প্রকাশ : ২০ মে ২০২২, ০০:০০
‘নিশ্চয়ই মানুষ তার পালনকর্তার প্রতি অকৃতজ্ঞ। এবং সে অবশ্য এ বিষয়ে অবহিত এবং নিশ্চয়ই সে ধন সম্পদের প্রতি প্রবলভাবে আসক্ত’ (সূরা আল্-আদিয়াত ৬-৮)। অন্যত্র বলা হয়েছে, "প্রাচুর্যের লালসা তোমাদেরকে গাফেল রাখে। যতক্ষণ না তোমরা কবরে উপনীত হও" (সূরা আৎ-তাকাসুর ১-২)। সৃষ্টির সেরা এবং নিকৃষ্ট উভয়ই মানুষ। মানুষ অন্যের কাছ থেকে ওজনে বেশি নেয়, দেয় কম। কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ জমা রাখে এবং তা গুণে গুণে রাখে। বরং সে মনে করে, অর্থ চিরকাল স্থায়ী থাকবে। ধন-সম্পদের মোহ ও প্রতিযোগিতা সম্পর্কে মানুষকে বার বার সতর্ক করা হয়েছে। মানুষ মাত্রই দুর্বল, লোভী ও নিন্দুক। তবে আল্লাহ তায়ালা যাকে রক্ষা করেন তার কথা ভিন্ন। ঈমানের নূরে যাঁর হৃদয় ভরপুর হয়ে রয়েছে সে ছাড়া এ লোভের হাতছানি থেকে কেউ বাঁচতে পারে না। একমাত্র ঈমানের মোহনী স্পর্শ তাকে এতোটা মহীয়ান করে যে, সে পার্থিব প্রয়োজন ও আকর্ষণ থেকে নিজেকে উর্ধ্বে তুলতে সক্ষম হয়। একমাত্র সেই সহজ প্রাপ্তির লোভের বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে পারে। কারণ সে জানে ও বিশ্বাস করে যে, এ লোভ সংবরণের ফলে তার জন্য অপেক্ষা করছে সর্বশ্রেষ্ট, গরীয়ান ও মহীয়ান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি। আর মুমিনের হৃদয় ঈমানী প্রভায় নির্লিপ্ত ও নিশ্চিন্ত। সুতরাং অর্থ ব্যয় করার কারণে অভাব আসার ভয় সে কখনো করে না। কারণ সে জানে বা বিশ্বাস করে, তার কাছে যা আছে তা সবই শেষ হয়ে যাবে, আর মহান আল্লাহর কাছে যা আছে তাই বাকি থাকবে। যদি তার সম্পদ হারিয়ে যায় বা দৈন্যদশা আসে, সে এর থেকে অনেক বড় বদলা আল্লাহর কাছে পাবে। কৃপণতা মানুষকে দ্বীন থেকে বিচ্যুত করে দেয়। কিন্তু এরূপ করা ঠিক নয়। কেননা ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি হল অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী বিষয়। এর কোনোটাই কেয়ামতের দিন কোন উপকারে আসবে না। মানুষ স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে দুইটি কাজ করে থাকে। অথচ এগুলো মানুষের করা উচিত নয়। (১) মহান আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞতা (২) সম্পদের প্রতি লোভ-লালসা। মানুষের মনে রাখা উচিত সকল অন্যায় ও অকৃতজ্ঞা ত্যাগ করে সৎপথে জীবযাপন করা। কারণ ধন-দৌলত বা সম্পদের মত ক্ষণস্থায়ী বিষয় নিয়ে অনন্ত অসীম চিরস্থায়ী আবাস পরকালীন জীবনকে ভয়াবহ বিপদে ঠেলে না দেয়া। রাসূল (সাঃ) বলেছেন "মুনাফিকের চিহ্ন তিনটি।" (১) মিথ্যা কথা বলা, (২) ওয়াদা পালন না করা, (৩) আমানতের খেয়ানত করা। মহান আল্লাহ তায়ালার পথে অর্থ, সময়, টাকাণ্ডপয়সা ব্যয় অর্থাৎ সাদকা (যাকাত) দান এগুলো সর্বদাই আর্শীবাদ। জরিমানা, কষ্টদায়ক বা পীড়াদায়ক মনে করা উচিত নয়। মানবজাতির হেদায়েতের কিতাব মহাগ্রন্থ আল্ কোরআনে বর্ণিত সূরা আৎ-তাওবায় এরকম এক শিক্ষনীয় অনন্য দৃষ্টান্ত বা ঘটনা রয়েছে, সারা পৃথিবীর মুমিনদের জন্য। সা'লাবা ইব্নে হাতেব আনসারীর বরাত দিয়ে এসেছে, তিনি বললেন, "হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আমার জন্য আল্লাহর কাছে মেহেরবাণী করে দোয়া করুন যেনো তিনি আমাকে সম্পদশালী করে দেন অর্থাৎ মালদার হয়ে যাই।" নবী (সাঃ) বলেলেন, "হে সা'লাবা দুঃখ হোক তোমার জন্য এত সম্পদ চেয়ো না, যার শোকর গোযারি করতে তুমি অপারগ হয়ে যাবে। তার থেকে বরং তুমি কম সম্পদ নিয়েই খুশি থাকো, যার শোকর গোযারি করতে পারবে।" সা'লাবা পুনরায় কথাটি বললেন। নবী (সাঃ) বললেন, "তাহলে কি তোমার কাছে আমার তরীকা পছন্দ নয়। সে সত্ত্বার কসম যার হাতে আমার জীবন, যদি আমি ইচ্ছা করতাম, তবে মদীনার আশপাশের পাহাড়গুলো সোনা হয়ে গিয়ে আমার সাথে ঘুরত। কিন্তু এমন ধনী হওয়া আমার পছন্দ নয়।" তখন সা'লাবা চলে গেলেন এবং ফিরে এসে পুনরায় একই নিবেদন করলেন। সা'লাবা বলে উঠলেন, "কসম সেই মহান সত্তার যিনি আপনাকে সত্য জীবন ব্যবস্থা দিয়ে পাঠিয়েছেন, যদি দয়া করে আপনি আমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন এবং তিনি যদি আমাকে প্রচুর সম্পদ দিতেন তাহলে আমি প্রত্যেক হকদারের হক আদায় করে দিতাম।" তখন নবী (সাঃ) বললেন, " ইয়া আল্লাহ আপনি সা'লাবার জন্যে ধন-সম্পদ বরাদ্দ করুন।" রেওয়াতকারী বাহেলী বলেন, যার ফল এই দাঁড়াল যে, তার ছাগল, ভেড়া, বকরী অসাধারণ প্রবৃদ্ধি আরম্ভ হলো। এমনকি মদীনার বসবাসের জায়গাটি সংকীর্ণ হয়ে গেল। পরবর্তীতে তিনি তাদের নিয়ে মদীনার বাইরে এক উপত্যকায় চলে গেলেন। মদীনায় এসে জোহর ও আসরের নামাজ নবী (সাঃ) এর সাথে আদায় করতেন এবং অন্যান্য নামাজ যেখানে তার মালামাল ছিলো সেখানেই পড়ে নিতেন। ভেড়া ও বকরীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তিনি আরও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন । তখন জুমআর নামাজ মদীনায় পড়তে আসতেন। অতঃপর মালামাল ও ব্যস্ততা বেড়ে গেলে মদীনা থেকে বহু দূরে চলে গেলেন। তখন জুমআও জামাতের সবকিছু থেকেই তাকে বঞ্চিত হতে হলো। কিছুদিন পর নবী (সাঃ) লোকদের কাছে সা'লাবার অবস্থা জানতে চাইলে, লোকেরা বললেন, তার মালামাল এত বেশি বেড়ে গেছে যে শহরের কাছাকাছি কোথাও তার স্থান সংকুলান হয় না। ফলে বহুদূরে কোথাও গিয়ে সে বসবাস করছে। এখন আর তাকে এখানে দেখা যায় না। একথা শুনে নবী (সাঃ) বললেন, সালাবার প্রতি আফসোস, সা'লাবার প্রতি আফসোস, সা'লাবার প্রতি আফসোস। ঘটনাক্রমে এ সময় সাদ্কার আহকাম (১০৩ নম্বর আয়াত) নাযিল হয়। "তাদের কাছ থেকে সাদ্কা (যাকাত) নিয়ে নাও।" নবী (সাঃ) এর লিখিত নির্দেশিকাসহ প্রশিক্ষণ দিয়ে মুসলমানদের নিকট সাদ্কা আদায় করার জন্যে দুইজন লোককে (একজন বনী বুহায়লা, অন্যজন বনী সোলায়মের মধ্য থেকে) পাঠালেন এবং তাদের প্রতি নির্দেশ দিলেন যেনো তারা সা'লাবার কাছে যান। এছাড়া বনী সোলায়মের আরও এক লোকের কাছে যাবার আদেশও করলেন। এরা উভয়ে যখন সা'লাবার কাছে গিয়ে পৌঁছালেন এবং নবী (সাঃ) এর লিখিত ফরমান দেখালেন তখন সা'লাবা বললেন, "এত জিযিয়া কর হয়ে গেলো যা অ-মুসলমানদের কাছ থেকে আদায় করা হয়।" তারপর বললেন, "এখন আপনারা যান, ফেরার পথে এখানে হয়ে যাবেন।" তারা চলে গেলেন অন্যদিকে সুলামী গোত্রের লোকটি ঐ দুই ব্যক্তিকে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উট-বকরীসমূহ বিনীতভাবে খুশিমনে সাদ্কা দিতে চাইলেন। ঐ ব্যক্তি সাদ্কা দিয়ে মালামাল পবিত্র করে নিলেন। অতঃপর দুই ব্যক্তি অন্যান্য মুসলমানদের সাদ্কা আদায় করে সা'লাবার কাছে পুনরায় এলেন। তখন সা'লাবা বললেন, "দাও দেখি সাদ্কার আইনগুলো আমাকে দেখাও। তারপর তা দেখে সে কথাই বলতে লাগলেন যে এতো এক রকম জিযিয়া করই হয়ে গেলো, যা মুসলমানদের কাছ থেকে নেওয়া উচিত নয়। যা হোক এখন আপনারা যান। আমি পরে চিন্তা করে একট সিদ্ধান্ত নেবো।" দুই ব্যক্তি মদীনায় ফিরে এসে কথাগুলো নবী (সাঃ) কে বললেন। নবী (সাঃ) পুনরায় তিনবার বললেন যা ইতোঃপূর্বে বলেছিলেন। "সা'লাবার প্রতি আফসোস, সা'লাবার প্রতি আফসোস, সা'লাবার প্রতি আফসোস।" তারপর সুলামীর ব্যাপারে খুশি হয়ে তার জন্য দোয়া করলেন। এ ঘটনারই প্রেক্ষিতে সূরা আৎ-তাওবার ৭৫,৭৬ ও ৭৭ নম্বর আয়াত নাযিল হয়। "তাদের মধ্যে কেউ কেউ রয়েছে যারা আল্লাহ তায়ালার সাথে ওয়াদা করেছিল যে, তিনি যদি আমাদের প্রতি অনুগ্রহ দান করেন, তবে অবশ্যই আমরা ব্যয় করব এবং সৎ কর্মীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে থাকব। অতঃপর যখন তাদেরকে নিজ অনুগ্রহের মাধ্যমে দান করা হয় তখন তাতে কার্পন্য করেছে এবং কৃত ওয়াদা থেকে ফিরে গেছে, তা ভেঙ্গে দিয়ে। অতঃপর এরই পরিনতিতে তাদের অন্তরে কপটতা স্থান করে নিয়েছে সেদিন পর্যন্ত যেদিন তারা তাঁর সাথে গিয়ে মিলবে। তা এজন্য যে, তারা আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা লঙ্ঘন করেছিল এবং এজন্য যে তারা মিথ্যা কথা বলত।" এ সময় সা'লাবার আত্মীয়দের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি উপস্থিত ছিল সে এ কথাগুলো শুনে সা'লাবার কাছে এসে বলল। আফ্সোস তোমার জন্যে হে সা'লাবা! তোমার সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা এই কথাগুলো নাযিল করেছেন। অতঃপর সা'লাবা রওয়ানা হয়ে নবী (সাঃ) এর কাছে আসলেন এবং তাঁকে যাকাত গ্রহন করার জন্য অনুরোধ করলেন। তখন নবী (সাঃ) বললেন, " তোমার যাকাত গ্রহণ করতে আমাকে আল্লাহ তায়ালা নিষেধ করেছেন" একথা শুনে সা'লাবা নিজের মাথায় মাটি নিক্ষেপ ও আর্তনাদ করতে লাগলেন। নবী (সাঃ) বললেন, "এ হচ্ছে তোমার আমল (কৃতকর্ম)। আমি তোমাকে বেশি ধন-সম্পদ সম্পর্কে কিছু নির্দেশ দিয়েছিলাম। তুমি আমার কথা মাননি।" রাসূল (সাঃ) তার যাকত গ্রহন করতে অস্বীকার করার পর সে ফিরে গেল এবং কিছুদিন পরই মহানবী (সাঃ) ইন্তেকাল করলেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) খলীফা হলে সা'লাবা তার সাদকা গ্রহন করার জন্য আবেদন জানায়। তিনি উত্তর দিলেন, "যখন স্বয়ং নবী (সাঃ) ই কবুল করেননি, তখন আমি কেমন করে কবুল করব। আবু বকর (রাঃ) ইন্তেকালের পর হযরত ওমর (রাঃ) এর খেলাফত আমলেও নিবেদন জানিয়েও ব্যর্থ হন এবং হযরত ওসমান (রাঃ) খেলাফত আমলেই সা'লাবা মৃত্যুবরণ করেন। সম্মানিত পাঠকবৃন্দ, সা'লাবার জীবন থেকে কি কি জ্ঞান অর্জন করলাম তা নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পেরেছেন। আমাদের সকলের উচিত জীবনে সর্বদা চলার পথে মহা মহিমান্বিত আল্লাহ তায়ালার আদেশ ও নিষেধ পুরোপুরিভাবে মেনে চলা, অনিচ্ছাকৃত ভুল পরিহার করা এবং ধৈর্য্য না হারানো। পবিত্র আল-কোরআনের বানী "মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে (শর্তসাপেক্ষে) এবং তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হইওনা।" সূরা আসরের ২ ও ৩নং আয়াত লিখে শেষ করছি, "নিশ্চয়ই মানুষ ধ্বংসের মধ্যে লিপ্ত কিন্তু তারা ব্যতীত, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং স্ৎকর্ম করে এবং একজন অপর জনকে হক উপদেশ দেয় এবং ধৈর্য্য ধারণ করে।"