প্রকাশ : ০৫ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
‘স্মার্ট অর্থনীতি’ বিনির্মাণে যাকাতের গুরুত্ব
পৃথিবীতে নামাজ এবং যাকাতের প্রচলন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর আবির্ভাবের আরোবহুকাল আগ থেকেই চালু হয়েছে। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বিভিন্ন আয়াতে বলেছেন। কোরআন নাজিলের মাধ্যমে আমরা সেই বিষয়গুলো জানতে পেরেছি। তার মানে সুষম সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় নামাজের যেমন প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তেমনি যাকাতের ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। ইসলামের ভিত্তি হলো পাঁচটি যথা- কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ ও যাকাত। এই পাঁচটি স্তম্ভকে আমরা যদি একটা তাবুর সাথে তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে যে, তাবুর চার কোনায় চারটি স্তম্ভ দেয়া হলো কিন্তু তাঁবুর ঠিক মাঝামাঝি আরেকটি স্তম্ভের প্রয়োজনীয়তা হয় যেই স্তম্ভটির মাধ্যমে তাবুকে উঁচু করে প্রসারিত করা হয়। যদি পঞ্চম স্তম্ভটি মাঝখানে না দেয়া হয় তাহলে তাবুর চারটি স্তম্ভ থাকা সত্ত্বেও তা কোন কাজেই লাগবে না, সেখানে মানুষ বসবাস করতে পারবেনা। তাবু প্রতিষ্ঠার বা স্থাপনের যেই লক্ষ্য সেটা ব্যাহত হবে। তাবুকে প্রসারিত করতে হলে বা ব্যবহার উপযোগী করতে হলে মাঝামাঝি আরেকটি খুঁটির প্রয়োজনীয়তা থাকে, যে খুঁটিকে আমি পঞ্চম স্তম্ভ হিসেবে নির্ধারণ করতে পারি। তাহলে দেখা যায় যে, কেবল চারটি স্তম্ভ থাকা সত্ত্বেও তাঁবুটি ব্যবহার উপযোগী হলো না পঞ্চম স্তম্ভটি না থাকার কারণে। এজন্য ইসলামে চারটি স্তম্ভ প্রতিষ্ঠার পরে যদি পঞ্চম স্তম্ভটি প্রতিষ্ঠা না হয় তাহলে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কার্যত বাহত হয়। সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে যদি অর্থনীতিকে গতিশীল রাখা না যায় তাহলে সেই সমাজ ক্রমেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। এজন্য পঞ্চম স্তম্ভ হিসেবে যাকাত ব্যবস্থা সুষম সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নামাজের পাশাপাশি যাকাতের বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন। নামাজের মাধ্যমে যেমন নিয়ম শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হয় যাকাতের মাধ্যমে অর্থনীতিকে সুষম রাখার বিষয়টি অত্যন্ত জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। এটা কেবল মুসলিম সমাজ ব্যবস্থার জন্যই প্রযোজ্য তা নয় সকল স্তরে, সকল সমাজে এই নিয়মটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
যাকাত ফান্ডের টাকায় পরিচালিত চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমি দেখেছি অনেক বিধর্মীও সেবা গ্রহণ করে থাকেন। এমন কয়েকটি হসপিটালের সাথে কর্ম সুবাদে আমি সম্পৃক্ত যেসব হাসপাতালে যাকাতের টাকায় গরিব মানুষদের ওষুধ দেয়া হয়, চিকিৎসা দেয়া হয়। সেখানে কেবল মুসলমানকেই যে সেবা দিচ্ছে তা নয় সেখানে অন্য ধর্মাবলম্বীগণও সেবা পাচ্ছেন। মুসলিম সমাজের বাইরেও অন্য ধর্মাবলম্বীরা যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে সুফল পেতে পারেন।
আমি যে শিরোনামটি এখানে উপস্থাপন করেছি ‘স্মার্ট অর্থনীতি বিনির্মাণে যাকাতের গুরুত্ব’ এখানে স্মার্ট শব্দটি এজন্য প্রয়োগ করলাম বর্তমানে আমাদের দেশের সরকার ব্যবস্থাপনায় স্মার্ট কনসেপ্ট রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠার জোরালো প্রচেষ্টা চলছে। এ প্রচেষ্টা ক্রমেই সফলতা লাভ করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে সমৃদ্ধ করে স্মার্ট রাষ্ট্রবিনির্মাণের লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছেন সাংগত কারণে আমি মনে করি, স্মার্ট অর্থনীতি বিনির্মাণের মাধ্যমে স্মার্ট দেশ এগিয়ে যেতে পারে। স্মার্ট অর্থনীতি হলো সে অর্থনীতি যেখানে সকল মানুষের অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। যে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দুর্নীতি থাকবে না, কালোবাজারি, মজুদদারি ও মুনাফা খোরের কোন সুযোগ থাকবে না। সে অর্থনীতি হলো প্রকৃতপক্ষে সুষম অর্থনীতি, কার্যকর অর্থনীতি, ইসলামিক অর্থনীতি, যাকে আধুনিক পরিভাষায় আমি ‘স্মার্ট অর্থনীতি’ বলে চিহ্নিত করলাম। যে অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে ধনী এবং গরিবের মধ্যে বৈষম্য লাঘব হবে। মানুষ তাঁর সুনির্দিষ্ট অধিকার ভিক্ষা করে চেয়ে নিবে না বরং তাঁর কাছে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে পৌঁছে যাবে। এটাই হলো সুষম সমাজব্যবস্থা, এটাই হলো ইসলামিক অর্থনীতি যাকে আমি ‘স্মার্ট অর্থনীতি’ হিসেবে চিহ্নিত করলাম। বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শতভাগ যাকাত প্রদান করার কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। এখনো সমাজে যাঁদের উপরে যাকাত ফরজ হয়েছে তাঁদের মধ্যে শতভাগ আদায় করছে এমন মানুষের সংখ্যা হয়তো খুবই কম। যদি সকল মানুষ তাঁর উপরে অর্পিত যাকাত আদায় করতে পারতো (অর্থাৎ যাঁদের উপরে যাকাত দেওয়া ফরজ হয়েছে) তাহলে সামাজিকভাবে জীবন মানের বৈষম্য লাঘব হতো। যাকাত ব্যবস্থাপনায় কোনো দরিদ্র মানুষ স্বাবলম্বী বা ধনী মানুষের কাছে হাত পাতবে না, বরঞ্চ লোক চক্ষুর আড়ালে তাঁর উপরে অর্পিত যাকাত সে প্রাপ্য ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দিবে। ঢাকঢোল পিটিয়ে সামাজিকভাবে একরকম সম্মেলন করে যাকাত প্রদান করতে হবে তা নয়, এমন কোন ধর্মীয় নির্দেশনাও নেই। এখানে লোক দেখানো এবং সামাজিক পরিচিতি লাভ করার বিষয়টি অনেকাংশে লক্ষ্য করা যায়। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এই বিষয়টি কমে গেলেও একটা সময়ে খুব শোনা যেত যে যাকাত গ্রহণ করতে গিয়ে মানুষ পদদলিত হয়ে মারা গেছে। এটা কোনভাবেই ইসলাম প্রবর্তিত অর্থনৈতিক নিয়মের মধ্যে পড়ে না। যাকাত কোন করুণা নয়, একজন দারিদ্র্য মানুষের প্রাপ্য। স্বাবলম্বী মানুষের উপর দায়িত্ব তা প্রাপ্য ব্যক্তির কাছে নিজ দায়িত্বে পৌঁছে দেয়া। এটা একজন মুসলমান ব্যক্তির দায়িত্ব যদি সে নিজেকে কোরআনের আলোকে পরিচালিত করতে চায় অথবা মুত্তাকি হতে চায়।
জাকাত আরবি শব্দণ্ডএর অর্থ পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। ইসলামে বাধ্যতামূলক ধর্মীয় দান অর্থে জাকাত শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কোনো মুসলমানের ধনসম্পদ থেকে তার নিজের ও পরিবারের সারা বছরের প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটানোর পর নির্ধারিত পরিমাণে অবশিষ্ট থাকলে এবং ওই ধনসম্পদ তার মালিকানায় এক বছর মেয়াদে স্থায়ী থাকলে বছর পূর্ণ হওয়ার পর সেই সম্পদের নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ শরিয়া-নির্ধারিত খাতগুলোয় প্রদান করাকে জাকাত বলা হয়।
যেমন, পবিত্র কোরআনের সুরা জারিয়াত-এর ১৯ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর তাদের (সম্পদশালীদের) ধনসম্পদে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের হক রয়েছে।’ এভাবে জাকাতের মাধ্যমে সামর্থ্যবানদের ধনসম্পদের কিছু অংশ ব্যয়ের ফলে তাদের অবশিষ্ট ধনসম্পদ পবিত্র হয়। সুরা তওবার ১০৩ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তুমি ওদের ধনসম্পদ থেকে সদকা আদায় করো, এর দ্বারা তুমি তাদের পবিত্র করে দেবে।’ জাকাত শব্দের অপর অর্থ বৃদ্ধি। বস্তুত, জাকাত প্রদান করলে ধনসম্পদ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।
সৃষ্টির সূচনা থেকেই ইসলামে যাকাতের বিধান প্রচলিত ছিল। কারণ মহান রব্বুল আলামীন যখন পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী হিসেবে তৈরি করেন, ঠিক সেই থেকে দুনিয়াতে ধনী ও দরিদ্র এ দুই শ্রেণির মানুষ বসবাস করে আসছে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি তাদের পরীক্ষার জন্য যাকাত প্রদানে উৎসাহিত করেছেন। তাই যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। এ পর্যায়ে বিভিন্ন যুগে যাকাতের প্রদানের ইতিহাস সম্পর্কে জানবো- ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক ভেদাভেদ দূর করে সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠাই যাকাতের বিধান বিভিন্ন নবী-রাসুলের আমলে প্রচলিত ছিল। হযরত ইবরাহীম (আ.) এর যুগে যাকাতের বিধান সম্পর্কে আল্লাহ পবিত্র কোরানে বলেন, ‘আমি তাঁদেরকে ইমাম বা নেতা বানিয়েছি, যাতে তারা তাঁর নির্দেশনা মতো আমার বিধান অনুযায়ী চলে এবং আমার জন্য ভালো ভালো কাজ স্বরূপ নামায কায়েম ও যাকাত প্রদান করে। বস্তুত তারাই ইবাদতকারী ছিল। হজরত ইসমাইল আ. সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, স্বরণ করুন, ইসমাইল আ. এর কিতাবের কথা। নিশ্চয়ই তিনি ওয়াদা সত্য প্রমাণকারী ছিল এবং তিনি নবি ও রাসুল। তিনি তাঁর জনগণকে নামাজ পড়ার ও যাকাত দেওয়ার নির্দেশ দিতেন। আর তিনি তাঁর আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় ও সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত ছিলেন।
বনী ইসরাইলদের যুগে যাকাতের চুক্তি বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর স্বরণ করুন আমরা যখন বনী ইসরাইলের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিলাম এই বলে যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো বন্দেগী করবে না। পিতামাতার সাথে সদ্বব্যবহার করবে। নামায কায়েম করো ও যাকাত আদায় করো। এছাড়া আল্লাহ তায়ালা হযরত ঈসা আ. এর উপর যাকাত ও নামায সম্পর্কে অসিয়ত করে বলেন, ‘আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন নামায ও যাকাত সম্পর্কে যতোদিন আমি জীবিত থাকব।
পরবর্তীতে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর উপর যাকাত প্রদান ফরজ করা হয়েছে। মক্কায় অবতীর্ণ কোরআনের আয়াতসমূহের প্রায় সকল অবস্থায়ই দারিদ্রদের দুঃখ মোচনের আহবান জানানো হয়েছে। আর যারা যাকাত দেয় না তাদের তিরস্কার করা হয়েছে। তবে ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় মুসলমানদের উপর যাকাত ফরয ছিলনা। যে ব্যক্তি যাকাত বা সদকাহ প্রদান করতো তাকে উৎসাহি করা হতো। কারণ সেই সময় যাকাত সম্বলিত আয়াত নাযিল হয়েছে। কিন্তু যাকাত ফরজ হওয়ার আয়াত নাযিল হয় নাই। কিন্তু রাসুল (সাঃ) হিজরত করে মদিনায় চলে গেলে ইসলামের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ট বিধান প্রয়োগ করেন। এমনকি যাকাতের ক্ষেত্রেও মদিনায় আল্লাহ তায়ালা রাসূল (সাঃ) উপর অনেক আয়াত নাযিল করেছেন। কোরআন মাজিদে মোট ১৮টি সূরার ২৯টি আয়াতে যাকাত শব্দটির ব্যবহার দেখা যায়। তন্মধ্যে ৯টি সুরা মাক্কী আর ৯টি মাদানী। মদিনায় নাযিল কৃত আয়াতসমূহের মধ্যে সূরা আল হজ্জ হিজরতের প্রথম বছরই নাযিল হয়। যেখানে আল্লাহ যাকাতকে ফরজ করে ঘোষণা করেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন। যে তাঁকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী। তাঁরা এমন যাঁদেরকে আমি যমীনে ক্ষমতা দান করলে তাঁরা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজের আদেশ দেবে ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে।
তবে যাকাদ প্রদানকারীর সুসংবাদ দিয়ে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, নবী কারিম (সাঃ) বলেছেন, দান আল্লাহর ক্রোধ প্রশমিত করে এবং অপমৃত্যু রোধ করে। মুসলিম শরীফে উল্লেখ রয়েছে, রাসূল (সাঃ) বলেন, সদকায় সম্পদ হ্রাস পায় না এবং ক্ষমার মাধ্যমে আল্লাহ শুধু বান্দার সম্মানই বাড়িয়ে দেন আর আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বিনয় অবলম্বনকারীকে আল্লাহ উপরে উঠিয়ে দেন।
তাই আসুন, যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনের মত অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজে সামিল হই। ফিরে যাই শুরুর কথায়, যাকাত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ‘স্মার্ট অর্থনীতি’ বিনির্মাণ সম্ভব যার মাধ্যমে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মিত হবে।
লেখক : আইনজীবী ও নির্বাহী পরিচালক, বিদ্যাভবন গবেষণা কেন্দ্র।