প্রকাশ : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
ইসলামে বড়দের প্রতি সম্মান করা, ছোটদের প্রতি স্নেহ করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করা এবং ছোটদের প্রতি স্নেহ না করার কারণে সামাজিক অনাচার সৃষ্টি হয়। মনে রাখতে হবে আমার একদিন পূর্বে যে পৃথিবীতে এসেছে সেই আমার বয়সে বড়। আমি যেখানে চাকরি করি সেখানে আমার পূর্বের পদ যাদের, তারা আমার চাকরিতে বড়। কোন বিষয়ে আমার চেয়ে যে বেশি জানে, তিনি আমার চেয়ে জানার দিকে বড়।
মানুষ পৃথিবীতে যেসব কারণে অন্যদের কাছ থেকে সম্মান পেয়ে থাকে। তন্মধ্যে, বয়সের কারণে! পদমর্যাদার কারণে! জ্ঞানের কারণে! অভিজ্ঞতার কারণে।
যখন একজন মানুষ তার অবস্থার চেয়ে অতিরিক্ত বাড়িয়ে যেতে থাকে, তখনই অন্যদেরকে অসম্মান করে। তখনই অন্যদের অসম্মান করা হয়।
আবু দাউদ শরীফের ৪৯৪৩ নং এবং মুসনাদে আহমদণ্ড৬৯৩৭ নং হাদীসে এসেছে - নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং যে বড়দের হক আদায় করে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।
অন্যত্র নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সে আমার উম্মতের দলভুক্ত নয়, যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না এবং আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না ও আমাদের আলেমদের হক জানে না’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ ৮/১৪)।
বড়দের সামনে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন। এতে করে বড়দের অসম্মান করা হয়। তবে বড়রা যদি অনুমতি প্রদান করে তবেই ছোটরা কথা বলতে পারবে। এক হাদিসে এসেছে, ‘কয়েকজন লোক একটি হত্যা মামলা নিয়ে নবীজীর কাছে এসেছেন। নিহতের ছোট সন্তান আগ বেড়ে কথা বলতে চাইলে নবীজী (সাঃ) তাকে থামিয়ে বড় ভাইকে কথা বলার আদেশ দিলেন’ (সুনানে আবু দাউদণ্ড৬১৪২)।
বড়রা ছোটদেরকে স্নেহ করতে হবে। এতে করে ছোটরা বড়দের প্রতি সম্মান বাড়িয়ে দিবে। বড়রা যদি ছোটদের সামনে অনৈতিক কোন কাজ করে, তাহলে ছোটরা বড়দের সম্মান করবে না। সম্মান কোন দিন জোর করে পাওয়া যায় না। এজন্য বড়রা তাদের আচার- ব্যবহার, ভালোবাসা, নম্রতা, ভদ্রতা, ছোটদের সম্মান নিতে হবে।
সম্মান জোর করে নেয়ার কোন বিষয় না। বরং বড়দের আদর্শ দেখে ছোটরা এমনিতেই বড়দের সম্মান করতে থাকবে। তবে ছোটরাও যাতে বেয়াদবি না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের সন্তানকে চুমু খেতে বলেছেন। একদিন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে চুমু খেলেন। সে সময় এক সাহাবী নবীজির কাছে ছিলেন। তিনি বললেন: ইয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামণ্ড আমার দশটি সন্তান রয়েছে আমি কখনো তাদের চুমু খাইনি।নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তুমি যদি দয়া করো তবে তুমি দয়া পাবে। এতে বুঝা গেল ছোটদের স্নেহ মায়া মমতা দয়া করলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের সম্মান বৃদ্ধি করে দেন।
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী করিম (সাঃ) তাঁর নাতি হাসানকে চুমু খেলেন। একজন বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার ১০টি সন্তান রয়েছে। আমি কখনো তাদের কাউকে চুমু খাইনি। নবীজী তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যে দয়া করে না তার প্রতি দয়া করা হবে না’ (সহিহ বুখারি-৫৬৫১)।
আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন- ‘আল্লাহ্ তা'আলা দয়াকে একশ’ ভাগে ভাগ করে নিরানব্বই ভাগ নিজের জন্য রেখে এক ভাগ গোটা সৃষ্টি জগতের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। সেইটুকু দয়ার কারণেই ঘোড়া সতর্কতার সাথে তার পা রাখে যেন নবজাতক বাচ্চার উপরে গিয়ে তা না পড়ে। (সহীহ আল বুখারী; সহীহ মুসলিম।)
কখনো ছোটরা ভুল করলে বড়রা স্নেহের সহিত ভালবাসা দিয়ে তাদের ভুল শুধরে দিতে হবে। আবার বড়রা ভুল করলে, ছোটরা আদবের সহিত তাদের বলতে হবে।
অনেক ক্ষেত্রে পিতা-মাতা বৃদ্ধ হলে, সন্তানরা পিতা-মাতাকে কোন মূল্য দিতে চায়না। পিতা-মাতার সাথে সন্তান পরামর্শ করে কাজকর্ম করবে এবং যে কোনো প্রয়োজনে পিতা-মাতাও সন্তানের সাথে পরামর্শ করে কাজ করবে। এতে করে পরিবারের মধ্যে কখনো অশান্তি সৃষ্টি হবে না।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কারো কাছে কিছু বলে কাজ করার প্রয়োজন হয়নি। অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জমিনে খলিফা বা তাঁর প্রতিনিধি পাঠাবেন এ মর্মে ফেরেশতাদেরকে বলেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও কখনো কখনো সাহাবায়ে কেরামদের সাথে পরামর্শ করতেন। ইমামত সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘তোমাদের মধ্যে যে বেশী বয়স্ক সেই ইমাম হবে।
আয়েশা (রাঃ) বলেন, এক বেদুইন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামণ্ডএর নিকট এসে বললো, আপনার কি শিশুদের চুমা দেন? আমরা শিশুদের চুমা দেই না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ যদি তোমার অন্তর থেকে দয়ামায়া তুলে নেন, তবে তোমার জন্য আমার কি করার আছে? (বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজাহ)
আবু হুরাইরা (রহঃ) বলেন, রসূলুল্লাহ (সাঃ) সে আলী (রহঃ)-এর পুত্র হাসানকে চুমা দিলেন। তখন আকরা ইবনে হাবিস আত-তামীমী তাঁর নিকট বসা ছিলেন। আকরা বলেন, আমার দশটি সন্তান আছে, কিন্তু আমি তাদের কাউকে চুমা দেইনি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাকালেন, অতঃপর বললেন, যে ব্যক্তি দয়া করে না সে দয়া পায় না (বুখারী, মুসলিম)।
সন্তানের সাথে পিতার সদাচরণ এবং তাকে ভদ্র আচরণ শিখানো : নোমান ইবনে বশীর (রহঃ) বলেন, তার পিতা তাকে বহন করে বাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামণ্ডএর নিকট গেলেন এবং বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনাকে সাক্ষী রাখছি যে, আমি নোমানকে এই এই জিনিস দান করেছি। তিনি বলেন, তোমার সব সন্তানকে কি দান করেছো? তিনি বলেন, না। তিনি বলেন, তাহলে আমি ছাড়া অন্যকে সাক্ষী রাখো। অতঃপর তিনি বলেন, তুমি কি কামনা করো না যে, তোমার সকল সন্তান তোমার সাথে সমানভাবে সদ্ব্যবহার করুক? তিনি বলেন, হ্যাঁ। তিনি বলেন, তাহলে এরূপ করো না (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ)।
ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামণ্ডএর বক্তব্যে বশীর (রাঃ)-কে অপর কোন ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখার অনুমতি ব্যক্ত করা হয়নি।
যে দয়া করে না, সে দয়া প্রাপ্ত হয় না : আবু সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে দয়া করে না সে দয়া প্রাপ্ত হয় না। (তিরমিযী)।
জারীর ইবনু আবদুল্লাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন- “যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়ার্দ্র নয় আল্লাহ্ তার প্রতি দয়া করেন না।”(সহীহ আল বুখারী; সহীহ মুসলিম।)
আবু উসমান (রহঃ) থেকে বর্ণিত। উমার (রাঃ) এক ব্যক্তিকে কর্মে নিয়োগ করলেন। সেই কর্মচারী বললো, আমার এতোগুলো সন্তান আছে, আমি তাদের একটিকেও চুমা দেইনি। উমার (রাঃ) মন্তব্য করলেন অথবা বললেন, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে সদাচারীদেরকেই দয়া করেন।
বারাআ (রাঃ) বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামণ্ডকে দেখেছি যে, হাসান তাঁর কাঁধের উপর আসীন অবস্থায় তিনি বলছেনঃ হে আল্লাহ! আমি একে ভালোবাসি। অতএব তুমিও একে ভালোবাস (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ)।
পরিশেষে বলব, প্রতিটি কথাবার্তা, কাজকর্ম, লেনদেন, আচার - ব্যবহারের মধ্যে বড়রা ছোটদের স্নেহ করবে এবং ছোটরা বড়দের সম্মান করবে। তবেই দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ পাওয়া যাবে।
লেখক : বিষ্ণুপুর মনোহরখাদী মদিনা বাজার বাইতুল আমিন জামে মসজিদ, চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর।