প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
ইতিবাচক ও কৌশলী স্ট্যান্ড বিতর্ক জয়ের সম্ভাবনা বাড়ায়
ঢাকা থেকে লঞ্চ যোগে চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বিকেলে সদরঘাট পৌঁছে শুনি ঈগল লঞ্চের হেলপাররা লঞ্চের যাত্রী বাড়াতে শ্লোগান দিচ্ছেন, ‘তিন ঘণ্টায় ঈগল, আগে গেলে ঈগল...।’ বলা বাহুল্য, বর্তমানে ঢাকা টু চাঁদপুর বা চাঁদপুর টু ঢাকা লঞ্চ ভাড়া ১৯০ টাকা। ঈগলের ভাড়াও তা-ই। পাশেই ঈগলের চাইতে কম গতিসম্পন্ন সোনার তরী-৪ লঞ্চের হেলপারগণ শ্লোগান দিচ্ছেন, ‘দেড়শ’ টাকায় চাঁদপুর, কম টাকায় চাঁদপুর..।’ সদরঘাট টার্মিনালে হেলপারগণের মধ্যে যা চলছিলো তাও কিন্তু একটি বিতর্ক। মডারেটর বা সভাপ্রধানহীন সে বিতর্কে বিচারক লঞ্চের যাত্রীগণ। বিতর্ক শুনে তারাই নির্ধারণ করবেন তারা কোন্ লঞ্চে যাবেন। ঈগল লঞ্চের শক্তি গতিতে। তাই তারা গতিকে স্ট্যান্ড পয়েন্ট ধরে শ্লোগান তুললো, ‘তিন ঘণ্টায় ঈগল, আগে গেলে ঈগল...।’ আবার এমভি সোনার তরী-৪ জানে, সে ঈগলের গতির সাথে পারবে না, তার পক্ষে ৩ ঘণ্টায় চাঁদপুর পৌঁছা সম্ভবও নয়। তাই সে ভাড়া কিছুটা কমিয়ে টিকেটের মূল্যকে বিতর্কের স্ট্যান্ড হিসেবে বেছে নিলো এবং খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলছে, দেড়শ’ টাকায় চাঁদপুর, কম টাকায় চাঁদপুর..।’
একদিন পর রাতের লঞ্চে ঢাকা যেতে চাঁদপুর লঞ্চঘাটে পৌঁছলাম। সেখানে দেখি আরও মজার বিতর্ক চলছে। কম গতিসম্পন্ন দুটি লঞ্চ এমভি তাকওয়া ও ইমাম হাসানের মধ্যে বিতর্ক চলছে। এমভি তাকওয়া পূর্বের দুটি স্ট্যান্ড নিয়েই হ্যান্ড মাইকে বলছে, ‘দেড়শ’ টাকায় ঢাকা, রাইত তিনটায় ঢাকা, কম টাকায় ঢাকা, ছাইড়া গেলো ঢাকা...।’ পাশেই ইমাম হাসান লঞ্চ। চাঁদপুর থেকে লঞ্চযোগে নিয়মিত ঢাকাগামী সব যাত্রীই জানেন, ইমাম হাসান রাত ১০টায় চাঁদপুর লঞ্চঘাট থেকে ছেড়ে যায় এবং ধীর গতিতে তা ৬ ঘণ্টা সময় নিয়ে ভোর ৪টায় ঢাকা পৌঁছে। তাকওয়া ১৫০ টাকা যেহেতু নিচ্ছে এর চেয়ে কম টাকা নিলেও ইমাম হাসানের লোকসানে পড়তে হবে। তাই আমি খুব আগ্রহ নিয়ে ইমাম হাসানের সামনে গেলাম তাদের বিতর্কের স্ট্যান্ডটি জানার জন্যে। গিয়ে শুনি তারা যাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলছে, ‘এক ঘুমে ঢাকা, ঘুমাই-ঘুমাই ঢাকা, ফজরের আগে ঢাকা...।’ গ্রামীণ মানুষ রাতের ঘুম পছন্দ করে বলেই নিজেদের নেতিবাচক সীমাবদ্ধতাগুলো ইতিবাচকে রূপ দিয়ে ঘুমের স্ট্যান্ডটি বেছে নিয়েছে ইমাম হাসান লঞ্চটি।--এটিই বিতর্ক। যা বাস্তব জীবনের বিতর্কের চমৎকার প্রয়োগ। যদি তাকওয়ার মত সময় বা গতিকে স্ট্যান্ড নিয়ে ইমাম হাসান যাত্রীদের বলতো, ‘ছয় ঘণ্টায় ঢাকা, ধীরে-ধীরে ঢাকা...।’ তবে কি যাত্রীরা ইমাম হাসানে উঠতো? এই যে ‘৬ ঘণ্টায় ঢাকা’ নেতিবাচক বাক্যটি এড়িয়ে গিয়ে ইতিবাচক ‘এক ঘুমে ঢাকা’ বাক্যের প্রয়োগ--এটিই বিরোধিতার স্ট্যান্ড। সেদিন লঞ্চঘাটের চলমান বিতর্ক শুনে আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘বিতর্ক শুধু মঞ্চে নয়, বিতর্ক এখন লঞ্চে।’
লঞ্চঘাটের নৌ-শ্রমিকদের বিতর্কের ন্যায় মঞ্চ বিতর্কের বিতার্কিকদেরও বিষয়ের নেতিবাচক দিক পরিহার করে ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে। তবেই বিতর্কে সফলতা আসবে। অর্থাৎ বিতর্কের পক্ষে বা বিপক্ষে স্ট্যান্ড নির্ধারণের আগে দৃষ্টিভঙ্গি স্থির করতে হবে ইতিবাচকভাবে। একই বাক্যের নেতিবাচক দিক পরিহার করে কোন্ কোন্ ইতিবাচক দিক গ্রহণ করলে কথা বলার ক্ষেত্র তৈরি হবে, প্রতিপক্ষকে গোলক ধাঁধায় ফেলা যাবে তা খুঁজে বের করতে পারলেই প্রতিযোগিতার আগেই বিতর্কের জয় নিশ্চিত করা যাবে।
ধরা যাক একটি বিতর্কের বিষয়, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে জানাতে বিতর্ক একটি কার্যকর মাধ্যম।’ এই বিষয় হাতে পাওয়ার পর নতুন বিতার্কিকরা ভাবতে পারেন যে, ‘বিতর্ক প্রতিযোগিতা’ কী করে কার্যকর মাধ্যম হয়? অথচ বিষয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতার কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে বিতর্কের কথা। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানাতে, যুদ্ধাপরাধীদের চেনাতে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্য ছিলো একটি বিতর্ক। হতে পারে তা আদালতীয় বিতর্ক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে কি হবে না, স্বাধীনতার ঘোষক কে, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার শুরু হবে কি-না--এই প্রতিটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেশবাসীকে জানাতে সংসদে সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে যে আলোচনা হয়েছিলো তাও একটি বিতর্ক। যার নাম সংসদীয় বিতর্ক। টিভি টকশোতে দুপক্ষের মধ্যে যে আলোচনা হচ্ছে তা গোলটেবিল বিতর্ক। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ ও বিপক্ষ শক্তি সমর্থিত পত্রিকা, বইয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যা কিছু লেখা হচ্ছে তা লেখ্য বিতর্ক। এভাবে প্রতিটি বিতর্কের মাধ্যমে দুই পক্ষের যৌক্তিক আলোচনায় সত্য উন্মোচিত হয় বলে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে জানাতে নিঃসন্দেহে বিতর্ক একটি কার্যকর মাধ্যম।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের মূল হাতিয়ার প্রযুক্তি নয়, যোগ্য নেতৃত্ব’ এই বিষয়ের যারা পক্ষে তারা ‘প্রযুক্তি নয়’ শব্দদ্বয়ের কারণে প্রযুক্তির বিপক্ষে বলাটা হবে আত্মঘাতী। আপাত দৃষ্টিতে ‘যোগ্য নেতৃত্ব’ বলতে দেশের নেতৃত্বকে বুঝানো হলেও সঠিক সংজ্ঞায়নের মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্বের সংজ্ঞাকে ছড়িয়ে দেয়া যায়। অর্থাৎ যোগ্য নেতৃত্ব হতে পারে দেশের, হতে পারে জনগণের, হতে পারে প্রযুক্তি ব্যবহারকারীর, হতে পারে প্রযুক্তি পরিচালনাকারীর। এক কথায় সর্বক্ষেত্রে যোগ্য নেতৃত্ব থাকলেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব। যোগ্য নেতৃত্বহীন প্রযুক্তি, দেশ ও দশের কাছে বোঝা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই প্রযুক্তি নয় বরং প্রযুক্তির যোগ্য নেতৃত্বই পারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে। এভাবে বিতর্ককে ইতিবাচকভাবে চালিয়ে নেয়া যায়।
‘লোভ নয়, অভাবের কারণেই দেশে দুর্নীতি বাড়ছে’ বিষয়ের বিপক্ষ দল ভাবতে পারেন ‘অভাবী গরিবরা কি আর দুর্নীতি করছে? দুর্নীতিতো প্রতিনিয়ত করছে ধনী শ্রেণির লোকজন। যার আছে সে আরো পাওয়ার লোভে দুর্নীতি করছে। তাই অভাবের চেয়ে ‘লোভ’ দুর্নীতি বাড়াতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে।’ এমন ভাবনায় কাতর হয়ে পক্ষ দলের বিতার্কিকরা হয়তো ভাবতে পারেন ‘তাহলে আমরা কী বলবো?’ আগেই বলেছি ভাবনার জগৎটিকে প্রসারিত করুন। ইতিবাচকভাবে কৌশলী স্ট্যান্ড নিতে মন স্থির করুন। বিতর্কের বিষয়ে কিন্তু বলা হয়নি ‘অভাব’ বলতে শুধু আর্থিক অভাবকে বুঝানো হয়েছে। যদি পক্ষ দলের ১ম বক্তা সংজ্ঞায়ন করেন, অভাব বলতে কারো মধ্যে কোনো কিছুর অনুপস্থিতিকে বুঝায়, তাহলে যার অর্থ নেই তার আর্থিক অভাব, যার নীতি নেই তার নীতির অভাব অর্থাৎ দুর্নীতি। যার দেশপ্রেম নেই তার দেশের প্রতি ভালোবাসার অভাব, যার মূল্যবোধ নেই তার মনুষ্যত্বের অভাব, যার জ্ঞান নেই তার জ্ঞানের অভাব। আর এ কথাতো সবাই-ই জানে যে, জ্ঞানহীন মানুষ পশুর সমান। আর একজন মানুষ যখন অভাবের কারণে পশুতে পরিণত হয়, নীতির অভাবে তখন তো সে দুর্নীতি করবেই। এজন্যেই আমরা বলছি, লোভ নয়, অভাবের কারণেই দেশে দুর্নীতি বাড়ছে। এভাবে ইতিবাচক সংজ্ঞা ও কৌশলের মাধ্যমে বিতর্ককে শুরুতেই নিজেদের দিকে নিয়ে আসা যায়।
‘ধূমপান নিরোধে রাষ্ট্রীয় আইনই মুখ্য’--বিষয়টি শুনলেই যে কেউ বিরোধিতার স্ট্যান্ড হিসেবে জনসচেতনতা বেছে নেয়। অথচ ধূমপান নিরোধে রাষ্ট্রীয় আইনই নয় বরং আইনের শতভাগ প্রয়োগ মুখ্য। এই স্ট্যান্ডেও চমৎকার বিতর্ক করা যায়। আবার শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় আইন নয়, সকল আইনই সমান গুরুত্বপূর্ণ বলেও বিতর্ক দারুণভাবে চালিয়ে নেয়া যায়। অর্থাৎ একজন সন্তান ধূমপায়ী হবে কি-না তা নির্ভর করে পারিবারিক আইনের উপর। পরিবার ছাপিয়ে যখন পাড়া-মহল্লায় ধূমপান গ্রহণ করে তা প্রতিরোধে প্রয়োজন সামাজিক আইন। আর এই সব ব্যর্থ হলে অতঃপর প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় আইন ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ। এভাবে নানান দৃষ্টিভঙ্গিতে বিতর্ককে উপভোগ্য করে তোলা যায়। তা না করে যদি কেউ সরাসরি রাষ্ট্রীয় আইনের বিরোধিতা করে ধূমপান বন্ধে নতুন কোনো শব্দ প্রতিস্থাপন করে তার পক্ষে কথা বলেন, তবে তাতে জয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যায়।
একটি বিষয়কে বৃত্তের বাইরে গিয়ে কীভাবে আর কতভাবে ভাবা যায়, তা একজন বিতার্কিকের থেকে ভালো কেউ বলতে পারবে না। তাই ভাবতে হবে অনেক এবং সেই ভাবনাটি অবশ্যই হতে হবে ইতিবাচক ও কৌশলী। যে জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বললে প্রতিপক্ষের কথা বলার পরিধি কমে আসবে সেই জায়গাটিই খুঁজে বের করতে হবে। হাতে সময় থাকলে তাড়াহুড়ো করে স্ক্রিপ্ট লেখা শেষ না করে ভেবে চিন্তে চমৎকার একটি বিরোধিতার স্ট্যান্ড নির্ধারণ করে তারপর পূর্ণাঙ্গ স্ক্রিপ্টে নজর দেয়াটা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। বিরোধিতার জায়গাটি তিন বক্তা মনে-প্রাণে বুঝতে হবে, অনুধাবন করতে হবে। তবেই কথার মঞ্চে কথার ডেলিভারি হবে প্রাণবন্ত ও অকৃত্রিম।
লেখক : উপাধ্যক্ষ, চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি; পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্কে কলেজ পর্যায়ে হ্যাট্রিক চ্যাম্পিয়ন দলের দলপ্রধান এবং অসংখ্যবার শ্রেষ্ঠ বক্তা হিসেবে পুরস্কারপ্রাপ্ত।