রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২১, ০০:০০

আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী : বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া এক সিপাহসালার
অনলাইন ডেস্ক

আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল কখন থেকে? ১৯৭১ সালে? ১৯৫২? ১৯৪৭? ১৯৪০? ১৯০৫-৬? নাকি তারও আগে! কখন থেকে?

১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলা তথা ভারতের স্বাধীনতার সূর্র্য অস্তমিত যাওয়ার পর এদেশের মুক্তিকামী মানুষ ব্রিটিশ বেনিয়াদের কবল থেকে স্বদেশকে মুক্ত করতে মরণপণ লড়াই শুরু করে। শহীদ তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১), ক্ষুদিরাম বসু (১৮৮৯-১৯০৮), সূর্যসেন (১৮৯৪-১৯৩৪) প্রমুখ দেশপ্রেমিক সূর্যসন্তানরা তো আসেন আরো অনেক পরে। এঁদের অনেক আগে পলাশী যুদ্ধের মাত্র সাত বছর পরে ১৭৬৪ সালে প্রথম এদেশী সিপাহীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। আর ১৮৫৭ সালে সিপাহীদের মহাবিদ্রোহ সমগ্র ভারতকে মুক্তির চেতনায় উত্তাল করে বৃটিশ রাজের সিংহাসনে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিল। তারই পূর্বগামিনী ছায়া দেখা যায় পলাশী যুদ্ধের মাত্র সাত বছর পরে।

আসুন, আমরা কিছু বেদনাময় ইতিহাস জেনে নিই, যা আজ আত্মভোলা এ জাতির অবহেলায় বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসেছে।

আন্দামান জেলখানার জেলার হিসেবে এসেছিলেন এক প-িত সজ্জন ব্যক্তি। তিনি ছিলেন একজন বিদগ্ধ দার্শনিক। দর্শন শাস্ত্রের একটা জটিল বই পড়তে গিয়ে অনেক শব্দের অর্থ ও বিষয় বুঝতে তাঁর বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। তিনি কারাগারে দায়িত্বরত তাঁর সহকর্মীদের কাছে সহযোগিতা কামনা করেন কেউ সেই জটিল বিষয়গুলো নিয়ে তাঁকে সাহায্য করতে পারেন কিনা। এক অফিসার জানান তাঁর জানামতে ভূ-ভারতে ঐ সময় দ্বিতীয় কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি নেই যিনি এই সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা রাখেন। তবে সুখের কথা হল, সেই সমস্যা সমাধানের একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি বৃটিশ সরকার কর্তৃক দ্বীপান্তরিত হয়ে আন্দামান জেলখানায় কয়েদী অবস্থায় আছেন।

আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী। জন্ম ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ আগস্ট। বাড়ি অযোধ্যার খায়রাবাদে, তাঁই তাকে খায়রাবাদী বলা হয়। তাঁর পিতা আল্লামা ফজলে ইমাম খায়রাবাদীও একজন যুগশ্রেষ্ঠ আলিম ছিলেন। প্রথম পরিচয় তিনি ভারতের একজন শ্রেষ্ঠ আলেম, বিখ্যাত সাহিত্যিক, কবি ও ঐতিহাসিক। তাঁর গর্বময় দ্বিতীয় পরিচয় হলো, তিনি ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের একজন প্রত্যক্ষ সংগ্রামী।

ভারতকে স্বাধীন করতে গিয়ে তিনি বন্দী হন। বিচারের নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তে তাঁর সমস্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয় আর তাঁকে নির্বাসন দেয়া হয় কুখ্যাত আন্দামানে। সেখানেই তাঁকে বাকিটা জীবন কাটাতে হয়।

আন্দামান দ্বীপ:

ইংরেজ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করায় আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীকে আন্দামানে ইংরেজদের জেলে এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা হয়েছিল। তার ছাদ দিয়ে বৃষ্টি পড়তো। ফলে টয়লেটের মতো ছোট কামড়ায় পানি জমে যেত। হাফ প্যান্ট আর ছোট জামা তাঁকে পরতে দেয়া হয়েছিল। খাদ্য হিসেবে দেয়া হতো নানা জাতের মাছ সিদ্ধ, যা ছিল অত্যন্ত দুর্গন্ধময় ও খাবার অযোগ্য। সময়ে সময়ে বালি মেশানো রুটিও দেয়া হতো। যা হোক, তাই দিয়েই তিনি ক্ষুধা নিবারণ করতেন। ঠাণ্ডা পানির পরিবর্তে গরম পানি দেয়া হতো। অবশ্য কিছুক্ষণ রাখলেই তা ঠাণ্ডা হবার কথা। কিন্তু তার উপায় ছিল না, তাড়াতাড়ি পানি না খেলে পানির পাত্র ফিরিয়ে নিয়ে যাবার নির্দেশ ছিল। প্রতিদিন নিয়মিত বেত্রাঘাতের ব্যবস্থা ছিল। স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে থাকতে হতো। রাত্রে অন্ধকারে রাখা হতো। কাঁকড়া বিছেতে প্রায়ই দংশন করত, তার যন্ত্রণায় সারাক্ষণ ছটফট করতে হতো। কক্ষে দ্বিতীয় কেউ ছিল না যে তাঁর কাছ থেকে একটু সাহায্য ও সান্ত্বনা পাওয়া যেতে পারে। সর্বাঙ্গ দাদ, চুলকানি ও একজিমাতে ভরে গিয়েছিল। তদুপরি চিকিৎসা ও ঔষধ দেয়া ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ভারতরত্ন যত্নের অভাবে যেন নোংরা আস্তাকুঁড়ে চাপা ছিলেন। আরও দুঃখের কথা, হযরত খয়রাবাদী দিনের বেলা সাধারণ সুইপারের মত নিজের ও অন্যান্য কয়েদীর পায়খানা পরিষ্কার করতে হতো। বন্দী বীরও তাই করতেন।

শুধু তাই নয়, প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীকে আন্দামানের সেলুলার জেলে বৃটিশরা ষড়যন্ত্র করে নামাজ না পড়ার জন্য এমন কাপড় সরবরাহ করেছিলো, যেন এই বিপ্লবী মহাবীর আল্লামা ঠিক মত শরীরের ছতর আবৃত না করতে পারেন। অথচ এমন নিছক ষড়যন্ত্রও কামিয়াব হয়নি। ইমামে আহলে সুন্নাত খায়রাবাদী নিজের ছতর ঢাকার জন্যে বৃদ্ধ শরীরে কোদাল হাতে ছতর পরিমাণ গর্ত খুঁড়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথাসময়ে আদায় করে নিতেন। এই মুজাহিদ গভীর রাতের নির্জন আঁধারে মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে সিজদায় অবনত হতেন, ঢুকরে ঢুকরে কেঁদে ভারতের স্বাধীনতা ও মুসলমানদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে দিতে মুনাজাত করতেন। তাঁর কান্নার আহাজারীর সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে পার্শ্ববর্তী সেলগুলো থেকে আমিন আমিন শব্দে মুখরিত হয়ে উঠতো। যেন স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে দাঁড়ান কুফার জমিনে রাসুল অতুলের দৌহিত্র শহীদকূল শিরোমণি ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর সিজদার রোনাজারি!!!

এদিকে ডেপুটি জেলার সাহেব তার কাছে রক্ষিত একটি মূল্যবান ফার্সি পা-ুলিপির যোগ্য অনুবাদকের খুঁজতে গিয়ে মাওলানা ফজলে হকের নাম পেলেন। তাই কারাকর্তা কাগজ-কলম দিয়ে পাণ্ডুলিপিগুলো তাঁর কাছে পাঠালেন। অসুস্থতা ও অস্বাভাবিক মানসিকতা সত্বেও মাওলানা টিকাসহ অনুবাদের কাজ শেষ করলেন। সেই সঙ্গে তথ্যগুলো কোন লেখকের কোন পুস্তকের কোন খণ্ড থেকে নেয়া হয়েছে তাও লিখে দিলেন। জেলার সাহেব সেটা পড়ে বিস্ময়ে হতবাক হলেন এই জন্য যে, কোন পুস্তকের সাহায্য ছাড়া এ কাজ সম্পন্ন করা তো আসলেই বিস্ময়কর। তাই তিনি ফজলে হকের সাথে সাক্ষাৎ করতে এলেন। ঠিক এই সময়েই মাওলানা সাহেব পায়খানা পরিষ্কার করে বিষ্ঠামাখা টিন ও ঝাঁটা নিয়ে অর্দ্ধোলঙ্গ পোশাক পরে ধীরে ধীরে আসছিলেন। সাহেব তাকে হাত খালি করে দাঁড়াতে বললেন। তারপর মূল্যবান পোশাক পরিহিত অবস্থাতেই মাওলানাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন। ক্ষমা চাইলেন ভুলবশতঃ তাঁকে ময়লা পরিষ্কারের দায়িত্ব দেয়ার জন্যে। ফজলে হক নিজেও কেঁদে ফেললেন এবং ক্ষমা করে দিলেন। এরপর জেলার সাহেব তাঁকে পুরস্কার দিতে চাইলে তিনি বললেন,"আমি আল্লাহর কাছ থেকেই পুরস্কার নেবো। মানুষের কাছ থেকে নয়।"

একবার ভাবুন তো!!!

স্বজনহারা নির্মম দ্বীপান্তরে তপ্ত সূর্যের নীচে ষাট বছরের শুভ্র শ্মশ্রুমন্ডিত এক বৃদ্ধ নবী প্রেমিক কোদাল হাতে মাটি কাটছেন। টুকরিতে ভরে মাথায় করে দূরে রেখে আসছেন। পবিত্র সেই ঘর্মসিক্ত গা বেয়ে দরদর করে ছুটে যায় ঘামের প্রস্রবন। মাঝে মাঝেই কোদালের বাঁট ছিটকে তাঁর চরণে আঘাত হানে। মহাবীরের গা বেয়ে ঘর্ম ঝরে, পা বেয়ে রক্তধারা। আবার পৃষ্ঠে পড়ছে লাল বেনিয়া বিলেতী সৈন্যের চাবুকের তীব্র যন্ত্রণা।

তবু এতটুকুও মাথা নুয়ে পড়ে না। দৃপ্ত শিরদাঁড়া সটান রেখে দরাজ কন্ঠে উচ্চারিত হয়-বৃটিশ রাজ! তোমার সাথে আঁতাত নয়, নহে বিন্দুমাত্র পরাজয়। ঈমানের প্রশ্নে আপোষ নয়, জিহাদই কাম্য।

জেলার তাঁকে বললেন, আপনি আমাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অস্ত্র ধরেছেন এবং আমাদের সাথে যুদ্ধ করাকে ওয়াজিব বলে ফতোয়া দিয়েছেন, আপনার অপরাধ অমার্জনীয়। কাজেই আপনাকে মুক্তি দেয়া ভারতের বড়লাটের ক্ষমতার বহির্ভূত। আপনাকে মুক্তি দিতে পারে একমাত্র লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিল। আমি সেখানেই আপনার মুক্তির জন্য সুপারিশ করবো।

ফজলে হক বললেন, আপনার এ উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমাকে মুক্তি দেয়া মানে আমাকে অনুগ্রহ করা। আমি ব্রিটিশের অনুগ্রহ নিব না। লক্ষ্মৌর হাইকোর্ট আমাকে বলেছিল, আমি ব্রিটিশ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করলেই আমাকে মুক্তি দেয়া হবে। কাজেই যে আনুগত্যের অনুগ্রহ তখন নেই নি, তা এখনও নিব না। আপনি একজন জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তি তাই বলছি। আমাদের কুরআনে আছে,-‘তোমরা কিছুই চাইতে পারবে না, কিন্তু আল্লাহ যা চান, তাই হয়।’ কাজেই আমি যে এখানে আছি তা আল্লাহর ইচ্ছাতেই আছি।

মাওলানা সাহেবের তেজস্বীতা দেখে জেলার সাহেব বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, মুক্তি গ্রহণ করা না করা সেটা আপনার ইচ্ছা, কিন্তু আমার বিবেকতাড়িত কাজ আমি করবই।

মাওলানা সাহেব তাঁর মনের অন্তিম কথাগুলো তিনি কাফনের উপর লিখে যেতেন। তাই তিনি ঐ জেলারকে আগেই বলেছিলেন,"আমার আনা কাফনখানি আমি আমার ছেলেদের কাছে পৌঁছে দিতে চাই। যদি আমার মৃত্যু এখানেই হয় তাহলে আপনারা সরকার অনুমোদিত কাফন দিয়েই আমার কবর দেবেন।" ঐ কাফনের কাপড়ের উপর নির্বাসিত জীবনে বসে কাব্য আকারে যে কাহিনী তিনি আরবী ভাষায় লিখেছিলেন সেটাই সুবিখ্যাত "আসসাওাতুল হিন্দিয়া" (ভারতের কান্না) এর পা-ুলিপি।

তাঁকে জেলার সাহেব এর দেয়া দর্শন শাস্ত্রের বইয়ের অনুবাদের জন্য যে কাগজ দেয়া হতো, তা থেকে কাগজ বাঁচানোর কোন উপায় ছিল না, কারণ কাগজ দেয়া হতো পরিমাণমত। তবে তিনি ছিঁড়াফাটা টুকরাগুলো রেখে দিতেন। এসব টুকরা কাগজ এবং কাফনের কাপড়ে পেন্সিল অথবা লাকড়ির কয়লা দিয়ে তিনি রচনা করেছিলেন এ অমূল্য গ্রন্থটি। এ বইয়ে তিনি ভারতের স্বাধীনতা বিপ্লবে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং আন্দামানে তাঁর উপর নির্যাতনের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। এ পুস্তকটি অবশেষে তাঁর ছেলে মাওলানা আব্দুল হক খায়রাবাদীর কাছে পৌঁছে। উলামায়ে কেরাম পান্ডুলিপিটির উর্দু অনুবাদ করেন। বেনিয়া সরকারের তা সহ্য হয়নি। তারা পুস্তকটি বাজেয়াপ্ত করে এবং অনুবাদক ও প্রকাশকের উপর অশেষ নির্যাতন চালায়।

যাই হোক, মাওলানা সাহেবের দুই ছেলে মাওলানা আব্দুল হক ও মাওলানা শামসুল হক দেশের জ্ঞানী-গুণীদের সুপারিশ সংগ্রহ করে পিতার মুক্তির জন্য লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলের কাছে পাঠান।

এদিকে জেলার সাহেব কারাগারে তাঁর সদাচরণ ও কর্মনিষ্ঠার কারণে সরকারের কাছে তাঁর দন্ড মওকুফের সুপারিশ পাঠান। অন্যদিকে দেশবাসীর আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রিভি কাউন্সিল আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীকে জামিনে মুক্তির আদেশ দেন। জামিননামার একটি কপি মাওলানা শামসুল হক খায়রাবাদীর কাছে, আরেকটি জেলার সাহেবের কাছে পাঠানো হলো।

মাওলানা শামসুল হক প্রায় চার বছর পর নিজের বরেণ্য পিতাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার জন্য মহানন্দে আন্দামানগামী জাহাজে উঠলেন।

মাওলানা শামসুল হক আন্দামানে নেমে দেখলেন হাজার হাজার রোরুদ্যমান কয়েদী একটি জানাজার পিছনে ধাবমান। তিনি একজন কয়েদীকে জিজ্ঞাসা করলেন, এটি কোন কয়েদীর জানাজা ভাই!

কয়েদী চোখ মুছে বলল, আপনি বুঝি নতুন এসেছেন?

-হ্যাঁ!

- বঙ্গোপসাগরের শান্ত সলিলে ভারতরবি আজ অস্ত গিয়েছে। আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী আর নেই!!

বাক্যবিমূঢ পুত্র মুক্তিনামাটি হাতে নিয়ে ছুটে গিয়ে পিতার বুকে স্থাপন করে খাটিয়া ধরে চললেন।

জেলার সাহেবও মুক্তিনামাটি মরহুমের বুকের উপর রেখে খাটিয়া ধরে চলছিলেন। দুজনের চোখেই তখন ভারত মহাসাগরের সমস্ত নোনাজল। যেন সাগরের নোনাজল স্থির হয়ে যায় ফোরাতের বাঁধের মতো, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের সাগরবেলা হয়ে যায় কারবালা প্রান্তর!!

জানাজা হচ্ছে আর জেলার সাহেব একটি পাথরের উপর বসে ভাবছিলেন, সেই দিনের আল্লামার কথাগুলো। শেষ পর্যন্ত তিনি আমাদের অনুগ্রহ গ্রহণ করলেন না। কী তাজা দিলের মানুষ ছিলেন এই খায়রাবাদী।

সত্যি! ফজলে হক খায়রাবাদী বেনিয়ার মুক্তিনামা হাতে নিয়ে স্বদেশে ফিরে আসার পরিবর্তে মহাপ্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে স্বস্থানে চলে গেলেন আর শেষ আশ্রয়গ্রহণ করলেন জন্মভূমি থেকে দূর বহুদূরে আন্দামানের মাটিতে।

বন্ধুরা! অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হলো ইনিই হলেন আমাদের ইমামে আহলে সুন্নাত। ইনি সেই মহান পণ্ডিত যিনি আরবী, ফার্সি, উর্দু ও হিন্দি ভাষাশাস্ত্রের এক জীবন্ত অভিধান ছিলেন। যাঁর কাছে যুগশ্রেষ্ঠ কবি মীর্জা গালিব নিজের লিখা কবিতার ভুলত্রুটি সংশোধনের জন্য দ্বারস্থ হতেন। আর আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীর সংশোধনী ব্যতীত মীর্জা গালিব কোন মজলিশে নিজের কবিতা আবৃত্তি করেননি।

ইনিই আমাদের ইমামে আহলে সুন্নাত বৃটিশ ভারতে যিনি প্রথম মুফতি হিসেবে ফতোয়া দিয়েছিলেন বৃটিশ রাজ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করা মুসলমানদের অবশ্যই করণীয়-ফরজে আইন। শুধুমাত্র এই ফতোয়াই সেদিন দিশেহারা মুসলিম মিল্লাতকে পথের সন্ধান দিয়েছিল। এই ফতোয়ার মাধ্যমে প্রথম ভারতের মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধভাবে বৃটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামেরত হয়। আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী ছিলেন জামানার শ্রেষ্ঠ আলেম। যাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এবং বুজুর্গীর কারণে সমসাময়িক সকল আলেম এক বাক্যে তাঁকে জমানার ইমামে আহলে সুন্নাত বলে মেনে নিয়েছিলেন। তিনি চাইলে বিত্ত বৈভবের মধ্যে আলীশান মহলে শানদার ইমারতে গদ্দীনশীন হতে পারতেন। নিজে তারীক্বতের শায়খ হয়ে তাছাউফ চর্চা করলেও পীর মুরিদির হাদিয়া তোহফার শানদার মজমা এড়িয়ে যিনি দুঃখ ক্লেশের সংগ্রামী জীবনকে নিজ জীবনের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করে নিয়েছিলেন। বৃটিশ রাজের বিরুদ্ধে দেয়া ফতোয়ার মধ্যে নিজের দায়িত্ব সারেন নি। বরং ষাট বছরের এক বৃদ্ধ হয়েও নিজে রণাঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যুব সমাজকে বৃটিশ বেনিয়া বিরোধী সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন। সুযোগ থাকা সত্বেও বৃটিশ রাজের সাথে আঁতাত করেননি। নিজের জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন আহলে সুন্নাত দাবিদার মানে খাসমহল, রংমহল, পীরজাদা, শাহজাদা লক্বব নয়, অকুতোভয় জেহাদী চেতনার মধ্য দিয়ে নিজের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়ার মধ্যেই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই হলো আমাদের ইমামে আহলে সুন্নাত।

পাদটীকা :

আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী। তিনি একজন অতি বড় প-িত ব্যক্তি, সেই সাথে একজন আপোষহীন যোদ্ধা। দর্শন শাস্ত্র, বিজ্ঞান, ইসলামী ধর্মতত্ব, সাহিত্য, প্রভৃতি বিষয়ে তিনি ছিলেন অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী। জটিল দর্শন বিষয়ে গ্রন্থ রচনাসহ বহু গ্রন্থ প্রণেতা তিনি। লাখনৌর নবাব সরকারে তিনি আট বছর প্রধান বিচারপতি ছিলেন। বৃটিশরা লাখনৌ দখল করলে তিনি বৃটিশের অধীনে চাকরি করতে অস্বীকার করার পর পদত্যাগ করে রাজপথে নেমে আসেন। স্থানীয় শাসক, জমিদার ও কৃষকদের মধ্যে বিদ্রোহের বাণী প্রচারের জন্যে চারদিকে সফর করা শুরু করেন। ১৮৫৭ সালে তিনি ‘বৃটিশের বিরুদ্ধে জিহাদ ফরজ’-এর ডাক দিয়ে ফতোয়া প্রচার করেন। ফতোয়াটি ভারতে তখনকার বিখ্যাত পত্রিকা ‘সাদিকুল আখবার’-এ প্রকাশিত হয়। ১৮৫৭ সালের বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামে দিল্লীর সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের পাশে তিনি ছিলেন। মোঘল শাসন কীভাবে চলবে ভবিষ্যতে তার দিক নির্দেশনার জন্যে তিনি একটি ‘গণতান্ত্রিক সংবিধান’ রচনা করেন এবং দিল্লীর শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে উদ্বুদ্ধ করেন নতুন পদ্ধতির শাসনের জন্যে। বৃটিশদের হাতে দিল্লীর পতন ঘটলে তিনি বিদ্রোহ সংগঠনের লক্ষ্যে দিল্লী ত্যাগ করেন। এরপর তিনি বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামের নায়িকা ‘হযরত মহল’- এর পাশে গিয়ে দাঁড়ান এবং চেষ্টা চালাতে থাকেন দেশীয় শক্তিতে ঐক্যবদ্ধ করতে। এই সময় তিনি বৃটিশদের হাতে গ্রেফতার হন। অভিযোগ আনা হয় যে, তিনি দেশীয় রাজা-জমিদারদের বিদ্রোহ-রক্তপাতে উস্কানি দিয়েছেন, যুদ্ধ করেছেন এবং হত্যা-খুনের মত অপরাধ করেছেন। ১৮৫৯ সালের ৪ঠা মার্চ এক রায়ে বৃটিশ কোর্ট তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দান করেন এবং ১৮৬০ সালে ৬৩ বছর বয়সে তিনি আন্দামানে দ্বীপান্তর লাভ করেন। ২ বছর পর ১৮৬২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি এই দ্বীপেই শাহাদাতবরণ করেন।

তথ্যসূত্রঃ

১) আযাদী আন্দোলন : ১৮৫৭ (হজরতের লিখিত আসসাওরাতুল হিন্দিয়া এর বঙ্গানুবাদ, কৃত : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান।)

২) চেপে রাখা ইতিহাস, কৃত : গোলাম আহমদ মোর্তজা।

৩) উলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাজি,

৪) আন্দামানে বন্দী বীর,

৫) উইকিপিডিয়া,

৬) আন্দামান ষড়যন্ত্র (সাইমুম সিরিজ) আবুল আসাদ,

৭) আজাদী আন্দোলনে আলেম সমাজের ভূমিকা,

কৃত : জুলফিকার আহমদ কিসমতী, হযরতকে মালিক কবুল করুক

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়