প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
স্বাগত মাহে রমজান
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) তার নির্দেশেই এ বিশ্বজগত পরিচালিত হচ্ছে আবার তার নির্দেশেই সব একদিন ধংস হয়ে যাবে। আবার তিনিই সবাইকে পুনর্জীবিত করে হিসেব-নিকাশ সম্পন্ন করে যার যার প্রাপ্য শাস্তি বা পুরস্কার তাকে তা দিয়ে দিবেন। এ ক্ষমতা একমাত্র তারই করায়েত্তে। কাজেই তার শাস্তি এড়িয়ে পুরস্কার পেতে হলে তার নির্দেশিত পথেই মানুষকে চলতে হবে। তিনি যদি দয়া করে মানুষকে এ পথ প্রদর্শন না করতেন তাহলেও তার কোন ক্ষতি হত না। তা সত্ত্বেও তিনি মানুষকে সর্বোত্তম পথের সন্ধান দিয়েছেন। মহান রাব্বুল আলামীন আরও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর প্রদর্শিত পথ ছাড়া অন্য কোন পন্থা বা পদ্ধতি তার কাছে আদৌ গ্রহণযোগ্য হবে না। মানুষ যেন এ কথা উপলব্ধি করে যে শাস্তি ও পুরস্কার প্রদানের ক্ষমতা একমাত্র তারই আছে, অন্য কারোই নাই। এ জন্য সকলেরই উচিত তার ক্ষমতা ও শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে তার শোকর আদায় করা। মানুষ যদি আল্লাহ প্রদত্ত হেদায়েত প্রাপ্ত হয়েও তার শোকর আদায় না করে , তাহলে সে হবে অকৃজ্ঞ। তিনি যদি মানুষকে সঠিক পথের দিশা না দিতেন, তাহলেই কেউ উত্তম পথ পেত না। দুনিয়াতে কোন মুমিন-মুসলমানের অস্তিত্বও থাকতো না। সকলেই কাফের, মুশরিক বা সংশয়বাদী হিসেবে জীবন যাপন করে পরকালে জাহান্নামের ইন্ধন হতো। শুধু পরকালেই নয়, আল্লাহ তায়ালার প্রদর্শিত পথে না চলে এ পৃথিবীতেও বহু লোক আজও ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে চরম অশান্তির অনলে দগ্ধ হচ্ছে।আর যারা তার হেদায়েত মেনে নিয়ে জীবন যাপন করেন, তারা এ পৃথিবীতেও অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করেন। পরকালের শান্তিতো তাদের জন্যই অপেক্ষা করছেই। কাজেই মহান রাব্বুল আলামীনের প্রদত্ত হেদায়েতের জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শোকরিয়া স্বরুপ তার শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতির ঘোষণা প্রদানের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের জীবনপথে চলার জন্য আল্লাহর হেদায়েতের দরকার কি? মানুষ কী নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে সুন্দর জীবন গঠন, সমাজ-সংসার, দেশ-রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় সক্ষম নয়? এ ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে বলা প্রয়োজন যে, মানুষ যখনই আল্লাহর হেদায়েত উপেক্ষা করে স্বীয় জ্ঞান-বুদ্ধির উপর নির্ভর করে জীবন ও পরিবার, রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার চেষ্টা করেছে, তখনই দেখা গেছে, মানব-সমাজে বিপর্যয়, ধ্বংস ও সংঘাত। অতিত ইতিহাস ও বর্তমান যুগে এর ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে। অতীতে আদ ও সামুদ জাতি, হযরত লুত (আঃ) ও হজরত শোয়াইব (আঃ)-এর জাতিসহ আরো অনেক প্রাচীন জাতি ও জনপদ ধংস হয়েছে একমাত্র আল্লাহর হেদায়েত অস্বীকার করে স্বেচ্ছাচারী জীবন-যাপন করার জন্য।কারণ মানুষের শুধু সুবুদ্ধিই নয়, ভয়ানক কুবুদ্ধিও আছে। আরও আছে নানা পাশবিক প্রবণতা , নীচতা, স্বার্থপরতা, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ ও ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি।
এ রোজা অর্থাৎ সারাদিন অনাহারে থাকাসহ সংযমী জীবন-যাপনের মাধ্যমে তার মাঝে খারাপ দোষগুলো নিস্তেজ হয়ে উত্তম গুনাবলী বিকশিত হয়। মানুষের মধ্যে এ উত্তম চরিত্রের গুণাবলি যত বেশি বিকশিত হবে,সমাজে তত বেশি শান্তি-শৃংখলা ও সপ্রীতি প্রতিষ্ঠিত হবে। রোজার মাধ্যমে মানুষের মাঝে উত্তম গুণাবলী সৃষ্টি ও সমাজে তার প্রতিপালন সম্পর্কে সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী বলেছেন, 'দেহ ও আত্মায় মিলিত ও ভারসাম্যপূর্ণ শক্তি ব্যতীত খিলাফতের এ গুরুদায়িত্ব পালন করা মানুষের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই মহা প্রজ্ঞার অধিকারী,বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক মানব জাতির আধ্যাতিক প্রশিক্ষণের জন্য নাজিল করেছেন সিয়ামের বিধান। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ তার ভেতরের পাশবিক শক্তি ও ভোগবাদী মানসিকতা কিছু পরিমাণে দমন করতে সক্ষম হয়। নফস ও প্রবৃত্তির সকল প্রলোভন ও প্ররোচনায় সব মুকাবিলা ও কার্যকর প্রতিরোধ সৃষ্টি করা অতি সহজ হয়। রোজার মাধ্যমে তার ইমান ও
আধ্যাত্মিকতার একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি অর্জন করে এবং ঝিমিয়ে পড়া আত্মা পুনরুদ্ধার করে তার হৃদয়ে উষ্ণতা একটু সজিবতা ছড়িয়ে দিতে পারে।
যখন আমরা খাওয়া বন্ধ রাখি এবং খাওয়ার যন্ত্রকে বিরতি দেই, তখন দেহে সংরক্ষিত জীবনী শক্তির এক নবজীবনের উদ্ভব হয়। ডা. জুয়েলস এম. ডি. বলেন, 'যখন একবেলা খাওয়া বন্ধ থাকে, তখন দেহ সেই মুহূর্তটিকে রোগমুক্তির সাধনায় নিয়োজিত করে। খাদ্যের পরিপাক ও আত্মীকরণে যে শক্তি ব্যয় হয়, খাওয়া বন্ধ করে আমরা যদি সেই শক্তি অন্যদিকে নিয়োজিত করি, তবে দেহের অপ্রয়োজনীয় বিষাক্ত অংশ বিদায়িত করতে পারি। পরিপাক প্রণালি যখন তার আত্মীয়করণে বিরত দেয়, তখন পাকস্থলী ও অন্ত্রের শ্লৈষ্মিক-ঝিল্লি দেহযন্ত্র থেকে জীর্ণ পদার্থগগুলিকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। অন্ত্রের ও পাকস্থলীর শ্লৈষ্মিক আবরণী খাদ্যবস্তু পরিপাকের বেলায় অনেকটা স্পঞ্জের মত কাজ করে। অতি ভোজনের ফলে দেহের স্নায়ুকোষে বিষক্রিয়া দেখা দেয়। ফলে শরীরে নেমে আসে অস্বাভাবিক ক্লান্তিবোধ ও জড়তা। সিয়াম প্রতিষেধকের কাজ করে। অতএব বোঝা গেল, রোজা দেহযন্ত্রের বিষ ধ্বংস করে এবং দেহের রোগ নিরাময়ের সংরক্ষিত শক্তির সদ্ব্যবহার করে। প্রতিটি রোগের পেছনে কোন না কোন কারণ রয়েছে। তবে জীবাণুবাহিত রোগগুলির মধ্যে ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস প্রধান। বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে জানা গেছে উপবাসের ফলে অনেক জীবাণু মারা পড়ে। ডা. ডিউই বলেছেন, জীর্ণ ও ক্লিষ্ট রুগ্ন মানুষটি উপোষ থাকছে না, সত্যিকারভাবে উপোষ থাকছে রোগটি। চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক হিপোক্রেটিস বলেছেন, 'অসুস্থ দেহে যতই খাবার দিবে ততই রোগ বাড়তে থাকবে।' গ্রাহাম বার্থলো জেনিংস প্রমুখ গবেষক এ বিষয়টি সত্য বলে প্রতিপন্ন করেছেন। অধিক পানাহারের অন্তর প্রাণহীন হয়ে যায়। রাসুল (সাঃ) বলেন, 'অতিরিক্ত পানাহার দ্বারা অন্তরকে প্রাণহীন করো না। কেননা, অন্তর শস্যক্ষেত্র স্বরূপ।' ক্ষেতে অতিরিক্ত পানি দিলে ক্ষেতের উর্বরতা শক্তি বিনষ্ট হয়। ক্ষুধার সময় আত্মা নির্মল ও পরিষ্কার হয়ে ফুটে ওঠে।
রোজাদার ব্যক্তি নিজেকে সংযত রাখা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাবশত তার থেকে ভুলভ্রান্তি হয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়া এবং রোজা বিনষ্টকারী বিষয়বস্তু থেকে বিরত থাকা তো সহজ; কিন্তু অনর্থক কথাবার্তা ও অশ্লীল বাক্য এবং অশালীন আচরণ ইত্যাদি থেকে পুরোপুরিভাবে বিরত থাকা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রিয় বান্দা-বান্দির জন্য সুন্দর আয়োজন করে রেখেছেন রমজান শেষে। তাহলো ‘সদকাতুল ফিতর’। এ সদকায় ফিতরের মাধ্যমে রোজার ভুলগুলো মার্জনা হয়ে যায়। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) সদকায় ফিতর আদায় করার জন্য খুব তাকিদ দিয়েছেন, যা অর্থহীন, অশালীন কথা ও কাজে রোজার যে ক্ষতি, তা দূরীকরণ এবং নিঃস্ব লোকের আহার জোগানোর মাধ্যম। সুতরাং যে ব্যক্তি তা ঈদের আগে আদায় করে, তাহলে তা মাকবুল জাকাত হবে। আর যদি ঈদের পর আদায় করে, তাহলে তা সাধারণ সদকা হবে। (আবু দাউদ : ১৬০৯)। ওই হাদিস দ্বারা বোঝা গেল, সদকায় ফিতর ওয়াজিব হওয়ার দুইটি উদ্দেশ্য। প্রথমত, রোজার মধ্যবর্তী সময়ে ভুলত্রুটির ক্ষতিপূরণ। দ্বিতীয়ত, অসহায় মিসকিনদের জন্য ঈদের দিন রিজিকের বন্দোবস্ত। যাতে সে-ও সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারে। আর এজন্যই প্রিয়নবী (সাঃ) বলেছেন, অসহায় নিঃস্বদের পেছনে এ পরিমাণ ব্যয় করো, যেন তারা এদিনে অন্যের কাছে চাওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ঈদের তিন দিন আগে সদকায় ফিতর আদায় করতেন। যাতে অসহায় পথশিশুরা ঈদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করতে পারে।
সদকায় ফিতর কার ওপর ওয়াজিব :
যার কাছে প্রয়োজনীয় সম্পদ ব্যতীত এ পরিমাণ ধনসম্পদ থাকে, যা থেকে জাকাত দেয়া ওয়াজিব। এমন ব্যক্তির জন্য সদকায় ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। জাকাতের পরিমাণ হলো, ‘রুপা ৫৯৫ গ্রাম (৫২.৫০ ভরি) কিংবা স্বর্ণ ৮৫ গ্রাম (৭.৫০ ভরি) অথবা স্বর্ণ বা রুপা যে কোনো একটির নিসাবের মূল্য পরিমাণ অর্থসম্পদ বা ব্যবসায়িক সামগ্রীকে জাকাতের নিসাব বলে।’ সুতরাং কোনো ব্যক্তির কাছে মৌলিক প্রয়োজন পূরণের পর যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ তার মালিকানায় থাকে এবং চান্দ্র মাসের হিসাবে ১ বছর তার মালিকানায় স্থায়ী থাকে, তাহলে তার ওপর এ সম্পদ থেকে ৪০ ভাগের এক ভাগ জাকাতরূপে প্রদান করা ফরজ। সদকায় ফিতর ও জাকাতের ভেতর সামান্য পার্থক্য রয়েছে। জাকাতের ক্ষেত্রে সম্পদ ‘মালে নামি‘ অর্থাৎ বৃদ্ধি পায় এমন সম্পদ হতে হবে। কিন্তু ফিতরার ক্ষেত্রে এমনটি নয়। জাকাতের সম্পদ পূর্ণ ১ বছর অতিবাহিত হতে হয়; কিন্তু সদকাতুল ফিতর তাৎক্ষণিক ওয়াজিব হয়। উভয়ের ক্ষেত্রে সম্পদ ঋণ থেকে মুক্ত এবং প্রয়োজন অতিরিক্ত হতে হবে। (তাহতায়ি : ৩৯৪)।
অপ্রাপ্ত সন্তানের পক্ষ থেকে সদকায় ফিতর :
শিশুর সদকায় ফিতর বাবার পক্ষ থেকে আদায় করা ওয়াজিব। আর যদি সন্তান নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তাহলে তার সম্পদ থেকে সদকায় ফিতর আদায় করতে হবে। এমনিভাবে পাগল সন্তানের সদকায় ফিতরের বিধানও। (ফতওয়ায় আলমগির : ১/১৯২)।
প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের পক্ষ থেকে সদকায় ফিতর :
সন্তানের প্রাপ্তবয়স হওয়ার পর বাবার পক্ষ থেকে সদকায় ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়। তবে বাবা যদি সন্তানের পক্ষ হয়ে আদায় করে দেন, তাহলে তা আদায় হয়ে যাবে। তদ্রুপ স্বামী স্ত্রীর সদকায় ফিতর আদায় করেন, তাহলেও তা হয়ে যাবে। চাই এ বিষয়ে স্ত্রী থেকে অনুমতি নিক কিংবা তার অজান্তে হোক। (দুররে মুখতার : ৩/২৮৫)। উত্তম হলো এক ব্যক্তির সদকায় ফিতর এক ব্যক্তিকে দেয়া। কেননা এক ব্যক্তির সদকায় ফিতর কয়েকজনকে দেয়া মাকরুহে তানিজিহি। তবে একাধিক সদকায় ফিতর এক ব্যক্তিকে দেয়া বৈধ। (ফতওয়ায় আলমগির : ৩/২৯১)।
রোজার লক্ষ্য হলো, মানুষকে তার পাশবিক ইচ্ছা ও জৈবিক অভ্যাস থেকে নিষ্কৃতি দেয়া এবং তার জৈবিক চাহিদাসমূহকে স্বাভাবিক ও সুনিয়ন্ত্রণ করা। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক পবিত্রতা অর্জন করে থাকে। সে পৌঁছে যায় পারলৌকিক সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে। ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হয়ে তার জৈবিক চাহিদা ও পাশবিক প্রবৃত্তিসমূহ দুর্বল হয়ে পড়ে, তার মনুষ্যত্ব সজীব ও সতেজ হয়ে ওঠে। তখন ক্ষুধাতুর অভুক্ত মানুষের অনাহারক্লিষ্ট মুখ তার হৃদয়ে সহানুভূতি ও সহমর্মিতার পবিত্র অনুভূতি জাগ্রত করে।
লেখক: প্রিন্সিপাল, শ্যামপুর কদমতলী রাজউক মাদ্রাসা ঢাকা।