প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বিতার্কিক সৃষ্টির আঁতুড়ঘর চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ডেমোক্রেসি ইজ অব দ্যা পিপলস, বাই দ্যা পিপলস, ফর দ্যা পিপলস।' চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমির সংজ্ঞায়নটা ঠিক তেমনই। সিডিএ ইজ অব দ্যা ডিবেটার্স, বাই দ্যা ডিবেটার্স, ফর দ্যা ডিবেটার্স। অর্থাৎ চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি (সিডিএ) বিতার্কিকদের নিয়ে, বিতার্কিকদের জন্যে ও বিতার্কিকদের দ্বারা পরিচালিত একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। যার প্রতিষ্ঠাতা বরেণ্য সাংবাদিক, একজন আদর্শ বিতর্ক শ্রমিক, চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশনের সভাপতি রোটারিয়ান কাজী শাহাদাত। বিতর্কে অকল্পনীয় শ্রম, মেধা বিনিয়োগ করে নিজেকে বিতর্ক অঙ্গনে উজাড় করে দিয়ে চাঁদপুরে বিতর্কের জোয়ার আনার জন্যে চাঁদপুর বিতর্ক আন্দোলন (সিডিএম) রোটাঃ কাজী শাহাদাতকে হাজারো বিতার্কিকের সামনে আজীবন সম্মাননা দিয়েছিলো। সম্মাননার দুই যুগ পেরিয়ে সেই সম্মান এখন বেড়েছে বহুগুণ। ধ্যানে-জ্ঞানে বিতর্ক ভাবুক ও বিতর্ক বিশ্লেষক এই মানুষটি শুধু চাঁদপুর বিতর্ক আন্দোলনেই শামিল হননি, বিতর্ক অঙ্গনে পা রাখা নতুন মুখদের বিতর্ক চর্চা করার জন্যে গড়ে তুলেছেন আদর্শ একটি প্ল্যাটফর্ম। যার নাম চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি (সিডিএ)।
প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, জেলার হাজারো বিতার্কিকের বিতর্ক বিষয়ক শিক্ষক, বিতর্কের পথপ্রদর্শক, একাধিক বিতর্ক বিষক গ্রন্থের রচয়িতা, একজন বিতর্ক সংগঠক ও প্রশিক্ষক ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া। যিনি বিতর্ক একাডেমির ক্লাস পরিচালনার পাশাপাশি বিতর্ক শিখতে আগ্রহী কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিতর্কের ব্যঞ্জনবর্ণ শেখাচ্ছেন তো বটেই, তার সাথে বিতর্কের কলাকৌশল, যুক্তির ফাঁক-ফোঁকর, ক্ষুরধার যুক্তির পাল্টা যুক্তি দেয়ার উপায় ও কথার অস্ত্রে শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করার কৌশল শিখিয়ে যাচ্ছেন বেশ সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায়। যাঁর প্রতিটি ক্লাস আনন্দের বলেই সানন্দে তা গ্রহণ করেন প্রশিক্ষণার্থীগণ।
কোর্স ভিত্তিক প্রতিটি সেশনে বিতর্কের ধারাপাত থেকে শুরু করে ব্যবহারিক ক্লাস পর্যন্ত বিতর্ক বিষয়ক আপাদমস্তক শিক্ষা দিয়ে থাকে বিতর্ক একাডেমি থেকে। শুধু বিতর্কই নয়, বিতর্কে ভালো করার জন্যে সহায়ক শিক্ষাগুলোও দেয়া হয়ে থাকে। উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি, উপস্থাপনা, মাইক্রোফোনের ব্যবহার, স্টেজে গিয়ে ডায়াসের সামনে দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা সবকিছু পর্যায়ক্রমে শেখানো হয় এখানে। একই সাথে বিতর্কে সচরাচর প্রয়োগ হয় এমন কিছু জটিল শব্দ বা বাক্যাংশ নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী ক্লাসও হয়ে থাকে। দৃশ্যমান সিলেবাসের পড়ার পাশাপাশি অদৃশ্যমান জড়তা দূর করতে কাজ করে সিডিএ। মঞ্চ ভীতি দূর করতে, প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে বিনয়ের সাথে নিজস্ব যৌক্তিক মতামত উপস্থাপন করতে, প্রতিকূল পরিস্থিতিকে যুক্তির অস্ত্র ও কথার মাধুর্য দিয়ে অনুকূল পরিস্থিতিতে রূপান্তর করতে কী করণীয় তা ব্যবহারিকভাবে শেখানো হয় প্রশিক্ষণার্থীদের।
নিকট অতীতে প্রথম ক্লাসে দাঁড়িয়ে নিজের নাম বলতেও সঙ্কোচবোধ করা বহু প্রশিক্ষণার্থীকে দেখেছি কোর্স শেষ করার পর গুছিয়ে কথা বলতে, বিতর্ক মঞ্চে বিতর্কের ঝড় তুলতে, প্রতিপক্ষের ভয়ের কারণ হতে। চাঁদপুর বিতর্ক অঙ্গনের পরিচিত মুখ ও জেলা বিতর্ক টুর্নামেন্টের ফাইনালিস্ট, সেমি-ফাইনালিস্ট বিতার্কিক তাওহীদ, অহনা, নোভা, সামিয়া, ওয়ারিয়া বিতর্ক একাডেমির এক একটি জীবন্ত বিজ্ঞাপন। যাদের বিতর্ক চর্চা ও বিতার্কিক হিসেবে বেড়ে ওঠা চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমির হাত ধরেই। প্রান্তিক পর্যায়ের বহু পরিপক্ক বিতার্কিক আছেন যারা বিতর্ক মঞ্চে পূর্বের তৈরি করা স্ক্রিপ্ট ভালো ডেলিভারি দিতে পারেন, কিন্তু নিজে বিতর্কের স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে পারেন না। চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি তা নিরসনে কাজ করছে শুরু থেকেই। বিতার্কিকগণ নিজেরা বিতর্ক করার পাশাপাশি নিজের বিতর্ক স্ক্রিপ্ট যেন নিজেই তৈরি করতে পারেন তার জন্যে হাতে কলমে শিক্ষা দেয়া হয়। কোর্স শেষে একাধিক পরীক্ষায় যে কোনো বিষয় বেঁধে দিয়ে তার উপর পক্ষে বা বিপক্ষে স্ক্রিপ্ট লিখতে দেয়া হয়। এই চর্চার মাধ্যমে প্রশিক্ষণার্থীরা বুঝতে পারে কী করে একটি আদর্শ বিতর্ক স্ক্রিপ্ট গঠন করা যায়।
কোনো কোনো বিতার্কিক আছেন যারা পূর্ব নির্ধারিত বিষয়ের উপর প্রস্তুতি নিয়ে বিতর্ক মঞ্চে ঝড় তুললেও তাৎক্ষণিক কোনো বিষয়ে বিতর্ক করতে দিলে কিছু বলতে পারেন না। চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমির সিলেবাসে সেই বিষয়ক অনুচ্ছেদও রয়েছে। ধারাবাহিক বিতর্ক বিষয়ক শিক্ষার মাধ্যমে কীভাবে যে কোনো সময়ে যে কোনো বিষয়ে বিতর্ক করা যায় তা নিয়ে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দুধরনের ক্লাসই করানো হয়।
নবাগত অনেক বিতার্কিক ভালো বিতর্ক পরিবেশন করলেও বিতর্কের বিষয় পাওয়ার পর কী করে একটি আদর্শ বিরোধিতার জায়গা খুঁজে বের করতে হয় তা নিয়ে দ্বিধায় থাকেন। আবার লটারিতে পক্ষ দল পেলে অনেকে মনঃক্ষুণ্ণ হন। তারা মনে করেন পক্ষ দলের বলার জায়গাটি কম কিংবা পক্ষ দল থেকে জয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাদের এই প্রচলিত ধারণা পাল্টে দিয়ে পক্ষ বা বিপক্ষ যে কোনো সাইড থেকেই যে বিতর্কে সমানে সমান বলা যায়, একটি আদর্শ স্ট্যান্ড নির্বাচন করে বিতর্কের জয় ছিনিয়ে আনা যায় তা একাধিক ক্লাসে শেখানো হয় প্রশিক্ষণার্থীদের।
প্রতিটি বিতর্কে প্রথম বক্তার জন্যে বিষয় সংজ্ঞায়ন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিতর্কের বিষয়ের প্রতিটি শব্দ সংজ্ঞায়ন করাটা যে সময়ক্ষেপণ মাত্র তা শেখানো হয় শুরু থেকেই। একটি বিষয়ের কোন্ কোন্ শব্দ বা বাক্যাংশ সংজ্ঞায়নের দাবি রাখে তা শেখানোর পাশাপাশি কতিপয় জটিল শব্দের সংজ্ঞা লিখিত শিটের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। ‘প্রতিকার ও প্রতিরোধ’, ‘কি ও কী’, ‘অবরোহন ও আরোহন’, ‘কিভাবে ও কীভাবে’, ‘চেষ্টা ও প্রচেষ্টা’, ‘সংস্থা ও সংগঠন’, ‘নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল’-এর মত কনফিউজিং শব্দগুলোর মধ্যকার পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করা হয়। যেন বিতার্কিকরা যে কোনো শব্দের ফাঁক-ফোঁকরকে কাজে লাগিয়ে বিরোধিতার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারেন। বিতর্কে ‘ই’ প্রত্যয়ের গুরুত্ব ও বিরোধিতার ক্ষেত্রে 'ই' প্রত্যয়ের ভূমিকা নিয়ে আলোচনাটিও নতুন বিতার্কিকদের ঋদ্ধ করে তোলে।
নবাগত বিতার্কিকদের প্রেরণা যোগাতে চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমির অধ্যক্ষ ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়ার ‘যে আসে বিতর্কে সে হারে না’ শিরোনামের উৎসাহব্যঞ্জক বিখ্যাত লেখাটি বিতার্কিকদের অনুধাবন করানো হয়। কেন তারা বিতর্ক অঙ্গনে আসলে হারে না, বিতর্ক তাদের কী শেখায় আর কী দেখায় তা অন্তর্চক্ষু দিয়ে উপলব্ধি করানোর মধ্য দিয়ে প্রজন্মকে বিনয়ী ও যুক্তিবাদী হিসেবে গড়ে তুলতে বিতর্ক একাডেমির প্রতিটি ক্লাস অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। একাডেমিতে একজন বিতার্কিক ও অবিতার্কিকের কথোপকথনের পার্থক্য তুলে ধরা হয়। বিতর্ক ও ঝগড়া যে এক নয়, দুটির পথ ও মত যে ভিন্ন তা আলোচনার মাধ্যমে মুক্তচিন্তার অধিকারী করে বিজ্ঞানমনস্ক জাতি হিসেবে গড়ে তোলা হয়।
এ কথা স্বীকার্য যে, যুক্তি জানা মানুষকে মুক্তির পথ দেখাতে হয় না, যুক্তিই মানুষকে মুক্তির পথ দেখায়। তাই যে সকল অভিভাবক তাদের সন্তানকে যুক্তিবাদী হিসেবে গড়ে তুলতে চান তাদেরকে বিনয়ের সাথে বলছি, বিতর্ক একাডেমিতে পাঠান। যারা তাদের সন্তানকে কুসংস্কারমুক্ত করে বিজ্ঞানমনস্ক মুক্তচিন্তার অধিকারী হিসেবে গড়ে তুলতে চান, তারা বিতর্ক একাডেমিতে পাঠান। যে সকল অভিভাবক চান আপনার সন্তান কথায় কথায় রেগে না গিয়ে শান্তভাবে যৌক্তিকভাবে প্রতিটি কথা মোকাবেলা করবে তাদের বিনয়ের সাথে বলছি, আপনার সন্তানকে বিতর্ক একাডেমিতে পাঠান। কেননা বিতার্কিক সৃষ্টির আঁতুড়ঘর চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি। বিতর্ক, বিতার্কিক ও বিতর্কপ্রেমীদের প্রতিষ্ঠান চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি। যৌক্তিক মানুষদের সান্নিধ্যে ও দিকনির্দেশনায়, প্রেরণায় ও প্রায়োগিকতায়, তত্ত্ব ও তথ্যে, সততা ও সত্যে প্রতিজন প্রশিক্ষণার্থী হয়ে উঠুক যুক্তি জানা মুক্ত মনের মানুষ--এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।
রাসেল হাসান : উপাধ্যক্ষ, চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি; পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্কে কলেজ পর্যায়ে হ্যাট্রিক চ্যাম্পিয়ন দলের দলপ্রধান ও বহুবার নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ বক্তা।