শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৩ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

প্রস্তাবনার বিশ্লেষণ ও বিতর্কের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ

ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
প্রস্তাবনার বিশ্লেষণ ও বিতর্কের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ

বিতর্ক এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক খেলা। এখানে চাল দিতে হয় দাবার মতো। বিতর্কের চাল হলো যুক্তি। যুক্তি তৈরির আগে নিজেদের কৌশলগত অবস্থান নির্ধারণ করা দরকার হয়। কোনো বিতর্কে প্রস্তাবনা দেখে কৌশলগত অবস্থান নির্ধারণ করা মানে কিন্তু পক্ষে বা বিপক্ষে নির্ধারণ করা নয়। এটা হলো প্রতিপক্ষের বিরোধিতা কী কৌশলে করবেন তা নির্ধারণ করা। যে কৌশল নির্ধারণ করবেন, দলের প্রত্যেককে সেই কৌশল মোতাবেক বক্তব্য রাখতে হবে। কিছু কিছু প্রস্তাবনা থাকে যেখানে প্রতিপক্ষের পূর্ণ বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করা যায়। যেমন : দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারের সদিচ্ছাই যথেষ্ট। এই প্রস্তাবনায় পক্ষ দলের বিরোধিতা করতে গিয়ে বিপক্ষ দল চাইলে সম্পূর্ণ প্রস্তাবনার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। অর্থাৎ বিপক্ষ দল বলতে পারে জনগণের আইনমান্যতা ছাড়া কখনো সরকারের শতভাগ সদিচ্ছাতেও দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। জনগণ যদি ঘুষ না দেয়, জনগণ যদি অতিরিক্ত সুবিধা না চায় তবে দুর্নীতিবাজরা কখনোই সফল হবে না। অর্থাৎ জনগণ শতভাগ আইন মানলে দুর্নীতি প্রতিরোধে কোন আইনের দরকার হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অসময়ে গিয়ে কেউ ট্রেনের টিকেট চেয়ে দায়িত্বরত ব্যক্তিকে বখশিশ বা ঘুষ না দিলে দুর্নীতি হওয়ার সুযোগ নেই। অর্থাৎ আইনমান্যতার সংস্কৃতিতে যদি জনগণ অভ্যস্ত হয়ে উঠে তবে কোথাও কোনো দুর্নীতি সংঘটিত হবে না। পক্ষান্তরে কিছু কিছু প্রস্তাবনা আছে যেগুলোতে বিপক্ষের সাথে একই তলে অবস্থান করে মাত্র কিছু অংশের বিরোধিতা করতে হয়। যেমন : নারীর ক্ষমতায়ন জাতির টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে। এই প্রস্তাবনায় নারীর ক্ষমতায়নের বিরোধিতা করা যাবে না। কারণ টেকসই উন্নয়নে নারীর ক্ষমতায়ন জরুরি। কাজেই এই বিতর্কে পক্ষ ও বিপক্ষকে একই তলে বা পৃষ্ঠায় অবস্থান করতে হবে। বিরোধিতার ক্ষেত্র হলো টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয় কি না। নাকি টেকসই উন্নয়ন আসলে ধীরগতির উন্নয়ন? নারীর ক্ষমতায়ন সকল জাতির উন্নয়নের জন্যে জরুরি। কিন্তু টেকসই উন্নয়ন করতে হলে দক্ষ জনশক্তি ও শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে। কেবল নারীর ক্ষমতায়ন উন্নয়নকে টেকসই করতে পারে না। আমাদের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। আমরা নারীর ক্ষমতায়ন করলাম কিন্তু বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সুনির্দিষ্ট কোনো পেশাগত দক্ষতা তৈরি করতে পারলাম না, তাতে কিন্তু উন্নয়ন টেকসই হবে না।

একটি বিতর্ক কোন্দিকে বাঁক নিবে তা নির্ধারিত হয় বিরোধিতার কৌশল নির্ধারণে। একটি বিতর্ককে বক্তা নিজেই বাঁক ঘোরাতে পারেন তার সংজ্ঞায়ন ও বিশ্লেষণের গভীরতার শক্তিতে। প্রত্যয়গুলোর সংজ্ঞায়ন সব সময় একাডেমিক দৃষ্টিকোণে করার প্রয়োজন নেই। বাস্তবতার নিরিখে বিতর্কের প্রস্তাবনার বক্তব্য নিরূপণ করে সংজ্ঞায়ন করা দরকার হয়। যেমন : শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। এই প্রস্তাবনায় মেরুদণ্ডের ব্যাখ্যা যেমন জরুরি তেমনি শিক্ষারও সংজ্ঞায়ন নিজের যুক্তির প্রয়োজনে তুলে ধরা দরকার। কেউ যদি শিক্ষা অর্থে একাডেমিক সংজ্ঞা না দিয়ে বলেন, শিক্ষা হলো জ্ঞানের চর্চা ও অনুশীলন, তাহলে তার বদৌলতে বিতর্কের জন্যে যে চাতাল তিনি পাবেন তাতে গতি-প্রকৃতি পাল্টে দেওয়া সহজ হয়ে যায়।

বিতর্কের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণে উহ্য প্রত্যয়গুলোর দিকে নজর দেওয়া জরুরি। কারণ প্রতিটি প্রস্তাবনায় বলা কথার চেয়ে না বলা কথার গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। ধরা যাক একটি প্রস্তাবনা : বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে রাজনীতিবিদের চেয়ে সংস্কৃতি কর্মীর ভূমিকা অধিক। এই প্রস্তাবনায় বিকাশের বিপরীতে উন্মেষ প্রত্যয়টি উহ্য রয়ে গেছে। কাজেই কেউ এই প্রস্তাবনার বিপক্ষে গেলে বুঝতে হবে সংস্কৃতির উন্মেষের বিপরীতে বিকাশের ব্যাপারটি জড়িত। সংস্কৃতি কর্মীরা এর উন্মেষ ঘটাতে পারলেও এর বিকাশের ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের হস্তক্ষেপ জরুরি। বঙ্গবন্ধু যদি আইয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়ার পক্ষে রুখে না দাঁড়াতেন, তবে আজ বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের কী হাল হতো তা বুঝাই যায়। একজন বঙ্গবন্ধু যদি তাঁর জনসভায় শাহ্ আব্দুল করিমের গানের প্রচার না করতেন তবে আজ তার বিকাশ কতোটুকু হতো তা বলা মুশকিল। কাজেই প্রস্তাবনায় বর্ণিত উহ্য প্রত্যয়গুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারলে তবেই বিষয়বস্তুর বিশ্লেষণ যথার্থ ও কার্যকর হয়ে উঠে।

অনেকেই বিতর্ককে হেড টু হেড বা চলক বনাম চলকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন। খেয়াল রাখতে হবে, বিতর্কের প্রস্তাবনায় আটকে থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই। যেমন : প্রজন্ম বিনির্মাণে পুঁথিগত শিক্ষা নয় নৈতিক শিক্ষাই অধিক জরুরি। এখানে বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ ও কৌশল নির্ধারণে পুঁথিগত শিক্ষা এবং নৈতিক শিক্ষার মধ্যে আটকে থাকার দরকার নেই। এ দুটি চলককে উপেক্ষা করে বলা যায়, প্রজন্ম বিনির্মাণে আসলে দরকার উপযুক্ত পুষ্টি ও শরীরচর্চা। কেননা, পুষ্টির ঘাটতি হলে মেধার বিকাশ হবে না। আবার শরীরচর্চার ঘাটতি হলে রুগ্ন প্রজন্ম তৈরি হবে। দুর্বল ও রুগ্ন প্রজন্ম দিয়ে জাতির কোনো উপকার সাধন হবে না। আবার কেউ যদি বলতে চায়, প্রজন্ম বিনির্মাণে পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষাও সমানভাবে জরুরি, তবে তাতেও বিতর্কের একটা স্ট্যান্ড পয়েন্ট দাঁড়িয়ে যায়। আসলে আমার বিতর্ককে আমিই পরিচালিত করবো। তাই স্ট্যান্ড পয়েন্ট নির্ধারণে অভিনবত্বকেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

প্রস্তাবনার ব্যবচ্ছেদে ছোট ছোট বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে সময় নষ্ট করা ঠিক নয়। যেমন : 'ই' প্রত্যয়, শুধুমাত্র, কেবলমাত্র ইত্যাদি। এগুলো বিতর্কের গতি নিরূপণ করে না বরং জটিলতা বাড়ায়। যেমন : শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। এই প্রস্তাবনায় 'ই' প্রত্যয় দ্বারা একমাত্র না বুঝিয়ে কেবলমাত্র জোর প্রদান করে। সুতরাং এর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ না করে শিক্ষাকে বাঙালি জাতির মস্তিষ্ক এবং কৃষিকে বাঙালি জাতির মেরুদণ্ডরূপে প্রতিপন্ন করুন। এতে ই-প্রত্যয় তুচ্ছ হয়ে যাবে। আরো একটা প্রস্তাবনার কথায় আসা যাক। প্রস্তাবনায় বলা হলো, দুর্নীতিই আমাদের উন্নয়নের একমাত্র অন্তরায়। এখানে ‘একমাত্র’ দিয়ে দুর্নীতি ছাড়া অন্য চলককে নাকচ করা হয়েছে। এই প্রস্তাবনার বিপক্ষে নিজেদের কৌশলগত অবস্থান নিরূপণ করতে হলে প্রস্তাবনায় 'একমাত্র' প্রত্যয়টিকে ঠিক রেখে তার আগে ‘অর্থনৈতিক’ শব্দটাকে বসিয়ে দেন। তাহলে আপনার কৌশলগত স্ট্যান্ড হলো, আপনি দুর্নীতিকে উন্নয়নের একমাত্র অন্তরায় হিসেবে নাকচ না করে বরং আরও নির্দিষ্ট করে বলছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে দুর্নীতিই একমাত্র অন্তরায়। কিন্তু সামাজিক কিংবা সাংস্কৃতিক উন্নয়নের অন্তরায় বরং উগ্র সাম্প্রদায়িকতা এবং অস্থিতিশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সুতরাং বিষয়বস্তুর বিশ্লেষণে সর্বদা সৃজনশীল অনুসন্ধিৎসা বজায় রাখতে হবে। তবেই বিতর্কের গতিপথকে নিজের ইচ্ছেমতো পরিচালিত করা যাবে।

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া : অধ্যক্ষ, চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি; গ্রন্থকার : বিতর্ক সমগ্র, বিতর্ক বিধান ও বিতর্ক বীক্ষণ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়