মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া, স্ত্রীর আত্মহত্যা
  •   ভারতকে কড়া বার্তা শ্রম উপদেষ্টার
  •   আধুনিক নৌ টার্মিনাল প্রকল্প পরিদর্শনে চাঁদপুরে নৌপরিবহণ উপদেষ্টা
  •   ডাকাতিয়া নদী ও সিআইপি অভ্যন্তরস্থ খাল খননসহ ৫ দফা দাবিতে সংগ্রাম কমিটির সংবাদ সম্মেলন

প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

ইসলাম প্রতিষ্ঠায় আলেমদের ভূমিকা ॥ প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

মাওঃ মোঃ মোশাররফ হোসাইন
ইসলাম প্রতিষ্ঠায় আলেমদের ভূমিকা ॥ প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

ইসলাম আরবি শব্দ। অর্থ অনুগত হওয়া, আনুগত্য করা, আত্মসমর্পণ করা ইত্যাদি। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহর অনুগত হওয়া, আনুগত্য করা ও তার নিকট পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা; বিনা দ্বিধায় তার আদেশ-নিষেধ মেনে চলা এবং তার দেওয়া বিধান অনুসারে জীবনযাপন করা। আর যিনি ইসলামের বিধান অনুসারে জীবনযাপন করেন, তিনি হলেন মুসলিম বা মুসলমান। ইসলাম আল্লাহ্পাকের মনোনীত একমাত্র দ্বীন যা একটি পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত এ ব্যবস্থার আলোকে একজন মুসলমানকে জীবনযাপন করতে হয়। ইসলামে রয়েছে সুষ্ঠু সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থ ব্যবস্থা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালা। মানব চরিত্রের উৎকর্ষসাধন, ন্যায়নীতি ও সুবিচার ভিত্তিক শান্তি-শৃঙ্খলাপূর্ণ গতিশীল সুন্দর সমাজ গঠন এবং সংরক্ষণে ইসলামের কোনো বিকল্প নেই, হতে পারে না। পবিত্র কোরআনে আল্লাপাক ইরশাদ করেছেন, ‘ইসলামই আল্লাহর একমাত্র মনোনীত দ্বীন।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৯)। তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো কবুল করা হবে না।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৮৫)। রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ‘ইসলাম হলো, আল্লাহ ব্যাতীত কোনো ইলাহ নেই এবং মোহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রসুল বলে সাক্ষ্য দেওয়া, সালাত আদায় করা, যাকাত প্রদান করা, রমজানের রোজা পালন করা এবং সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্যে হজ আদায় করা।’ (বোখারি ও মুসলিম)।

মুসলিম জাতির সুদীর্ঘ ইতিহাসে তারা কখনো এমন বিপর্যয়ের শিকার হয়নি যার পরে তাদের উত্থান হয়নি। তারা কখনো এমনভাবে ঘুমিয়ে পড়েনি যার পরে তারা জাগ্রত হয়নি। তবে বর্তমান বিপর্যয়টি ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ বিপর্যয়। বর্তমানে মুসলিম জাতি চতুর্মুখী হামলার শিকার এবং তারা বিভিন্ন প্রশ্নে বিভক্ত। এই সংকটের সমাধান করা সমাজ সংস্কারক আলেমদের জন্য কঠিন। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে মুসলিম জাতি আল্লাহর মনোনীত শেষ জাতি। সুতরাং আল্লাহ্ পৃথিবীর বুকে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবেন এবং চূড়ান্ত বিজয় তাদের জন্যে নির্ধারিত। এ জন্যে তাদের সেসব উপায়-উপকরণ ও মাধ্যম সম্পর্কে অবগত হতে হবে, যা তাদের পুনর্জাগরণ ও উন্নয়নের পথে অগ্রযাত্রার নিশ্চয়তা দেবে। প্রকৃতপক্ষে মুসলিম উম্মাহর জাগরণের পথ ও পদ্ধতি সাধারণ মুসলমানের অনুসৃত পথ-পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেটা ঠিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জিত হবে না, যদিও এসব কাজ নিজ নিজ জায়গায় যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। মুসলিম জাতির পুনর্জাগরণের সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি কোরআন ও সুন্নাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা। এটাই মুসলিম জাতির শক্তি-সামর্থ্যের মূল উৎস। মুসলিম জাতির জাগরণে সবচেয়ে প্রভাবক শক্তি পবিত্র কোরআন।

কোরআনের চর্চা ও তিলাওয়াত এ জাতির জন্য অপরিহার্য। সব যুগের মুসলমানের জন্য কোরআনের জ্ঞান অর্জন করা মৌলিক দায়িত্ব। আর মুমিনের দায়িত্ব মহানবী (সাঃ)-এর ভালোবাসায় অন্তর ভরপুর থাকবে। পরিস্থিতি যত নাজুক ও ভয়াবহ হোক না কেন মুসলমান যদি কোরআনের শিক্ষা ও নবীজি (সাঃ)-এর আদর্শ-ভালোবাসা বুকে ধারণ করতে পারে, তবে তারা উত্তরণের আশা করতে পারে। এই দুই শক্তিই তাদেরকে মানবজীবনের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করতে পারে এবং তাদেরকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। যদিও তারা বারবার পতনের মুখে পড়ে। মুসলিম জাতিকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করা এবং তাদের উত্তরণের পথে নিয়ে যাওয়ার কাজ সবার মাধ্যমে হয় না, এ কাজ তাদের মাধ্যমেই হয় যাদের আল্লাহ যুগ সংস্কারক হিসেবে মনোনীত করেছেন এবং এ জাতির অভিভাবক হিসেবে প্রস্তুত করেছেন। তারা তাদের জীবনের সর্বস্ব দিয়ে আল্লাহ্ প্রদত্ত দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেন। যেন মুসলিম উম্মাহ সংকট কাটিয়ে নিজের অবস্থানে ফিরতে পারে।

খুশির সংবাদ হলো, দীর্ঘ আলস্য ও উদাসীনতার পর মুসলিম উম্মাহর ভেতর নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। মুসলিম জাতির ভেতর রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। আরববিশ্বে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক জাগরণ সৃষ্টি হয়। এ জাগরণে সাইয়েদ জামাল উদ্দিন আফগানী ও শায়খ মুহাম্মদ আবদুহু (রহঃ)-এর অবদান স্মরণীয়। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম জাগরণে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ)-এর শিষ্য ও পরিবারের সন্তানরা কৃতিত্বের দাবিদার। যেমন সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহঃ), শাহ ইসমাইল শহীদ (রহঃ) প্রমুখ। সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতাদের চেষ্টা, শ্রম ও আত্মত্যাগও বিশেষভাবে স্মরণীয়। ভারতীয় মহাদেশে জ্ঞানগত, বুদ্ধিবৃত্তিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব তৈরির প্রচেষ্টাও মুসলিম জাগরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে। ভারতীয় উপমহাদেশে জ্ঞানগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের পুরোধা ছিলেন শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দী (রহঃ) ও মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর (রহঃ)। পরবর্তী সময়ে এমন আরো বহু ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হয়, যাঁরা পূর্বসূরিদের আন্দোলন-সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে কাজ করে গেছেন। যদিও তাঁদের কেউ কেউ খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন।

অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দেশগুলোর সৌভাগ্য যে সেখানে জামাল উদ্দিন আফগানি (রহঃ)-এর মতো একাধিক ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছেন, যাঁরা সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছেন এবং দ্বিনের প্রচার-প্রসারে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। শায়খ হাসানুল বান্না শহীদ (রহঃ) তাঁদের মধ্যে অগ্রগামী। তিনি মুসলিম যুবকদের ভেতর আত্মমর্যাদাবোধ ও সাহসিকতার প্রাণ সৃষ্টি করেছেন, জাতির উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার জন্য তাদের ভেতর ঈমানি চেতনা, স্পৃহা ও আবেগ ঢেলে দিয়েছেন। তাঁর সহকর্মী ও শিষ্যদের ত্যাগ ও বিসর্জন মুসলিম বিশ্বের ইসলামী জাগরণে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। মুসলিম জাগরণে ভারতীয় উপমহাদেশের আলেমরাও সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাঁদের শ্রম, ত্যাগ ও প্রচেষ্টা মুসলমানের বৈশ্বিক জাগরণকে অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত করেছিল। ভারতীয় আলেমদের দ্বিনি সংগ্রামকে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায় : ১. ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার আন্দোলন, ২. ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, ৩. ইসলামী শিক্ষা ও দীক্ষার প্রসারের প্রচেষ্টা।

মুসলিম বিশ্বে ভারতীয় উপমহাদেশের একটি বিশেষ গুরুত্ব থাকার কারণ হলো পৃথিবীর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসলমান ভারতবর্ষে বসবাস করে। এখানে ইসলামী কর্মকাণ্ড, ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও প্রচারমাধ্যমও তুলনামূলক বেশি। এ ছাড়া ইসলামী জাগরণের সূচনা এখান থেকে হয় এবং ধীরে ধীরে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে তা ছড়িয়ে পড়ে। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে মুসলিম জাগরণে ভারতীয় মুসলমানের খেলাফত আন্দোলন জোরালো রসদ জুগিয়েছিল। এই আন্দোলন মুসলিম জাতির আত্মমর্যাদা, সাহসিকতা ও মনোবল বৃদ্ধি করেছিল। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে দানা বাঁধা খেলাফত আন্দোলনের সংযোগ ছিল মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে এবং এর প্রভাব পড়েছিল সমগ্র মুসলিম বিশ্বে। খেলাফত আন্দোলন মুসলমানের আত্মমর্যাদাবোধ ও সাহসিকতাই শুধু তৈরি করেনি, বরং ভিনদেশি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সমাজ, বর্ণ ও শ্রেণিতে বিভক্ত ভারতীয় সমাজকে একতাবদ্ধ করেছিল, তাদের সহযাত্রী ও সহযোদ্ধায় পরিণত করেছিল। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগ্রত করাই ছিল খেলাফত আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। তা সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে আলেমদের বর্ণাঢ্য অবদান সব যুগের মুসলমানের অনুপ্রেণার উৎস হয়ে আছে। মোগল শাসনের পতনের সঙ্গে সঙ্গে এ দেশে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। বিশেষত ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ায় মুসলমানরা এক চরম বৈরী পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। এমন বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেও ভারতীয় উপমহাদেশের আলেমরা ইসলামী শিক্ষার ধারা অব্যাহত রেখেছেন, যেন পরবর্তী প্রজন্ম দ্বিনবিমুখ হয়ে না যায়।

ইসলাম বাংলাদেশের প্রধান ধর্ম। এ দেশের সর্বাধিক জনগণ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। বাংলাদেশে মুসলমান জনসংখ্যার দিক থেকে যা বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মুসলমান জন-অধ্যুষিত দেশ (ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান এবং ভারতের পরে)। আলেমরা দুনিয়াতে নবীদের প্রতিনিধিত্ব করেন। নবীদের অনুপস্থিতিতে তাদের সব কাজ আঞ্জাম দেন। নবী কারিম (সাঃ) বলেছেন, আলেমরা নবীদের ওয়ারিশ। -সুনানে আবু দাউদ : ৩৬৪১। তারা নবীদের ওয়ারিশ জ্ঞানে-গুণে, আদবে-আখলাকে, ভদ্রতায়-শিষ্টাচারে, আচার-আচরণে ও ন্যায়-ইনসাফে। নবীরা ধর্মীয়, সমাজিক, রাষ্ট্রীয়, বৈশ্বিক ক্ষেত্রে যত ধরনের কাজ করেছেন সবক্ষেত্রেই আলেমরা নবীদের ওয়ারিশ। নবীরা যত ধরনের কাজ করেছেন, তাদের অনুপস্থিতিতে আলেমরা সবগুলো পরিচালনা করবেন। সভ্য সমাজ বিনির্মাণে নবীরা যেসব ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। আলেমরাও সেসব ক্ষেত্রে অবদান রাখবেন। সভ্য সমাজ বিনির্মাণে আলেমদের অবদান চিত্রায়িত করা হলো।

আদর্শ জাতি গঠনের প্রধান কারিগর : পরিশুদ্ধ, আদর্শ জাতি গঠনে আলেমদের অবদান অনস্বীকার্য। তাদের নৈতিকতা ও শুদ্ধতার শিক্ষা, আদর্শ জাতিগঠন ও সমাজ বিনির্মাণে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তার আয়াতসমূহ, তাদের পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কেতাব ও হেকমত।’ -সুরা জুমআ : ২। নবীজির অনুপস্থিতিতে এই কাজটি আলেমরা করে থাকেন। মসজিদের মিম্বরে, ওয়াজের ময়দানে, দরবারে, খানকায়, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে জনসাধারণের জন্য নসিহতমূলক বক্তৃতায় এবং স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে তাদের সঞ্জীবনী আলোচনা ছাত্রদের নৈতিকতাসম্পন্ন আদর্শ ব্যক্তি হতে আত্মার খোরাক হিসেবে কাজ করে।

সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজে বাধাদান : ভালো কাজে আদেশ এবং খারাপ কাজে বাধা দেওয়া সব মানুষের নৈতিক এবং ইমানি দায়িত্ব হলেও এই কাজ পূর্ণাঙ্গ নিষ্ঠার সঙ্গে আলেমরাই পালন করেন। আল্লাহ বলেন, তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহ্বান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভালো কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে।’ -সুরা আলে ইমরান : ১০৪। আর করবেন-ই না বা কেন? তাদের প্রতি মহান আল্লাহর হুকুম রয়েছে যে, আলেমরাই জাতিকে সর্তক করবেন। তাদের ভালো-মন্দ বোঝাবেন। সঠিক পথ দেখাবেন। আল্লাহ বলেন, প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না, যাতে তারা দ্বীনের জ্ঞান লাভ করে এবং সতর্ক করে স্বজাতিকে, যখন তারা তাদের কাছে আসবে, যেন তারা বাঁচতে পারে।’ -তওবা : ১২২

শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান : মুসলিম জাতিকে শিক্ষিত করতে যুগ যুগ ধরে আলেমরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন। আমরা যদি দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে তাকাই তাহলে দ্বিধাহীন চিত্তে এই কথা স্বীকার করব যে, গোটাদেশে বিশেষত গরিব-অসহায় ও প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাব্যবস্থা আলেমদের দ্বারাই সাধিত হচ্ছে। তারা তাদের ধর্মীয় ও জাগতিক উভয় শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। নবী কারিম (সাঃ)-এর বিদায় হজের সেই আদেশকে কার্যকর করছেন। তিনি বলেছিলেন, আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও অন্যের কাছে পৌঁছে দাও। -সহিহ বোখারি : ৩৪৬১

জনসেবামূলক কাজ : প্রত্যেক আলেম তার গোটাজীবনকে কোনো না কোনো জনসেবামূলক কাজে উৎসর্গ করেন। কিন্তু তারা সেই সেবাকে মানুষের কাছে প্রকাশ করেন না বা করতে চান না। কারণ তারা জনসেবা করেন ইবাদত হিসেবে। আর মানুষ দেখান ইবাদত আল্লাহ কবুল করেন না। হজরত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, দুনিয়াবাসীর ওপর অনুগ্রহ করো, তাহলে আসমানের অধিপতি তোমার ওপর অনুগ্রহ করবেন। -সুনানে আবু দাউদ : ৪৯৪১। জনসেবায় তারা রাসুলের এই কথাকে মূলনীতি মেনে চলেন। সেবার দ্বারা মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করেন কিন্তু সেটাকে প্রকাশ করেন না।

সমাজে নৈতিকতার ভিত তৈরি : ধর্মই মানুষকে নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। আর ধর্মীয় জ্ঞানের অধিকারী আলেমরা সেই শিক্ষাকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে মানুষের নৈতিকতার ভিত মজবুত করেন। আলেমরা সমাজকে শিক্ষা দেন, সদা সত্য কথা বলতে এবং মিথ্যা পরিহার করতে। নবী কারিম (সাঃ) বলেছেন, সত্য আত্মার জন্য শান্তিদায়ক আর মিথ্যা অশান্তিকারক। -সুনানে তিরমিজি : ২৫১৭ সতর্ক করেন মানুষকে ধোঁকা দিতে। বেঁচে থাকতে বলেন সুদ, ঘুষ ও সব ধরনের বাটপারি থেকে। উৎসাহিত করেন অন্যকে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, কে সেই ব্যক্তি যে, আল্লাহকে (গরিব, অসহায়দের) উত্তম ঋণ দেবে, এরপর তিনি তার জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন। -সুরা হাদিদ : ১১

সমাজে অপতৎপরতা রোধ : সমাজকে অপরাধমুক্ত করতে। অপরাধী ও কুচক্রী যারা সর্বদা সমাজে ফ্যাসাদ সৃষ্টির সুযোগ সন্ধানে থাকে কিন্তু নিজেদের নিরপরাধ ও শান্তিকামী বলে প্রকাশ করে। আল্লাহর ভাষায়, যখন তাদের বলা হয়, দুনিয়াতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করো না। তারা বলে, আমরাই মীমাংসাকারী। -সুরা বাকারা : ১১। আলেমরা এমন কুচক্রীদের ব্যাপারে সমাজকে সচেতন করেন। কুটিল লোকদের অপতৎপরতা থেকে সমাজকে রক্ষা করতে আলেমরা সর্বক্ষণ অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করেন। মসজিদের মিম্বরে মিম্বরে জোরালো আওয়াজ তুলে অপতৎপরতা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দেশের জনসাধারণকে সতর্ক করেন। সতর্ক করেন এসবে যোগদান থেকে।

রাজনীতিতে আলেম সমাজ : রাজনীতি আমাদের সমাজ জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেই রাজনীতিকে নবী (সঃ)-এঁর আদর্শে ফেরাতে এদেশের কিছু আলেম নিরলসভাবে কাজ করছেন। চেষ্টা করেছেন স্বচ্ছ রাজনীতি করতে এবং দেশের মানুষকে শেখাতে। এদের মধ্যে মাও. শাহ নেছার উদ্দীন, শাহ আবু জাফর ছালেহ, শাহ মো. মুহিবুল্লাহ, আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহঃ), হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ), শায়খুল হাদীস মাওলানা আজিজুল হক (রহঃ), মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহঃ) অন্যতম। যারা এদেশে আদর্শভিত্তিক রাজনীতির স্বপ্নদ্রষ্টা। ইসলামের মুহাম্মাদ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নবী মুহাম্মাদ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জন্মগ্রহণ করেন খ্রিষ্টীয় ৫৭০ সালে। এর মাত্র ৫০ বছর পর ৬২০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে আসে ইসলাম। আর উত্তরের জেলা লালমনিরহাটে শুরু হয় যাত্রা। বিভিন্ন গবেষণা ও প্রাপ্ত শিলালিপি এমন দাবিই জোরালো করেছে। এতে আরও দেখা যায়, ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে দেশের প্রথম মসজিদটিও নির্মিত হয় এই জেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের ‘মজেদের আড়া’ নামক গ্রামে। এটির নাম সাহাবায়ে কেরাম জামে মসজিদ। ১৯৮৭ সালে পঞ্চগ্রামে জঙ্গল খননের সময় প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। এর একটি ইটে কালেমা তাইয়্যেবা ও ৬৯ হিজরি লেখা রয়েছে। এ থেকে অনুমান করা হয়, মসজিদটি হিজরি ৬৯ অর্থাৎ ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে স্থাপন কিংবা সংস্কার করা হয়।

রংপুর জেলার ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মামা, মা আমেনার চাচাতো ভাই আবু ওয়াক্কাস (রা.) ৬২০ থেকে ৬২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করেন (পৃ. ১২৬)। অনেকে অনুমান করেন, পঞ্চগ্রামের মসজিদটিও তিনি নির্মাণ করেন যা ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে সংস্কার করা হয়। মতিউর রহমান বসুনিয়া রচিত ‘রংপুরে দ্বীনি দাওয়াত’ গ্রন্থেও এই মসজিদের বিশদ বিবরণ আছে। ‘দেশে ইসলাম প্রচার করেন ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন খিলজী’ এমন একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত থাকলেও এসব তথ্য প্রমাণ করে যে, এর অনেক আগেই এদেশে ইসলাম প্রচারিত হয়। ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন খিলজীর বাংলা বিজয়ের প্রায় ৬০০ বছর আগেই সাহাবীদের দ্বারা বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব হয়। প্রথম মসজিদও নির্মিত হয় সেই সময়েই। ঐতিহাসিক মসজিদসমূহ আবু আক্কাস মসজিদণ্ড৬৪৮, শাহবাজ খান মসজিদণ্ড১৬৭৯, সোনা মসজিদণ্ড১৪৯৩,বাঘা মসজিদণ্ড১৫২৩,নয়াবাদ মসজিদণ্ড১৭৫৫,খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদণ্ড১৭০৩,ষাট গম্বুজ মসজিদণ্ড১৫শ শতক,সাত মসজিদণ্ড১৬৬৯,লালবাগ কেল্লা-১৬৬৪।

বাংলাদেশে মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব, খানকা ও ইসলাম প্রচারের কেন্দ্র সমূহ এদেশের আলেমদের অবদান। প্রত্যেক আলেম ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন ও রাসূল (সাঃ) আর্দশ অনুসরণ পূর্বক ইসলামের বিজয় লাভ টিকিয়ে রেখেছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সকল দল মত ও পীর-মাশায়েখ ঐক্যমত পোষণ করে এমন একটি দেশ গঠন প্রয়োজন যেখানে অন্য ধর্মের মানুষ যাতে তাদের ধর্ম পালনে বাধাঁর সম্মুখিন না হন। অন্য ধর্মের লোকদের কষ্ট দিয়ে ইসলাম প্রচার করা যাবে না এমনকি এটা ইসলাম স্বীকৃতিও দেয়নি। সুতরাং বাংলাদেশের ইসলাম টিকিয়ে রাখার বিশেষ প্রয়োজন আলম। আমল সহীহ হলে সাধারণ মানুষ অনায়েসে আলেমদের দিকে ঝুকে যাবে ইনশাল্লাহ। আমল বিহীন ইসলামী দল বাংলাদেশের মুসলমান কখনো গ্রহণ করবে না এবং যারা ইসলাম মতনক্য সৃষ্টি করে মুসলমানদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করতে চায় তারাও এখন সংশোধন হয়ে একটি ছায়া তলে আসার সময় হয়েছে। আল্লাহ সকলকে কবুল করুন। আমীন

মাওঃ মোঃ মোশাররফ হোসাইন, খতীব, কালেক্টরেট জামে মসজিদ, পিএইচডি গবেষক (আরবী), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়