প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
আরবী ভাষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
গত ১৮ ডিসেম্বর-২০২৩ ঈসায়ী। ইউনেসকো ২০১২ সালে সর্বপ্রথম ১৮ ডিসেম্বরকে আরবি ভাষা দিবস হিসেবে নির্ধারণ করে। প্রায় চার দশক আগে ১৯৭৩ সালে ঠিক এই দিনেই জাতিসংঘের সাধারণ সভার ২৮ তম অধিবেশনে আরবি ভাষাকে এর দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি প্রদান করা হয় এবং ষষ্ঠ ভাষা হিসেবে আরবি ভাষা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা লাভ করে। ২০১২ সালে ইউনেসকোর উপদেষ্টা পরিষদের ১৯০ তম অধিবেশনে আরবি সংস্কৃতি তুলে ধরার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী এই দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ বছরে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো 'কবিতা ও শিল্প'। আরবি নামটি শুনলে প্রথমেই আমাদের মনে আসে এটি পবিত্র কুরআনের ভাষা, যা ইসলাম ধর্মের সাথে সম্পর্কিত। আল্লাহ তা’আলা বলেন: ‘এইভাবে আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি বিধানরূপে আরবী ভাষায়।’ (সূরা রাদ: আয়াত ৩৭)।‘এই রূপেই আমি কুরআনকে অবতীর্ণ করেছি আরবী ভাষায় এবং তাতে বিশদভাবে বিবৃত করেছি সতর্কবাণী, যাতে তারা ভয় করে অথবা এটা হয় তাদের জন্য উপদেশ।’ (সূরা তাহা: আয়াত ১১৩)। ‘আরবী ভাষায় এই কুরআন বক্রতা মুক্ত, যাতে মানুষ সাবধানতা অবলম্বন করে।’ (সূরা জুমার: আয়াত ২৮)। ‘আমিই আরবী ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ করেছি। যেন তোমরা উপলব্ধি করতে পারো।’ (সুরা ইউসুফ: আয়াত ২)। ‘সুস্পষ্ট আরবী ভাষায় আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি।’ (সুরা শুআরা : আয়াত ১৯৫)। আরবী ভাষা শেখার ক্ষেত্রে হযরত ওমর (রাঃ)-এর একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রাঃ) বলেন: ‘তোমরা আরবী ভাষা শেখো। তা তোমাদের দীনের অংশ।’ আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.)-এর একটি উক্তি স্মরণযোগ্য। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা আরবী ভাষায় কুরআন নাযিল করেছেন। আর প্রিয় নবী (সাঃ)- কে আরবী ভাষায় কুরআন ও সুন্নাহ প্রচারের নির্দেশ দিয়েছেন। দীনের প্রথম অনুসারীরা ছিল আরবীভাষী। তাই দীনের গভীর জ্ঞানার্জনের জন্য এই ভাষা অর্জন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। অতএব আরবী চর্চা করা দীনেরই অংশ ও দীনের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক।’ জাগতিক দিক থেকে আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ আরবদেশে বসবাস করে জীবিকার তাগিতে। তাই তাদেরকে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় আরবী ভাষা শিখতে হয়। অপর দিকে একজন মানুষের আলেম হতে হলে আরবী ভাষা শিক্ষা করা অপরিহার্য। কারণ, দীনের বিষয়ে ফাতোয়া দিতে হলে তাকে অবশ্যই আরবী ভাষায় পণ্ডিত হতে হবে। না হলে সে দীনের বিষয়ে ফাতোয়া দিতে পারবে না। যদিও সে দীনের দিকে আহ্বান করতে পারবে। সবদিক থেকে আরবী ভাষা আমাদের জীবন চলার ক্ষেত্রে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
সারা বিশ্বের মুসলমানরা প্রতিদিন তাদের প্রার্থনায় আরবি ভাষায় কুরআনের কিছু অংশ পাঠ করে থাকেন। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আরবি ভাষা মুসলমানদের কাছে একটি অতি পবিত্র ভাষা হিসেবে গণ্য।সর্বশেষ নবী ও রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মাতৃভাষা ছিল আরবি, আর আল্লাহ জিব্রাইলের (আ.) মাধ্যমে তার উপর এই ভাষায় ওহী নাযিল করতেন। ঐতিহাসিকভাবে মুসলিমদের বিশ্বাসমতে, আরবিই সেই ভাষা যার মাধ্যমে জান্নাত বা স্বর্গে মানুষ একে অন্যের সাথে বা ফেরেশতাদের সাথে যোগাযোগ করবে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আরবি ভাষার প্রসার : বিশ্ব আরবি ভাষা দিবসের আরো একটি লক্ষ্য হলো এই ভাষাকে বিশ্বের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা। কারণ আরবি ভাষা হলো সেমিটিক ভাষাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও বহুল প্রচলিত। আরবি ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৫ কোটি। এ ছাড়া গোটা দুনিয়ার সব মুসলিম এই ভাষায় ইসলামের মৌলিক বিধি-বিধান পালন করে। সাধারণত ইবাদত-বন্দেগি আরবি ভাষায়ই হয়। এমনকি প্রাচ্যের খিস্টানদের অনেক গির্জারও নির্ভরযোগ্য ভাষা হলো আরবি। আরবি ভাষায়ই ইহুদি ও খিস্টানদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় গ্রন্থ লেখা হয়েছে।
জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা : ইউনেসকো তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আরবি ভাষার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। ১৯৪৮ সালে গঠিত হওয়া ইউনেসকো তৃতীয় সম্মেলনে আরবি ভাষাকে ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চের পাশাপাশি আরবিকেও দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আরবি ভাষাভাষী অঞ্চলে ইউনেসকো কার্যক্রম পরিচালনার সুবিধার্থে এটিকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এ ছাড়া আরবি ভাষায় ইউনেসকোর সব অনুষ্ঠান, কার্যক্রম ও শিক্ষামূলক নানা প্রগ্রাম প্রচার করারও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
যেভাবে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা : ১৯৬০ সালে জাতিসংঘের এক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে আরবি ভাষায় নানা প্রকাশনা প্রকাশ করা হবে। কারণ এতে খুব সহজেই আরবি ভাষাভাষী মানুষের কাছে সেবা পৌঁছানো যাবে। এভাবে আরবিতে ইউনেসকোর গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৬৬ সালে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সাধারণ পরিষদের সভা চলাকালে সব বক্তব্যই আরবিতে অনুবাদ করা হবে এবং আরবি বক্তব্যও অন্য ভাষায় অনূদিত হবে। এর ঠিক দুই বছর পর আরবি ভাষা জাতিসংঘের দাপ্তরিক নানা কাজে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব ফ্রান্সের দার্শনিক রিনাহ মাহের আন্তরিকতার কারণে তা সম্পন্ন হয়।
আধুনিক যুগে আরবি ভাষার বহুমুখী ব্যবহার : একবিংশ শতাব্দীতে আরবি ভাষা বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। বিজ্ঞানের নিত্যনতুন পরিভাষার যথার্থ অনুবাদ, বর্তমান সময়ের তথ্য-প্রযুক্তির নানা শব্দ নির্বাচন ইত্যাদি আরবি ভাষাবিজ্ঞানীদের বিপাকে ফেলে দেয়। প্রকৃতপক্ষে এটি কোনো মৌলিক সমস্যা নয়। কারণ আরবি ভাষার ব্যাপ্তি ও বিশালতা অবাক করার মতো। তাই আধুনিক বস্তুসামগ্রীর নাম দেওয়া তেমন কঠিন ব্যাপার নয়। যুগ যুগ ধরে সৃষ্টি হওয়া সমস্যার সমাধানে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। এ ছাড়া আরো সমস্যার মোকাবেলা করতে হচ্ছে। প্রশাসন, অর্থনীতি, শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে উপনিবেশের কারণে গেড়ে বসা পশ্চিমা ভাষার প্রভাব, আঞ্চলিক ভাষার প্রসার।
অন্যান্য ভাষা দিবস: আন্তর্জাতিক ভাতৃভাষা দিবস একটি ২১ শে ফেব্রুয়ারী। এ দিন বাংলাদেশের সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বার ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। যা ছিল বিশ্ব দরবারে একমাত্র ভাষার জন্য আত্মত্যাগ। বাংলাদেশীদের এ আত্মত্যাগ কে বিশ্ব দরবার মূল্যায়ন করেছে এ দিবসকে আন্তর্জাতিক মতৃভাষা দিবস পালনের মাধ্যমে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান, ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা, ইউনোস্কোর ১৯৯৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের প্রস্তাব জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। পরবর্তীতে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ছটি ভাষার পৃথক পৃথক আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের ঘোষণা করা হয়। ২০ মার্চ আন্তর্জাতিক ফরাসী ভাষা দিবস। ২০ শে এপ্রিল আন্তর্জাতিক চীনা ভাষা দিবস। ২৩ এপ্রিল আন্তর্জাতিক ইংরেজি ভাষা দিবস, ৬ই জুন আন্তর্জাতিক রুশ ভাষা দিবস, ২১ শে অক্টোবর আন্তর্জাতিক স্প্যানিশ ভাষা দিবস ও ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস পালন করা হয়।
আরবী ভাষার গুরুত্ব : আরবী ভাষার সাথে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের আত্মার সম্পর্ক। এ দেশের আপামর জনসাধরণ আরবি ভাষাকে পরম শ্রদ্ধা করে। মনে থেকে ভক্তি করে। হৃদয় দিয়েই ভালবাসে। আরবী ভাষার যেমন রয়েছে ধর্মীয় গুরুত্ব তেমনি রয়েছে বৈষয়িক গুরুত্ব। পৃথিবীর প্রায় ২৮ কোটি জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা আরবি। ২৫ কোটি মানুষ আরবীকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে। ২৫টি দেশের দাপ্তরিক ভাষা আরবি। অপর দিকে অর্থনৈতিক বিবেচনায় আরবি ভাষা বাংলাদেশের জন্য অতি বেশি গুরত্ব রাখে। দেশের অর্থনীতির অন্যতম শক্তি ধরা হয় রেমিটেন্সে। আর এ রেমিটেন্সের সিংহভাগই অর্জিত হয় আরবি ভাষার দেশসমূহ থেকে। এদেশের জনগণ যখন আরব দেশে যায় তখন তারা ভাষা না জানায় বেশ বিড়ম্বনায় পড়ে। তারা যদি ভালোভাবে আরবি ভাষা জানতো তবে লোকগুলো আরবদেশে নিজেদের অবস্থান আরও মজবুত করতে পারতো। তাদের ন্যায্য সুযোগ সুবিধা আরো বেশি আদায় করে নিতে পারতো। তাই বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক আরো চাঙ্গা করার লক্ষ্যে হলেও আরবি ভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্ব দেয় দরকার। কিন্তু বাংলাদেশের মূলধারার মিডিয়ায় গুরুত্বসহকারে তুলে না ধরায় বাংলাদেশে আরবি ভাষা দিবসটির প্রতিও কোন গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয় না। ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে তো আরবী ভাষা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। ইসলামের যে কোন বিধান আবিস্কার করতে হলে আরবী ভাষা জানতে হবে। কুরআন ও হাদীসের সঠিক মূল মর্ম বের করতে হলেও আরবি ভাষা অবশ্যই প্রয়োজন। আরবি ভাষা অধ্যয়ন বা আয়ত্ব করা ছাড়া কোন লোক ইসলামের কোন বিষয়ের উপর ফতোয়া দিতে পারবে না। তাফসীর বা কুরআনের ব্যখ্যা অন্যকে শিখাতে হলে বিধানাবলি বলতে হলে অবশ্যই তাকে আরবী ভাষা জানতে হবে। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি আরবি ভাষা সর্বদিক থেকে আমাদের জন্য অতি প্রয়োজন। তাই আমরা আরবী ভাষা শিখার প্রতি আরো উৎসাহী হই এবং শিখি। এ ভাষা আরো বিস্তারের ক্ষেত্রে সরকারও প্রদক্ষেপ নিতে পারে।
বাংলাদেশে আরবি ভাষার আগমন : বাংলাদেশের সাথে আরবি ভাষার পরিচয় ঘটে সুদূর অতীতে বাণিজ্য সূত্রে। আরব বণিকেরা বাণিজ্যসম্ভার নিয়ে বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় বন্দর চট্টগ্রাম বা সন্দ্বীপে পৌঁছতেন এবং সেখান থেকে মিয়ানমার (বার্মা), মালয় উপদ্বীপ ইত্যাদি অতিক্রম করে চীনের ক্যানটন পর্যন্ত যেতেন। আরবে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের পরও বাণিজ্য সূত্রে তারা এ দেশে আসতেন এবং তাদের সাথে আসতেন ধর্মপ্রচারকেরা। এভাবে প্রাচীনকালে আরবদের এবং পরবর্তীকালে আরব মুসলিমদের বাংলায় যাতায়াতের ফলে বাংলার অধিবাসীরা আরবি ভাষার সাথে পরিচিত হয়। কালক্রমে এ দেশীয় কিছু লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তাদের মধ্যে আরবি ভাষা শেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। ইসলাম প্রচারকেরা নামাজ আদায়ের জন্য যেসব মসজিদ ও খানকাহ নির্মাণ করেন, সেখানে আরবি কুরআন পাঠ ও শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবেই এ দেশে আরবি ভাষা চর্চার সূত্রপাত হয়। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে আরব বণিক এবং ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় আরবি ভাষার মিশ্রণ শুরু হয়। বাংলাপিডিয়ায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রামাঞ্চল বিশেষত বৃহত্তর চট্টগ্রামের উপভাষার মোট শব্দের প্রায় অর্ধেক আরবি বা আরবি শব্দজাত। তবে বাস্তবতা হলো- ব্যবসায়িক প্রয়োজনে আরব বণিক আর ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে বহুকাল আগে থেকেই এ দেশে আরবি ভাষা চর্চা শুরু হলেও আজো তা ধর্মীয় গোষ্ঠীর ভেতরেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। আধুনিক জীবনযাত্রার সাথে সম্পৃক্ত আরবি ভাষা চর্চার পরিবেশ এখনো এ দেশে তৈরি হয়নি।
বাংলাদেশে আধুনিক আরবি ভাষা চর্চার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা : আমরা বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী দৈনন্দিন নিজেদের আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ-বেদনা, মতামত ও অভিব্যক্তি ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে অসংখ্য আরবি শব্দ ব্যবহার করি। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী আরব দেশগুলোতে কর্মের সন্ধানে, ব্যবসায়িক প্রয়োজনে, কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আমরা আরবি ভাষা চর্চার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করি। এভাবে নানা কারণে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরবি ভাষা চর্চার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যেমন-
১. মুসলিম দেশ হিসেবে ধর্মীয় প্রয়োজনে : বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ হওয়ায় দৈনন্দিন ধর্মীয় প্রয়োজনে আরবি ভাষাশিক্ষা ও চর্চার গুরুত্ব স্বাভাবিকভাবেই অনুভূত হয়। নামাজ পড়া, কুরআন তিলাওয়াত ও দোয়া পাঠ করা এবং কুরআন, হাদিস, তাফসির (কুরআনের ব্যাখ্যা) ও ফিকাহর (ইসলামি আইন) বিধিবিধান সঠিকভাবে জানার জন্য আরবি ভাষা শিক্ষার বিকল্প নেই। কারণ ইসলামের বিশুদ্ধ ও মৌলিক জ্ঞান সবই আরবি ভাষায় লিখিত ও রচিত। এ ছাড়া সভ্যতাণ্ডসংস্কৃতির বিকাশ, অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির আবির্ভাব এবং পৃথিবীতে মানুষের জীবনাচরণ পরিবর্তনের ফলে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে গবেষণালব্ধ ইসলামের বিধিবিধান জানার মুখাপেক্ষী হতে হয়। আধুনিক যুগ সমস্যার সমাধানকল্পে প্রতিষ্ঠিত বেশির ভাগ ফিকাহ একাডেমি ও ইসলামি আইন গবেষণা কেন্দ্র আরব দেশগুলোতে অবস্থিত। সেখান থেকেই সাধারণত নতুন নতুন বিষয়ে ইসলামীকরণের যথার্থ ব্যাখ্যা এসে থাকে। তাই ইসলামের সব বিষয়ে যথার্থ জ্ঞান অর্জনের তাগিদে তথা ধর্মীয় প্রয়োজনে আরবি ভাষা চর্চা একান্তই জরুরি।
২. অধিক রেমিট্যান্স অর্জনের লক্ষ্যে : এ দেশের শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা বা রেমিট্যান্স আসে সৌদি আরবসহ আরবি ভাষাভাষী দেশ থেকে। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ আরবদেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছে। কিন্তু তারা পেশাগতভাবে আরবি ভাষায় দক্ষ না হওয়ায় যথার্থ বেতনভাতা ও নানাবিধ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভারত-পাকিস্তানের মতো আমাদের দেশেও যদি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিদেশগামী জনশক্তিকে ভাষাগত দক্ষতাসম্পন্ন করে রফতানি করা যেত, তাহলে তারা আরো অধিক বেতন ও নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারত; দেশে আরো অধিক পরিমাণে রেমিট্যান্স আসত। এ দিক বিবেচনায় জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থেই দেশে আধুনিক আরবি ভাষা চর্চার ব্যবস্থা করে এ ভাষায় দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা প্রয়োজন।
৩. কূটনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ়করণে : আরব দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ়করণে আধুনিক আরবি ভাষা চর্চার ব্যাপক ও সুদূর পরিকল্পনা থাকা দরকার। কারণ আরবদেশগুলো আমাদের দেশের ধর্মীয়, সামাজিক ও উন্নয়নমূলক বিভিন্ন খাতে প্রচুর আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকে। বন্যা, সিডর, আইলা ও বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে আমরা আরবদেশগুলো থেকেই সবচেয়ে বেশি অনুদান পেয়ে থাকি। অপর দিকে অনেক আরব দেশ আমাদের চেয়ে রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি ও তথ্যপ্রযুক্তিতে বহু ধাপ এগিয়ে গেছে। দক্ষ আরবিভাষী হয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারকরণের মাধ্যমে আমরা তাদের কাছ থেকে সহজে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা, বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নয়নের রূপরেখা ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক নানা দিকনির্দেশনা গ্রহণ করতে পারি।
৪. ব্যবসায়িক সফলতা অর্জনে : ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে, ইসলাম আগমনের বহু বছর আগ থেকেই এ দেশের সাথে আরবদেশের বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক ছিল এবং অদ্যাবধি আছে। এ সম্পর্ককে আরো জোরদার করার জন্য আধুনিক আরবি ভাষা চর্চার বিকল্প নেই। কারণ আরবেরা ব্যবসায়িক কার্যক্রমসহ সব ক্ষেত্রে আরবি ভাষা ব্যবহারকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া আরবি ভাষা বর্তমান বিশ্বে ট্রেড ল্যাংগুয়েজ হিসেবে পরিচিতি পাওয়ায় অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী বিশাল ভূখণ্ডের আরব বিশ্বে ব্যবসায়িক সফলতা অর্জনের জন্য আরবি ভাষা চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম।
অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হলো, মুসলিম অধ্যুষিত বিশাল জনসংখ্যার এ দেশে সরাসরি আধুনিক আরবি ভাষা শিক্ষা ও চর্চার জন্য সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে। যদিও এ দেশে সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত আলিয়া মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি পড়ানো হয়, তবুও এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি আরবি বিশেষজ্ঞ সরকারি কর্মকর্তাদের নজর না থাকায় এবং শিক্ষাব্যবস্থায় পেশাগত আধুনিক আরবির বিষয়াবলি সিলেবাসভুক্ত না করায় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে আধুনিক আরবি ভাষায় যোগ্য জনশক্তি তৈরি হচ্ছে না।
অবশ্য সরকার বর্তমানে করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনষ্টিটিউট কর্তৃক পরিচালিত ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের সার্বিক তত্ত্ববধায়নে ০১-১২১ পর্যন্ত অনলাইন আরবী ভাষা প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন হয়েছে। যা সারা দেশের এমপিও ভূক্ত মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক (আরবী), প্রভাষক (আরবী), সহকারী মৌলভী ও ইবতেদায়ী জুনিয়র মৌলভীদেরকে আরবী ভাষা প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। যার দ্বারা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা আধুনিক আরবী ভাষা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করতে পারবে এবং অর্নগল আরবী ভাষায় কথা বলতে সক্ষম হবে। মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে কোন শিক্ষার্থী আরবী দেগুলোতে কর্মস্থান নিলে যাতে আরবী ভাষায় কথা বলতে কোন সমস্যা হবে না।
পরিবশেষে আমি বলব, আবরী ভাষা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করতে হলে এ ভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাভক্তি থাকা বাধ্যতামূলক।
লেখক : মাওঃ মোঃ মোশাররফ হোসাইন, পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী, প্রভাষক (আরবি), মান্দারী ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা, চাঁদপুর, খতীব, কালেক্টরেট জামে মসজিদ, চাঁদপুর।