প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বিতর্ক শিক্ষণ ও আজকের বাস্তবতা
আজকের যুগ হলো সফ্ট স্কিলের যুগ। যে যত বেশি যোগাযোগে দক্ষ সে ততবেশি যাপিত জীবনে সফল ও সার্থক। সাফল্য ও সার্থকতাকে করায়ত্ত করতে হলে ভাষাভিত্তিক যোগাযোগ দক্ষতা তৈরি করতে হবে। মানব জীবনের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হলো ভাষা। এই ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগে বুদ্ধিবৃত্তিক শৃঙ্খলা অপরিহার্য। শুধু কথা বলতে পারলেই হয় না, যথাস্থানে যথা সময়ে যথা কথা বলতে পারাতেই দক্ষতার যোগ্য প্রতিফলন ঘটে। তথ্য প্রযুক্তির অতিদ্রুত যোগাযোগ মাধ্যমে নিবিষ্ট মানুষের সময়ের গুরুত্ব আজকাল বলার অপেক্ষা রাখে না। দীর্ঘ সময় ধরে কারও কথা শোনার যেমন সময় নাই, তেমনি দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলারও সময় কারো নাই। কাজেই অল্প সময়ে দরকারি কথাকে যুক্তিসহ উপস্থাপন করতে পারার দক্ষতা তৈরি করা আজ সময়ের দাবি। অনেককেই আফসোস করতে শুনি, আমাদের পবিত্র সংসদে যাদেরকে পাঠানো হয় তাদের কেউ কেউ বক্তব্যের নামে সময় ও শক্তির অপচয় ঘটান। অর্থাৎ মহান সংসদেও কথা বলার দক্ষতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। ব্যক্তি-ব্যক্তি আন্তঃযোগাযোগের ক্ষেত্রে এবং কতিপয় পেশাগত চর্চাতেও যুক্তি দিয়ে স্বল্প সময়ে নিজের মত প্রকাশের মাধ্যমে একটা ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে পারাটা অতীব জরুরি। শুধুমাত্র নিজ স্বার্থে কথা বলার দক্ষতা অর্জন করা নয়, রাষ্ট্রের স্বার্থেও অল্প সময়ে যুক্তি দিয়ে যথা কথা বলে নিজের প্রভাব তৈরি করতে পারা উচিত। বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দরকষাকষির ক্ষেত্রে নিজের দেশকে লাভবান করে তুলতে হলেও কথা বলার স্কিল থাকা জরুরি। কথা বললেই শুধু হয় না, কথাকে অন্যের বোধগম্য করে তোলাটাও একটা দক্ষতা।
কথা বলা একটা শিল্প। কেবল প্রয়োজনের কথা যন্ত্রের মতো চালিত বা তাড়িত হয়ে বলার মধ্যে কোনো সার্থকতা থাকে না। কথাকে এমনভাবে বলতে হবে যেনো তা বছরের পর বছর টিকে থাকে মানব সভ্যতায়। ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ বলে মার্টিন লুথার কিং যা বলে গেছেন তা আজও মানুষকে নাড়িয়ে দেয়। মাত্র দুশো বাহাত্তরটি শব্দ ব্যবহার করে আব্রাহাম লিঙ্কন যে বক্তব্য রেখে গিয়েছেন তা নিয়ে আজও গবেষণা হচ্ছে। রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণে যেভাবে কথা বলে গেছেন তাকে সংরক্ষণ করার তাগিদ অনুভব করে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড রেজিস্ট্রারে অন্তর্ভুক্ত করেছে। সুতরাং কথা কেবল দায়সারা নয়, কথা হতে পারে শিল্পের সরোবরের মতো, যাতে অবগাহন করে শ্রোতা কেবল সমৃদ্ধ হয়, নির্মিত হয় নিত্য নতুন নান্দনিকতায়। পয়সা দিয়ে বক্তব্য শোনার প্রচলন আগেকার যুগে যেমন ছিলো তেমনি আজও আছে। মানুষ টিকেট কেটে কথা শুনেছে রবীন্দ্রনাথের, টিকেট কেটে আজও কথা শুনছে মানুষ অমর্ত্য সেন কিংবা ড. মুহম্মদ ইউনুসের। তাই আজকের বাস্তবতায় কথার চেয়ে বড়ো অস্ত্র যেমন আর নেই, তেমনি কথাই হলো অনেকের জন্যে সবচেয়ে বড়ো বিনিয়োগ। যারা জীবন বীমার পেশায় নিজপদে নিয়োজিত রেখেছেন তাদের মূলধনই হলো কথার শিল্প। গ্রাহককে কথা বলতে বলতে এমন মুগ্ধ করে তোলা হয় যে, গ্রাহক শ্রোতা হিসেবে মুগ্ধ হয়ে বীমা পলিসি গ্রহণ করে। রেল স্টেশন কিংবা বাসস্ট্যান্ডে যে মানুষটা কথার মজমা জমিয়ে শেকড়-লতাপাতার পসরা সাজায় সে মানুষটাকে সবাই ক্যানভাসার বললেও সে আসলে কথার জাদুকর। তার কথায় জীবনের গল্প যেমন আছে তেমনি আছে জীবিকার ঠিকানা। শুধু কথা বেচেই তার পেট চলে, পোষ্যদের খোরপোশ চলে। আলোকিত মানুষ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ কথা বলতে বলতে শ্রোতাকে এমন মজিয়ে ফেলেন যে, দুই-তিন ঘন্টার হদিস মেলে না। আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবাই নিজেদের কথা বিশেষজ্ঞ হিসেবে জাহির করে ফ্যান-ফলোয়ার বাড়িয়ে মনিটাইজেশনের দিকে ঝুঁকছেন। বলা হয়ে থাকে, কথার গুণে জয় আর কথার গুণে ক্ষয়। অতএব, কথাকে লাগাম যেমন টেনে ধরা দরকার তেমনি কথার বিস্তারও ক্ষেত্র বিশেষে করতে হয়।
কথাশিল্পের এক প্রধান শাখা হচ্ছে বিতর্ক। একে অন্যতম বাচিক শিল্প হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। শিল্পের যত শাখা আছে তাতে বিতর্কই একমাত্র মাধ্যম যেখানে কথাকে যুগপৎ শিল্প ও হাতিয়ার হিসেবে তৈরি করা হয়। অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের শিক্ষণের প্রতিষ্ঠান থাকলেও বিতর্ক শিক্ষার কোনো প্রতিষ্ঠান দুহাজার ঊনিশ সালের আগে ছিলো বলে জানা যায় না। চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমিই জানামতে দেশজুড়ে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত বিতর্ক শেখার প্রতিষ্ঠান। বিতর্ক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একদিকে শুদ্ধ উচ্চারণ ও প্রমিত ভাষার ব্যবহার যেমন আয়ত্তে আসে তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সূত্রপাত ঘটে। যে জাতি বুদ্ধির মুক্তি ঘটাতে পারেনি, নিজের চিন্তাকে পথ চলার বাহন করতে পারেনি, সে জাতির উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি সুদূর পরাহত। অন্যের ধার করা দশটা চিন্তার চেয়ে নিজের একটা মৌলিক চিন্তার শক্তি অনেক গুণ বেশি। বিতর্কের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির জ্ঞানের চর্চা যেমন বিকশিত হয় তেমনি তার চিন্তার জগৎও প্রসারিত হয় অনেকগুণ বেশি। কোন বিষয়কে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক থেকে বিশ্লেষণ করার দক্ষতা যেমন বিতর্ক তৈরি করে দেয় তেমনি যে কোন কিছু নিয়ে গভীর হতে চিন্তা করার সক্ষমতা তৈরি করে দেয়। বিতর্ক এমন একটি বিদ্যা যা এককভাবে আয়ত্ত করা অসম্ভব। এটি দলগতভাবেই শিক্ষণীয় বিষয়। কেননা, এতে কোনো বিষয় সম্পর্কে যেমন একাধিক মস্তিষ্কের চিন্তনের ব্যাপার আছে তেমনি ব্যক্তিকে মুক্ত চিন্তা দিয়ে বিরোধিতা করারও ক্রিয়া রয়েছে। যদি বিরোধিতাই কেউ না করে তবে বিতার্কিক অভিব্যক্তি আনা সম্ভব নয়। বিতর্ক শিক্ষণের বিষয়টি আসলে তত্ত্ব নির্ভর নয় বরং চর্চা নির্ভর। যে যতবেশি ব্যবহারিকভাবে বিতর্ক চর্চায় নিবেদিত থাকবে তার পক্ষে ততবেশি বিতর্কশিল্প আয়ত্ত করা সম্ভব হবে।
বিতর্ক এমন কোন বিদ্যা নয় যে, এটি ভালো নোট যোগাড় করে উত্তীর্ণ হওয়া যাবে। এটি মূলত একটি প্রায়োগিক বিদ্যা যা প্রদর্শনী আকারে না অধ্যয়ন করলে উৎকর্ষ অর্জন করা যায় না। এখানে যুক্তি প্রয়োগের যেমন কাজ আছে তেমনি সত্যকে অনুসন্ধানের ব্যাপারও নিহিত আছে। চিন্তা, অনুসন্ধান ও প্রয়োগে বিতর্কে ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে হয় বলেই বিতর্ক একাডেমির অবতারণা করতে হলো।
বিতর্ক একাডেমির কাজ হলো উদীয়মান বিতার্কিকদের জন্যে অনুশীলনের একটা মঞ্চ তৈরি করে দেওয়া এবং নতুন বিতর্ক শিক্ষার্থীদের কাছে বিতর্ককে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। পরিপক্ক বিতার্কিকরা এখানে নূতনদের জন্যে পথ প্রদর্শকরূপে কাজ করে। এখানে বিতর্ক নিয়ে প্রতিনিয়ত পঠন-পাঠনের মাধ্যমে সকল কলা-কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হয়। বিতর্ক এখানে যাপনের বিষয়, বিতর্ক এখানে উদ্যমের বিষয়। যুক্তিকে শাণিত করতে হলে, নিজের চিন্তাকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হলে বিতর্ক একাডেমির মতো একটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাঙ্গনের আবশ্যকীয়তা অনস্বীকার্য। কেননা, বিতর্ক হলো বহুর সমাহারে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠা শিল্প। যত অধিক মত বা চিন্তার সমাহার ঘটবে তত অধিক বিতর্ক শিল্প হয়ে উঠবে। যত মতের সম্মিলন হবে তত পরমত সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পাবে। যত বৈচিত্র্য আসবে তত নান্দনিকতার পূর্ণতা আসবে। কাজেই, বিতর্ক শিক্ষণে বিতর্ক একাডেমির মত প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। স্কুল-কলেজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে সম্পূরক শক্তিতে বলীয়ান করতে হলে বিতর্ক একাডেমির মতো সুকুমার বৃত্তির চর্চাকেন্দ্র গড়ে তোলা জরুরি। সনদ নির্ভর শিক্ষা হতে দক্ষতাপ্রধান প্রজন্ম গড়ে তুলতে হলে বিতর্ক একাডেমির মতো কলাকেন্দ্র অপরিহার্য। শিক্ষার রূপান্তরকে সফল ও সার্থক করে তুলতে হলে আমাদের বিতর্ক একাডেমি গড়ে তোলা দরকার, যাতে এখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের পরিবর্তিত বিশ্বের যোগ্য নাগরিকরূপে গড়ে তুলতে পারে।
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া : অধ্যক্ষ, চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি; গ্রন্থকার : বিতর্ক সমগ্র, বিতর্ক বিধান ও বিতর্ক বীক্ষণ।