প্রকাশ : ০৫ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
যাকাত ও ফিতরা এবং কিছু কথা
যাকাত ও ফিতরা এ দুটোর মাঝে পার্থক্য আছে। যাকাত ও ফিতরার মূল পার্থক্য হলো, যাকাতের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির মালিকানায় নেসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর থাকলে তাকে সম্পদের ২.৫ শতাংশ হারে জাকাত প্রদান করতে হয়, কিন্তু ফিতরার ক্ষেত্রে সম্পদ পূর্ণ এক বছর স্থায়ী হওয়ার প্রয়োজন হয় না। বরং ঈদুল ফিতরের দিন সকালে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেই তার ওপর ফিতরা ওয়াজিব হয়। প্রথমেই জেনে নেই...
ফিতরা
ফিতরাও এক ধরনের যাকাত, একে সাদাকাতুল ফিতরও বলা হয়। রমজান মুবারকের শেষে ফিতরা ওয়াজিব হয়ে যায় শরী’আত দ্বারা।সাহিবে নিসাব নিজের পরিবারের নাবালিগ সন্তানাদি, কাজের লোক সবার ফিতরা তিনি আদায় করবেন। এমনকি ঈদুল ফিতরের দিন সকাল বেলার পূর্বে যদি কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করে তারও ফিতরা আদায় করবেন। ঈদের দিন সকালে ঈদের সালাত আদায় করতে যাওয়ার পূর্বে ফিতরা দেওয়া উত্তম।
সাদকাতুল ফিতর শুধু মাত্র রমজান মাসে রোজাদরদের মধ্যে যদি কোনো অনিচ্ছাকৃত ছোটখাটো ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকে তাই তাঁর কাফ্ফারা হিসেবে দিতে হয়। নিসাবের পরিমাণ হচ্ছে সাড়ে সাত তোলা সোনা অর্থাৎ ৮৭.৪৫ গ্রাম সোনা অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য অর্থাৎ ৫১২.১৫ রৌপ্য অথবা ওই পরিমাণ সোনা বা রৌপ্যের দামের অর্থ অথবা সম্পদ। বর্তমানে যা প্রায় ৫২ হাজার টাকার সমপরিমাণ সম্পদ থাকে তার উপর ফেতরা ওয়াজিব। তাকে নির্ধারিত মাথাপিছু হিসেবে গরিব-মিসকিনদের মধ্যে ফিতরা বিতরণ করতে হবে।
বাংলাদেশে গম বা আটার উপর বাজার দাম ধরে।এবার ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক সর্বনিন্ম ১১৫ টাকা ও সর্বোচ্চ ২৯৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
যাকাত
আসুন জেনে নেই সম্পদের যাকাত । যাকাত ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিধান। কুরআনের বহু স্থানে সালাতের আদেশের সঙ্গে জাকাতের আদেশ দেওয়া হয়েছে। যাকাত শুরু হয়েছে ২য় হিজরীতে। ইসলাম ধর্মে জাকাত শর্তসাপেক্ষ যে, তা সম্পদশালীদের জন্য ফরয। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনে "যাকাত" শব্দের উল্লেখ এসেছে ৩২ বার। যাকাত ফরয হওয়ার তৃতীয় শর্ত হচ্ছে শরীয়ত নির্ধারিত সীমাতিরিক্ত সম্পদ থাকা। অথাৎ ৫২.৫ তোলা রূপা বা ৭.৫ তোলা স্বর্ণ বা উভয়টি মিলে ৫২.৫ তোলা রূপার সমমূল্যের সম্পদ থাকলে সে সম্পদের যাকাত দিতে হয়।এবংনগদ অর্থ, টাকা-পয়সা, ব্যাংকে জমা, পোস্টাল সেভিংস, বৈদেশিক মূদ্রা (নগদ, এফসি অ্যাকাউন্ট, টিসি, ওয়েজ আর্নার বন্ড), কোম্পানির শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড, ঋণপত্র বা ডিবেঞ্চার, বন্ড, সঞ্চয়পত্র, জমাকৃত মালামাল (রাখী মাল), প্রাইজবন্ড, বীমা পলিসি (জমাকৃত কিস্তি), কো-অপারেটিভ বা সমিতির শেয়ার বা জমা, পোস্টাল সেভিংস সার্টিফিকেট, ডিপোজিট পেনশন স্কিম কিংবা নিরাপত্তামূলক তহবিলে জমাকৃত অর্থের যাকাত প্রতিবছর যথা নিয়মে প্রযোজ্য হবে।
এছাড়া পেনশনের টাকাও হাতে পেলে যাকাত হিসাবে দিতে হবে। মানত, কাফ্ফারা, স্ত্রীর মাহরের জমাকৃত টাকা, হজ ও কুরবানির জন্য জমাকৃত টাকার উপরেও বছরান্তে যথা নিয়মে যাকাত দিতে হবে। আল্লাহ তায়লা বলেন,তোমরা নামাজ আদায় কর এবং যাকাত প্রদান কর। তোমরা নিজের জন্যে পূর্বে যে সৎকর্ম প্রেরণ করবে, তা আল্লাহর কাছে পাবে। তোমরা যা কিছু কর, নিশ্চয় আল্লাহ তা প্রত্যক্ষ করেন। (সূরা বাকারা-১১০)।
সাধারণত নির্ধারিত সীমার অধিক সম্পত্তি হিজরি ১ বছর ধরে থাকলে মোট সম্পত্তির ২.৫% করে যাকাত দিতে হবে। যাকাত ফকীর মিসকীন মুসাফির দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্থদের জন্য, আল্লাহ্র পথে সংগ্রামকারীকে যাকাত দেওয়া যাবে। কিন্তু মা, বাবা, দাদা, দাদী, নানা, নানী, নাতি নাতিনকে যাকাত দেওয়া যাবে না। স্বামী তাঁর স্ত্রী কে এবং স্ত্রী তাঁর স্বামীকে জাকাত দিতে পারবে না। এমনকি কোন কাফেরকেও যাকাত দেওয়া যাবে না। হাদিসে আছেআপন ভাই বোন, ভাগনে-ভাগনি, ভাতিজা-ভাতিজি, চাচা-জেঠাণ্ডফুফা, মামা-খালা, চাচাত-জেঠাতো ভাই-বোন, ফুফাতো ভাই-বোন, মামাতো-খালাতো ভাই-বোন এবং অন্য নিকটাত্মীয় যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হয়, তাহলে তাদেরকে ও জাকাত, সদকায়ে ফিতর, ওয়াজিব সদাকাত, ফিদিয়া, কাফফারা ও মান্নত দেওয়া যাবে বরং তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। হাদিস শরিফে রয়েছে নিকটাত্মীয়দের দান করলে দ্বিগুণ সওয়াব হয়। প্রথমত দানের সওয়াব, দ্বিতীয়ত আত্মীয়তা সম্পর্ক রক্ষার সওয়াব।
দেশে বা বিদেশে মনে হয় যাকাত আর ফিতরা কে এক করে ফেলেছে। অনেকে ফিতরা দিয়েই মনে করে যাকাত দেওয়া হয়ে গেছে। আবার অনেকে যাকাত কি বুঝে ও না বুঝার ভান করে থাকে। আমাদের দেশে যদি সব ধন-সম্পতির মালিকরা ১০০% জাকাত দেয় তাইলে দেশে কোন অভাব থাকবে না। আর প্রবাসীদের কথা কি বলবো আমার মনে হয় ৮০% যাকাত দেয় না যদিও দেয় ফিতরা! কোন বিবাহ বা পার্টিতে গেলা দেখা যায় সোনার ছড়াছড়ি। কন্যাকে ৪০/৫০ ভরি সোনা সাজিয়ে আনা হয়েছে আবার অনেক অতিথি সোনা দেখানোর জন্য হিজাবের উপর দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। আর পার্টি টেবিলে বসলে শোনা যায় ৬টা বাড়ির মালিক ১০/১২ বিজনেস আছে, কোটি কোটি টাকা ব্যাংকে, লাখ লাখ ডলার শেয়ার মার্কেটে, কয়েক একর জায়গা নিয়ে বাড়ি।
কিন্ত যাকাতের সময় আসলেই বলে কোন রকম আছি! গতকাল আমার কলীগ বললো তার ভাই মাত্র ৫ হাজার টাকা (৫০) ডলার পাঠিয়েছে বাংলাদেশে গরীবদেরকে দেয়ার জন্য। অথচ তিনি কয়েকশ’ কোটি টাকার মালিক। ৫০ ডলার উনার ফিতরার টাকাও হয় নাই। এখন প্রশ্ন উনি কি আল্লাহকে ফাঁকি দিচ্ছেন? না উনার স্বভাব এখনো পরিবর্তন করতে পারেন নাই? আপনারা ফুটানি করেন ভালো কথা কিন্তু গরীবের হক খেয়ে না! আল্লাহ্ তুমি সবাইকে হেদায়েত কর। সবাইকে যাকাত ও ফিতরা দেওয়ার মন মাসিকতা করে দাও। আমিন।
লেখক : ড. আব্দুস সাত্তার, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক, ওয়াশিংটন ডিসি।