প্রকাশ : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বিতর্কে যা বর্জনীয়
শৈল্পিক বিতর্ককে যথাযথ উপস্থাপনের মাধ্যমে যদি জয়ের স্বাদ পাওয়া যায় তবে সে অর্জনে আনন্দের গর্জন দেয়া যেতেই পারে। কিন্তু জয়ী না হলে যারা নেতিবাচক গর্জন তুলে বিতর্ককে বর্জন করেন তাদের জন্যে আজকের লেখাটি।
মূলত বিতর্ককে বর্জন করা যায় না। যারা সাময়িক হারে বিতর্ককে বর্জন করেন তারা পক্ষান্তরে নিজের যৌক্তিক কথা বলার চর্চাকে গলা টিপে হত্যা করেন। তাই আনুষ্ঠানিক কোনো মঞ্চে প্রতিপক্ষের কাছে নম্বরের ব্যবধানে বিতর্কে হেরে বিতর্ক বর্জন না করে, বিতর্ক মঞ্চে যাওয়ার আগে কোন্ কোন্ দিকগুলো বর্জন করলে বিজয় অর্জন করা যাবে সে বিষয়গুলো জানাটা জরুরি।
মনে রাখতে হবে, কোনো স্কুলের একটি শ্রেণি কক্ষের যে শিক্ষার্থী পাঠ্যপুস্তকের ভিতরে-বাইরে তত্ত্বে ও তথ্যে ভালো জ্ঞান রাখে সে মেধাবী, কণ্ঠ যার ভালো সে কণ্ঠশিল্পী, বাচনভঙ্গি ও প্রমিত উচ্চারণে যে ভালো সে আবৃত্তিকার, অনর্গল কথা বলার সাহস আছে যার সে সুবক্তা, কোনো প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর দিতে পারে যে সে প্রত্যুৎপন্নমতি, যে শিক্ষার্থী অন্যের মতকে সম্মান করে শান্তভাবে নিজের মত প্রকাশ করে সে বিনয়ী আর এই সব গুণ একত্রে যার মধ্যে আছে সে বিতার্কিক। অর্থাৎ তত্ত্বে ও তথ্যে, বাচনভঙ্গি ও প্রমিত উচ্চারণে, কথা বলার সাহস ও উপস্থিত বুদ্ধিতে, যুক্তি প্রদান ও খণ্ডনে, বিনয় ও সাবলীলতার মত সব প্রতিভার প্যাকেজ যার মধ্যে রয়েছে সে-ই আদর্শ বিতার্কিক। এর যে কোনো একটি অনুপস্থিত থাকলেই বিতার্কিক হওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে থাকতে হয়। বিতার্কিক হওয়ার এই পূর্ব শর্তগুলো হয়তো অনেকেরই জানা, কিন্তু বিতর্কে করতে গেলে কী কী বর্জনীয় তা অনেকেরই অজানা। প্রচলিত ভুলের কয়েকটি দিক নিচে তুলে ধরা হলো।
সম্বোধনে সময়ক্ষেপণ না করা :
বিতার্কিকদের সম্বোধন করার ক্ষেত্রে অধিক বিশেষণ জুড়ে না দিয়ে সরাসরি সম্বোধন করা উচিত। উপস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু বহুল চর্চিত শব্দগুচ্ছ বা বাক্য আছে, যেমন ‘তর্কের খাতিরে তর্ক না করে আমাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলুন’, ‘অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কারণে আজকে প্রস্তাবের পক্ষে/বিপক্ষে আমাদের সুদৃঢ় অবস্থান’ এইরকম আরো বেশ কিছু বাক্যই প্রচলিত বিতর্কে ব্যবহার হয়ে আসছে। এসব বাক্য পরিহার করাই শ্রেয়। খুব সহজভাবেই তো বোঝা যায়, কণ্ঠে কণ্ঠ মিলাতে তো কেউ বিতর্ক করতে আসে না বা যুক্তিসঙ্গত কারণেও বিতর্কের পক্ষ বিপক্ষ নির্ধারণ হয় না। --এটি হয় আয়োজকদের নির্ধারিত পদ্ধতিতে। কাজেই কেনো এসব বাহুল্য কথার ব্যবহার করে সময় ক্ষেপণ করা? বিতর্কে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে বিতার্কিককে নিজেদের পক্ষে একটি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করতে হয়। সে জন্যে পর্যাপ্ত যুক্তি, উদাহরণ ইত্যাদি তাকে উপস্থাপন করতে হয়। অপ্রয়োজনীয় স্থূল কথা বলে সময় নষ্ট করার মতো সময় কোথায় তার কাছে? তাই সময় বাঁচাতে বাক্য দুটিকে 'প্রতিপক্ষ বন্ধু আশা করি বুঝতে পেরেছেন' বা 'বিষয়ের পক্ষে/বিপক্ষে বলছি' বলাটাই উত্তম।
ভাষায় আঞ্চলিকতা পরিহার :
বিতর্কে আঞ্চলিকতা সম্পূর্ণ বর্জন করতে হবে। চর এলাকায় বসবাসরত বিতার্কিকগণ কিছু কিছু ক্রিয়াপদের প্রথম অক্ষরকে খাড়াভাবে উচ্চারণ করেন। কেউ কেউ হয়তো মনে করেন এটিই শুদ্ধ। যেমন : করতে, ধরতে, বলতে, চলতে শব্দগুলোর উচ্চারণ যথাক্রমে কোরতে, ধোরতে, বোলতে, চোলতে। এভাবে না বলে কেউ কেউ উচ্চারণ করেন যথাক্রমে, কর-তে, ধর-তে, বল-তে, চল-তে...। কোন্ শব্দের কোন্ উচ্চারণ তা চাইলেই রপ্ত করা সম্ভব। গুগলের সহযোগিতায় আঞ্চলিকতা পরিহার করে প্রমিত উচ্চারণ করতে না পারলে স্ট্রং ধারালো যুক্তিগুলোও ধারহীন হয়ে যায়।
বাংলা বিতর্কে ইংরেজি শব্দের পাণ্ডিত্য বর্জন :
কথার মধ্যে ইংরেজি শব্দের মিশ্রণ ঘটিয়ে পাণ্ডিত্য দেখানোটা বাংলা বিতর্কের জন্যে নেতিবাচক। কথায় কথায় বিদেশি শব্দ ব্যবহার করার মধ্যে পাণ্ডিত্যের কিছু নেই। কাজেই বিদেশি শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা বর্জন করতে হবে। বিতর্কে ভাষার প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগেও বলেছি, বাংলা বিতর্কে প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যবহারই করতে হবে। ৭/৮ শব্দের একটি বাংলা বাক্য বলতে ৪-৫টি ইংরেজি মিশিয়ে বলার যে প্রচলন আজকাল দেখা যায়, বিতর্কে তেমনটা গ্রহণযোগ্য নয়। বিতর্কের ভাষা হবে স্পষ্ট, স্থূলতা হবে বর্জিত। অপ্রয়োজনীয় অলঙ্কার দিয়ে বক্তব্যকে অতি কাব্যিক করে ফেলাও উচিত নয়। বিতর্ক যুক্তিপ্রধান শিল্প। তাই কাব্য করে বা রূপকের আড়ালে লুকিয়ে না বলে সরাসরি কথা বলার চর্চাই এখানে বেশি প্রাসঙ্গিক। যেমন : 'মাননীয় মডারেটর, স্কুলের টিচাররা স্টুডেন্টদের প্র্যাক্টিকেল ক্লাস না করিয়ে যখন থিওরি ক্লাসে টাইম পাস করেন তখনতো স্টুডেন্টরা পিছিয়ে পড়বেই।' বাক্যটি শুনতে প্রচলিত বাংলা ভাষায় মনে হলেও ১১টি ইংরেজি শব্দ রয়েছে, যা ভাষার গুরুচণ্ডালী।
শারীরিক ভাষা বিনয়ী হোক :
যে ভাষা বিনয়ী নয়, সে ভাষা বিতার্কিকের নয়। মুখের ভাষা, শারীরিক ভাষা দুটোই হতে হবে বিনয়ী। উপস্থাপনায় যেমন বিতার্কিকের উচ্চারণ, ভাষা ব্যবহার বা শব্দচয়ন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ তার শরীরের ভাষা। আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি, ডান হাতের তর্জনী তুলে প্রতিপক্ষকে ইঙ্গিত করতে অনেকেই পছন্দ করেন, যা সম্পূর্ণ বর্জনীয়। মঞ্চে বিতার্কিকের দাঁড়ানো, তার হাত-পায়ের নড়াচড়া, তার চোখের ভাষা, শ্রোতাণ্ডদর্শকের সাথে যোগাযোগের দক্ষতা, মাইক্রোফোন ব্যবহার, প্রতিপক্ষের বিতার্কিকের প্রতি মনোভাব প্রকাশ--এসবই গুরুত্বপূর্ণ। বিতার্কিককে তাকাতে হবে দর্শকের চোখের দিকে। শরীর থাকবে সোজা। হাত ও মুখের অভিব্যক্তি হতে হবে বক্তব্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। দুঃখের কথা বলতে গিয়ে হাসি আর আনন্দের বিষয়ে কাঁদো কাঁদো মুখের ভাব হলে চলবে না। বিতার্কিককে তার চাহনি দিয়েও দর্শক-শ্রোতা এবং বিচারকের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারতে হবে। যখন যাকে সম্বোধন করছে সে তার দিকে তাকাতে হবে। চোখের ভাষায় আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। কথায় আছে, চোখ যে মনের কথা বলে।
হাত ও মাইক্রোফোনের ব্যবহার :
বিতর্ক চলাকালীন হাত কোথায় থাকবে, তা নিয়ে প্রায়শই নতুন বিতার্কিকরা বিপাকে পড়েন। হাত কি দেহের দুই পাশে থাকবে, রোস্টাম বা বক্তৃতা মঞ্চে থাকবে, নাকি ঘনঘন নাড়াচাড়া করবে-এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পেয়ে কী করবে, কোথায় রাখবে, কীভাবে নাড়বে এসব কিছু নিয়েই বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। যেন কিছু সময়ের জন্যে হাত দুটি না থাকলেই ভালো হতো। এর সবচেয়ে সহজ সমাধান হচ্ছে, হাত নিয়ে না ভাবা। কথা বলার সময় হাতের সহজাত যে নড়াচড়া তেমনই হতে দেয়া ভালো। কথায় কথায় তর্জনী আঙ্গুল উঠে যাওয়া অনেকের অভ্যাস। সেই অভ্যাস দূর করতে হলে আপাতত একটি আঙ্গুল নয়, ৫টি আঙ্গুলই সামনের দিকে তুলুন। এতে কিছুটা বিনয় প্রদর্শিত হবে। আরেকটি বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায় মাইক্রোফোন। কেনো যেনো অনেকেরই একটা যন্ত্রভীতি থাকে। মাইক্রোফোন মুখের কতটুকু কাছে নিবে, নাকি দূরে রেখে কথা বলবে এসব ভাবতে ভাবতে সে যা বলে তা শ্রোতার কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় না। কাজেই মাইক্রোফোনের ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। প্রয়োজনে বিতর্ক শুরুর আগেই জেনে নিতে হবে যে মাইক্রোফোন ব্যবহার করা হচ্ছে তার ধরণ সম্পর্কে। কেননা কিছু মাইক্রোফোন থাকে যেগুলো মুখের খুব কাছে নিয়ে কথা না বললে কিছুই শোনা যায় না, আবার কিছু আছে যেগুলোতে একটু দূর থেকেই কথা বলতে হয়। কাছে থেকে বললে কথা বোঝা যায় না কিছুই।
রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন :
ডেল কার্নেগির বিখ্যাত উক্তি, 'রেগে গেলেনতো হেরে গেলেন।' বিতর্ক মঞ্চে যেহেতু জয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে দাঁড়াচ্ছেন, তাহলে অযথা রাগ বাড়িয়ে হার ডেকে আনবেন কেন? তাই পরিস্থিতি যা-ই হোক, প্রতিপক্ষ যত খোঁচা দিয়েই কথা বলুক, আপনি আপনার বক্তব্যকে নম্র করুন, রাগকে বর্জন করুন। আবেগী বিষয়ের বক্তব্যে অনেকেই উত্তেজিত হয়ে যান। বিতর্ক মঞ্চে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারাটা খুবই জরুরি। অনেক সময়ই প্রতিপক্ষের কোনো কথা, এমনকি বিচারক বা সভাপতি/মডারেটরের কোনো কথার সাথেও বিতার্কিকের দ্বিমত থাকতে পারে। তাই বলে উত্তেজিত হয়ে ওঠা চলবে না। বরং মনে রাখতে হবে, ভিন্ন মতের সহাবস্থানই সভ্যতা। পরমতসহিষ্ণুতা একজন আদর্শ বিতার্কিকের অন্যতম গুণ।
বক্তব্যে রসিকতা থাকুক নিয়ন্ত্রণে :
নিয়ন্ত্রিত রসিকতা বক্তব্যকে প্রাণবন্ত করে তোলে। তবে সজাগ থাকতে হবে মাত্রাতিরিক্ত রসিকতা সনাতনী বিতর্ক ধারাকে যেন রম্য বিতর্কে পরিণত না করে। বক্তব্যে রুচিশীল হাস্যরসের ব্যবহার শ্রোতা আকৃষ্ট করতে খুবই ফলপ্রসূ। কঠিন বক্তব্যের মাঝে যদি বিষয় সম্পৃক্ত হাস্যরস যুক্ত করা যায়, তাহলে বিতর্ক আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে। তবে সেই হাস্যরস হতে হবে প্রাসঙ্গিক। এমন একটি রসিক টপিক আলোচনার জন্যে বেছে নেয়া উচিত, যা শুনতে কৌতুক মনে হলেও পরোক্ষভাবে তা যুক্তি খণ্ডনের কাজ করছে। হাস্যরসের উপাদান সংগ্রহ করা যেতে পারে বিশাল সাহিত্য ভাণ্ডার থেকে, জনপ্রিয় কোনো গান বা নাটক থেকে অথবা বিজ্ঞাপন থেকেও। হতে পারে নিজের থেকে বলা কথাও। এমন রসাত্মক কথা নির্বাচন করা যাবে না, যা বলতে গিয়ে শ্রোতার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। তবে সচেতন থাকতে হবে যে, রসিকতা যেন কোনোভাবেই বর্ণবাদী বা সাম্প্রদায়িক না হয়। শালীনতার মাত্রাও যেনো অতিক্রম না করে কোনোভাবেই। যে কোনো ব্যক্তিকে আহত করবে এমন রসিকতা বিতর্কে বর্জন করাই শ্রেয়। প্রতিপক্ষকে বিনয়ের সাথে যুক্তির অস্ত্র দিয়ে কুপোকাত করাই বিতর্ক, রসিকতার ছলে কটাক্ষ বা অশালীন ভাষায় আহত করাটা বিতর্ক নয়।
স্বল্প সময় বা দীর্ঘ সময়, দুটোই বর্জনীয় :
সময় সচেতনতার ক্ষেত্রে বিতর্ককে ফুটবল খেলার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। একটি দল যত ভালোই খেলুক, নির্দিষ্ট সময়ের আগে যেমনি রেফারি খেলার চূড়ান্ত বাঁশি বাজাবেন না, তেমনি একটি দল যত খরাপই খেলুক না কেন রেফারির চূড়ান্ত বাঁশি বাজার পর কোনো দলই খেলা চালিয়ে যাবে না। বিতর্কের বাঁশি বাজানোর রেফারির দায়িত্বটি পালন করে থাকেন সময় নিয়ন্ত্রক। চূড়ান্ত ঘণ্টার আগে যেমনি মূল বক্তব্য শেষ করে ফেলা দৃষ্টিকটু, তেমনি সময় নিয়ন্ত্রক বার বার চূড়ান্ত ঘণ্টা দেয়ার পরও বিতর্ক চালিয়ে যাওয়াটা সময়ানুবর্তী না হওয়া। অনেক বিতার্কিক বক্তব্যের মাঝে চূড়ান্ত ঘণ্টা বেজে উঠলে সময় ক্ষেপণ করে স্ক্রিপ্টের চলমান পয়েন্টটি তড়িঘড়ি করে শেষ করেন অথবা গতানুগতিক ভাবে বলে উঠেন, 'তাই প্রতিপক্ষ বন্ধু তর্কের খাতিরে তর্ক না করে আমাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলুন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহারের কারণেই শিক্ষার্থীরা শিক্ষা বিমুখ হচ্ছে....।' এই কথাগুলো বলতে যে ২০-৩০ সেকেন্ডের মত অতিরিক্ত সময় ব্যয় হলো, যা বিচারকগণ মোটেই ইতিবাচক চোখে দেখেন না। বরং বিতর্কের মাঝপথে চূড়ান্ত ঘণ্টা বেজে গেলে বলা যেতে পারে, 'প্রতিপক্ষ বন্ধু আশা করি বুঝতে পেরেছেন। ধন্যবাদ মাননীয় মডারেটর, ধন্যবাদ উপস্থিত সবাইকে।' তাহলে চূড়ান্ত ঘণ্টা বাজার ৫ সেকেন্ডের মধ্যে নিজের বক্তব্যের সমাপ্তি টানা যায়। যদিও বিতার্কিকদের আগেই সময়ের সাথে সমন্বয় রেখে স্ক্রিপ্ট তৈরি করা বুদ্ধিদীপ্ত কাজ।
ভুল তথ্য দেয়ার চেয়ে কোনো তথ্য না দেয়াই ভালো :
কথায় আছে, একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না। তেমনি একটি ভুল তথ্য পুরো বিতর্কের জন্যে কলঙ্ক। বিতর্কে বিতার্কিকদের অবশ্যই তত্ত্ব ও তথ্য দিতে হবে। তবে সে তথ্য যেন কোনোভাবেই ভুল বা রেফারেন্সহীন ভূতুড়ে তথ্য না হয়। স্যোসাল মিডিয়ায় অনেক তথ্যই ভেসে বেড়ায় যার কোনো তথ্য সূত্র নেই। এমন তথ্য বিতর্কের জন্যে বাছাই করা যাবে না। বিতর্কে কোনো একজন বক্তার ভুল তথ্য পুরো বিতর্কে তিনজন বক্তার বক্তব্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। তাই ভুল তথ্য অবশ্যই বর্জন করতে হবে। ভুল তথ্য দেয়ার চেয়ে কোনো তথ্য না দেয়াই উত্তম। কোনো তথ্য দিলে সেই তথ্যটি কোন্ পত্রিকায়, কত তারিখে প্রকাশিত হয়েছে, কোন্ লেখকের কোন্ বইতে প্রকাশ পেয়েছে তা উল্লেখ করলে তথ্য অধিকতর শক্তিশালী হয়।
প্রতিপক্ষকে মিসকোড করা যাবে না :
প্রতিপক্ষের বিতার্কিকগণ যে বক্তব্য দেননি, সে বক্তব্য দিয়েছে বলে মিস কোড করা আর নিজের পায়ে নিজে কুড়াল দেয়া একই কথা। সংসদীয় বিতর্কে মিসকোড করলে যার বক্তব্য মিসকোড করা হয়েছে তিনি 'পয়েন্ট অব প্রিভিলেজ' উত্থাপন করে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ৫ নম্বর পর্যন্ত কর্তন হতে পারে। তবে সনাতনী বিতর্কে এ ধরনের কোনো সুযোগ না থাকলেও বিচারকরা বিষয়টি অবশ্যই নজরে আনেন। এবং যিনি অহেতুক মিস কোড করেছেন তার প্রাপ্ত নম্বর কমে যায়। যেমন : 'মাননীয় মডারেটর প্রতিপক্ষ দলের ২য় বক্তা বাল্য বিয়ের কথা বলে গেলেন....।' অথচ তিনি বাল্য নিয়ে কোনো বক্তব্যই দেননি। এ ধরনের মিস কোড বর্জনীয়।
বিতর্কের জয় অর্জন করতে হলে ছোট ছোট এই দিকগুলো অবশ্যই বর্জন করতে হবে। বিতর্কের হার নেই তা আমরা জানি। বিতর্কে হয় জেতা হয়, নয় শেখা হয়। নম্বরের জয়টাই প্রকৃত জয় নয়। উপস্থিত দর্শকের মন জয় করাটাই প্রকৃত জয়। কোনো বক্তার বক্তব্য যদি ভুলের ঊর্ধ্বে থাকে, ছোট ছোট ভুলগুলো ডিঙ্গিয়ে বিতর্ক মঞ্চে চমৎকার একটি পরিবেশন করা হয় তবে নম্বরের ব্যবধানে তার দল হেরে গেলেও তার বক্তব্য উপস্থিত শ্রোতার হৃদয়ে যে দাগ কেটেছে সেই সাফল্যটাই প্রকৃত সাফল্য। একই টুর্নামেন্টে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিপক্ষ পেয়ে সাদামাটা বক্তব্যে নম্বরের ব্যবধানে জয়লাভ করে কেউ বাড়ি ফিরে যায়, আবার কেউ শক্তিশালী দলের সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে যুক্তিতে, তত্ত্বে, তথ্যে চমৎকার বক্তব্য দিয়ে শত শত শ্রোতার মন জয় করে সীমিত নম্বরের ব্যবধানে হেরে বাড়ি ফিরে যায়। একজনের নামের পাশে বিজয়ী, অপরজনের নামের পাশে বিজিত যোগ হলেও যিনি শত শত শ্রোতার মন জয় করে বাড়ি ফিরলেন তিনিই প্রকৃত বিতার্কিক। টুর্নামেন্ট আসে, টুর্নামেন্ট যায়, মানুষের হৃদয়ে এই বিতার্কিকরা রয়ে যায়। তাই ফলাফল যা-ই হোক, বিতর্কে প্রকৃত বিতার্কিকরা হারে না বরং ক্রমাগত তুখোড় বিতার্কিক হওয়ার ক্ষুধা বাড়ে।
রাসেল হাসান : উপাধ্যক্ষ, চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি; পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্কে কলেজ পর্যায়ে হ্যাট্রিক চ্যাম্পিয়ন দলের দলপ্রধান এবং অসংখ্যবার শ্রেষ্ঠ বক্তা হিসেবে পুরস্কারপ্রাপ্ত।