রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

যুক্তিযুদ্ধে আবশ্যকীয় টেম্পারামেন্ট

ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
যুক্তিযুদ্ধে আবশ্যকীয় টেম্পারামেন্ট

জীবনটাই যুদ্ধের। মায়ের গর্ভ ছেড়ে পৃথিবীর আলোয় আসার জন্যে মানব ভ্রূণের যুদ্ধটা কেউ দেখে না। সবাই দেখে, মায়ের কষ্টের দিকটা। ঠিক তেমনি বিতর্ক-মঞ্চে একজন বিতার্কিকের মানসিক যুদ্ধটা অনেকের চোখ এড়িয়ে যায়, অনেকেই অনুধাবনও করতে পারে না তা। সবাই দেখে মুখ ফুটে কী যুক্তি বের হয়ে এলো কিংবা বিতর্কের মঞ্চে বক্তার দাঁড়ানোর ঢংটাই বা কী। কিন্তু একজন বক্তাকে বিতর্কের মঞ্চে নিয়ে যেতে তার মনের যে কসরত, তা কেবল একজন পর্বতারোহীর পর্বতে ওঠার কষ্টের সাথেই তুলনীয়। তাই যুক্তিযুদ্ধের মঞ্চে প্রতিজন বক্তার মানসিক ব্যায়ামের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিতর্ক চলাকালীন মনকে শান্ত ও সুস্থির রাখতে পারা অত্যন্ত জরুরি। বিক্ষিপ্ত মন বক্তার সূক্ষ্ম বিশ্লেষণী দক্ষতাকে ভোঁতা করে দেয়। অশান্ত ও অধীর মন বক্তাকে একদিকে যেমন ভালো শ্রোতা হতে দেয় না, তেমনি অন্যদিকে বিতর্ককে নিজের দিকে টেনে আনার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বকে ভোঁতা করে দেয়। কাজেই নিস্তরঙ্গ পুকুরে বিরাজমান উৎপলের মৃণালের মতোই মনকে প্রশান্ত ও প্রকট করে রাখতে হবে। প্রতিপক্ষের বক্তব্য শুনে মন বক্তাকে প্রতিনিয়ত পরিচালিত করার চেষ্টা করে। মস্তিষ্ককে কখনোই বিতর্কের মঞ্চে মনের খামখেয়ালীপনার হাতে তুলে দিতে নেই। মন বলবে, প্রতিপক্ষের সকল যুক্তির জবাব দিতে। কিন্তু মস্তিষ্ক বলবে, পাতিলের সব ভাত যেমন একজনের পক্ষে খাওয়ার জন্যে নয়, তেমনি প্রতিপক্ষের সব যুক্তি প্রতিদানযোগ্য বা জবাবের উপযোগী নয়। প্রতিপক্ষের যুক্তির মেরিট যাচাই ও তার পরিণাম ভেবে নেওয়ার দায়িত্ব মনকে নয়, মস্তিষ্ককে দিন। বরং মস্তিষ্ক দিয়ে মনের লাগাম টানুন, কেননা মন বক্তাকে খেই হারিয়ে দিতে পারে, কিন্তু মস্তিষ্ক সর্বদাই বক্তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করে।

বিতর্কের মঞ্চে প্রতিপক্ষের লক্ষ্যই থাকে আপনাকে রাগিয়ে দেওয়া। কারণ, কাউকে রাগিয়ে দিতে পারলেই তার বোধ-বুদ্ধি লোপ পায়। ভালো-মন্দ তা বিবেচনার শক্তি আপাত অন্তর্হিত হয়ে যায়। ফলে তখন বক্তার পক্ষে সংজ্ঞায়নও জটিল হয়ে যায়। ক্ষিপ্ত বক্তা তখন প্রতিপক্ষের ফাঁদে পা দিয়ে রাগের তাড়নায় তার ভালো যুক্তিগুলোকে এড়িয়ে চাতুর্যপূর্ণ যুক্তির প্রত্যুত্তরে ব্রতী হয়। ফলে বিতর্ক-মঞ্চে মূল্যবান চারটি মিনিট কোন্ ফাঁকে যে অতিবাহিত হয়ে যায় তা কেউ অনুধাবন করতে পারে না।

লড়ার আগে হারার মানসিকতাকে অবশ্যই পরিহার করতে হবে। নামকরা প্রতিষ্ঠানের বিতার্কিক বলেই যে আজও প্রতিপক্ষ ভালো বিতর্ক করবে তা নাও হতে পারে। প্রতিপক্ষের নামে যে ভয় পায় লড়ার আগে সে-ই তো হেরে যায়। কাজেই নিজের দলের প্রতি, নিজেদের সামর্থ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখতে হবে। সব প্রতিযোগিতাতেই কচ্ছপ আর খরগোশের গল্প লুকিয়ে থাকে। প্রতিপক্ষ অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উড়ু উড়ু করলে তাকে মাটিতে নামিয়ে আনার দায়িত্ব সে যে আপনারই। বিতর্কে আপনার বিবেচনায় নয়, বিচারকের বিবেচনাতেই নির্ধারিত হয় জয়-পরাজয়। কাজেই, বিতর্কের মঞ্চে নিজেকে যোগ্যভাবে মেলে ধরুন। মনে করুন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিশ্বের সেরা প্রশিক্ষিত বাহিনীর একটিকে হারিয়েছিলাম। কাজেই, দলের নামে নয়, বিতর্কের দিনে বিতর্ক-মঞ্চে আপনার পরিস্ফুটনই আপনাকে জিতিয়ে দিবে। মরার আগে মৃত্যু নয়, লড়ার আগে হার নয়। বিনা যুদ্ধে নাহি দিবো স্চুগ্র মেদিনী। এটাই হবে আত্মপ্রত্যয়ের বোধ। আপনিই জানেন, আপনার শক্তি ও সামর্থ্য। কাজেই মনোবল অটুট রাখাটা জরুরি। মনোবলের বদৌলতে মানুষ পার হতে পারে অকূল সমুদ্র। মাতৃভক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তো মনোবলেই পার হয়েছেন দুর্বার দামোদর। বিতর্কের দামোদর পাড়ি দিতে হলে মনোবলের পানসি চাই, মৃত্যুঞ্জয়ী পণ চাই।

পর্যাপ্ত আত্মবিশ্বাস যে কোনো অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে। নিজের আত্মবিশ্বাসে চিড়্ ধরতে দেওয়া যাবে না মোটেই। আত্মবিশ্বাস হচ্ছে আপনার বিশ্বজয়ের সোপান। আপনার প্রতিটা পদক্ষেপকে যে শক্তি সহজ করে তুলতে পারে তার নাম আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়েই পিঁপড়া তার চেয়ে অধিক ভারী খাদ্য-পাহাড় টেনে নিয়ে যায়। আপনি পারবেন না, এই ভাবনা আপনাকে দুর্বল করে তুলবে। তুলবেই। এতে আপনি যা পারতেন, তা-ও পারা সম্ভব হবে না। আপনার মনের শক্তিতে ঘুণ ধরানোর জন্যে প্রতিপক্ষের প্রতি অতিরিক্ত সমীহ পোষণ করাটাই যথেষ্ট। বলা হয়ে থাকে, যত অতি তত ক্ষতি। তা আপনার নিজের আত্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রেই হোক কিংবা প্রতিপক্ষকে সমীহ করার ক্ষেত্রেই হোক। আত্মবিশ্বাসী মানুষ যুদ্ধে খালি হাতেও জিতে যায়। রবীন্দ্রনাথই বলেছেন, হাত থাকলে হাতিয়ার দরকার হয় না। কারণ ইচ্ছাশক্তির দৃঢ়তার চেয়ে বড় হাতিয়ার আর নেই। আপনি মচকাবেন না কখনোই। এ মানসিকতা আপনার থাকতেই হবে। যুক্তিতে বলীয়ান হতে হলে ইচ্ছাশক্তিতেও বলীয়ান হতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রতিপক্ষ কোনো ফেরেশতা নয় যে তার কোনো ভুল হবে না। তক্কে তক্কে থাকতে হবে তাদের ভুল খুঁজে পাওয়ার জন্যে। এ কোনো খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজা নয়। এ হলো মন-কান গভীর অভিনিবেশে একত্র করে রাখলে আপনার সামনে ভুলের ছড়াছড়ি ধরা পড়বে। আপনি আয়ুর্বেদিক জীবকের কথা মনে করুন। আচার্য তাকে একহাত দৈর্ঘ্যের একটা কুঠার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, 'যাও, একযোজনব্যাপী এলাকায় ঔষধের অনুপযোগী কোনো গাছ পেলে তা কেটে এনো আমার জন্যে।' মেধাবী জীবক অনেকক্ষণ ঘুরেও সেরকম কোনো গাছের খোঁজ পেলেন না। ফিরে এসে গুরুকে সে কথা বলতেই গুরু বুঝলেন, তাঁর প্রিয় শিষ্যের শিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে। নিজেকে জীবকের মতো অধ্যবসায়ী করে গড়ে তুলুন। মুক্ত চিন্তার অবিরল চর্চা করুন। যে কোনো যুক্তির বিকল্প যুক্তি বা পাল্টা যুক্তি দাঁড় করাতে শিখুন। একদিন আপনার কানেও যে কোনো যুক্তি শোনার সাথে সাথেই মস্তিষ্ক তার পাল্টা যুক্তি আপনাকে প্রতিদান হিসেবে তৈরি করে দিবে।

দলনেতার কাঁধে সব বোঝা চাপাবেন না। আপনার কাঁধ যতটুকু চওড়া আপনার দলনেতার কাঁধও ঠিক ততটুকুই চওড়া। আপনি আপনার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলেই আপনার দলনেতা এগিয়ে যেতে পারবেন। কাজেই দায়িত্বের সমবায় করে নিতে হবে। তিনে মিলে করি কাজ, তিনে গড়ি এক আওয়াজ। এই একই আওয়াজ তৈরি করতে পারার মধ্যেই নিহিত আছে বিতর্কের মূল সম্বিৎ। বিতর্ককে জাগিয়ে তুলবেন আপনারাই। একটা বিতর্ক প্রাণবন্ত করে তুলতে হলে আপনাদের নিজেদেরকেই আগে প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে হবে। একজন সপ্রতিভ মানুষের চোখ থাকে হাজারটা, কানও থাকে হাজারটা। প্রতিপক্ষের কোনো যুক্তি তার কান বা শ্রবণ এড়িয়ে যায় না। সুতরাং বিতর্কের মঞ্চে জবরজং হয়ে নয়, বরং সচকিত, সমন্বিত হয়ে বসুন।

বলা হয়ে থাকে, বনের বাঘে খাওয়ার আগে মনের বাঘে খায়। তাই মনের ভয়কে জয় করুন। কোনো অবস্থাতেই মনকে দুর্বল হতে দেওয়া চলবে না। মন হচ্ছে 'একে তো নাচুনে বুড়ি, তার উপর ঢোলের বাড়ি'র মতো। ভয় পাওয়ালেই সে ভয় পায়। আবার উজ্জীবিত করে তুললে সে সহজেই উজ্জীবিত হয়। উজ্জীবনী শক্তি যার যত বেশি, বিতর্ক-মঞ্চে তার যুক্তি উদ্ভাবনের হারও তত বেশি। যে কোনো সময় মিরাকল্ ঘটতে পারে। আপনার চিন্তায় যে কোনো সময়েই সেরা যুক্তিটা ধরা দিতে পারে। কাজেই, হাল ছাড়বেন না। বরং ভয় ছাড়ুন, শঙ্কা ছাড়ুন। আতঙ্ককে জয় করুন। তাহলেই বিতর্কের বিজয়লক্ষ্মী আপনার করতলগত হয়ে বরমাল্য দিয়ে যাবে।

ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া : অধ্যক্ষ, চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি (সিডিএ); গ্রন্থকার : বিতর্ক সমগ্র, বিতর্ক বিধান ও বিতর্ক বীক্ষণ; সব্যসাচী লেখক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়