত্য শব্দ।’ কিন্তু কীভাবে এই শব্দ-সন্ধান সম্ভব? শঙ্খ ঘোষ এ সম্পর্কে ভেবেছেন। একজন কবি ব্যবহৃত কিংবা পরিচিত শব্দের ওপর আরোপ করেন কাব্যসৌন্দর্য। কাব্যালঙ্কারের রঙে শব্দ নতুন অর্থবহতায় উপস্থাপিত হয়। ‘শব্দের পবিত্র শিখা’ জ্বলে ওঠে। শঙ্খ ঘোষের ভাষায় :

‘নতুন শব্দের সৃষ্টি তাহলে শেষ কথা নয়, শব্দের নতুন সৃষ্টিই মূল। কিন্তু শব্দের নতুন সৃষ্টি কেমনভাবে সম্ভব? তখন আমাদের মনে পড়ে যে গ্রন্থকীটের ভাষা নয়, লৌকিক ভাষা মৌখিক ভাষাই হলো কবিতার অবলম্বন । কবিতার শব্দ নামে পৃথক কোনো বস্তু নেই, সমস্ত প্রচলিত শব্দই কবিতার শব্দ। কিন্তু এ-কথাও তো আজ কতদিনের পুরোনো। দেড়শো বছর আগে ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছিলেন ওই রকম, ওই একই প্রেরণা ছিল হুইটম্যান বা আর্নো হোলৎসের, তিরিশ বছর আগেও ওইটেই ছিল কবির মূল ঘোষণা, আবার আজও বীট কবিরা বা সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও-রকম ভাবেন।’ [শব্দের পবিত্র শিখা]

কবিতায় শব্দের অর্থবহতা তৈরিতে কবির ইচ্ছাই মুখ্য ভূমিকা রাখে। ফলে কাব্যিক শব্দ কিংবা অকাব্যিক শব্দ বলে পৃথক প্রসঙ্গের অবতারণা হলেও অবস্থাভেদে এমন বিভাজন অবান্তর বৈকি। শব্দের জাতবিচার, রুচিবোধ কিংবা নীতিগোত্র নেই। ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করেই কেবল ‘শব্দের পবিত্র শিখা’ দ্যুতি ছড়ায়। পবিত্র দ্যুতি ছড়ানো প্রসঙ্গে শঙ্খ ঘোষ বলেন :

‘শব্দের কি নিজস্ব কোনো পবিত্রতা আছে? জড় স্থাণু একটা শব্দ একক, তার কোনো শক্তি নেই জনন নেই, অপর এক শব্দের সমবায় সংঘর্ষে সে জ্বলে ওঠে। যেমন সমস্ত পাপহর অগ্নিদেবতা, কবিতাও তেমন। তার আগুনের মধ্যে সমিধ হয়ে আসতে পারে যা-কিছু, তাই অবশেষে পবিত্রতা অর্জন করে। কিন্তু সেই লেলিহান আগুন কি কবিকে সুদ্ধ গ্রাস করে নেবে?’ [শব্দের পবিত্র শিখা]

শিল্পসাহিত্যে বিভিন্ন সময়ে ইজম কিংবা ইশতেহার ঘোষণা করে নতুন সাহিত্য-আন্দোলনের জোয়ার দেখা যায়। অনেকটা প্রত্যক্ষ আন্দোলন-সংগ্রামের মতোই কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। তাঁদের ধারণা, এরকম সাহিত্য-আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বিষয় ও প্রকরণে আসবে নতুন বাঁক। ষাটের দশকের বাংলা কাব্যভুবনে ‘হাংরি জেনারেশন’ তথা ‘ক্ষুধার্ত কবি-সমাজ’ নামে এমনই এক কাব্যান্দোলন সাড়া ফেলে। যাদের লেখার মূল প্রবণতা ছিল প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা। তারা সংঘর্ষ, নেতিবাচকতা এবং নগ্নতাকে কবিতার শরীরে উপস্থাপনে প্রয়াসী। মূলত মার্কিন কবি এলেন গিনসবার্গ এবং ফার্লিংগোত্তিদের দ্বারা প্রথম এই আন্দোলনের সূচনা। শঙ্খ ঘোষ তাঁর লেখা ‘শব্দ আর সত্য’ প্রবন্ধে এদের নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। তিনি তাদের সমাজ ও রাজনীতি সচেতন অভিপ্রায়কে কেন্দ্র লরে সংক্ষুব্ধ মনোভঙ্গির প্রশংসা করেছেন। তবে প্রতিষ্ঠানবিরোধী মনোভাবের প্রশ্নে স্বতন্ত্র পথ বাতলে দিয়েছেন। তাঁর ভাষায় :

‘কবিতার জগতেও কেউ যদি প্রতিষ্ঠান ভাঙতে চান তবে তারও প্রয়োজন কেবল নিঃশব্দে সেইসব কবিতা লিখে যাওয়া, যা সামাজিকদের পক্ষে অনায়াসে ব্যবহার্য বা আস্বাদ্য নয়, যা গোপন পদসঞ্চারে ঘিরে ফেলবে সবাইকে। স্বতন্ত্র বিদ্বেষ জানানোর ততটা দরকার করে না তখন, রচনাটি নিজে নিজেই তখন হয়ে দাঁড়ায় প্রতিষ্ঠান বিরোধী।’ [শব্দ আর সত্য]

শঙ্খ ঘোষ যখন তাঁর লেখায় মন্তব্য করেন-‘লেখকের পক্ষে মূল প্রতিষ্ঠান হলো সমসাময়িক জনরুচি।’ তখন পুঁজিবাদী সমাজকাঠামোয় প্রতিষ্ঠিত যাবতীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কাব্যময় প্রতিবাদ করতে গেলে কবিতাকে 'সমসাময়িক জনরুচি'র প্রতি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি বৈকি। সমাজে রাগী কিংবা ক্ষুৎকাতর কবিদের দ্রোহীকবিতার ভক্তপাঠক নিশ্চয় আছে। তবে সংখ্যায় তারা খুবই নগণ্য। পুঁজিবাদের আগ্রাসনে গড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত সমাজ ব্যাপকভাবে এই প্রথিষ্ঠানবিরোধী কবিতা গ্রহণ না-ও করতে পারে। শঙ্খ ঘোষ বলেন :

‘যে সত্যের কথা আজ বলতে চাইবেন ক্ষুধার্ত কবি, অথবা রাজনৈতিক কবি, অথবা যে কোনো সত্য কবি, সেই সত্যকে সহজে মেনে নেওয়া কি সম্ভব স্বভাববিমুখ এই পথচলতি মানুষের পক্ষে? আমরা তো ভুলতে পারি না যে আমাদের প্রধান পাঠকজনতা বস্তুত এক মধ্যবিত্ত জনসংঘ, স্বরচিত কিছু সংস্কার এবং মুখোশমালায় নিজেকে সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করছে যে মধ্যবিত্ত জনতা। সে কেন সহ্য করবে তার মুখোশ ছিঁড়বার আয়োজন? সে কেন সহ্য করবে তার তৈরি-করা নিজস্ব মূল্যবোধের বিপর্যয়?’ [শব্দ আর সত্য]

‘শব্দ আর সত্য’ প্রবন্ধটি আগাগোড়া ক্ষুৎকাতর কবি ও কবিতার সমালোচনামুখর গদ্য। কবি মলয়রায় চৌধুরী কিংবা শৈলেশ্বরের বক্তব্যের আপাতবিপরীতে দাঁড়িয়ে শঙ্খ ঘোষ নিজের যুক্তিকে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর মতে, ক্ষুৎকাতর কবিরা কবিতা লেখার চেয়ে কবিতায় যেন ইশতিহার উপস্থাপনে অধিক উৎসাহী। ফলে কবিতার রূপসৌন্দর্য্য এখানে বাধাপ্রাপ্ত হয়। কবিতা হয়ে ওঠার বদলে হয়ে ওঠে প্রচারপত্র। ফলে এমন ক্ষুৎকাতর কবিকুলের প্রতি শঙ্খ ঘোষের বিনীত প্রস্তাবÑ‘শব্দবাহুল্যের বাইরে দাঁড়িয়ে, বিজ্ঞাপনের বাইরে দাঁড়িয়ে, ভুল আস্ফালনের বাইরে দাঁড়িয়ে সত্যিই যদি নিজেকে, নিজের ভিতর এবং বাহিরকে, আগ্নেয় জীবনযাপনের বিভীষিকার সামনে খুলে দিতে পারেন কবি, সেই হবে আজ তাঁর অস্তিত্বের পরম যোগ্যতা, তাঁর কবিতা।’ [শব্দ আর সত্য]

শঙ্খ ঘোষ কবিতার আঙ্গিক পরিচর্যায় ধ্রুপদী ঘরানার। কবিতায় অলঙ্কার প্রয়োগে পরিমিত দারুণ কুশলী। ফলে কবিতা প্রগলভতায় পর্যবসিত হয়নি। যথাবিহিত শব্দের সম্মিলনে কবিতা হয়েছে অনন্য। কবিতায় মুহূর্তের মুগ্ধতা সৃষ্টিতে তিনি যেন নিপুণ শিল্পী। তাঁর একান্ত প্রতীতি, ‘কবিতা মুহূর্ত চায়, শিকড়ে সর্পিল স্বাধীনতা।’ নৈর্ব্যক্তিক ভাবপ্রধান কবিতা ছাড়াও দ্রোহী কিংবা প্রতিবাদী কবিতাও অনুরূপ সংহত শব্দসমন্বয়ে সৃষ্ট। দৃষ্টান্ত স্বরূপ ‘যমুনাবতী’ কবিতার অংশবিশেষ দেখা যেতে পারে :

নিভন্ত এই চুল্লিতে মা

একটু আগুন দে,

আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি

বাঁচার আনন্দে !

নোটন নোটন পায়রাগুলি

খাঁচাতে বন্দী-

দুয়েক মুঠো ভাত পেলে তা

ওড়াতে মন দিই!

উদ্ধৃত কবিতাংশে শঙ্খ ঘোষ পরিমিত শব্দবন্ধে প্রকাশ করেছেন কী গভীরতম উপলব্ধি। প্রতিটি পঙ্ক্তি যেনো শাণিত তরবারি। অনবদ্য কাব্যভাষায় যেন ঝলসে ওঠেছে।

কবিতার সুদীর্ঘ ইতিহাসে নজর দিলে দেখা যাবে ‘ছন্দ’ কবিতার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। কেউ কেউ মনে করেন ‘ছন্দই কবিতা’। ছন্দ সচেতন কবি শঙ্খ ঘোষ কবিতার এই অনিবার্য উপাদান সম্পর্কে বিভিন্ন লেখা এবং সাক্ষৎকারে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছেন। তবে নিছক ছন্দবদ্ধ পদ্যকে ‘কবিতা’ হিসেবে মান্য করতে চাননি। 'ছন্দের বারান্দা' গ্রন্থে বিভিন্ন কবির কবিতা নিয়ে নির্মোহ আলোচনার মধ্যে এই ব্যাপারটি প্রতিভাত হয়েছে। ছন্দকে গুরুত্বপূর্ণ মেনে নেওয়ার পাশাপাশি এ-ও বলেছেন, ‘ছন্দই কবিতা নয়, কবিতার থাকে আরও অনেক উপাদান।’ আধুনিক কবিতা এখন জীবনের বহুবিধ অনুষঙ্গকে কবিতার বিষয় করে নিয়েছে। এই সময়ে এসে কেবল ছন্দের ঝঙ্কারে কবিতার জয় ঘোষণা করা যায় না। তবে সমকালীন কবিদের ‘ছন্দছুট’ কিংবা 'ছন্দে উদাসীনতা'র ব্যাপারটি তিনি সমর্থন করেননি। ছন্দের গ্রহণ-বর্জন প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন :

‘কবিতায় ছন্দ ব্যবহার করা, না করা, এটা একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। কেউ যদি মনে করে আমি ছন্দে লিখব না, সে লিখবে না। ছন্দে লিখতেই হবে এমন তো কথা নেই। তবে চিত্রশিল্পী যেমন একটি শিল্পকর্ম নির্মাণের আগে তার রঙ, রঙের বিন্যাস ও তুলি চালানো বিষয়ে একটি ধারণা নিয়েই শিল্পকর্ম করতে বসেন। অবশ্য কেউ ইচ্ছে করলে রঙের বিন্যাস ও তুলি চালানোর সুনির্দিষ্ট ধারণা ছাড়াও রঙ নিয়ে বসে তুলি চালাতে পারেন। কিন্তু রঙের বিন্যাস ও তুলি চালানোর বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকার পর যদি তিনি তাঁর সেই ধারণায় তুলি না চালিয়ে অন্য কোনো প্রকারে তুলি চালান, চালাতে পারেন। তার তো বিষয়টি জানা আছে, কোনভাবে চালালে কী হয়। না জানলে সেটি হয়তো অন্য বিষয় হবে। এ জন্য বলি, ছন্দটা জানা থাকা দরকার। ছন্দটা জানা থাকলে ছন্দ ভাঙাটা সহজ হয়।’ [সাক্ষৎকার গ্রহণ : সফেদ ফরাজী]

শঙ্খ ঘোষ যাপন করেছেন দীর্ঘ কবিজীবন। পেশায় অধ্যাপক হয়েও কবিতার ঘোর ও গরিমায় পাঠককে আবিষ্ট রেখেছেন। অজস্র গদ্যের ফাঁকফোকরে তাঁর কাব্যবোধ উচ্চকিত হয়েছে। ফলে কবিতাবিষয়ে তাঁর ভাবনানিচয় নিবিড় গবেষণা দাবি করে। তাঁর কাব্যবোধ এবং প্রকরণগত অভিজ্ঞান উত্তরপ্রজন্মের কবিতাকর্মীদের নবভাবনায় উজ্জীবিত করবে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়