রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

আহলে বাইতে রাসূলের ভালোবাসা উম্মতে মোহাম্মদীর নাজাতের তরী

হাফেজ মাওলানা আবুল হাসান মোহাম্মদ বায়জীদ
আহলে বাইতে রাসূলের ভালোবাসা উম্মতে মোহাম্মদীর নাজাতের তরী

‘আহলে বাইত’ শব্দের অর্থ হলো ঘরের অধিবাসীগণ, পরিবারবর্গ ইত্যাদি। তবে ইসলামী পরিভাষায় আহলে বাইত বলতে প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার পরিবারবর্গ, ঘরের অধিবাসীগণকে বুঝায়। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার প্রতি হৃদয়গভীর থেকে আন্তরিক মহব্বত থাকার পাশাপাশি এই ভালোবাসার দাবি হিসেবে তাঁরই আহলে বাইতের প্রতিও গভীর মহব্বত-শ্রদ্ধাবোধ রাখা প্রত্যেক ঈমানদারের জন্যে অবশ্য কর্তব্য। রাসূলে খোদার পরিবার-পরিজন বিশেষত পাক-পাঞ্জাতনের প্রতি অন্তঃকরণ থেকে মহব্বত রাখা ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আল্লাহ জাল্লা শানুহু পবিত্র কুরআনুল কারীমে এ ব্যাপারে এরশাদ ফরমান, “(হে আমার হাবিব!) আপনি বলুন; আমি তোমাদের কাছে (আমার দীন প্রচারের সীমাহীন কষ্টের বিনিময়ে) কোনো প্রতিদান চাই না, তবে আমার নিকটাত্মীয়দের ভালোবাসা ছাড়া, যে উত্তম কাজ করে আমি তার জন্যে এতে কল্যাণ বর্ধিত করি।” [সূরা আশ্ শুরা-২৩] এখানে একই আয়াতের দু’টি অংশ তবে উভয় অংশের উদ্দেশ্যে এক। সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম এ আয়াতে কারীমার প্রেক্ষিতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করলেন; ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, এ আয়াতে বর্ণিত নিকটাত্মীয় কারা? যাদেরকে মহব্বত করা আমাদের উপর ওয়াজিব? নবীজী জবাব দিলেন, তারা হলেন, আলী, ফাতিমা এবং তাদের দু সন্তান অর্থাৎ হাসান-হোসাইন আলাইহিমুস সালাম। [তাফসীরে কুরতবী-৮/২১, মু’জামুল কবীর লিত তবারানী-৩/৪৭] আর আয়াতের পরবর্তী অংশ ‘যে উত্তম কাজ করে আমি তার জন্য এতে কল্যাণ বর্ধিত করি’ এখানেও উত্তম কাজ বলতে যা বুঝানো হয়েছে তা হলো, ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, “যে উত্তম কাজ করে অর্থাৎ আ’লে মোহাম্মদ (রাসূলের বংশধর) আলাইহিমুস সালামকে ভালোবাসে তার জন্য আল্লাহ কল্যাণ বাড়িয়ে দেন।” [তাফসীরে দুররুল মানসুর-৫/৭০১, কুরতবী-৮/২৪] যদিও হুব্বে আহলে বাইত আবশ্যক হওয়ার ব্যাপারে আরো অসংখ্য দলিল রয়েছে তবে এই একটি আয়াতের দিকে ঈমানী দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলেই আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসার অতীব প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়ে উঠে। আইম্মায়ে আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে পবিত্র কুরআন মাজীদের কম-বেশি প্রায় ৪৩টি সূরার কমপক্ষে ৭৪টি আয়াতে রাব্বুল আলামীন পবিত্র আহলে বাইতের মহব্বত, তাদের মর্যাদা প্রসঙ্গে প্রত্যক্ষ-প্রচ্ছন্নভাবে আলোচনা করেছেন। এটিই প্রমাণ করে আহলে বাইতে রাসূলের প্রতি অকুণ্ঠ মহব্বত রাখা ঈমানদারের জন্য খুবই জরুরী।

এ কথা প্রত্যেক খাঁটি মুমিন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সবচেয়ে বেশি মহব্বত করাই হলো ইহ-পরকালে মুক্তির একমাত্র পাথেয়। সুতরাং যে মুমিনের অন্তরে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ভালোবাসা থাকবে তার অন্তরে সেই সমুদয় বস্তুর ভালোবাসাও থাকবে যা নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সম্পৃক্ত। এটা একটা প্রাকৃতিক বিষয় যে, মানুষ যাকে ভালোবাসে তার সাথে ভালোবাসা ও সম্পৃক্তধারী প্রত্যেক কিছুই তার কাছে প্রিয় হয়ে যায়। অতএব যারা কুল কায়েনাতের সরদার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করে তারা তাঁর সন্তান-সন্ততি, সাহাবীগণ, তাঁর বাণী ও কর্ম, তাঁর মোবারক জন্মস্থান এবং সেই সমুদয় বস্তুকে মনে-প্রাণে ভালোবাসবে যেগুলো তাঁর সাথে আত্মিক বা শারীরিকভাবে সম্পৃক্ত। কেননা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কারণেই এগুলোর ভালোবাসা। এগুলোর মহব্বত হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহব্বতেরই অংশ। পক্ষান্তরে যে বা যার অন্তরে এগুলোর কোন একটির প্রতি বিদ্বেষ রয়েছে, এগুলোর প্রতি বেয়াদবী বা অবজ্ঞামূলক ধারনা রয়েছে, সে ঈমান থেকে বঞ্চিত, সে হতভাগা আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় হাবিবের শত্রু। মানুষ নিজের শত্রু বা নিজের পিতার দুশমনের সাথে সম্পর্ক রাখা দূরে থাক তার সাথে সানন্দে কথা বলাও পছন্দ করে না; তাহলে যে আল্লাহ-তাঁর রাসূল-আহলে বাইত-সাহাবায়ে কেরাম, ওলী-আউলিয়ার দুশমন তার সাথে কিরূপে সম্পর্ক রাখতে পারে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর আহলে বাইতের প্রতি প্রাণাধিক মহব্বত রাখা, এক্ষেত্রে প্রয়োজনে নিজের জান-মাল কুরবানী করা, এটা কোন ঈমানের অংশ নয় বরং এটাই ঈমান। নবীয়ে দো-জাহাঁ সাল্লাল্লাহু আলাাইহি ওয়া সাল্লামও নিজের মহব্বতের শর্ত হিসেবে আহলে বাইতে রাসূলের মহব্বতকে জুড়ে দিয়েছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ ফরমান, “তোমরা আমার আহলে বাইতকে ভালোবাসো আমার ভালোবাসার কারণে”। [মুসতাদরাকে হাকেমণ্ড৩/১৬২]. হুজুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও এরশাদ করেন, “তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি যদি রূকনে ইয়ামানী ও মাকামে ইবরাহীমের মাঝে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায় অত:পর নামাজ পড়ে ও রোযা রাখে, তারপর সে আহলে বাইতে মোহাম্মদের প্রতি শত্রুতা রেখে মারা যায় (তার এই ইবাদত সমূহ কবুল হবেনা) সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” [মু’জামুল কবীর-১১/১৪২]. শুধু তাই নয় আহলে বাইতে রাসূলের প্রতি মহব্বত না রেখে শত্রুতা পোষন করলে হাশরের ময়দানেও সেই হতভাগার উপায় নেই। নবীজী আমার মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নূরাণী জবানে এরশাদ করেন,“যে কেউ আমাদের (আহলে বাইত) প্রতি বিদ্বেষ রাখবে, আমাদের হিংসা করবে কেয়ামতের দিন হাউযে কাউসারের প্রান্ত থেকে (পানি না দিয়ে) তাদেরকে জাহান্নামের চাবুক দ্বারা চাপড়িয়ে তাড়িয়ে দেয়া হবে।” [সহিহ ইবনে হিব্বান-১৫/৪৩৫]. অন্য হাদিসে এসেছে, “যারা আমার আহলে বাইতের প্রতি শত্রুতা রাখবে আল্লাহ তাদেরকে কেয়ামতের দিন ইহুদিদের সাথে হাশরে উঠাবেন। রাবী বলেন আমি জিজ্ঞাসা করলাম যদি সে নামাজ পড়ে রোযা রাখে? রাসূল বললেন যদিও সে নামাজ পড়ে রোযা রাখে এবং ধারনা করে সে মুসলিম” ”[মু’জামুল আওসাত-৫/১৪]. এ জন্য মোমিনের উচিত আহলে বাইতের প্রতি সুগভীর ঈমানী ভালোবাসা রাখা।

চৌদ্দশত বছরের সংগ্রামী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যুগে যুগে আহলে বাইতে রাসূলরাই সত্য দীন তথা ঈমান-আমল-আখলাকে হাসানাহ এ যমীনে প্রতিষ্ঠার জন্য সবেচেয়ে বেশী কষ্ট স্বীকার করেছেন। বাতিলের হুমকি-ধামকি কিংবা জালিমের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সত্য এবং ন্যায়ের সোনালী ঝান্ডা তাদের নেতৃত্বেই স্ব-গৌরবে উড্ডীন রেখেছেন। পৃথিবী জুড়ে জুলুমের ঘন-কালো মেঘ যখনই আচ্ছাদন করেছে, আমার প্রিয় রাসূলের পবিত্র বংশধররাই প্রাণপন সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেদের জান-মাল কুরবানী করে মুক্তির সোনালী কিরণ উদয় করেছেন। এ জাতি কালে কালে তাদের আশ্রয়েই শান্তি-মুক্তির দিশা লাভ করেছে। সপ্ত জমিনের তলদেশ থেকে দিগন্ত বিস্তৃত ইসলাম নামক সুবিশাল বটবৃক্ষকে কুফরি-নিফাকী শক্তি যখনই নিশ্চি‎‎হ্ন করতে চেয়েছে; তখনই আহলে বাইতে রাসূলরা বুকের তাজা খুন ঢেলে এ বটবৃক্ষকে সজীব-সতেজ করেছেন। আমার প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর আহলে বাইতকে সেজন্যইতো এ উম্মতের নাজাতের তরী, উম্মতে মোহাম্মদীর কান্ডারী-পথের দিশারী ঘোষণা করেছেন। এরশাদ হচ্ছে, “আমার আহলে বাইতের উপমা নূহ আলাইহিস সালামের নৌকার মতই। যে ব্যক্তি তাতে আরোহণ করবে সে নাজাত পাবে আর যে আরোহণ করবেনা সে নিমজ্জিত বা ধ্বংস হবে।” [মুসতাদরাক-৩/১৬৩, কানযুল উম্মাল-১২/৯৪]. এই পবিত্র হাদিসখানা থেকে প্রতিভাত হয় যে, ইহ-পরকালে মুক্তি পেতে হলে আহলে বাইতে রাসূলকে মহব্বত এবং তাদের অনুসরণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। সাইয়্যেদুনা হযরত নূহ আলাইহিস সালামের সময় পুরো পৃথিবী জুড়ে যে মহাপ্লাবন সংঘটিত হয়েছিল, সে প্লাবনের ধ্বংসলীলা থেকে তারাই মুক্তি পেয়েছে যারা নূহ আলাইহিস সালামের কিশ্তিতে উঠেছিল। যারা দাম্ভিকতা দেখিয়ে ঐ কিশ্তিতে আরোহণ করেনি অথৈ জলে তাদের সলিল সমাধি হয়েছে। ঠিক তেমনিভাবে এ উম্মত যখন কুফরির মহাপ্লাবনে ঘুরপাক খাবে সেখান থেকে নাজাতের জন্য আহলে বাইতে রাসূলের কাছেই ফিরে আসতে হবে। পক্ষান্তরে যারা আহলে বাইতকে অবজ্ঞা করবে, তাদের মহব্বত করবেনা-তা’জিম করবেনা তাদের ধ্বংস অনিবার্য। প্রাণের আক্বা ও মওলা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, “মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধরদের পরিচয় লাভ করা দোযখ হতে নাজাতের মাধ্যম, তাঁর বংশধরদের প্রতি ভালোবাসা রাখা পুলসিরাত অতিক্রম করার সনদ এবং তাঁর বংশধরদের অভিভাবকত্ব মেনে নেয়া আল্লাহর আযাব হতে নিরাপত্তা লাভের উপায়।” [শিফা শরীফ-২/৪৭]. কেউ যদি আল্লাহতে বিশ্বাস রাখে, নবীজীর প্রতি ঈমান আনে কিন্তু অন্তরে আহলে বাইতে রাসূলের প্রতি মহব্বত রাখেনা সে ঈমানদারই নয়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, “আল্লাহর শপথ! কোন মুসলমানের অন্তরে ঈমান প্রবেশ করবেনা যতক্ষণনা সে আল্লাহকে এবং তার সাথে আমার নিকটাত্মীয়দের (আহলে বাইত)কে ভালোবাসবে।” [মসনদে আহমদণ্ড১/৩৪২, সুনানে তিরমিজি-৫/৬১০].

বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ইন্তেকালের পর জাহেরী অনুপস্থিতিতে এ উম্মতকে হেদায়েতের জন্য দু’টি পথের দিশা দিয়েছেন। একটি হচ্ছে মহাগ্রন্থ আল কুরআন অপরটি তাঁর পবিত্র আহলে বাইত। হুজুরে আকরাম নূরে মুজাস্সাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, “(হে মানব জাতি) আমি তোমাদের কাছে দু’টি বিষয় রেখে যাচ্ছি, যতক্ষণ তোমরা এ দু’টি বিষয়কে আঁকড়ে ধরে রাখবে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না, সে দু’টি বিষয় হলো আল্লাহর কিতাব তথা কুরআন ও আমার আহলে বাইত। এ দু’টি হাউযে কাউসার পর্যন্ত আমার থেকে পৃথক হবে না। অতএব, তোমরা এ দু’টি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখ।” [সুনানে তিরমিজি-৫/৬২২]. লক্ষ্য করার বিষয় এটি আমার রাসূলের পবিত্র নূরাণী যিন্দেগীর শেষ গুরুত্বপূর্ণ অসীয়তগুলোর একটি।

আহলে বাইতের সদস্যরা জীবন্ত কুরআনরূপী আমার রাসূলকে নিকট থেকে দেখেছেন, তাঁর কথা-বার্তা চাল-চলন গভীরভাবে অবলোকন করেছেন, নবীজীর থেকে হেদায়েতের মৌলিক বিষয় সমূহ তারা দেহ-মন-মানসিকতায় ধারণ করেছেন, তাদের যাপিত জীবন নবীজীর চক্ষু মোবারকের সামনেই ছিল, তারা বেড়ে উঠেছেন হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে, নূরে মোহাম্মদীর পবিত্র বেষ্টনীতেই তারা যিন্দেগী কাটিয়েছেন। সুতরাং এ উম্মত আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের পাশাপাশি আহলে বাইতের পায়রবি করবেনা তো কাদের পায়রবি করবে? উম্মতের সম্মান-মর্যাদা, উন্নতি-অগ্রগতি তাদের অনুসরণের মাঝেই বিদ্যমান। আহলে বাইতের সদস্যরা সবাই জান্নাতী নি:সন্দেহে। ঐতিহাসিক খন্দকের যুদ্ধে নবীজীর মুখ মোবারক থেকে যখন খুন বয়ে যাচ্ছিল, রাসূলের পাগল প্রেমিক সাহাবী মালিক ইবনে সিনান রাদিয়াল্লাহু আনহু জখমী যায়গায় মুখ লাগিয়ে রক্ত মোবারক চুষে খেয়ে ফেলেন। তার জন্য আমার রাসূল ঘোষণা করলেন- “আমার রক্ত যার রক্তের সাথে মিশেছে তাকে জাহান্নাম স্পর্শ করবেনা।” [মু’জামুল আওসাত-৯/৪৭, সিরাতে ইবনে হিশামণ্ড২/৭৯]. সুতরাং যাদের শরীরে আমার রাসূলের মূল রক্ত-মাংস-অস্থির অংশ রয়েছে তাদের ব্যাপারে কি ধারনা করা যেতে পারে? অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ ফরমান, “আমি আমার প্রতিপালকের কাছে দোয়া করেছি যেন আমার আহলে বাইতের কাউকেই জাহান্নামে প্রবেশ না করান। আল্লাহ তা মঞ্জুর করেছেন।” [জামেউস সগীর-১/৪৫৬, সাওয়ায়েকে মুহরেকাণ্ড২/৪৬৩]

আহলে বাইতে রাসূল আল্লাহর পছন্দনীয়-নির্বাচিত পবিত্র সত্তা। পবিত্র কুরআনুল হাকীমে রাব্বুল আলামীন তাদের শানে এমন একটি আয়াত নাযিল করেছেন অন্য কারো পবিত্রতা বর্ণনার্থে এ জাতীয় আয়াতে কারীমা অবতীর্ণ হয়নি। এরশাদ হচ্ছে, “হে নবী পরিবার! আল্লাহতো কেবল চান তোমাদের থেকে পবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।” [সূরা আহযাব-৩৩]. আম্মাজান উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, এ আয়াত আমার ঘরেই নবীজী অবস্থানকালীন নাযিল হয়েছে। অতঃপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলী, ফাতেমা, হাসান, হোসাইনকে ডেকে পাঠান। তারা আসলে আদরের দুই নাতি হাসান-হোসাইনকে দুই উরুর উপর বসান, তারপর ফাতেমাকে এরপর আলীকে নিজের গায়ে জড়ানো একই চাদরের নিচে ঢেকে নেন এবং এদের চারজনকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহর কাছে পরপর তিনবার দোয়া করেন, হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বাইত। এদের থেকে আপনি যাবতীয় অপবিত্রতা দূর করুন, আর এদেরকে পূত-পবিত্র করুন। [মুসতাদরাক-২/৪৫১, মু’জামুল আওসাত-৭/৩১৮]

রাসূলের বংশধরদের কি মহান আযমত! স্বয়ং আল্লাহ যিনি সব পবিত্রতার উৎস তিনি নিজে দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁর প্রিয় হাবিবের বংশধরদের সব ধরনের জাহেরী-বাতেনী অপবিত্রতা থেকে মুক্ত রাখার। আমার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তাঁর কলিজার টুকরো আহলে বাইতের নিষ্কলুষতার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চাইছেন। এর কারণ কি? কারণ স্পষ্ট, এরাইতো অদূর ভবিষ্যতে পথহারা উম্মতের রাহবার হবে। কুফর-শিরক-নিফাকসহ যাবতীয় বাহ্যিক-অভ্যন্তরীন পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত জাতি তাদের দেখানো পথেই মুক্তির দিশা পাবে। শরীয়ত-তরীকত-হাকীকত-মা’রিফাতের এরাই হবেন কেন্দ্রবিন্দু। উম্মতে মোহাম্মদীর অস্তিত্ব-স্থিতি আহলে বাইতে রাসূল ছাড়া কল্পনাও করা যায় না। নবীয়ে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, “আকাশের তারকারাজি আসমানবাসীদের জন্য রক্ষাকবচ আর আমার উম্মতের রক্ষাকবচ হল আমার আহলে বাইত।” [মু’জামুল কবীর-৭/২২, কানযুল উম্মাল-১২/১০১].

আমার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ উম্মতকে তাঁর আহলে বাইতের ব্যাপারে সাবধান করেছেন এই বলে, “তোমরা আমার আহলে বাইতের মহব্বতকে নিজেদের জন্য আবশ্যক করে নাও। নিশ্চয়ই যে এ অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ (মৃত্যুবরণ) করবে যে আমাদের প্রতি তার মহব্বত আছে, সে আমাদের সুপারিশক্রমেই জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ ! বান্দার কোন আমলই (ফরজ-নফল) কাজে আসবে না যতক্ষণনা সে আমাদের (আহলে বাইতের) মর্যাদা উপলব্ধি করবে।” [মু’জামুল আওসাত-৩/১২২] যারা আল্লাহর প্রিয় হাবিবের আওলাদদের তা’জিম ও মহব্বত করেনা তাদের ব্যাপারে এরশাদ হচ্ছে, “যে আমার আহলে বাইত এবং আনসারদের মর্যাদা উপলব্ধি করলো না সে তিন শ্রেণির যে কোনো একটির অন্তর্ভুক্ত; সে মুনাফিক, নয়তো বা সে জারজ সন্তান কিংবা তার মাতা অপবিত্র অবস্থায় তাকে গর্ভে ধারন করেছে।” [শু’আবুল ঈমান-২/২৩২]. যুগে যুগে যারাই আহলে বাইতের সাথে বেয়াদবী করেছে তারা ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে তারা উপরোক্ত তিন শ্রেণির মধ্যে থেকেই এসেছে।

একবার নাজরানের একদল খৃষ্টান আল্লাহর রাসূলের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বহস করতে আসল। নবীজীর পেশকৃত অকাট্য দলিল-যুক্তির সামনে তারা যখন হার মানল, গোঁয়ার্তুমি করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে চ্যালেঞ্জ করল যে উভয়পক্ষ তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে খোলা মাঠে আসবে এবং একে অপরের জন্য বদদোয়া করবে। যারা হকপন্থী আল্লাহ তাদের বিজয়ী করবেন অন্যদের আসমান থেকে গযবের আগুণ এসে ভস্মিভূত করবে। কথামত নির্দিষ্ট সময়ে খৃষ্টানরা তাদের বড় বড় পাদ্রীদের নিয়ে সুসজ্জিত অবস্থায় ময়দানে আসল, অন্যদিকে আমার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ অবস্থায় ময়দানে আসলেন যে, তাঁর বাম পার্শ্বের কোলে রয়েছেন ইমাম হোসাইন, ডান হাতে ইমাম হাসান, মা ফাতিমা ও হযরত আলী হুজুরের পেছনে দু’জন দুই পাশে। নবীজী তার পরিবারকে বললেন আমি যখন দোয়া করব তখন তোমরা আমীন আমীন বলবে। অতঃপর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের দরবারে দোয়া করতে লাগলেন ‘হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বাইত .. ..

খৃষ্টানদের সবচেয়ে বড় পাদ্রী যখন এই সুদর্শণ, অনুপমণ্ডঅভূতপূর্ব দৃশ্য অবলোকন করল তখন বলে উঠল হে খৃষ্টানগণ! ‘নিঃসন্দেহে আমি এমন কিছু চেহারা দেখছি যদি তারা আল্লাহ তায়ালার নিকট কোন পর্বতকে তার স্থান থেকে সরিয়ে দেয়ার প্রার্থনা করেন তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাদের দোয়ায় পর্বতকে তাদের স্থান থেকে সরিয়ে দেবেন। আল্লাহর ওয়াস্তে তাদের সাথে মুবাহালা (দু’পক্ষের পরষ্পরের জন্য বদদোয়া) কর না নচেৎ ধ্বংস হয়ে যাবে এবং ভূপৃষ্ঠে কেয়ামত পর্যন্ত কোন খৃষ্টান অবশিষ্ট থাকবে না। অতঃপর তারা পরাজিত হয়ে পশ্চাতে প্রস্থান করে। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমায়েছেন, খোদার কসম! আল্লাহর আজাব তাদের নিকট এসে পৌঁছেছিলো। যদি মুবাহালা হয়ে যেতো তাহলে এরা সবাই বানর ও শুকরে পরিণত হতো। তাদের জনপদে আগুন জ্বলে উঠতো এমনকি নাজরানের পশু-পাখি পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যেত। [তাফসীরে কবির-৮/৭১] এভাবেই যারা আহলে বাইতে রাসূলের সাথে বেয়াদবি করেছে তারাই অপমান-অপদস্থতা কিংবা ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হয়েছে। পাপাত্মা-অভিশপ্ত এজিদ, উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ, মারওয়ান, শীমারদের অস্তিত্ব আজ বিলীন। তাদের মানুষ চিরকাল চরম ঘৃণাভরে স্মরণ করবে। অন্যদিকে মুসলমানদের ঘরে ঘরে ইমাম হোসাইনের স্মরণ হচ্ছে পরম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আদবের সাথে। এটা চলতেই থাকবে। তবে আহলে বাইতে রাসূলকে ভালোবাসার দাবি করে উম্মতের স্তম্ভ সম্মানিত সাহাবাগণের সমালোচনা করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। জাহান্নামী বাতিল ফিরকা শীয়া-রাফেজীগণ অত্যন্ত সূক্ষ্ম কৌশলে মহব্বতে আহলে বাইতের আড়ালে সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে সমাজে বিদ্বেষ ছড়িয়ে যাচ্ছে। এদের থেকে আমাদের সাবধান থাকতে হবে। আহলে বাইতে রাসূলের মহব্বত, তাদের নক্শে কদম চলা, তাদের আদর্শ অনুসরণে বাতিলের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামই হোক আমাদের প্রত্যয়। কারণ এ দুনিয়ায়তো বটেই রোজ হাশরেও আমরা তাঁদেরই করুণার ভিখারী। আমীন। বি হুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালীন।

হাফেজ মাওলানা আবুল হাসান মোহাম্মদ বায়জীদ : প্রভাষক, ধানুয়া ছালেহিয়া ফাযিল মাদ্রাসা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়